মানবাধিকার ও ইসলামী আইন -২য় অংশ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ইসলামে মানবাধিকারের ক্ষেত্রসমূহ ও তার পর্যালোচনা

ক. জীবনের অধিকার : পবিত্র কোরআন জীবনের অধিকারকে মানুষের প্রধান অধিকার বলে মনে করে। মানুষের দু’ধরনের জীবন রয়েছে। দৈহিক বা আধ্যাত্মিক জীবন হরণের কোন অধিকার নেই। দৈহিক জীবন হরণ হত্যার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। কোরআনের দৃষ্টিতে এ কর্ম সমগ্র মানব জাতিকে হত্যার শামিল। তাই বলা হয়েছে,

مَنْ قَتل نفساً بغير نفسٍ أو فسادٍ في الأرض فكأنَّما قتل الناس جميعاً

“যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে।”

মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন হরণ মানুষকে পথভ্রষ্ট করার মাধ্যমে ঘটে থাকে। যদি কোন ব্যক্তি কাউকে কোনভাবে পথভ্রষ্ট করে,সে তার আধ্যাত্মিক জীবনের বিনাশ সাধন করেছে।

কোরআনের দৃষ্টিতে জীবনের অধিকার আল্লাহর পক্ষ হতে মানুষকে দেয়া হয়েছে। তাই একমাত্র তিনিই এর ওপর অধিকার রাখেন এবং তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে নিজেকে অথবা অন্যকে দৈহিক বা আধ্যাত্মিকভাবে হত্যার অধিকার কেউ রাখে না। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে,অন্যান্য অধিকারের মত জীবনের অধিকারও নিঃশর্ত নয়। মানবাধিকারের দাবিদার প্রায় সকলেই এটি স্বীকার করেন। মানুষের জীবন ততক্ষণ পর্যন্ত সম্মানিত বলে বিবেচিত যতক্ষণ না সে অন্যের জীবনকে হুমকির সম্মুখীন করে। এ কারণেই যদি কোন ব্যক্তি কাউকে হত্যার চেষ্টা করে (উদ্যত হয়),তবে ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করা বৈধ বলে সকলেই বিশ্বাস করে। ইসলামে ‘কেসাস’-এর বিধানও মানুষের জীবন রক্ষার জন্য প্রণীত হয়েছে। কোরআন বলেছে,

و لكم في القصاص حياة يا أولي الألباب

“হে বুদ্ধিমানগণ! কেসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে।”

‘কেসাস’-এর শাব্দিক অর্থ হলো সমপরিমাণ বা অনুরূপ। পরিভাষিক অর্থে ‘কেসাস’ হলো বিশেষ অপরাধের ক্ষেত্রে (হত্যা,অঙ্গহানি বা আহত করা) অপরাধীকে অনুরূপ শাস্তি প্রদান যাতে করে যার ওপর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে,আহত বা অঙ্গহানির ক্ষেত্রে স্বয়ং সে এবং হত্যার ক্ষেত্রে তার রক্তের দাবিদার নিকটাত্মীয়গণ আন্তরিক সান্ত্বনা পান এবং তার হৃত অধিকারের এভাবে ক্ষতিপূরণ হয়।

কেসাসের বৈশিষ্ট্য

১. কেসাসের বিধানকে ইসলাম ব্যক্তিকেন্দ্রিক হিসেবে ঘোষণা করেছে : ইসলাম-পূর্ব আরবে কেসাসের কোন বিধান ছিল না। তাই যে ব্যক্তির ওপর অপরাধ সংঘটিত হতো তার নিকটাত্মীয়গণ শুধু অপরাধী ব্যক্তিকেই নয়,তার পরিবার,এমন কি গোত্রের ওপর হামলা করত। ফলে এক ব্যক্তির রক্তের বিপরীতে দশ বা শত ব্যক্তির রক্ত ঝরত ও নিহত হতো। এরূপ সমাজে কেসাসের বিধান প্রণয়ন করে ইসলাম শাস্তিকে একমাত্র অপরাধীকেন্দ্রিক ঘোষণা দেয় এবং শত ব্যক্তির জীবন রক্ষা করে। এজন্যই মহান আল্লাহর কথায় কেসাসকে মানুষের জন্য জীবন হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে।

২. কেসাস (হত্যা ও অঙ্গহানির) ইসলামের এ সম্পর্কিত ত্রিবিধানের একটি : কেসাস অর্থ এটি নয়,রক্তের দাবিদার আত্মীয়গণকে অবশ্যই কেসাস গ্রহণ করতে হবে,বরং তারা কেসাস ও ‘দিয়াত’ (রক্তের বিনিময়ে অর্থ বা রক্তপণ)-এর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে পারেন,এমন কি অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামী শরীয়তে রক্তের দাবিদারদের অপরাধীকে ক্ষমা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। সূরা বাকারার ১৭৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে :

“...অতঃপর তার ভাইয়ের তরফ থেকে যদি কাউকে কিছুটা মাফ করে দেয়া হয় (এবং কেসাসের বিধান রক্তপণে পরিণত হয়) পছন্দ পথে যেন তার অনুসরণ করে এবং (হত্যাকারী) যেন ভালভাবে তা (রক্তপণ) প্রদান করে (দাবিদারকে)।”

৩. কেসাস ইচ্ছাকৃত হত্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য,যে কোন হত্যার জন্যই নয় : মহান আল্লাহ্ কোরআনে বলেছেন,

“যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে ভুলক্রমে হত্যা করে,সে একজন মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করবে এবং রক্ত বিনিময় সমর্পণ করবে তার স্বজনদেরকে,কিন্তু যদি তারা ক্ষমা করে দেয়। আর যদি নিহত ব্যক্তি তোমাদের শত্রু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়,তবে মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করবে।”

সুতরাং বোঝা যায়,ভুলক্রমে হত্যার ক্ষেত্রে কোন কেসাস নেই,বরং ভিন্ন বিধান রয়েছে এবং কেসাস ইচ্ছাকৃত হত্যার ক্ষেত্রেই শুধু প্রযোজ্য।

অনেকের ন্যায় কেসাসকে সহিংস মনোবৃত্তির পরিচায়ক মনে করা চরম ভুল। কেসাসের বিধান না থাকলে বা কার্যকর না হলে গুরুতর অপরাধীরা নিরাপত্তা বোধ করবে এবং সহস্র ব্যক্তির জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে,যার প্রমাণ আমরা অহরহ লক্ষ্য করছি। এজন্যই হযরত আলী (আ.) বলেছেন,“আল্লাহ্পাক কেসাসের বিধান প্রণয়ন করেছেন এজন্য যে,এর মাধ্যমে সমাজের মানুষদের জীবন রক্ষিত হয়।”

ইসলামী আইনে আরো কিছু ক্ষেত্রে জীবন নাশের অধিকার দিয়েছে,যেমন (১) সমকামিতা ও কয়েক ধরেনের ব্যভিচার (২) ধর্মত্যাগ।

১. অবৈধ যৌনাচার (সমকামিতা ও ব্যভিচার) : অবৈধ যৌনাচারের অপরাধের মৃত্যুদণ্ডের আইনটি ইসলামী শরীয়তে এ লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে যাতে সামাজিক পবিত্রতা রক্ষিত হয় এবং সমাজ সুস্থভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে। বিষয়টির গুরুত্ব পাশ্চাত্য সামাজের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা বুঝতে পারব। লক্ষ লক্ষ অবৈধ সন্তান তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে বর্তমানে একটি বড় সমস্যা।

২. ধর্মত্যাগ : ইসলামে ধর্মত্যাগ একটি বড় অপরাধ হিসেবে পরিগণিত। ধর্মত্যাগ শরীয়তের দৃষ্টিতে ইসলাম ও এর সমাজের প্রতি একটি বিশ্বাসঘাতকতা বা খেয়ানত। এ কর্ম মুসলিম সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিকে দুর্বল করে বিধায় এরূপ ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাসূল (সা.) কঠোর নীতি গ্রহণ করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। ধর্মত্যাগ যেমন ঘোষণা দানের মাধ্যমে হতে পারে তেমনি ইসলামের প্রতিষ্ঠিত কোন বিধি বা মৌল বিশ্বাসকে অস্বীকারের মাধ্যমেও হতে পারে। ধর্মত্যাগী ব্যক্তিকে ইসলামী পরিভাষায় ‘মুরতাদ’ বলা হয়।

মুরতাদ দু’ধরনের হয়ে থাকে। যথা : মুরতাদে ফেতরী ও মুরতাদে মিল্লী। মুরতাদে মিল্লী হলো যে অন্য ধর্ম হতে ইসলামে প্রবেশ করে পুনরায় সে ধর্মে ফিরে যায় এবং মুরতাদে ফেতরী হলো যে জন্মগতভাবে মুসলিম ছিল,পরবর্তীতে ধর্মত্যাগ করে কাফির হয়েছে। অধিকাংশ ফকীহর মতে এ উভয় ধরনের মুরতাদের জন্য ইসলামের প্রসিদ্ধ নীতি হলো তাদের তওবা করে ইসলামে ফিরে আসার সুযোগ দান করা। কিন্তু ধর্মত্যাগ বা ধর্মের ভিত্তিকে অস্বীকারের তীব্রতা যদি এতটা অধিক হয় যে,ফিরে আসার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় তবে সেক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড ভিন্ন পথ থাকে না। এ ধরনের ঘটনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো সালমান রুশদী যে তার ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে পবিত্র নবী (সা.)-এর প্রতি চরম অসম্মান দেখিয়েছে। এরূপ ক্ষেত্রে তওবা গ্রহণযোগ্য নয়,বরং ইসলামের অন্যান্য শাস্তি বিধির ন্যায় (যেমন যেনার অপরাধ স্বীকার ও তওবা করার পরও তার হতে বিধি রহিত হয় না) তা অবশ্যই কার্যকর করতে হবে।

