কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা : একটি সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত (২য় অংশ)

[বক্ষমান নিবন্ধটি ড. সাইয়্যেদ জাফর শাহীদী রচিত বিখ্যাত ‘কেয়ামে ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম’(ইমাম হুসাইনের অভ্যুত্থান)-এর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। ফার্সী ভাষায় রচিত এ বিখ্যাত গ্রন্থটি কয়েক বছর পূর্বে প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশের পর পরই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ভক্ত-অনুরক্তদের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। লেখক দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর যাবত এ বিষয়ে যে অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছেন এ মূল্যবান গ্রন্থে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণার কারণেই তিনি ইতিহাসের এ বিয়োগান্ত ঘটনার এমন কতক অন্ধকার দিক অত্যন্ত সাফল্যের সাথে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন যার প্রতি এ বিষয়ে লিখিত অন্যান্য ইতিহাসবিদদের রচনায় কদাচিৎ দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। তেহরান থেকে প্রকাশিত আল তাওহীদ সাময়িকীতে মুদ্রিত গ্রন্থটির সংক্ষিপ্ত ইংরেজী অনুবাদ থেকে বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে]

যুদ্ধ কতক্ষণ চলেছিল

ইবনে যিয়াদের বাহিনীর কোন কোন সেনাপতি যেমন দাবী করেছে কারবালার যুদ্ধ তত অল্প সময়ে সমাপ্ত হয় নি। তবে কতক সরলমনা ইতিহাসবিদ যেরূপ বলেছেন,এ যুদ্ধ তদ্রূপ দীর্ঘও হয় নি। এমনকি কেউ কেউ কবিতা লিখতে গিয়ে আশুরার দিনটিকে টেনে বাহাত্তর ঘণ্টা বানাতে বাধ্য হয়েছেন যাতে এ দিনের ঘটনায় দম্ভোক্তি,বহু ভাষণ এবং বহু সৈন্য হত্যার যে বর্ণনা তাঁরা দিয়েছেন তাকে যুক্তিসিদ্ধ করতে পারেন।

এ যুদ্ধে ঠিক কতজন লোক নিহত হয়েছিল তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পাশে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের সংখ্যা সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত হতে পারি। [ইমাম হুসাইনের ছয় মাস বয়সের শিশুপুত্র আলী আসগার (আ.)-এর কথা ব্যতিক্রম হিসাবে বাদ দিলে] ইমামের পরিবারের চৌদ্দ বছরের ঊর্ধ্ববয়স্ক পুরুষ সদস্যরা সকলেই শাহাদাত বরণ করেন।

কিন্তু কুফার বাহিনীর কতজন সদস্য নিহত হয়েছিল সে সম্বন্ধে আল্লাহ্তায়ালাই সঠিকভাবে অবগত। এ ব্যাপারে ন্যূনতম সংখ্যা হচ্ছে ৭৩ জন। অন্যদিকে সর্বোচ্চ সংখ্যা হচ্ছে হাজার হাজার। তবে এখানে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই যে,এ যুদ্ধ চলাকালীন মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে জাহেলীয়াতের যামানার অজ্ঞ আরবদের নিষ্ঠুর ও বর্বর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি প্রতিভাত হয়। যে আরব ব্যক্তি তার তাঁবুতে আশ্রয়গ্রহণকারী টিড্ডি ফড়িং ধরতে আসা লোকদের সাথে লড়াই করার জন্য তীর ধনুক তুলে নিত,তারই পুত্র কারবালার রণাঙ্গনে এক ভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং জাহেলীয়াত যুগের ইয়াসূস,বাকর,তাকলাব প্রভৃতি যুদ্ধের স্মৃতি পুনর্জীবিত করে। এ প্রচণ্ড যুদ্ধের মাঝে এক ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ.)-কে সম্বোধন করে বলে : “হুসাইন! তুমি কি (ফোরাত নদীর) পানির ঐ তরঙ্গগুলোকে দেখতে পাচ্ছ? আল্লাহর কসম,তুমি জাহান্নামের তিক্ত ও বিষাক্ত পানির স্বাদ গ্রহণ ব্যতীত এ পানি পান করতে পারবে না।”আর এক নির্লজ্জ্ কাপুরুষ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় নাতিকে সম্বোধন করে বলে : “আমরাই উত্তম উৎস (পূর্বপুরুষ) থেকে উৎসারিত,তুমি নও।”

যুদ্ধ সমাপ্ত হবার পর সেই উদ্ধত কাপুরুষদের বাহিনীর সেনাপতি ইমামের পক্ষের শহীদ যোদ্ধাদের পবিত্র লাশসমূহের ওপর দিয়ে ঘোড়া দাবড়ানোর জন্যে স্বীয় সৈন্যদেরকে নির্দেশ প্রদান করে। বস্তুত এটা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন ছিল যে,এই লোকগুলো সেই লোকদের সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্ম যাঁরা (মহানবীর সময় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুজাহিদ) রণাঙ্গনে আহত হবার পর চরম পিপাসার্ত অবস্থায়ও স্বীয় পিপাসা নিবারণের পানি বন্ধুর জন্য প্রদান করেন এবং সে বন্ধুও তা তাঁর বন্ধুর জন্য দান করেন;এভাবে সকলেই পিপাসা নিবৃত্তি ছাড়াই শাহাদাত বরণ করেন অথবা ঘরে যথেষ্ট খাবার না থাকায় মেহমানদের খাওয়ানোর জন্য বাতি নিভিয়ে দিয়ে খাবার খাচ্ছেন বলে ভান করেছিলেন,ফলে সকলেই খাবার খাচ্ছেন মনে করে মেহমান তৃপ্তি সহকারে খাবার খেয়ে নিয়েছিলেন।

কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনায় আমরা দেখতে পাই কীভাবে একই আরবদের সন্তানরা তাদের রাসূলের বংশধর নারী ও কন্যাদের তাঁবুতে অগ্নিসংযোগ করেছিল যার উদ্দেশ্যে ছিল মহানবীর নাতি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কন্যাদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা।

এই দু’টি দৃশ্যের মধ্যে কোনটি প্রকৃতই হৃদয়বিদারক? কী করে মানুষ মানবতার এহেন মহান ও সমুন্নত পর্যায় থেকে এমন নিচু পর্যায়ে নেমে যেতে পারে? এ অবস্থা দর্শনে আমাদের এ কথা মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই যে,মানব মস্তিষ্ক একটি অত্যন্ত জটিল জিনিস। আমাদের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্তায়ালার বাণীই কেবল এ জটিল রহস্যের সমাধান ও এহেন রূপান্তরের ব্যাখ্যা দিতে পারে। তিনি বলেন :

“শয়তান তাদেরকে বশীভূত করে নিয়েছে,অতঃপর তাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছে। তারা হচ্ছে শয়তানের দল। সাবধান! অবশ্যই শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত।”-সূরা মুজাদিলাহ্ : ১৯

একটি উট জবেহ করার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের সম পরিমাণ সময়ের মধ্যেই এ যুদ্ধ শেষ হয়ে থাক,অথবা পাঁচ ঘণ্টা,দশ ঘণ্টা,এমনকি ৭২ ঘণ্টা দীর্ঘায়িত হয়ে থাক,এতে মূল বিষয়ে কোন পার্থক্য নেই।

শপথ ভঙ্গের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত

কুফা নগরীতে মুখতার ইবনে উবাইদার বাড়িতে এক লক্ষ,মতান্তরে ত্রিশ হাজার,মতান্তরে আঠারো হাজার লোক সমবেত হয়ে মুসলিম ইবনে আকীলের সাথে এ মর্মে শপথ করেছিল যে,এমনকি নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে হলেও তারা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পক্ষে থাকবে। কিন্তু দশ মুহররমের সেই বিভীষিকাময় দিবসের সন্ধ্যায় কারাবালার বালুময় প্রান্তরে মাত্র বাহাত্তর জন শহীদের রক্তমাখা লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু এই বাহাত্তর জনও ছিলেন ইরাকের অন্যান্য শহর ও হেজায থেকে ইমামের দলে যোগদানকারী;কুফার লোক নয়।

কারবালার রণাঙ্গনে তাঁদের ছিন্নভিন্ন লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই লোকগুলো কারা ছিলেন? তাঁরা ছিলেন খাঁটি মুসলমান। তাঁরা ছিলেন এমন মুসলমান যাঁরা অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন এবং তাঁদের সকলেই অত্যন্ত চমৎকারভাবে এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তাঁরা শুধু চিরন্তন মর্যাদার আসনেই উন্নীত হন নি,বরং সমগ্র মানবতার জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছেন। তাঁরা মানব জাতির জন্য এ শিক্ষা রেখে গেছেন যে,ধরণীর বুকে মানব প্রজাতির অস্তিত্বের শেষ দিন পর্যন্ত যারাই এ ধরনের কঠিন পরীক্ষায় প্রবেশ করতে ইচ্ছুক হবে তাদেরকে অবশ্যই তাদের যা কিছু আছে তার সব কিছুই হারাতে হবে।

কিন্তু সেই অন্যূন বিশ হাজার লোকের ব্যাপারটা কী রকম যে,আজ আমরা যাদের চি‎হ্ন মাত্র দেখছি না? অর্থাৎ যারা মুসলিম ইবনে আকীলের সাথে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অনুকূলে আনুগত্যের শপথ করেছিল তাদের খবর কী? তারা কি মুসলমান ছিল না? নিঃসন্দেহে তারাও মুসলমান ছিল,কিন্তু তারা ছিল এমন মুসলমান যারা ইসলামকে কেবল অতটুকু গুরুত্ব দিত যতটুকু গুরুত্ব দিলে তাদের জান-মালের কোনরূপ ক্ষতি না হয়,বরং তা পুরোপুরি নিরাপদ থকে। তাই তারা যখনই বুঝতে পারল যে,তাদের সামনে এক কঠিন পরীক্ষা সমুপস্থিত হয়েছে,সাথে সাথে তারা পিছু হটে যায়। তারা তাদের নিজ নিজ গৃহে চলে যায় এবং গৃহের দরজা ভালোভাবে বন্ধ করে দেয়। হয়তো বা তারা অন্য একটি সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিল যখন তাদেরকে আরেকটি পরীক্ষার জন্য ডাকা হবে বলে তারা মনে করছিল,হয়তো বা আরেকজন বীর পুরুষ অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে উত্থান করবেন এবং তারা তাঁর চারপাশে সমবেত হয়ে আমরণ লড়াই করবে বলে আনুগত্যের শপথ করবে!

আরেকটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী অধিকতর অসহায়ত্বের নিদর্শন পেশ করে। তারা এমন কাজ করেছিল যে কারণে তারা অনন্তকাল পর্যন্ত মানুষের উপহাসের পাত্র হয়ে থাকবে এবং ইতিহাসে তাদের ঘটনা একটি উপহাসের অধ্যায়রূপে লিপিবদ্ধ থাকবে। সেই বিয়োগান্ত দিবসে এই লোকগুলো পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে (যুদ্ধের মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে) রুমাল দ্বারা তাদের অশ্রুসজল চোখ ঢেকে ফেলে আল্লাহর নিকট আবেদন করেছিল :“হে আল্লাহ্! অনুগ্রহপূর্বক হুসাইনকে সাহায্য করুন।”

এমনকি শয়তানও বিলাপ করে!

সেই দিনটির সর্বশেষ প্রহরও অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছিল। সেইসব নির্বোধ ব্যক্তির অন্তঃকরণ প্রতিহিংসায় এবং ধন-সম্পদ ও পার্থিব পদমর্যাদার লোভে মাতাল হয়ে গিয়েছিল;তারা হত্যা,অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের কাজ সমাপ্ত করল। তারা যখন লক্ষ্য করল যে,আর কোন পুরুষ বা নারী তাদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে আসছে না তখন তারা সহসাই অনুভব করল যে,তারা একটি লজ্জাজনক অপরাধ সংঘটিত করেছে।

বস্তুত এ হচ্ছে সেই সব মানুষের প্রকৃতির আরেকটি দিক যারা সুস্থ মন-মানসিকতা ও বিচার-বুদ্ধির অধিকারী নয় অথবা খুব কম মাত্রায় এর অধিকারী। তারা খুব সহজেই উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত হয়ে যায়,কিন্তু এরপর খুব সহজেই তাদের কৃতকর্মের জন্য দুঃখিত হয়। এখন তারা অনুতপ্ত হয় : “হায়! এ আমরা কী করলাম?”হ্যাঁ,তারা কী করেছিল? এসব লোক প্রথমে তাদের নিজেদের মনের মধ্যে এ কথাগুলো আওড়ায়। তারপর তারা বিড়বিড় করে মুখেও তা উচ্চারণ করে। পরবর্তী সময় এ কথাগুলো চুপে চুপে ছড়িয়ে পড়ে ঠিক বিশাল জনতার ভিড়ের মাঝে গুজব ছড়িয়ে পড়ার মতো। শেষ পর্যন্ত তাদের প্রত্যেকেই পরস্পরের কাছে বলে : “হায়! এ আমরা কী করেছি! ধিক! আমাদেরকে। এ মানুষটি তো আমাদের কল্যাণকামী ছিলেন। আমরা নিজেরাই তো তাঁকে আমাদের নিকট আসার জন্য দাওয়াত করেছিলাম। অতঃপর আমরা যে তাঁকে স্বাগত জানাই নি,সাহায্য করি নি,শুধু তাই নয়,বরং তাঁকে ও তাঁর সকল অনুসারীকে দামেশকের সরকারের এক সেবাদাসের পদতলে বলি দিয়েছি। আমরা ‘বেহেশতের যুবকদের নেতা’র চেহারা ও দেহকে রক্তাক্ত ও ধুলিলিপ্ত করেছি।”

হ্যাঁ,এ পর্যায়ে এসে তাদের অনেকেই দুঃখিত হয়েছিল,কিন্তু তাদের এভাবে দুঃখিত হওয়ায় কোনই লাভ হয় নি।

কুফাবাসীরা আরেকবার প্রমাণ করল যে,তারা কতই না দুর্ভাগা এবং তারা কতটা হীন ও নিচ হতে পারে! ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর পবিত্র মহিমামণ্ডিত জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে তাদেরকে তাদের এ তিক্ত করুণ পরিণতি সম্বন্ধে সতর্ক করেছিলেন। ইমাম বলেন : “আল্লাহর কসম,তোমরা যদি আমাকে হত্যা করো,তাহলে অচিরেই তোমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং পরস্পরের রক্তপাত ঘটাবে। কিন্তু এ ধরনের পাপ কাজ সম্পাদনের কারণে আল্লাহ্ তোমাদের বিরুদ্ধে অধিকতর ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।”

এরপর ইমাম হুসাইন (আ.) অন্তর থেকে তাদেরকে অভিশম্পাৎ করেন যা তাদের জন্য পুরোপুরি যথাযথ ছিল। তিনি বলেন : “হে আল্লাহ! আপনি তাদের ওপর এবং তাদের ভূখণ্ডকে পরিপূর্ণ করার জন্য আপনার রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করবেন না। তাদের ভূখণ্ড থেকে ধরণীর কল্যাণকে তুলে নিন। নামাযেই হোক বা অন্য কাজেই হোক,তাদেরকে প্রশান্তচিত্তে কোন কাজ করার সুযোগ দেবেন না।”

কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার পর চতুর্থ বছরের শেষ দিকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অভিশস্পাৎ পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়।

ধরণীর বুকে আল্লাহর আযাব

হিজরী ৬৬ সালে ইরাকে হত্যা ও রক্তপাত শুরু হয়। ব্যাপকভাবে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠল। তবে এক্ষেত্রে প্রথমেই এলো তাদের পালা-নিরীহ ও নিষ্পাপদের হত্যায় যারা অংশ নিয়েছিল বা এর পেছনে যাদের ভূমিকা ছিল। পরকালীন দুনিয়ায় উপযুক্ত শাস্তির স্বাদ গ্রহণের পূর্বে ইহকালীন জীবনেও তাদেরকে লাঞ্ছিত হতে হয়।

কিন্তু যারা কারবালার ঘটনায় কোন পক্ষে কোন ভূমিকা পালন করে নি,বরং ঝুঁকি এড়িয়ে ঘরের কোণে চুপ করে বসেছিল,তাদের অবস্থা কেমন হয়েছিল? তারাও প্রতিশোধের ন্যায্য অংশ পেয়েছিল? তারাও কেন প্রতিশোধের শিকার হলো? তারা তো এ মারাত্মক অপরাধে অংশগ্রহণ করে নি। এ প্রসঙ্গে আমরা সাইয়্যেদুশ শুহাদা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অমর বাণীর এ অংশের প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত করলেই এ প্রশ্নের জবাব পাব যেখানে তিনি বলেন : “লোকেরা (পার্থিব) জগতের দাস। তারা ততক্ষণই দীনের ব্যাপারে আগ্রহী যতক্ষণ তা তাদের জন্য একটি ভালো (সচ্ছল ও নিরূপদ্রব) জীবনের নিশ্চয়তা দেয়! কিন্তু যখনই তাদের সামনে কোন পরীক্ষা উপস্থিত হয় তখন যারা তাদের ঈমানের ওপর অটল থাকে এদের সংখ্যা খুবই কম।”

আশুরার ঘটনার পর দীর্ঘ সাড়ে তের শতাব্দীরও বেশি অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কুফার বুকে অনেকগুলো প্রজন্মের আবির্ভাব হয়েছে;কুফার প্রতিটি প্রজন্মের লোকেরাই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর  শাহাদাত দিবসে তাঁর মাযারের চারিদিকে সমবেত হয়। তারা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিদেহী নাফ্সের সাথে তাঁর মহান পথ অনুসরণের অঙ্গীকার করে।

কারবালার যুদ্ধে বিজয়ী সেনাপতিরা যুদ্ধ সমাপ্তি এবং রণাঙ্গনে নীরবতা ও শান্ত পরিবেশ নেমে আসার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পরাজয় অনুভব করে। কিছু লোকের দুঃখ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাদের এ পরাজয়ের অনুভূতির সূচনা। যে সব লোকের বিবেকবোধ দ্রুত নিদ্রিত হয়ে পড়েছিল এবং এ কারণে তারা তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছিল,কয়েক মুহূর্ত বা কয়েক ঘণ্টার জন্য তাদের বিবেকবোধ পুনরায় জাগ্রত হয়ে ওঠে ও তাদেরকে দংশন করে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট ছিল না। এরপর তাদের নিজ শহরে ফিরে আসার পালা;তাদের সামনে তখন প্রশ্ন এটাই যে,তাদের শহরে থেকে যাওয়া তাদের পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনরা তাদের সাথে কী আচরণ করবে? অবশ্য শহরে থেকে যাওয়া এই লোকেরাও মাত্র এক মাস আগে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অনুকূলে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছিল এবং একই দিনে তা ভঙ্গ করেছিল,তবে তারা এর সাথে তাদের অতিথি হত্যার নতুন কলঙ্ক যোগ করে নি।

রাতের বেলা কুফার এক ব্যক্তি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিজয়ীর বেশে তার বাড়িতে ফিরে এল। তার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করল যে,সে কেন এত আনন্দিত? জবাবে সে বলল : “তুমি কি জান না কেন আমি এত আনন্দিত? আমি তোমার জন্য সবচেয়ে মূল্যবান উপহার নিয়ে এসেছি। আমার থলির মধ্যে রয়েছে আলীর পুত্র হুসাইনের শির।”জবাবে তার স্ত্রী বলল :  “তোমার ওপর লানত হোক। লোকেরা তাদের স্ত্রীদের জন্য স্বর্ণ-রৌপ্য নিয়ে আসে,আর তুমি আমার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর দৌহিত্রের মাথা নিয়ে এসেছো? আল্লাহর কসম,আমি আর তোমার সাথে থাকব না।”

এভাবে কারবালার রণাঙ্গনের বিজয়ী সৈন্যরা ঘরে ফেরার পর স্বামী-স্ত্রীতে বিচ্ছেদ ঘটেছে. পিতা-পুত্রের বিচ্ছেদ ঘটেছে;নিঃসন্দেহে এ ধরনের ঘটনা অনেক ঘটেছে যদিও ব্যক্তিগত পর্যায়ের এসব প্রতিক্রিয়ার পরিসংখ্যান ও বিস্তারিত বিবরণ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ নেই।

