কোরআনী সমাজে নারী১ (১ম পর্ব)

এ ধারণা থেকে অত্র প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নির্বাচন করা হয়েছে যে,মানব জাতি বর্তমানে নারী সংক্রান্ত এবং সমাজে নারী-পুরুষের আন্তঃসম্পর্ক সংক্রান্ত অনেকগুলো গুরুতর সমস্যায় ভুগছে। যদিও আমাদের মধ্যে কতক লোক অন্যদের তুলনায় এ সমস্যায় অধিকতর ভুক্তভোগী এবং এ সমস্যাগুলো তাদের জন্য অধিকতর কষ্টদায়ক ও বিব্রতকর,তবে সমকালীন বিশ্বের কোন কোন অঞ্চলে সম্ভবত খুবই কম সংখ্যক লোকই রয়েছে যারা এ সব সমস্যার প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন নয়। সুতরাং এ সমস্যাবলীর সমাধান উদ্ভাবন অপরিহার্য। বর্তমান গবেষণায় আমরা নারীর সমস্যাকে কোরআন মাজীদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে চাই। এ ক্ষেত্রে আমরা যে ‘কোরআনী সমাজ’ কথাটি ব্যবহার করেছি তা এ মর্মে অকাট্য প্রত্যয়ের কারণে যে,বর্তমান সমাজের সংস্কার ও পুনর্গঠনের জন্য কোরআন মাজীদ সর্বোত্তম পরামর্শ প্রদান করে যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি অনুসরণীয় আদর্শ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

আপনাদের মধ্যে অনেকে হয়তো অত্র প্রবন্ধের শিরোনাম ‘কোরআনী সমাজে নারী’ দেখে বিস্মিত হয়ে থাকবেন। আপনারা হয়তো মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করছেন,লেখিকা ‘মুসলিম সমাজে নারী’ বা ‘ইসলামী সমাজে নারী’ শিরোনাম ব্যবহার করলেন না কেন? তাই আলোচনার শুরুতেই অত্র প্রবন্ধের শিরোনামে ‘মুসলিম’ বা ‘ইসলামী’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার না করার কারণ এবং ‘কোরআনী সমাজ’ ব্যবহারের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে চাই। প্রবন্ধের জন্য অত্র শিরোনাম বেছে নেয়ার পিছনে তিনটি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে :

প্রথম কারণ হচ্ছে এই যে,কোন অকাট্য প্রমাণ ছাড়াই মুসলিম সমাজের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন চিন্তা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা লালিত হচ্ছে এবং সেগুলোকে ‘মুসলিম’ বা ‘ইসলামী’ বিশেষণে বিশেষায়িত করা হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে মোটামুটি চল্লিশটির মতো জাতি রয়েছে যারা নিজেদেরকে মুসলিম সংখ্যাগুরু বলে দাবি করে এবং সে সাথে নিজেদেরকে আদর্শ ‘মুসলিম’ বা ‘ইসলামী’ সমাজ বলেও দাবি করে থাকে। কিন্তু এর ফলে বড় ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এর ফলে এ প্রশ্নের উদয় হয়েছে যে,এ অঞ্চলগুলোর মধ্যে কোন্টি যথার্থভাবেই ইসলামী সমাজ? অবশ্য মুসলমানদের মধ্য হতে কোনরূপ চিন্তা ও গবেষণা ছাড়া খুব সহজেই এ প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়। প্রতিটি মুসলিম সমাজই দাবি করে থাকে যে,আল্লাহ্তায়ালা যে ধরনের সমাজ দেখতে চান তাদের জাতির বা অঞ্চলের সমাজই তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