মৃত্যুদণ্ডের বিধান : ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে মৃত্যুদণ্ডের বিধানকে অমানবিক বলে রহিত করা হয়েছে। তাদের মতে হত্যাকে হত্যার মাধ্যমে জবাব দান সহিংসতার মাধ্যমে সহিংসতার জবাব দেয়ার শামিল যা কাঙ্ক্ষিত নয়। এ জন্যই ইউরোপীয় দেশগুলোতে এ বিধান নেই,এমন কি আন্তর্জাতিক বিচারালয়ও বসনিয়া,রুয়ান্ডা বা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের (যারা লক্ষ লোকের প্রাণহানির কারণ হয়েছিল) বিচারের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার অধিকারপ্রাপ্ত নয়। তাদের অপর একটি যুক্তি হলো অপরাধীকে সংশোধন করতে হবে,হত্যার মাধ্যমে সংশোধনের পথ রুদ্ধ করা হয়। এর জবাবে বলা যায় যে,প্রথমত মৃত্যুদণ্ড সহিংসতার মাধ্যমে সহিংসতার উত্তর দেয়া নয়। কারণ মানুষখেকো নেকড়ে হত্যা করাকে সহিংসতা বলা যায় না। দ্বিতীয়ত আমরা অপরাধীকে সংশোধিত করব অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে,অপরাধ সংঘটিত হবার পর নয়। আমাদের সমাজে সঠিক নৈতিক প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত অভাব রয়েছে,এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে নৈতিক প্রশিক্ষণ তো নেইই;বরং এর বিপরীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী উপাদানসমূহ পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান। এরূপ সমাজে অপরাধপ্রবণতা হ্রাসের জন্য কঠোর বিধান না থাকলে তা অপরাধীদের গুরুতর অপরাধে উদ্বুদ্ধ করাই স্বাভাবিক। যদি ধরেও নিই আমাদের সমাজে পর্যাপ্ত নৈতিক প্রশিক্ষণ রয়েছে,তদুপরি সমাজে সকল সময়ই একদল জন্মগত অপরাধী (এ অর্থে যে অপরাধপ্রবণতা তাদের মজ্জাগত) রয়েছে যারা এভাবে সংশোধিত হবার নয়। তাই অপরাধীকে সংশোধিত করতে হবে-এ কথা বলে এরূপ অপরাধীদের অপরাধের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া যুক্তিযুক্ত নয়,বরং যদি তা করা হয় তাহলে এ ধরনের অপরাধীদের অপরাধে উৎসাহিত করা হবে।

খ. স্বাধীনতার অধিকার

স্বাধীনতা মানুষের অন্যতম প্রধান অধিকার। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আইনবিদ স্বাধীনতার বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন মন্টেস্কু বলেছেন,“স্বাধীনতা মানুষের এমন একটি অধিকার যাতে সে আইন অনুমোদিত সকল কাজ করার ক্ষমতা লাভ করে এং আইনের নিষিদ্ধ ও তার অনুপযোগী কর্মে বাধ্য না হয়।” তবে আমাদের মতে স্বাধীনতাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় : “স্বাধীনতা হলো এমন একটি অধিকার যা মানুষকে সঠিক চিন্তা ও তার উপযোগী কর্মের পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং এর প্রতিবন্ধকতাসমূহকে দূর করে।” একে ‘দায়িত্বপূর্ণ স্বাধীনতা’ বলে অভিহিত করা যায়-যা কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে সমর্থিত হয়েছে। যেমন সূরা জাসিয়ার ১৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে :

من عمل صالحاً فلنفسه و من أساءَ فعليها ثُمَّ إلى ربِّكم ترجعون

“যে সৎ কাজ করছে সে কল্যাণার্থেই করছে। আর যে অসৎ কাজ করছে তা তার ওপরই বর্তাবে। অতঃপর তোমরা তোমাদের পালনকর্তার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।”

আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) বলেছেন,

لا تكن عبد غيرك و قد جعلك الله حرًّا

“অন্যের দাসে পরিণত হয়ো না। কারণ আল্লাহ্ তোমাকে স্বাধীন হিসেবে সৃষ্টি করেছেন।”