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পরিবারের নারীদেরকে ও তাঁর কন্যাদেরকে,ইমাম আলী (আ.)-এর সন্তানদেরকে এবং রাসূল (সা.)-এর বংশধরদেরকে কাফের-মুশরিক যুদ্ধবন্দীদের ন্যায় অমর্যাদাকরভাবে কুফায় নিয়ে আসা হলো। এ দৃশ্য দেখেই কুফায় থেকে যাওয়া নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধরা বুঝতে পারল যে,তাদের লোকেরা কারবালায় কী ধরনের লজ্জাজনক ও ঘৃণ্য আচরণ করেছে।

মহানবী (সা.)-এর খলীফা আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) পাঁচ বছর যাবত ন্যায়নিষ্ঠা সহকারে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের পর এ কুফা নগরীতেই শহীদ হন;এরপর মাত্র বিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। যেসব নারীর বয়স এখন ত্রিশ বছর (তখন তারা ছিল দশ বছরের বালিকা) তারা হযরত আলী (আ.)-এর কন্যা হযরত যায়নাব (আ.)-কে দেখেছে। তারা সেসব দিনের স্মৃতি স্মরণ করতে পারছে,তাদের কাছে কতই না প্রিয় ছিলেন যায়নাব! তাদের আরো স্মরণ হলো যে,তাদের পিতারা ও স্বামীরা এক সময় হযরত যায়নাব (আ.)-কে কতই না সম্মান করত! এ কাফেলাকে দেখে তাদের অতীত স্মৃতিগুলো আবারো মনে পড়ে গেল। ফলে কুফা নগরীর প্রতিটি সড়ক,গলি,প্রতিটি বাজার এবং শহরের প্রতিটি স্থানেই আর্তনাদ,বিলাপ আর ক্রন্দনের রোল উঠল। নারীদের আর্তনাদ ও বিলাপের ফলে শিশুদের মধ্যেও ক্রন্দন ছড়িয়ে পড়ল এবং শিশুদের ক্রন্দন বৃদ্ধদের কঠিন হয়ে যাওয়া হৃদয়েগুলোকেও নরম করেছিল। সহসাই গোটা নগরী আর্তনাদ,বিলাপ আর ক্রন্দনের সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে গেল।

সমগ্র জনতার মধ্যে একমাত্র যে মানুষটি জনতার ভাবাবেগকে সর্বোচ্চ চূড়ায় উপনীত করে দিলেন তিনি হলেন ইমাম আলী (আ.)-এর কন্যা। তাঁর কোন্ কন্যা? যায়নাব,নাকি উম্মে কুলসুম! জানি না।

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের পর তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তথা বন্দীদের কাফেলার সর্বাধিক বয়োজ্যেষ্ঠ ও সর্বাধিক সম্মানের পাত্রী ছিলেন হযরত যায়নাব (আ.)। এ কারণে তিনিই ছিলেন সকলের মুরুব্বী ও তত্ত্বাবধায়ক। কারবালার ঘটনার বর্ণনাকারীদের অধিকাংশই এবং ইতিহাসবিদগণ এ ব্যাপারে একমত যে,নিম্নোক্ত উক্তিটি হযরত যায়নাব (আ.)-এর। অবশ্য প্রাপ্ত প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপিটিতে এ উক্তিটি উম্মে কুলসুমের বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একমাত্র জীবিত পুরুষ সদস্য ছিলেন হযরত আলী ইবনে হুসাইন (আ.),যিনি ‘ইমাম যায়নুল আবেদীন’ও ‘ইমাম সাজ্জাদ’নামে সমধিক পরিচিত। তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পরে তাঁর উত্তরাধিকারী এবং মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের ধারাবাহিকতার চতুর্থ নিষ্পাপ ইমাম।

আল্লাহ্তায়ালার ইচ্ছা ছিল এই যে,তাঁর মাধ্যমে আহলে বাইতের ইমামতের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। এ কারণে কারবালায় তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণে সক্ষম হন নি। কুফায় এসে পৌঁছার পরও তিনি অসুস্থ ছিলেন। তিনি যখন দেখলেন যে,কুফার লোকেরা ক্রন্দন ও বিলাপ করছে তখন তিনি কুফাবাসীদের সম্বোধন করে বললেন : “হে লোকসকল! তোমরা কি আমাদের দুঃখ-কষ্টের জন্য ক্রন্দন করছ? তোমরা ব্যতীত আর কারা আমাদের স্বজনদেরকে হত্যা করেছে?”

এ সময় উম্মে কুলসুম লোকদের দিকে হাত তুলে ইশারা করেন এবং তাদেরকে চুপ করার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ শোনার সাথে সাথে সমবেত সকল মানুষ নীরব হয়ে গেল;কেবল তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তখন উম্মে কুলসুম বললেন :

“হে কুফার লোকেরা! হে ধূর্ত,বিশ্বাসঘাতকের দল! তোমাদের চোখ সর্বদাই অশ্রুপূর্ণ হয়ে থাকুক। তোমরা হচ্ছ সেই (নির্বোধ) নারীর ন্যায় যে সারাদিন তার চরকা দ্বারা সুতা কাটল,কিন্তু সারা দিন সে যত সুতা কেটেছিল রাতের বেলা তার সবই ছিঁড়ে ফেলল। না তোমাদের আনুগত্য উল্লেখ করার মতো,না তোমাদের শপথের কোন মূল্য আছে। তোমরা শুধু আত্মম্ভরিতা করে থাকো,তোমরা শুধু নিজেদেরই প্রশংসা করে থাকো। তোমরা ক্রীতদাসীর মতো,কেবল কেউ সামনে থাকলে তখনই চাটুকারিতা কর,কিন্তু আড়ালে তার শত্রুদের সাথে হাসি-ঠাট্টা,গল্প-গুজব করে থাকো।

