আশুরা আন্দোলনের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক

কারবালার আকাশের তারার ন্যায় অন্য কোন আকাশের তারা উজ্জল ও জাকজমকপূর্ণভাবে উদ্ভাসিত হয়নি। আশুরার দিনে সূর্য যেরূপ দুঃখভরাক্রান্ত,বিবর্ণ ও দ্বিধা নিয়ে উদিত হয়েছিল অন্য কোন দিনে সেরূপ রঙ্গহীন ও মনোবেদনা নিয়ে উদিত হয়নি। পৃথিবীর কোন স্থানই নেইনাওয়া (কারবালা)র ন্যায় সুন্দর ও অসুন্দরকে পাশাপাশি এত উত্তমরূপে প্রদর্শন করেনি।ঐতিহাসিক কোন ঘটনাই ইমাম হোসাইন (আ.) এর আন্দোলনের মত মানবতার মহান বাণী ধারণ করেনি।‘তেফ’ এর মরুভূমিতে সেদিন ‘তওহীদ’ দ্বিতীয়বারের মত জন্ম গ্রহণ করেছিল। আশুরার দিন ‘খোদাপ্রেম’ নতুন ভাবে ব্যাখ্যা হয়েছিল এবং কোরআন (এর শিক্ষা) নবজীবন লাভ করেছিল। দশই মুহররমেই কেন ফেরেশতারা হযরত আদম (আ.)কে সিজদা করেছিল তার রহস্য উম্মোচিত হয়েছিল। বস্তুত আশুরার দিন কারবালায় মহান আল্লাহর সকল সৌন্দর্যময় বৈশিষ্ট্য পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয়েছিল।

চরম তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ফোরাতের কূলে আলীর সন্তান আব্বাস যখন ঘোড়াসহ পানিতে নেমে পানি পান না করেই মশক ভর্তি করে পানি থেকে উঠে এলেন,তার এ কর্মের মাধ্যমে ভালবাসা,আত্মসম্মানবোধ,মনুষ্যত্ব ও আত্মত্যাগের যে মহান শিক্ষার নমুনা পৃথিবীর বুকে রেখে গেলেন তা সত্য পিপাসুদের জন্য চিরন্তন এক সুপেয় পানির ঝরনা প্রবাহিত করেছে। রক্তাক্ত কারবালার এ মহান বীর মিথ্যার ওপর সত্যের বিজয়ের নিশানা উড়িয়েছিলেন। তিনি সুন্দরের চিরন্তনতা ও অসুন্দরের স্থায়িত্বহীনতার মহান সাক্ষী। কারবালায় ইমাম হোসাইন ও তাঁর ভ্রাতা আব্বাস এবং তাঁদের সঙ্গী সাথীরা কারবালাকে খোদাপরিচিতি,মানবতা ও মানুষ গড়ার মহান এক শিক্ষালয়ে পরিণত করেছিলেন।

কোন শিক্ষালয়ই কারবালার শিক্ষালয়ের মত উত্তম ও সফল শিক্ষার্থী তৈরী ও প্রশিক্ষিত করতে পারেনি। কারবালার ন্যায় কোন শিক্ষাকেন্দ্রেই এত বৈচিত্রময় শিক্ষা বিভাগ নেই। খোদা পরিচিত,খোদাপ্রেম,মর্যাদকর বেশিষ্ট্য,লক্ষ্যের পথে চুড়ান্ত দৃঢ়তা প্রদর্শন,ধের্য,সাহসীকতা,একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দাসত্বসহ অসংখ্য বিভাগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সফলতার শীর্ষে আরোহন করেছে। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুগ্ধপোষ্য শিশু,কিশোর,তরুন,যুবক,মধ্যবয়সী,প্রবীণ,বৃদ্ধ,পুরুষ-নারী,স্বাধীন মানুষ ও দাস সকলেই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করেছে। তাদের সকলেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান শিক্ষক ইমাম হোসাইন ইবনে আলী থেকে শিক্ষা লাভ করেছে। তাঁর ছাত্ররা কঠিনতম পরীক্ষায় সম্মানের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছে যা তাদের অতুলনীয় যোগ্যতার প্রমাণ বহন করে। শাহাদাতের ময়দানের এ অকুতোভয় সৈনিকেরা খোদা প্রেমে এতটা নিমজ্জিত ছিলেন যে,তাদের নেতার পাশে তাদের নাম চিরন্তনতা লাভ করেছে। কেননা যে কেউ মহান আল্লাহর জন্য তার সত্তাকে একনিষ্ঠ করবে অবশ্যই সে স্থায়িত্ব ও অমরতা লাভ করবে। আশুরার ঘটনার প্রতিটি মূহুর্ত জ্ঞান,উন্নত নৈতিকচরিত্র ও মর্যাদাকর বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ। কারবালার ভূমির প্রতিটি অংশ মহান আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ ও মহান প্রভূর দাসত্বের স্বীকৃতরি প্রমাণবাহী।

কারবালার চিরন্তন বিপ্লবী ইতিহাসের প্রতিটি পাতা আত্মমর্যাদা,বন্দেগি,মহত্ব ও আত্মত্যাগের স্বর্ণলিপি খচিত । এ মহান ঘটনার সকল দিক একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। আমরা সংক্ষেপে এ কালজয়ী বিপ্লবের কিছুদিকের উল্লেখ করছিঃ