সুতরাং ইসলাম স্বাধীনতাকে মানুষের জন্মগত অধিকার বলে মনে করে।

স্বাধীনতার প্রকারভেদ

১. ব্যক্তি স্বাধীনতা

২. ধর্মীয় স্বাধীনতা

৩. চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা

৪. লেখনী ও বাক স্বাধীনতা

৫. রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা

১. ব্যক্তি স্বাধীনতা : ইসলাম সকল মানুষকে আল্লাহর বান্দা বলে মনে করে। আল্লাহর বান্দা হিসেবে সকলে সমান ও স্বাধীন। তাই মানুষ অন্যকে নিজের বান্দা বা দাসে পরিণত করতে পারে না।

ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) অধিকার সম্পর্কিত আলোচনায় বলেছেন,

“তোমার দাস তোমার ওপর যে অধিকার রাখে তা হলো তাকে তুমি তোমার সৃষ্টিকর্তার অন্যতম সৃষ্টি (তোমার অনুরূপ) বলে জানবে। তুমি ও সে একই পিতামাতার সন্তান,তোমরা একই রক্ত-মাংসে গঠিত। তুমি তার মালিক হয়েছ-এর অর্থ এ নয় যে,খোদা নয়-তুমিই তাকে সৃষ্টি করেছ।”

মহানবী (সা.) বলেছেন,

“তোমাদের দাসরা তোমাদেরই ভাই। তাদের প্রতি সদাচরণ কর।... কঠিন কাজে তাদের সহযোগিতা কর।”

উপরিউক্ত হাদীসসমূহ হতেও বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে,ইসলামের দৃষ্টিতে ক্রীতদাসের বিষয়টি একটি অপ্রধান বিষয় এবং বিষয়টি সাময়িক প্রয়োজনে বাহ্যিক কারণে মেনে নেয়া হয়েছিল। বাহ্যিক কারণটি যদি অপসারিত হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এ প্রথা রহিত হয়ে যায়।

পূর্বোল্লিখিত হযরত আলী (আ.)-এর হাদীস হতে স্পষ্ট যে,ইসলাম কোন ব্যক্তির দাস হওয়াকে মন্দ দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের প্রাথমিক যুগে হঠাৎ করে এ পথাকে নিম্নোক্ত কিছু কারণে রহিত করা সম্ভব ছিল না :

ক. ক্রীতদাসদের অভ্যুত্থানের ফলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা ছিল।

খ. পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতার অভাবে তারা স্বাধীন জীবন যাপনে সক্ষম ছিল না।

গ. দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ প্রথার অবসান ঘটানোর পরিবেশ সৃষ্টি।

ইসলাম এ কুপ্রথার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে যে পদ্ধতি অবলম্বন করে তাতে সময়ের ব্যবধানে পর্যায়ক্রমে সকল ক্রীতদাসই স্বাধীনতা লাভ করে। ইসলাম এ সম্পর্কিত কিছু আইন প্রণয়ন করে যা তাদের স্বাধীনতার পথকে প্রশস্ত করে। যেমন ক্রীতদাস নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ তার মালিককে দেয়ার মাধ্যমে নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারে অথবা সে তার মালিকের সঙ্গে এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হতে পারে যে,মালিকের মৃত্যুর পর সে স্বাধীনতা লাভ করবে অথবা কোন কাফের ব্যক্তির দাস মুসলমান হলে সে স্বাধীনতা লাভ করবে অথবা কোন মালিক তার দাসকে শারীরিকভাবে গুরুতর আহত বা তার অঙ্গহানি ঘটালে সে মুক্তি পাবে অথবা কোন মুমিন ক্রীতদাস সাত বছর তার মালিককে সেবা দানের পর স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন হয়ে যাবে প্রভৃতি।

ইসলামী ফিকাহ্শাস্ত্রে রোযা,কসম,প্রতিজ্ঞা,ভুলবশত হত্যা ও এরূপ সাতটি ক্ষেত্রে ক্রীতদাস মুক্ত করাকে কাফ্ফারাহ্ নির্ধারণ করেছে।

পাশ্চাত্যে দেড়শ’ বছর পূর্ব পর্যন্ত ক্রীতদাসের ক্রয়-বিক্রয় আইনসম্মত ছিল। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এ বিষয়টি ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত আইনত বৈধ বলে পরিগণিত হতো। এ প্রথাটি রহিত হওয়ার পর সেখানে আইন প্রণয়নকারী ও এর বিরোধীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছিল। ইসলাম চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে যুক্তিসম্মত এমন এক পদ্ধতি প্রণয়ন করেছিল যাতে স্বাভাবিকভাবেই সময়ের পরিক্রমায় এ কুপ্রথাটির অবসান ঘটে। ইসলাম ব্যক্তির স্বাধীনতাকে তার দেহের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে করে না;বরং এর ঊর্ধ্বে আত্মিক স্বাধীনতা অর্জনকে-যা ব্যক্তির প্রবৃত্তির ওপর বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয়-এর প্রকৃত লক্ষ্য বলে মনে করে।

