সূরা আলে ইমরান;(৩৫তম পর্ব)

সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১৮৩-১৮৬

সূরা আলে ইমরানের ১৮৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ عَهِدَ إِلَيْنَا أَلَّا نُؤْمِنَ لِرَسُولٍ حَتَّى يَأْتِيَنَا بِقُرْبَانٍ تَأْكُلُهُ النَّارُ قُلْ قَدْ جَاءَكُمْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِي بِالْبَيِّنَاتِ وَبِالَّذِي قُلْتُمْ فَلِمَ قَتَلْتُمُوهُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ ((১৮৩

"যারা বলেছেন অবশ্যই আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার আদায় করে নিয়েছিলেন যে,আগুন গ্রাস করে এমন কোন কোরবানী না আনা পর্যন্ত আমরা যেন কোন নবীর ওপর ঈমান না আনি। হে রাসূল! আপনি বলুন নিশ্চয়ই আমার আগেও স্পষ্ট নিদর্শনাবলী অর্থাৎ মোজেজাসহ নবী রাসূলগণ এসেছিলেন এবং তোমরা যা বলেছিলে তা নিয়ে এসেছিলেন। তাহলে তোমরা সত্যবাদীই হয়ে থাকো,কেন তাদের হত্যা করেছিলে?" (৩:১৮৩)

একদল ইহুদী মহানবী (সা.)'র ওপর ঈমান না আনার জন্য বিভিন্ন ধরনের অজুহাত দেখাত। এই আয়াতে তাদের আরো একটি অজুহাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা বলতঃ কোন নবীর ওপর আমরা তখনই ঈমান আনবো,যখন দেখবো যে,তিনি একটি পশু কোরবানী করেছেন। আর আকাশ থেকে বজ্র এসে মানুষের চোখের সামনে ঐ পশুকে পুড়িয়ে ফেলবে। এটাকেই আমরা ঐ কোরবানী কবুল হবার লক্ষণ বলে মনে করব যেমনটি হযরত আদম (আঃ)'র পুত্র হাবীল ও কাবিলের ঘটনায় আল্লাহ আকাশ থেকে বজ্র পাঠিয়ে হাবিলের কোরবানী গ্রহণ করেছিলেন এবং কাবিলের কোরবানী গ্রহণ করেননি। ইহুদীদের এই অজুহাতের জবাবে আল্লাহ বলছেন,প্রথমতঃ সকল নবীর মোজেজা একই রকম হওয়াটা জরুরি নয়। প্রত্যেক নবীর জন্য মোজেজা থাকাই যথেষ্ট। দ্বিতীয়ত : যেসব নবী তোমাদের উল্লেখিত বা দাবীকৃত মোজেজা দেখিয়েছেন,সে সব নবীকেও তোমরা মেনে নেয়ার পরিবর্তে হত্যা করেছিলে। হত্যার এ বিষয়টি ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতেও উল্লেখ করা হয়েছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : সত্যকে অস্বীকার করার জন্য নিজেদের কাজকে খোদায়ী বা ধর্মীয় বলে ব্যাখ্যা দেয়াটা অন্যায়। আল্লাহ এ ধরনের অজুহাত বা অপব্যাখ্যা পছন্দ করেন না।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানী করার রীতি অত্যন্ত প্রাচীন। পশু কোরবানী কবুল হবার বিষয়টি ছিল কোন কোন নবীর মোজেজা।

সূরা আলে ইমরানের ১৮৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَإِنْ كَذَّبُوكَ فَقَدْ كُذِّبَ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ جَاءُوا بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ وَالْكِتَابِ الْمُنِيرِ ((১৮৪

"হে নবী! অজুহাতকামীরা যদি আপনাকেও প্রত্যাখ্যান করে,আপনি দুঃখিত হবেন না। কারণ,আপনার আগে যেসব নবী-রাসূল প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী তথা মোজেজা ও স্পষ্ট গ্রন্থসহ এসেছিলেন তাঁদেরকেও মিথ্যাবাদী বলে গণ্য করা হয়েছিল।" (৩:১৮৪)

এই আয়াতে মহানবী (সা.) কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলছেন,সত্য অস্বীকার করা বা সত্যকে মিথ্যা বলে উল্লেখ করা খোদাদ্রোহীদের অতি প্রাচীন একটি রীতি। শুধু আপনার ক্ষেত্রেই একদল লোক বিরোধিতায় নেমেছে এমনটি নয়। আপনার আগে সত্যতার স্পষ্ট নিদর্শনাদী থাকা সত্ত্বেও সমস্ত নবীর ওপরই অসত্য আরোপ করা হয়েছে। মানুষকে সত্য গ্রহণ বা অস্বীকারের ক্ষমতা দেয়ার কারণেই এই সব বিরোধিতা এবং অসত্য আরোপের ঘটনা ঘটছে। যদি সব মানুষই একযোগে নবীর ওপর ঈমান আনতো তাহলেই বরং তাঁর সত্যতা নিয়ে হয়তো এ প্রশ্ন উঠতো যে এটা কেমন ধর্ম যে তা সব মানুষের ভালো ও মন্দ রুচির সাথেই খাপ খায়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : অতীতের মানুষের ইতিহাস অর্থাৎ যুগে যুগে সত্য ও মিথ্যার সংগ্রামের ইতিহাস মানুষের মধ্যে ধৈর্য্য ও প্রতিরোধের চেতনা বাড়ায়। এই সব শিক্ষা মানুষের মনে প্রশান্তি বয়ে আনে।
দ্বিতীয়ত : নবীদের আন্দোলন ছিল প্রথম পর্যায়ে সাংস্কৃতিক এবং এর মাধ্যম ছিল বই ও যুক্তি। মানুষের ওপর খোদাদ্রোহীদের শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর জন্যে পরবর্তী পর্যায়ে তাঁরা জিহাদ করেছেন।