অন্যদিকে অমুসলিমরা,বিশেষ করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আচার-আচরণ ও রীতিনীতি-ঐতিহ্য সম্বন্ধে অনুসন্ধানের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণকারী পাশ্চাত্য নৃতত্ত্ববিদগণ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অংশের জনগণের মাঝে প্রচলিত সব ধরনের চিন্তা-বিশ্বাস ও আচরণকেই সমানভাবে ইসলামী বলে মনে করেন। তাঁদের এরূপ উপসংহারে উপনীত হবার কারণ জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে ‘চিড়িয়াখানা তত্ত্ব’-এর অনুসরণ। এ তত্ত্বের ভক্তরা মানব জাতিকে একটি চিড়িয়াখানাতুল্য এবং সকল মুসলমানকে-বলা বাহুল্য যে,অনুরূপভাবে অন্যান্য পাশ্চাত্য বহির্ভূত জাতিসমূহকেও-এ চিড়িয়াখানার বিভিন্ন প্রজাতিতুল্য মনে করে। ‘চিড়িয়াখানা তত্ত্ব’-এর প্রবক্তারা সরেজমীনে পর্যবেক্ষণে নেমে যান এবং যে সব অভিনব ও চমকপ্রদ বিষয় দেখেন বা শোনেন তারই ছবি গ্রহণ বা রেকর্ড করেন;তাঁদের কাছে এগুলোই ইসলাম বা ইসলামী কার্যকলাপ। তাঁরা রেকর্ডিং ও ফটোগ্রাফির অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসহ মুসলিম জাহানের অন্য অংশে গিয়েও হাজির হন এবং সেখানকার মুসলিম জনগণের আচার-আচরণ ও রীতি-নীতির একটি বাহ্যিক চিত্র ধারণ করে নিয়ে আসেন। কিন্তু ‘চিড়িয়াখানা তত্ত্ব’-এর প্রবক্তা অনুসন্ধানী ও বর্ণনাকারীদের দৃষ্টিতে এ-ও হচ্ছে ইসলাম বা ইসলামী কার্যকলাপ। এ ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে ইসলামকে অনুধাবন করার জন্য কদাচ চেষ্টা করা হয়। ফলে অনুসন্ধানকারী বা গবেষকের মনে পূর্ব থেকেই যে সন্দেহবাদী ও আপেক্ষিকতাবাদী ধ্যান-ধারণা বিরাজমান থাকে তার ভিত্তিতে তিনি এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণসহ প্রত্যাবর্তন করেন যে,ইসলাম একটি নয়,বরং বিশ্বে ডজন ডজন ইসলামের অস্তিত্ব রয়েছে। ফ্যাশন বৈচিত্র্যের ওপর প্রতিবেদন প্রদানের ন্যায় গবেষক তাঁর প্রতিবেদনে বলেন,মুসলিম সমাজে নারীর মর্যাদা ও ভূমিকা সম্বন্ধে অনেক সংজ্ঞা ও বর্ণনা রয়েছে। এরূপ প্রতিটি সংজ্ঞা ও বর্ণনাকেই ‘মুসলিম’ বা ‘ইসলামী’ নামে অভিহিত করা হয়। এমনকি আমরা মুসলমানরা যদি এ সব কার্যকলাপের কতককে বিকৃত,আমাদের ঈমান-আকীদার বিপরীত এবং পথভ্রষ্ট বা জাহেল লোকদের কাজ বলে গণ্য করি,তা সত্ত্বেও তাঁরা এগুলোকে ‘মুসলিম’ বা ‘ইসলামী’ বলে অভিহিত করতে বিরত হন না।

 ‘মুসলিম’ ও ‘ইসলাম’ সম্পর্কে এ ধরনের বিভিন্ন বর্ণনা এবং ভুল ধারণা অত্র প্রবন্ধের নামকরণে ‘কোরআনী’ শব্দ ব্যবহারের অন্যতম প্রধান কারণ। আমরা আশা করছি যে,এর ফলে ‘চিড়িয়াখানা তত্ত্ব’ ভিত্তিক অনুসন্ধান থেকে উৎসারিত মুসলিম সমাজ সম্পর্কিত বহুবিধ চিত্র এড়িয়ে সঠিক ইসলামী বিধিবিধানসহ ইসলামী আদর্শ ভিত্তিক আলোচনায় সক্ষম হব। বস্তুত যে সব বিষয় আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ ও অস্তিত্ব রক্ষার সাথে সম্পর্কযুক্ত সে সব বিষয়ে আমরা কথিত ‘চিড়িয়াখানা’র কতক মানব-প্রাণী সম্পর্কিত প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করতে পারি না,যদিও তারা পরিসংখ্যানগতভাবে ‘মুসলিম’ বা তাদের আচার-আচরণ ও রীতি-নীতিকে ‘ইসলামী’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কারণ ক্ষেত্রবিশেষে এ সব আখ্যার ভুল ব্যবহার বা অপব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে ‘কোরআনী’ এমন একটি পরিভাষা যা পুরোপুরি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। তাই এ শিরোনাম আমাদের আলোচ্য বিষয়ের প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশ করতে সক্ষম।