১. ইমাম হোসাইন (আ.) এর জ্ঞান,চরিত্র ও মর্যাদার দিক

কথা এবং কাজের মাধ্যমে তওহীদের দিকে আহবান সকল ঐশী ধর্মের মূল এবং নবিদের শিক্ষার ভিত্তি। ইমাম হোসাইন (আ.) এর মহান আন্দোলনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তওহীদের সর্বোজ্জল উপস্থিতি লক্ষণীয়। ইমাম হোসাইন (আ.) এক মুহূর্তের জন্য মহান আল্লাহর স্মরণ,প্রশংসা,মর্যদা বর্ণনা এবং কৃতজ্ঞতা থেকে উদাসীন হননি। তিনি যখন মক্কা থেকে ইরাকের দিকে রওয়ানা হন প্রথম মহান আল্লাহকে এভাবে স্মরণ করেনঃ

الحمد لله و ما شاء الله و لا حول ولا قوة الا بالله

মহান আল্লাহর প্রশংসা,তিনি যা চান তাই হবে আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন শক্তি ও ক্ষমতা নেই। তিনি তাঁর জীবনের শেষলগ্নে শাহাদাতের মুহূর্তে-যখন তিনি তৃষ্ণার্ত ও রক্তাক্ত অবস্থায় শত্রুবেষ্টিত হয়ে পড়েছিলেন এবং শিমার তাঁর শির বিচ্ছিন্ন করার জন্য তাঁর বুকের ওপর বসেছিল তখন বলেনঃ হে প্রভূ,আমি আপনার সিদ্ধান্তে (সন্তুষ্টচিত্তে) ধৈর্য ধারণ করছি। আপনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। হে আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় (দাতা)।

২.ঐশী (খোদা অর্পিত) দায়িত্ব পালনও মানবিক মূল্যবোধকে দৃঢ়করণ

স্বাভাবিক ভাবেই যে কোন সেনাপতি যখন শত্রুর সামনে দাঁড়ায় এবং সৈন্য সমবেত করে তার উদ্দেশ্য থাকে শত্রুকে পরাভূত করে জয়ী হওয়া। ইমাম হোসাইন (আ.) ও এ সাধারণ নীতি থেকে ব্যতিক্রম নন। কিন্তু জয় ও পরাজয় তাঁর দৃষ্টিতে ছিল ভিন্ন যা অনেকের জন্যই বোঝা বেশ কঠিন।

ইমাম হোসাইন (আ.) এর  দৃষ্টিতে বিজয় হল আল্লাহ অর্পিত দায়িত্ব সর্বোত্তমরূপে সম্পাদন করা এবং মানবিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করা। যদিও এ কর্ম সম্পাদন করতে তাঁকে শহীদ হতে হয় ও বাহ্যিকভাবে পরাজিত হতে হয়। বাহ্যিক জয় পরাজয় তাঁর লক্ষ্য ছিল না।

এ কারণেই আমরা দেখি মহানবী (সা.) এর আহলে বাইত এবং ইমাম আলী (আ.) এর বিশেষভক্ত ও অনুসারী তেরেম্মাহ ইবনে আদী যখন ইমাম হোসাইন (আ.) এর সাথে কারবালার পথে সাক্ষাৎ করেন তখন ইমাম তাকে কুফার পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তেরেম্মাহ বলেনঃ কুফার বিভিন্ন গোত্রপ্রধান এবং গোত্রপতিরা (গোত্রের বিশেষ ব্যক্তিরা) ইবনে যিয়াদের থেকে মোটা অংকের ঘুষ গ্রহণ করে তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আর সাধারণ মানুষের অন্তর আপনার সঙ্গে কিন্তু তাদের তরবারিগুলি আপনার দিকে (বিরুদ্ধে)। তেরেম্মাহ ইমাম হোসাইন (আ.) কে প্রস্তাব করেঃ আপনাকে আল্লাহর নামে কসম দিয়ে বলছি যে,এ সফর থেকে বিরত হয়ে আমার গোত্র যে অঞ্চলে বাস করে আমার সঙ্গে সেখানে আসুন। কারণ তা শত্রুর নাগালের বাইরে। এতে আপনি শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাবেন।

আবু আব্দুল্লাহ (আ.) তেরেম্মার দৃষ্টি দু’টি বিষয়ের দিকে আকর্ষণ করেন। যে ঐশী দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছে এবং মানবিক মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করা। এ দায়িত্বের অংশ হিসেবে তিনি চুক্তি ও প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন যা তাঁর ও কুফার অধিবাসীদের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ কুফাবাসীর সাথে আমার যে চুক্তি হয়েছে তা থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়। এতে শেষ পরিণতি যা-ই হোক না কেন? অর্থাৎ আমি তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে,কুফায় যেয়ে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করব এবং তাদেরকে সত্যের দিকে পথ নির্দেশ করব। আর তারা আমার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে যে আমাকে সাহায্য করবে ও পৃষ্ঠপোষকতা দিবে। আমার দায়িত্ব হল আমি আমার প্রতিশ্রুতি পালন করব যদিও এ পথে আমাকে বিভিন্নরূপ বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। এখন কুফাবাসী তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুক বা না করুক (অঙ্গীকার ভঙ্গ করুক) আমি আমার দায়িত্ব পালন করব।

 

তথ্য সূত্রঃ

১.আলী সায়াদাত পরভার,ফুরুগে শাহাদাত পৃ.১৫৮।

২.মুহাম্মদ সাদিক নাজমি,মদীনা থেকে কারবালা পর্যন্ত ইমাম হোসাইন (আ.)এর বক্তৃতামালা গ্রন্থ দ্রষ্টব্য