সূরা আলে ইমরানের ১৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ ((১৮৫

"সমস্ত প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এবং নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন তোমাদের পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে। তাই যারা দোযখের আগুন থেকে মুক্ত হয়েছে এবং জান্নাতে প্রবেশ করেছে,তারা নিশ্চয়ই সফলকাম। আর দুনিয়ার জীবন ছলনার বস্তু ছাড়া অন্য কিছু নয়।" (৩:১৮৫)

সকল যুগেই নবীগণ ও তাঁদের অনুসারীদের প্রতি খোদাদ্রোহীরা ব্যাপক অত্যাচার এবং হয়রানী করেছে। তাই আল্লাহ মহানবী (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ্যে বলছেন,ধৈর্য ধারণ করুন এবং প্রতিরোধ করুন। এইসব যন্ত্রণা ও হয়রানি ক্ষণস্থায়ী। কারণ,নবী এবং তাঁর বিরোধী সবাইকে মরতে হবে। তাই কিয়ামতের কথা ভাবা উচিত। যারা সেদিন দোযখ থেকে মুক্তি পাবে এবং বেহেশতে প্রবেশ করবে তারাই সফলকাম। ক্ষণস্থায়ী এ দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া উচিত নয়। কারণ,তা এক ধরনের ছলনা বা প্রবঞ্চনা মাত্র।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : মৃত্যু সবার জন্যই অবধারিত। নবী এবং অশান্তি সৃষ্টিকারী কাফের কেউই অমর নয়। কাফের এবং মুমিন সবাই এই দুনিয়ার পান্থশালার স্বল্প সময়ের মুসাফির।
দ্বিতীয়ত : মৃত্যুর অর্থ ধ্বংস নয়। মৃত্যু এক জগত থেকে অন্য জগতে স্থানান্তরের মাধ্যম মাত্র। এই স্থানান্তরের স্বাদ নেয়া সবার জন্যেই অবধারিত। তবে এই স্বাদ কারো জন্য সুখময় এবং কারো জন্য তিক্ত হতে পারে।
তৃতীয়ত : কাফেরদের ধন ও সম্পদের চাকচিক্যে মোহিত হওয়া উচিত নয়। কারণ,স্থায়ী নেয়ামত পরকালের বেহেশতের মধ্যেই রয়েছে,ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে নয়।

সূরা আলে ইমরানের ১৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ ((১৮৬

"তোমাদেরকে নিশ্চয়ই ধন সম্পদ ও জীবন সম্পর্কে পরীক্ষা করা হবে এবং যাদেরকে তোমাদের আগে কেতাব দেয়া হয়েছে ও যারা শিরক করেছে তাদের কাছ থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে। যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং সংযমী হও,তবে তা সুদৃঢ় কাজের অন্তর্ভুক্ত হবে।" (৩:১৮৬)

ইতিহাসে বলা হয়েছে,মুসলমানরা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার সাথে সাথে মুশরিকরা তাদের সম্পদ দখল করে নেয় এবং অন্যান্য মুসলমানদের ব্যাপক জ্বালাতন করা ছাড়াও তাদের ওপর বিষাক্ত কথার তীর ছুঁড়তে থাকে। ওদিকে মদীনার ইহুদীরাও মুহাজির মুসলমানদেরকে অসম্মান করে মুসলিম মহিলাদেরকে অসম্মান করে মুসলিম বিদ্বেষী তৎপরতা চালাতে থাকে। এই সব উৎপীড়ন এত বেশি চলতে থাকে যে মহানবী (সা.) এইসব উৎপীড়ক গোষ্ঠীর হোতাদের জীবন অবসানের নির্দেশ দিতে বাধ্য হন। এই আয়াতে আল্লাহ মহাপরীক্ষার চিরাচরিত রীতির কথা উল্লেখ করে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলছেন,ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেই নির্ঝঞ্ঝাটে ও ভোগ বিলাস এবং আরামের মধ্যে থাকা যাবে,এমন ধারণা করা ভুল। বরং শত্রুদের সর্বাত্মক হামলা,উৎপীড়ন ও ষড়যন্ত্রের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এমনকি তোমরা তাদের বিরুদ্ধে কিছু না করলেও তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সব অস্ত্রই প্রয়োগ করবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : জীবন ও সম্পদ সবসময়ই পরীক্ষার সম্মুখীন। আমাদেরকে এমনভাবে জীবন যাপন করতে হবে যে,আমরা যেন সব সময়ই আল্লাহর রাস্তায় জীবন ও সম্পদ বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকি।
দ্বিতীয়ত : ইসলামের শত্রুরা ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর আঘাত হানার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত এবং ঐক্যবদ্ধ। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য মুশরিকদের সাথে জোটবদ্ধ হতে পারে।
তৃতীয়ত : একই সময়ে ধৈর্য ও খোদাভীতি হলো বিজয়ের চাবিকাঠি। অনেক একগুঁয়ে লোকের মধ্যে ধৈর্য ও অধ্যবসায় থাকলেও খোদাভীতি থাকে না।