দ্বিতীয়ত ‘কোরআনী সমাজ’কে এ কারণে পুরোপুরি যথাযথ শিরোনাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে যে,এ শিরোনাম আমাদেরকে স্বয়ং কোরআন মাজীদে নিহিত সে সব মূলনীতি উদ্ঘাটনে অনুপ্রাণিত করে যা মুসলিম জাহানের সবগুলো মুসলিম সমাজের মূল মর্মবাণী ও অন্তর্কাঠামোরূপে কাজ করছে। বস্তুত আমাদের সকলেরই লক্ষ্য হচ্ছে কোরআন মাজীদের মূলনীতিসমূহের ভিত্তিতে আমাদের সমাজকে গড়ে তোলা,যদিও হতে পারে যে,অজ্ঞতাবশত আমরা বিভিন্ন সময় এ সব মূলনীতি থেকে দূরে সরে গিয়েছি। এ ব্যাপারেও দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই যে,বিশ্বের মুসলিম জনগণ যদি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করতে চায় তাহলে তাদেরকে অবশ্যই এমন একটি সমাজ গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে যা কোরআন মাজীদের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিশীল। যে সমাজকে আমরা অবিসংবাদিত ও বিতর্কাতীত রীতিনীতিভিত্তিক বলে গণ্য করতে পারব নিঃসন্দেহে তা ইন্দোনেশীয়,পাকিস্তানী,সউদী,মিশরীয় বা নাইজেরীয় সমাজ নয়,বরং তা কোরআন মাজীদের শিক্ষার ওপরে দৃঢ়ভাবে ভিত্তিশীল সমাজ। কেবল এমন একটি সমাজেই আমরা নারীর ভূমিকার যথাযথ সংজ্ঞা খুঁজে পেতে পারি। যেহেতু এ শিক্ষাই অত্র প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সেহেতু ‘কোরআনী সমাজে নারী’-ই যথাযথ শিরোনাম বলে মনে হয়।

তৃতীয়ত এ শিরোনাম বেছে নেয়ার মাধ্যমে আমরা এ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে চাই যে,আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদের উচিত কোরআন মাজীদকে পথনির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করা। কারণ কোরআন মাজীদ কেবল আমাদের আকীদা-বিশ্বাস,দায়িত্ব-কর্তব্য সংক্রান্ত বিধি-বিধান এবং আচার-আচরণ সংক্রান্ত নির্দেশাবলীর চূড়ান্ত উৎসই নয়,বরং ইসলামী সভ্যতার প্রতিটি দিকের জন্যই কোরআন আমাদেরকে পথনির্দেশ প্রদান করে;সে পথনির্দেশ সুনির্দিষ্টই হোক অথবা এর বিশ্লেষণ থেকে নিষ্পন্ন হোক। অতীতের গৌরবময় শতাব্দীগুলোতে কোরআন মাজীদই মুসলিম জনগণের রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,সামাজিক ও শিল্পকলা অঙ্গনের সৃজনশীলতাকে নির্ধারণ করেছে। আগামী দশকগুলোতে ও শতাব্দীগুলোতে আমরা যদি একটি ইসলামী সমাজের সদস্য হিসেবে সফল হতে চাই তাহলে অবশ্যই পুনরায় আমাদের চিন্তা-চেতনা ও কার্যাবলীকে সর্বাত্মকভাবে কোরআন মাজীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে দিতে হবে।

বস্তুত দীন কেবল এর পাঁচ স্তম্ভ অর্থাৎ শাহাদাত,সালাত,সিয়াম,যাকাত ও হজ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃতপক্ষে ‘দীন’ নিজেকে ইংরেজি পরিভাষা ‘রিলিজিয়ন’ (ধর্ম)-এর সমার্থক বলে স্বীকার করে না। কারণ দীন মানুষের অস্তিত্ব ও আচরণের প্রতিটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্থানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে;‘দীনের’ বিশেষত্ব এখানেই। তাই অবশ্যই আমাদের প্রতিটি কাজকেই দীনের কাজে পরিণত করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে গঠন ও পুনর্গঠনের ভার কেবল কোরআন মাজীদকে প্রদানের মাধ্যমেই তা সম্ভবপর।

এ লক্ষ্যে অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে,আসুন,আমরা পর্যালোচনা করে দেখি,আমাদের কি ধরনের সমাজ গড়ে তোলার জন্যে সর্বাত্মক সাধনা করা উচিত-এ ব্যাপারে কোরআন মাজীদ আমাদেরকে কি শিক্ষা দিচ্ছে এবং নারীর মর্যাদা ও অবস্থানের ওপর তার প্রভাব কি-সে সম্বন্ধেও চিন্তা করি। কোরআনী সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ কি যা বিশেষভাবে নারীর মর্যাদা ও অবস্থানকে প্রভাবান্বিত করে?