তোমরা হচ্ছ সেই তরতাজা সবুজ উদ্ভিদের ন্যায় যা আবর্জনার স্তূপের ওপর জন্মে এবং সেই চুন-সুরকির মিশ্রণের ন্যায় যা দ্বারা কবরের ওপর আস্তরণ দেয়া হয়। হায়! তোমরা তোমাদের  পরকালীন জীবনের জন্য কতই না নিকৃষ্ট পাথেয় দ্বারা বোঝা পূর্ণ করেছ! তোমরা একে আল্লাহর ক্রোধ ও জাহান্নামের অগ্নি দ্বারা পূর্ণ করেছ। তোমরা এখন ক্রন্দন করছ? হ্যাঁ. আল্লাহর কসম,তোমাদের অবশ্যই ক্রন্দন করা উচিত,কারণ এটাই তোমাদের জন্য সর্বাধিক উপযোগী। অতএব,তোমরা বেশি বেশি ক্রন্দন কর এবং খুব কম হাস। তোমরা তো তোমাদের সুখ্যাতির ললাটে এই কলঙ্ক লেপন করেছ। অতএব,কেন তোমরা সে জন্য ক্রন্দন করবে না? এ হচ্ছে এমন এক নোংরা কলঙ্ক যা সাত সাগরের পানি দ্বারা ধৌত করেও দূরীভূত করা সম্ভব নয়। তোমরা তোমাদের নবীর বংশধর এবং বেহেশতে যুবকদের নেতাকে হত্যা করেছ;এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে? তিনি এমন এক ব্যক্তি যিনি ছিলেন তোমাদের জন্য আঁধার রাতের আলোকবর্তিকা এবং তোমাদের অন্ধকার দিনগুলোতে তোমাদের সাহায্যকারী। তোমরা মরে যাও! তোমরা লজ্জায় তোমাদের মস্তকসমূহ অবনত কর। তোমরা সহসাই তোমাদের অতীতের যা কিছু ভালো ছিল তার সবই ধ্বংস করে ফেলেছ এবং ভবিষ্যতের জন্যও কিছুই অর্জন করতে পার নি। এখন থেকে তোমাদের দুর্দশা ও লাঞ্ছনার জীবন যাপন করতে হবে।

তোমরা নিজেরাই তোমাদের জন্য আল্লাহর আক্রোশ ডেকে এনেছ। তোমরা এমন কাজ করেছ যে কারণে আসমান পৃথিবীর ওপর পরার উপক্রম হয়েছিল এবং পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে যাবার ও পাহাড়-পর্বতসমূহ ধসে পরার উপক্রম হয়েছিল। তোমরা কি জান,তোমরা কার রক্তপাত ঘটিয়েছ? তোমরা এই যে নারী ও কন্যাদেরকে হিজাববিহীন করে এ রাজপথে টেনে নিয়ে এসেছ,তারা কারা,তা কি তোমাদের জানা আছে? তোমরা কি জান যে,তোমরা আল্লাহর রাসূলের হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করেছ? কতই না নোংরা ও নির্বুদ্ধিতার কাজ! এ হচ্ছে এমন এক পাপ কর্ম যার পাপ সমগ্র পৃথিবীকে পূর্ণ করে ফেলেছে।

এতে কি তোমরা আশ্চর্যান্বিত হচ্ছ যে,তোমাদের নগরীতে বৃষ্টির পরিবর্তে রক্তের ফোটা বর্ষিত হচ্ছে? কিন্তু এটা নিশ্চিত জেনে রেখো যে,শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর শাস্তি এর চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হবে। তোমরা যে পাপ করেছ সে জন্য আল্লাহ্ যদি এখনও তোমাদেরকে কোন শাস্তি না দেন তাহলে সে কারণে তোমরা স্বস্তিবোধ করো না। কিন্তু তিনি নিরীহ-নিষ্পাপ লোকদের রক্তপাত ঘটানোকে বিনা প্রতিশোধে যেতেও দেন না। আর আল্লাহ্তায়ালা সকলের কাজেরই হিসাব রাখেন।”

এ ধরনের তেজস্বী প্রাঞ্জল উক্তি কেবল একটি দগ্ধ হৃদয় থেকে উৎসারিত হওয়াই সম্ভব ছিল যার মূল তাকওয়া ও আল্লাহর প্রতি ঈমানের অতল মহাসমুদ্রে নিহিত। এ কারণেই তা কুফাবাসীদের অন্তরের অন্তস্তলে এমন গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। যারাই এ কথাগুলো শুনল তারাই লজ্জা ও দুঃখে মুখ ঢাকল এবং অনুশোচনায় নিজেদের আঙ্গুল কামড়াল।