২. ধর্মীয় স্বাধীনতা : ইসলাম সকল ধর্ম,সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহাবস্থানকে নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।

প্রথমত ইসলামে ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে কাউকে বাধ্য করার অবকাশ নেই। কারণ আন্তরিক বিশ্বাসের বিষয়ে কাউকে বাধ্য করা যায় না। কাউকে কোন ধর্মীয় বিশ্বাস গ্রহণে বাধ্য করলে তা স্থায়ী হয় না। কারণ বাধ্যতার কারণসমূহ দূরীভূত হলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যার পরিণাম ভয়াবহ। পবিত্র কোরআন ইসলাম গ্রহণে মানুষের স্বাধীনতার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছে :

لا إكراه في الدّين قد تبيّن الرّشدُ من الغيّ

“দীনের ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। নিঃসন্দেহে হেদায়েত থেকে পথভ্রষ্টতার পথ পৃথক হয়ে গেছে।”

কেউ কেউ বলে থাকে ইসলাম তরবারীর ধর্ম এবং ইসলামী জিহাদের উদ্দেশ্য হলো জোরপূর্বক ইসলামে আনয়ন। কথাটি সঠিক নয়। কারণ ইসলামের জিহাদ সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের অবসান এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারের পথে বাধা দানকারী অপশক্তিকে দমনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়ে থাকে। যদি এই প্রতিবন্ধকতা দূর হয় এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় সে ক্ষেত্রে সকল ধর্মের অনুসারীই ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে।

দ্বিতীয়ত ইসলাম এর প্রচারের পদ্ধতি হিসেবে যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে বিতর্ক ও আলোচনার নীতি গ্রহণ করেছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :

لا تجادلوا أهل الكتاب إلّا بالّتي هي أحسن

“আহলে কিতাবদের সঙ্গে উত্তম পদ্ধতি ব্যতিরেকে বিতর্ক করো না।”

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে :

أدع إلى سبيل ربّك بالحكمة و الموعظة الحسنة و جادلْهم بالّتي هي أحسن

“প্রজ্ঞা ও উপদেশ সহকারে তোমার প্রতিপালকের প্রতি আহবান কর এবং তাদের সাথে উত্তম যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে বিতর্ক কর।”

তৃতীয়ত ইসলাম এর রাষ্ট্রের অধীনে বসবাসকারী অমুসলিমদের পূর্ণ নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন অমুসলমানদের ‘জিম্মী’ বলে অভিহিত করা হয়। তারা ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে নিরাপত্তা চুক্তি সম্পাদনের পূর্ণ অধিকার রাখে। এ চুক্তির অধীনে তারা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম-কর্ম পালনের এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের অধিকারপ্রাপ্ত হয়। এ ক্ষেত্রে আহলে কিতাব ও মুশরিকদের সঙ্গে ভিন্ন শর্তে চুক্তিনামা স্বাক্ষর করা হয়ে থাকে। নিম্নোক্ত শর্তসমূহ পূরণের অঙ্গীকার গ্রহণের মাধ্যমে তাদের উপরিউক্ত অধিকার দেয়া হয়ে থাকে :

ক. জিজিয়া বা নিরাপত্তা কর প্রদান।

খ. মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে ইসলামের মৌল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রচারণা না চালানো।

গ. ইসলামের প্রকাশ্য ও গোপন শত্রুদের আশ্রয় না দেয়া।

ঘ. ইসলামী রাষ্ট্রের শত্রুদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি না করা অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের গোপনীয় তথ্য পাচার না করা।

ঙ. কোন মুসলিম নারীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়া।

চ. কোন মুসলিম নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন না করা।

ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে বসবাসকারী অন্যান্য ঐশী ধর্মের অনুসারীরা (আহলে কিতাব) উপরিউক্ত শর্ত পূরণ সাপেক্ষে নিম্নোক্ত অধিকারসমূহ লাভ করে :

ক. সর্ববিধ নিরাপত্তা : জিম্মী চুক্তির অধীনে তারা সর্ববিধ নিরাপত্তা লাভ করে অর্থাৎ তাদের জীবন,সম্পদ এবং পরিবারের সদস্যগণের নিরাপত্তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দানের দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। এর ফলে তারা স্বদেশী মুসলমানদের মতো সামাজিক ও অন্যান্য অধিকার লাভ করে। রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদিত ও আইনসম্মত সকল সুবিধা তারা ভোগ করে। বহিঃশত্রুদের আক্রমণ হতে তাদের রক্ষা করাও ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

খ. ধর্মীয় স্বাধীনতা : ইসলামী রাষ্ট্র ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তাদের কখনই বাধ্য করবে না;বরং তাদের ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হবে।

গ. বিচার সম্পর্কীয় স্বাধীনতা : জিম্মী আহলে কিতাবগণ তাদের নিজস্ব বিচার ফয়সালার জন্য স্বতন্ত্র আদালতের ব্যবস্থাপনার দাবি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী আদালতের শরণাপন্ন হওয়ারও অধিকার তাদের রয়েছে।

