সূরা আলে ইমরান;(৩৬তম পর্ব)

সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১৮৭-১৯০

সূরা আলে ইমরানের ১৮৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلًا فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ ((১৮৭

"যাদের গ্রন্থ দেয়া হয়েছে,আল্লাহ যখন তাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে,তোমরা নিশ্চয়ই এটা মানুষের মধ্যে প্রচার করবে এবং তা গোপন করবে না। কিন্তু তারা তা তাদের পেছনে নিক্ষেপ করল এবং খুব কম মূল্যে বিক্রয় করল,অতএব তারা যা কিনল তা নিকৃষ্টতর।" (৩:১৮৭)

প্রত্যেক জাতির মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষ জীবনের আদর্শ এবং ধর্মীয় রীতিনীতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের জ্ঞানী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অনুসরণ করে। তাই বলা যায়,সৎ জ্ঞানী বা সৎ নেতৃবৃন্দ দুর্নীতিপরায়ন জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের সংশোধনের মাধ্যমে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেন। মানুষের কাছে ধর্মের বাস্তবতা ও জ্ঞান তুলে ধরা চিন্তাশীল ও ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তিদের দায়িত্ব। আল্লাহই এ দায়িত্ব পালন করতে জ্ঞানীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। জ্ঞানীরা শুধু নিজের সংশোধন নয়,সমাজ পরিচালনা ও সংশোধনেরও দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাই পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে ধর্মের বাস্তবতা ও সত্যতা গোপন করা বা আল্লাহর বাণী গোপন রাখা সবচেয়ে বড় পাপ। যেমন,বর্তমানে ঐশী ধর্মগ্রন্থের অনুসারী পন্ডিতরা তাওরাত ও ইঞ্জিল গ্রন্থে উল্লেখিত ইসলামের নবী (সা.)'র আবির্ভাব হবার সুসংবাদ সম্পর্কে নীরব। তারা নিজেদের পদ ও স্বার্থ রক্ষার জন্যেই মানুষের কাছে এই বাস্তবতা প্রচার করছেন না। এভাবে দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের বিনিময়ে তারা আল্লাহর বাণী বিকিয়ে দিয়েছেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত: অন্যায় বক্তব্য রাখা এবং সত্যের পক্ষে বক্তব্য রাখা জরুরী হওয়া সত্ত্বেও নীরব থাকা অর্থাৎ সত্য গোপন রাখা এমন এক অপরাধ,যাতে প্রত্যেক জাতির জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের জড়িয়ে পড়ার আশংকা বা বিপদ সব সময়ই রয়েছে। সত্যকে গোপন করার কুফল শত শত বছর ধরেও বজায় থাকে।
দ্বিতীয়ত: মানুষকে সৎপথে পরিচালনা করা এবং সচেতন রাখা জ্ঞানীদের দায়িত্ব।
তৃতীয়ত : দুনিয়া পুজারী জ্ঞানীরা সমাজের কল্যাণের পরিবর্তে সমাজের পতন বা পথভ্রষ্টতার কারণ হয়ে থাকেন।

সূরা আলে ইমরানের ১৮৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَفْرَحُونَ بِمَا أَتَوْا وَيُحِبُّونَ أَنْ يُحْمَدُوا بِمَا لَمْ يَفْعَلُوا فَلَا تَحْسَبَنَّهُمْ بِمَفَازَةٍ مِنَ الْعَذَابِ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ((১৮৮

"তুমি মনে কর না,যারা নিজেদের কৃতকর্মের উপর আনন্দিত হয় এবং না করা বিষয়ের জন্য প্রশংসা কামনা করে,তারা আমার নিকট থেকে অব্যাহতি লাভ করেছে। বস্তুত: তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।" (৩:১৮৮)

পৃথিবীতে প্রশংসা পাবার প্রত্যাশী তিন ধরনের মানুষ দেখা যায়। এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা যে কোন ভাল কাজ এবং এমনকি অন্যদের প্রতি তাদের দান খয়রাত ও আল্লাহ ছাড়া কেউ জানুক তা চায় না। দ্বিতীয় এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা মানুষের প্রশংসা পাওয়ার লক্ষ্যে ও নিজেদের জাহির করার জন্য বিভিন্ন ভাল কাজ করেন। কিন্তু তৃতীয় এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা কোন কাজ না করেই মানুষের প্রশংসা পেতে চায়,কিংবা অন্যের কাজ বা কৃতিত্বকে নিজের বলে প্রচার করতে চায়। এই তৃতীয় শ্রেণীর মানুষের কথাই সূরা আলে ইমরানের ১৮৮ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। এরা হচ্ছে সে রকম অজ্ঞ লোকদের মত যারা চায় মানুষ তাদের জ্ঞানী বলুক,অথবা এরা সে রকম ভীরু লোকদের মত,যাদেরকে সাহসী বললে তারা খুশী হয়। এ ধরনের আচরণ প্রতারিত হবার পথ সুগম করে এবং এই সব লোক কখনও সৌভাগ্যের নাগাল পাবে না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : কোন কাজ না করেই প্রশংসার আশা করা দুরাশা মাত্র। এটা মানুষের পতন ও ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করে।
দ্বিতীয়ত : কাজ না করে প্রশংসা পাওয়ার আশার চেয়েও বড় বিপজ্জনক ধারণা হলো,অন্তসারশূন্য বড় বড় উপাধির অধিকারী মানুষদের শাসন মানুষকে মুক্তি দেবে বলে বিশ্বাস করা।
তৃতীয়ত : যে কোন ধরনের তোষামোদ ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ,এর ফলে মানুষের মধ্যে চেষ্টা ও প্রচেষ্টা ছাড়াই খ্যাতি এবং প্রশংসা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়।
চতুর্থত : একজন পাপী অনুতপ্ত হতে পারে এবং তওবা করতে পারে। কিন্তু অহংকারী ও দাম্ভিক মানুষেরা তওবা বা ক্ষমা প্রার্থনার কথা চিন্তাও করে না। ফলে তাদের মুক্তির কোন সুযোগ নেই।