এ ছিল এমনই এক দুঃখ-ভারাক্রান্ত ও চিন্তা উদ্রেককারী পরিবেশ যে,বণি জু’ফা গোত্রের একজন বৃদ্ধ-অনবরত অশ্রুপাতে যার দাঁড়ি ভিজে গিয়েছিল-তৎক্ষণাৎই স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি কবিতা রচনা করে ফেলেন। তিনি এক কবিতায় বলেন :

“এই পরিবারের সন্তানগণ

সকল ভূমিষ্ঠের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সন্তান

কোন লজ্জা বা দুর্ভাগ্যের কলঙ্ক

কখনো লাগে নি পোশাকে

তাদের গোত্রের কোন সদস্যের।”

ইবনে যিয়াদের প্রাসাদে

কারবালার বন্দীদের কাফেলাকে কুফার আমীর ইবনে যিয়াদের প্রাসাদের দিকে নিয়ে যাওয়া  হলো। বন্দীদেরকে আমীরের প্রাসাদে নিয়ে আসার পর যাতে সরকারের শক্তি ও ক্ষমতার প্রদর্শনী করা যায় সে লক্ষ্যে ইবনে যিয়াদের সেবাদাসরা সাধ্যানুযায়ী এক বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ইবনে যিয়াদ ধারণা করেছিল যে,সে বিজয়ের পথে যাত্রা শুরু করেছে এবং এ পথের শেষ প্রান্তে উপনীত হওয়া পর্যন্ত তার এ যাত্রা অব্যাহত থাকবে। কারণ সে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সকল পুরুষ অনুসারীকে এবং তাঁর পরিবারের নারী ও শিশুদেরকে কাছে নিয়ে আসতে পেরেছে। অতএব,অবশ্যই সব কিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়ে থাকবে। এখন সে হচ্ছে বিজয়ী এবং তার ধারণায় রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হচ্ছেন পরাজিত পক্ষ।

বন্দীদেরকে ওবায়দুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের সামনে আনা হলে সে ঔদ্ধত্যের সাথে দম্ভ প্রকাশ করে বলল : “আল্লাহর শুকরিয়া,তিনি তোমাদেরকে লাঞ্ছিত করেছেন এবং প্রমাণ করে দিয়েছেন যে,তোমরা যা কিছু দাবী করতে তা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।”

কিন্তু কেবল ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল একজন স্বৈরাচারী শাসককে যখন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য,উপহাস ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয় তখন তার জন্য এর চেয়ে বিপর্যয়কর আর কী হতে পারে? হযরত যায়নাব (আ.) অত্যন্ত শান্তভাবে ও দৃঢ়তার সাথে এ নিম্নমানের উক্তির জবাব দিলেন। মনে হচ্ছিল যেন তিনি কোনরূপ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন নি এবং তাঁর কোন স্বজন শহীদ বা বন্দী হন নি। তিনি এমন এক ব্যক্তিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিলেন এবং তীক্ষ্ণ কথা-বাণে বিপর্যস্ত করছিলেন যার হাতে তাঁকে এবং অন্যান্য বন্দীকে তখনই ও সেখানেই হত্যা করার নির্দেশ দানের ক্ষমতা আছে বলে মনে হচ্ছিল না। তিনি বললেন :

“শুকরিয়া সেই আল্লাহ্তায়ালার জন্য যিনি মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর রাসূল মনোনীত করে আমাদের পরিবারকে মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।

সীমা লঙ্ঘনকারীরা ব্যতীত কেউ মিথ্যা বলে না এবং যারা পাপাচারী তারা ব্যতীত কেউ জনসমক্ষে লজ্জিত হয় না,আর আমরা এ দুই দলের কোনটিরই অন্তর্ভুক্ত নই।”

এতে ইবনে যিয়াদের মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছিল,কিন্তু সে জোর করে আগের চেয়েও তার মাথা উঁচু করল। এরপর সে হযরত যায়নাব (আ.)-কে একটি মোক্ষম জবাব দিয়ে পরাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিল। এ কারণে সে হযরত যায়নাবের জ্বালাময়ী প্রাঞ্জল ভাষণে বাধা দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিল এবং বলল : “তুমি দেখেছ আল্লাহ্ তোমার ভাইয়ের সাথে কেমন আচরণ করেছেন?”

হযরত যায়নাব দাঁতভাঙ্গা কথা দ্বারা ইবনে যিয়াদের এ ঘৃণ্য কথার জবাব দিলেন। তিনি বললেন : “আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই নি। আমার ভাই এবং তাঁর সঙ্গীরা সে পথেই গিয়েছেন আল্লাহ্ তাঁদের জন্য যে পথ পছন্দ করেছেন। তাঁরা গর্বের সাথে শাহাদাতকে বেছে নিয়েছেন এবং এ মহাসম্মানে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু হে ইবনে যিয়াদ! তুমি যে অপরাধ করেছ সে কারণে তোমাকে এক কঠিন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে হবে।”