এ ছাড়াও তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্যান্য অধিকার পূর্ণরূপে প্রাপ্ত হয়। রাজনৈতিকভাবে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকারের পাশাপাশি জন প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ভোটাধিকার রয়েছে। তবে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের স্থলাভিষিক্ত করা হয় না। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রের ধর্মীয় মৌলিক বিধিবিধানের প্রতি তারা বিশ্বাসী নয়। একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেমন পুঁজিবাদে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তির ওপর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করা হয় না তেমনি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী কোন ব্যক্তিকে এরূপ দায়িত্ব দেয়া হয় না।

ইসলামী রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ আহলে কিতাবদের (জিম্মী) নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার ব্যাপারে রাসূল (সা.) খুবই কঠোরতা অবলম্বন করতেন। তিনি বলেছেন,“যে কেউ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন জিম্মীকে কষ্ট দেবে আমি তার শত্রুতে পরিণত হব এবং কিয়ামতের দিন আমার এ শত্রুতাকে প্রকাশ করব।”

রাসূল (সা.) নাজরানের খ্রিস্টানদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে তাদের ধর্মীয় নিরাপত্তাকে এভাবে নিশ্চয়তা দান করেছেন :

“...কোন ধর্মযাজককেই গীর্জা থেকে বহিষ্কার করা হবে না,তাদের কোনরূপ অবমাননা করা হবে না। মুসলিম সৈনিকরা তাদের ভূমি জবরদখল করবে না,তাদের সাথে ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে আচরণ করা হবে...।”

অন্যত্র ২য় হিজরী শতাব্দীতে মীনার খ্রিস্টানদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিনামায় তিনি এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হন যে,

“আমি এ মর্মে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হচ্ছি,কোন খ্রিস্টান ধর্মযাজককেই বিতাড়িত করা হবে না,তাদের উপাসনালয়ের কোনরূপ ক্ষতিসাধন করা হবে না,তাদের গীর্জা হতে মসজিদের জন্য কোন কিছু আনা হবে না। কোন মুসলমান এরূপ করলে সে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে... খ্রিস্টানদের প্রতি কোনরূপ জবরদস্তি করা হবে না। তাদের সঙ্গে সদাচরণ করা হবে,তাদের ওপর জুলুম করা হতে বিরত থাকা হবে,তারা যেখানেই থাকুক তাদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করা হবে...।”১০

উপরিউক্ত আলোচনা হতে ইসলামে ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে এ অর্থে যে,ইসলামী রাষ্ট্রে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে জীবন যাপন ও ধর্মীয় আচার পালন করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব মানবাধিকার ঘোষণার ১৮ নম্বর ধারায় বর্ণিত ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি ইসলামে স্বীকৃত। তবে এ ধারাতে ধর্ম পরিবর্তনের স্বাধীনতার বিষয়টিকে ইসলাম স্বীকৃতি দেয় না। যদিও ইসলাম অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টিকে স্বাগত জানায়,কিন্তু কোন মুসলমানের ইসলাম ধর্ম ত্যাগের অনুমতি দেয় না। কারণ ইসলাম এ বিষয়কে ইসলামী সমাজের ভিত্তিকে দুর্বল করার শামিল বলে মনে করে এবং একে ইসলামের বিরুদ্ধে একরকম বিদ্রোহ বলে মনে করে। বিশেষত যদি কেউ জন্মসূত্রে মুসলমান হয়ে থাকে সে যদি ইসলামকে ত্যাগ করে তবে তার এ কর্মকে ইসলামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে ধরা হয়। কারণ এরূপ ব্যক্তি ইসলামী পরিবেশে ইসলামের মৌল নীতিকে পূর্ণরূপে অনুধাবন করার পরও তাকে বর্জন করেছে। ইসলামী আইনে সে ‘মুরতাদ’ হিসেবে পরিগণিত এবং মৃতুদণ্ডের শাস্তিতে দণ্ডিত।