সূরা আলে ইমরানের ১৮৯ ও ১৯০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (১৮৯) إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآَيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ ((১৯০

"আল্লাহরই জন্য আসমান ও জমিনের আধিপত্য। আল্লাহ সব বিষয়ের ওপর শক্তিমান।" (৩:১৮৯)

"নিশ্চয়ই আসমান ও জমীন সৃষ্টিতে এবং দিন ও রাতের আবর্তনের মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার স্পষ্ট নিদর্শনাবলী রয়েছে।" (৩:১৯০)

পবিত্র কোরআনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো,আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার আহবান। যারা পবিত্র কোরআনের প্রতি বিশ্বাস রাখে তারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখলেও জ্ঞান ছাড়া শুধু অন্ধ বিশ্বাস মূল্যহীন। একজন মুসলমান শুধু মাটিতে এবং নিজের পায়ের নীচে তাকাবেন এমনটি হওয়া ঠিক নয়। বরং তাকে তার মাথার ওপরে আকাশে ও সব দিকেই আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টির দিকে দৃষ্টি দিয়ে এই সব বিশাল ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে দৃশ্যমান ও নিয়মিত বিষয়ের মধ্যে দিন রাতের আবর্তনকেও গুরুত্বহীন ভাবা ঠিক হবে না। বরং দিন ও রাতের সময়ের পার্থক্য এবং সুশৃঙ্খলভাবে দিন রাতের আবর্তন মানুষের জন্য আল্লাহর নিরংকুশ ক্ষমতা ও মহিমাকে জানার এক ভাল মাধ্যম। এর মাধ্যমে এটাও বোঝা সম্ভব যে,একমাত্র আল্লাহই সৃষ্টি জগতের ওপর কর্তৃত্বশীল।

বিভিন্ন তাফসীরে বলা হয়েছে,মহানবী (সা.) এক রাতে ঘরে বিশ্রাম করছিলেন। কিন্তু তিনি শ্রান্তি দূর করার আগেই শয্যা থেকে উঠে অজু করে নামাজে দাঁড়ালেন। নামাজে তিনি এত কাঁদলেন যে তাঁর পোশাক ও মাটি ভিজে গেল। এই কান্নার কারণ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন,গত রাতে আমার ওপর কয়েকটি আয়াত নাজেল হয়েছে। এই ক'টি আয়াতে আল্লাহর সৃষ্টি জগত নিয়ে চিন্তা করতে বলা হয়েছে,তাদের জন্য দুঃখ যারা এই সব আয়াত পড়বে অথচ চিন্তা-ভাবনা করবে না। তাই এই সব আয়াত অর্থাৎ সূরা আলে ইমরানের ১৯০ নম্বর আয়াত থেকে ১৯৪ নম্বর আয়াত প্রতি রাতে এশার নামাজের আগে পড়ার উপদেশ দেয়া হয়েছে।

সূরা আলে ইমরানের ১৮৯ ও ১৯০ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : বিশাল আকাশের তুলনায় ভূমি কিছুই নয়। তাই গুরুত্ব ও মূল্যের দিক থেকে ভূমিকে প্রাধান্য দেয়া উচিত নয়। সামান্য পরিমাণ ভূমির ওপর কর্তৃত্ব সমস্ত আকাশ ও জমিনের ওপর আল্লাহর নিরংকুশ কর্তৃত্বের সাথে মোটেই তুলনীয় নয়।
দ্বিতীয়ত : সৃষ্টি জগতের রহস্য ও পরিচয় আল্লাহর শক্তি এবং ক্ষমতাকে জানার প্রাথমিক পর্যায়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান আল্লাহর পরিচয় জানা এবং ঈমান শক্তিশালী করার ব্যাপারে গভীর প্রভাব রাখতে পারে।
তৃতীয়ত : আল্লাহকে জানার জন্য সৃষ্টিজগত নিয়ে চিন্তা করা জ্ঞানী হবার লক্ষণ। প্রকৃতি বা সৃষ্টির উৎসকে না জেনে তাকে ব্যবহার করা বুদ্ধিহীনতার লক্ষণ।