ইবনে যিয়াদ বুঝতে পারল যে,এভাবে হযরত যায়নাবের বক্তব্যে অসময়োচিত বাধা দেয়ার ফলে সে নিজেই এক বেকায়দা অবস্থায় পড়ে গেছে। সে নিজেকে পুরোপুরি পরাজিত ও বিপর্যস্ত অনুভব করল। এ কারণেই সে সাধারণভাবে নির্বোধদের দ্বারা ব্যবহৃত সর্বশেষ অস্ত্রটি তুলে নিল। সে আল্লাহর নামে শপথ করে বলল : “আল্লাহ্ তোমার বিদ্রোহী ভাইকে হত্যার মাধ্যমে আমাকে আনন্দ দিয়ে আমার আহত হৃদয়কে নিরাময় করেছেন।”

তখন হযরত যায়নাব বললেন : “হে ইবনে যিয়াদ! তুমি আমাদের নেতাকে হত্যা করেছ এবং আমাদের পুরুষ আত্মীয়-স্বজনদের বেঁচে থাকতে দাও নি। তুমি আমাদের কচি চারাগুলোকে ভেঙ্গেছ (শিশু সন্তানদের হত্যা করেছ) এবং আমাদের হৃদয়গুলোকেও ভেঙ্গেছ;এতেই যদি তোমার হৃদয়ের ক্ষত নিরাময় হয়ে থাকে,তাহলে সত্যিই তুমি নিরাময় হয়েছ।”

ইবনে যিয়াদ হযরত যায়নাবের বক্তব্যে আবার বাধা দিল। সে বলল : “ যায়নাব ছন্দের ভাষায় কথা বলছে। আমার প্রাণের শপথ,তার বাবা আলীও তা-ই করত।”

হযরত যায়নাব (আ.) তার কথা খণ্ডন করে বললেন : “হে ইবনে যিয়াদ! আমার কথার সাথে ছন্দের কী সম্পর্ক? আর ছন্দ রচনার জন্য কী চমৎকার উপযুক্ত পরিবেশ!”

দামেশকের অধিবাসীদের কেউই রাসূল (সা.)-কে দেখে নি বা তাঁর কথা শ্রবণ করে নি। তেমনি মদীনার লোকেরা যেভাবে ইসলাম পালন করতেন তাও সেখানে প্রবেশ করে নি। মহানবী (সা.)-এর মাত্র একশ’তের জন সাহাবী এ ভূখণ্ডটি দখলের অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন অথবা এখানে ক্রমান্বয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এ ব্যক্তিদের জীবনেতিহাস পর্যালোচনা করলে একটি সত্য সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে যে,তাঁদের মধ্য থেকে অল্প কয়েকজন বাদে বাকী সকলেই রাসূল (সা.)-এর সাহচর্যে খুব অল্প সময়ই কাটিয়েছিলেন। তাঁরা রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে অল্প সংখ্যক হাদীস শ্রবণ করে তা মনে রেখেছিলেন। আর এঁদের মধ্যকার বেশিরভাগ সাহাবীই আমীরে মুয়াবিয়ার ক্ষমতা দখলের বেশ পূর্বে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলীফার শাসনামলে ইন্তেকাল করেন। কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার সময় এই একশ’তের জন সাহাবীর মধ্য থেকে মাত্র এগারো জন জীবিত ছিলেন এবং তাঁরা দামেশকে বসবাস করতেন।

এ থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে,দামেশকে ইয়াযীদের সমবয়সী প্রজন্ম ইসলাম সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানত না। আসলে মহানবী (সা.)-এর বংশধর কারা,সে সম্পর্কেও তাদের কোন ধারণা ছিল না। সুতরাং কতক ইতিহাসবিদ যেমন লিখেছেন যে,বন্দীদেরকে যেদিন দামেশকে নিয়ে আসা হয় সেদিন সেখানকার জনগণ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নিহত হবার খবরে উল্লসিত হয়ে আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠেছিল;এ খবরের সত্যতায় সন্দেহের কোন কারণ নেই।

এমনকি ইয়াযীদের সামনেও হযরত যায়নাব বিরাট শক্তি ও সাহসের পরিচয় দিয়ে বক্তব্য রাখেন। তিনি ইয়াযীদের পরিষদবর্গকে জানিয়ে দেন যে,ইয়াযীদ নিজেকে যে রাসূল (সা.)-এর খলীফা বলে দাবী করে সিরিয়ার জনগণের ওপর শাসনকার্য চালাচ্ছে,জিঞ্জির দিয়ে বেঁধে দামেশকে নিয়ে আসা বন্দীরা হচ্ছেন সেই রাসূল (সা.)-এরই বংশধর।

ইয়াযীদের দরবারে হযরত যায়নাব (আ.) যে ভাষণ দেন তাতে তিনি দামেশকের জনগণের সামনে ইয়াযীদের আসল চেহারা তুলে ধরেন। এর ফলে অন্তত তাদের মধ্যকার কতক লোক বুঝতে পারে যে,তারা যে ধর্ম পালন করছিল,ইসলাম তা থেকে আলাদা এবং সত্যিকারের মুসলিম নেতা ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া নয়,অন্য কেউ।

তথ্যসূত্র

১. মুহাম্মদ ইবনে জারীর তাবারী প্রণীত তারীখুর রাসূল ওয়াল মুলূক,৭ম খণ্ড,পৃ. ৩১১।

২. প্রাগুক্ত,পৃ. ৩৪৭।

৩. প্রাগুক্ত।

(জ্যোতি,৩য় বর্ষ, ৩য় ও ৪র্থ সংখ্যা)