৩. চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা : ইসলামে চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। ইসলাম চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী,কিন্তু যে কোন কিছু বিশ্বাসের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়। কারণ মানুষ যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে চিন্তা করে থাকে;সে তার চিন্তাশক্তির মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম। তাই কোরআন অসংখ্যবার মানুষকে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির দিকে আহবান জানিয়েছে। যেমন পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : أفلا تعقلون অর্থাৎ তোমরা কি চিন্তাশক্তিকে প্রয়োগ কর না? অন্যত্র বলা হয়েছে : أفلا يتدبّرون অর্থাৎ তারা কি গভীর চিন্তা করে না? কোরআন বুদ্ধিবৃত্তির মানদণ্ডে অগ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণে পূর্ববর্তীদের অনেক বিশ্বাসকে সমালোচনা করেছে;সে সকল বিশ্বাসের সঠিক কোন চিন্তাগত ভিত্তি নেই;বরং অন্ধ অনুকরণের ফলশ্রুতিতে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ইসলাম একে অকল্যাণকর মনে করেছে। ভিত্তিহীন চিন্তা হতে উৎসারিত মূল্যবোধশূন্য বিশ্বাসসমূহ মানুষকে উদ্দেশ্যহীন অনর্থক কর্মে লিপ্ত করে যা মানবতার অবমাননা ছাড়া কিছু নয়। তাই ইসলাম অযৌক্তিক বিশ্বাস গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষকে স্বাধীনতা দেয়নি। এর বিপরীতে সঠিক চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসকে সম্মান দেখিয়েছে।

৪. লেখনী ও বাক স্বাধীনতা : বাক স্বাধীনতা বলতে ব্যক্তির চিন্তা,বিশ্বাস ও মত প্রকাশের অধিকার বুঝায়। মানুষ তার চিন্তা ও বিশ্বাসকে বক্তব্য,গ্রন্থ,পত্রিকা ও লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। বক্তব্য ও লেখনীর স্বাধীনতা আইন দ্বারা সীমিত। ইসলাম মানুষের বাক স্বাধীনতাকে অন্যতম মৌলিক অধিকার বলে মনে করে,কিন্তু কেউ যদি এ স্বাধীনতাকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বা মানুষকে বিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে তাহলে ইসলাম তাকে তা করার অনুমতি দেয় না। বাক স্বাধীনতার শিক্ষাটি আমরা রাসূল (সা.),হযরত আলী (আ.) এবং অন্যান্য ইমামদের নিকট হতে নিতে পারি। হযরত আলীর সময়ে খারেজীরা তাদের বিশ্বাস প্রচার করত। হযরত আলী উপদেশ ও যুক্তির মাধ্যমে তাদের সঠিক পথে আনার চেষ্টা করেছেন। তাদের এ কর্মে অস্ত্রের দ্বারা বাধা প্রদান করেননি যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরাই অস্ত্রধারণ করেছে। যেহেতু খারেজীরা মুয়াবিয়া ও অন্যদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছিল তাই তিনি তাদের প্রথমে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু যদি কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সত্যকে জানার পরও তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বাক স্বাধীনতার অপব্যবহার করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় তাহলে তার পথ রুদ্ধ করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

লেখনীর স্বাধীনতার বিষয়ে শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী বলেছেন,

“যে সকল গ্রন্থ যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেছে,কিন্তু সঠিক ধারণার অনুপস্থিতির কারণে ভুলভ্রান্তি করেছে;যেহেতু এ গ্রন্থসমূহের লেখকগণ তাঁদের কর্মে সৎ ও যুক্তির অনুসারী হওয়ার প্রয়াসী ছিলেন সেহেতু ইসলাম তাঁদের দিক-নির্দেশনার মাধ্যমে সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়,কিন্তু কারো কারো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অসত্য বিষয় উপস্থাপনের সম্ভাবনা রয়েছে। তারা বাক স্বাধীনতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সহস্র মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করতে পারে,মিথ্যা পরিসংখ্যান উপস্থাপন করতে পারে,কোন রাষ্ট্র বা ব্যক্তির নামে অপপ্রচার করতে পারে,কারো বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ আনতে পারে,মিথ্যা দলিল উপস্থাপন করতে পারে... এখানেই লেখনী ও বাক স্বাধীনতার স্পষ্ট সীমারেখা চি‎ি‎হ্নত হওয়া আবশ্যক... আমরা যদি এরূপ মিথ্যা ও অসচেতন প্রয়াসের পথরোধ করি তখন অনেকেই বলে থাকেন কেন বাক স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করা হয়েছে? আমাদের প্রশ্ন হলো আমরা কি মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রের পথকে রুদ্ধ না করে চিন্তা,বিশ্বাস ও বাক স্বাধীনতার নামে জনসাধারণের মাঝে অসত্যের প্রচারের পথকে উন্মুক্ত করে দেব?”

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ভাষায় :

“ইসলাম আমাদের যে স্বাধীনতা দিয়েছে তার সীমা রয়েছে। এ স্বাধীনতা আইন দ্বারা সীমিত। পৃথিবীর সব দেশেই স্বাধীনতা আইন দ্বারা সীমিত। তাই স্বাধীনতার নামে কারো আইন ভঙ্গের অধিকার নেই।”

কিন্তু জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার ১৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে :

“সকলেরই বিশ্বাস ও বাক স্বাধীনতা রয়েছে এবং এ স্বাধীনতার আওতায় সে তার বিশ্বাসের বিষয়ে শংকাহীন হবে। যে কোন তথ্য ও চিন্তা গ্রহণ ও প্রচারে সকল ধরনের মাধ্যম ব্যবহারে সে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন।”

যদি কেউ এই স্বাধীনতার অপব্যবহারের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি,প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালায় তবে কোন আন্তর্জাতিক আদালতে কি তার বিচার সম্ভব?

৫. রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা : আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি সমাজে মানুষের স্বাধীনতা আইন দ্বারা সীমিত। কারণ আইন ব্যক্তি ও সমাজের অধিকার ও নিরাপত্তা সংরক্ষণ করে। পাশ্চাত্যের ধারণায় স্বাধীনতার সীমা অন্যের অধিকারের সীমা দ্বারা সীমিত হলেও ইসলামের ক্ষেত্রে সামাজিক কল্যাণের দিকটিই মুখ্য। তাই ইসলামে যে স্বাধীনতা সমাজের বস্তুগত ও নৈতিক কল্যাণের পরিপন্থী তা অগ্রহণীয়। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে রুশো ও জন লক সামাজিক আইনকে ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী বলে মনে করেছেন। রুশো তাঁর ‘আইনের মর্মকথা’ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন,“প্রকৃতি মানুষকে স্বাধীনভাবে সৃষ্টি করেছে,কিন্তু সমাজ তাকে দাস বানিয়েছে। প্রকৃতি মানুষকে সৌভাগ্যবান করেছে,কিন্তু সমাজ তাকে দুর্ভাগা ও অসহায়ে পরিণত করেছে।” যেহেতু পাশ্চাত্যের মানবাধিকারে স্বাধীনতার বিষয়টি উদারতাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত সেহেতু সেখানে নৈতিকতার বিষয়টি গৌণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ইসলামের সামাজিক আইন অবাধ ও শর্তহীন স্বাধীনতাকে যেমন সমর্থন করে না তেমনি মানুষের স্বাধীনতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখারও পক্ষপাতী নয়। এ কারণেই ইসলাম মানুষকে এমনভাবে বর্ণনা করেছে যা তাকে মূল্যবোধসম্পন্ন ও পবিত্র প্রকৃতির ধারক এক সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তাই ইসলাম মানুষের সামাজিক,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে তেমন সীমাবদ্ধতা রাখেনি। সীমাবদ্ধতা শুধু সেখানেই যেখানে বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক কল্যাণ ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ইসলামের স্বাধীনতার ধারণা ইসলামী শাসন ব্যবস্থার বিশেষত্বের কারণে অনেক উদার। ইসলামী শাসন ব্যবস্থা স্বৈরতন্ত্রকে যেমন সমর্থন করে না তেমনি তা জনগণের ওপর জনগণের শাসনের পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক ধারারও বিরোধী। ইসলামী শাসন ব্যবস্থা জনমত ও জাতীয় শাসনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে তা প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে এর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করে। এ শাসন ব্যবস্থায় শাসকবর্গের যেরূপ জনসাধারণকে রাষ্ট্রীয় বিষয়ে হস্থক্ষেপ হতে বিরত রাখার অধিকার নেই তেমনি জনসাধারণেরও সরকারের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকার সুযোগ নেই। অর্থাৎ জনসাধারণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সৎ পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারকে যেরূপ প্রভাবিত করতে পারে তেমনি সরকারের গৃহীত অকল্যাণকর পদক্ষেপে তাদের বাধা দানের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। ইসলামে রাজনৈতিক স্বাধীনতার নমুনা হিসেবে হযরত আলী (আ.)-এর নিম্নোক্ত কথাটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর অধীন ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশে বলেন,“অত্যাচারী শাসকবর্গের সম্মুখে যেরূপ কথা বলা হয় আমার সাথে সেরূপ বলো না। আমার সামনে নির্ভয়ে ও সাহসিকতার সাথে কথা বলো। তাদের সামনে যেমন সত্য বলা হতে বিরত থাকা হয় আমার সামনে সেরূপ করো না।”

(চলবে)

তথ্যসূত্র

১.সূরা মায়েদাহ্ : ৩২।

২.সূরা বাকারাহ্ : ১৭৯।

৩. নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ৩।

৪. তোহাফুল উকুল,পৃ. ২৬২।

৫. নাহজুল ফাসাহা,পৃ. ৫২।

৬. সূরা বাকারাহ্ : ২৫৬।

৭. সূরা আনকাবুত : ৪৬।

৮. সূরা নাহল : ১২৫।

৯. বালাযুরী প্রণীত ফুতুহুল বুলদান,পৃ. ৬৫।

১০. জুরজি যাইদান প্রণীত তারিখে তামাদ্দুনে ইসলাম,চতুর্থ খণ্ড,পৃ. ১২০।

(সূত্র:জ্যোতি,২য় বর্ষ,১ম সংখ্যা)