একটি কোরআনী সমাজের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য আছে বলে গণ্য করা যায় যা মৌলিক,গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কাতীত। যদিও এ বৈশিষ্ট্যগুলো একের পর এক বর্ণনা করতে হচ্ছে,কিন্তু এর প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই অপর বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে জড়িত এবং একটি অপরটিকে প্রভাবিত করে। এ পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের পারস্পরিক আন্তঃনির্ভরতার কারণে এর কোন একটি সম্পর্কেও অন্যগুলোর উল্লেখ ব্যতিরেকে আলোচনা করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। আর তাই বলা বাহুল্য যে,এ বৈশিষ্ট্যগুলোর কোন একটিও অন্যগুলো থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কোন সমাজে থাকে না ও থাকতে পারে না।

এক : নারী-পুরুষের অভিন্ন মর্যাদা ও মূল্য

একটি কোরআনী সমাজের যে সব বৈশিষ্ট্য নারীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে প্রথম বৈশিষ্ট্য এই যে,এরূপ সমাজে নারী ও পুরুষের মর্যাদা ও মূল্য অভিন্ন ও পরস্পর সমান। অন্য কথায় কোরআন মাজীদ আমাদেরকে এ শিক্ষাই দিচ্ছে যে,নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই আল্লাহ্তায়ালার সৃষ্টি;তাদের ‘মর্যাদা ও মূল্য’ অভিন্ন স্তরে অবস্থিত যদিও তাদের এ অভিন্ন গুরুত্বের মানে এ নয় যে,তাদের উভয়কে সকল দিক দিয়ে সমান গণ্য করতে হবে বা উভয়ের পূর্ণ পরিচিতি অভিন্ন হবে।

নারী-পুরুষের মর্যাদা ও মূল্য যে অভিন্ন তা কোরআন মাজীদের বহু আয়াত থেকে প্রমাণিত। মানব জাতির অস্তিত্ব ও আন্তঃক্রিয়ার অন্তত চারটি দিক সম্পর্কে কোরআন মাজীদে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে।

ক. দীনী বিষয়ে

কোরআন মাজীদ যেখানে ধর্মীয় বিষয়ে কথা বলেছে,যেমন মানব জাতির উৎস বা ধর্মীয় দায়িত্ব-কর্তব্য ও প্রতিদান সম্পর্কে,সে ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অভিন্নতার স্বীকৃতি প্রদান করেছে।

১. মানব জাতির উৎপত্তি : বাইবেলের পুরাতন নিয়মে বর্ণিত কাহিনীতে যে ভাবে নারীকে অবমূল্যায়ন ও দোষারোপ করা হয়েছে কোরআন মাজীদে তেমন কিছুর অস্তিত্ব নেই। কোরআন মাজীদে এমন কোন ইঙ্গিতও নেই যে,আল্লাহ্তায়ালা কর্তৃক সৃষ্ট প্রথম পুরুষের তুলনায় প্রথম নারীর মূল্য ও গুরুত্ব কম ছিল অথবা তাঁকে প্রথম পুরুষের পাঁজরের হাড় দিয়ে আনুষঙ্গিক হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছিল। বরং আমরা কোরআন মাজীদে দেখতে পাই যে,পুরুষ ও নারী উভয়কেই পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে এবং একই আত্মা বা সত্তা থেকে (من نفسٍ واحدة-সূরা আন-নিসা: ১ এবং সূরা আল-আ’রাফ : ১৮৯) সৃষ্টি করা হয়েছে।

তাওরাতে যেখানে হযরত হাওয়া (আ.)-কে বেহেশতে থাকা অবস্থায় কুপ্ররোচনার মূর্তরূপ হিসেবে-আল্লাহ্তায়ালার নাফরমানী করার জন্য হযরত আদম (আ.)-কে প্ররোচনা দানে শয়তানের সাহায্যকারিনীরূপে চিত্রিত করা হয়েছে সেখানে কোরআন মাজীদ এ দম্পতির উভয় সদস্যকে সমভাবে উল্লেখ করেছে। কোরআন মাজীদের দৃষ্টিতে উভয়ই গুনাহ করার ক্ষেত্রে সমভাবে অপরাধী ছিলেন,সমভাবেই শাস্তিস্বরূপ বেহেশ্ত থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন এবং তওবা করার কারণে উভয়ই সমভাবে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

২. দীনী দায়িত্ব-কর্তব্য ও প্রতিদান : কোরআন মাজীদ দীনী দায়িত্ব-কর্তব্য পালন ও তার প্রতিদানের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়কে অভিন্ন গণ্য করেছে। আদেশ-নিষেধ জারী করার ক্ষেত্রে এই সমতার বিষয়ে কোরআন মাজীদে কোনরূপ অস্পষ্টতা রাখা হয়নি। যেমন,এরশাদ হয়েছে :

يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَعْرُوفًا (32) وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا

 “নিঃসন্দেহে মুসলিম পুরুষগণ ও মুসলিম নারিগণ,ঈমানদার পুরুষগণ ও ঈমানদার নারিগণ,(আল্লাহর) অনুগত পুরুষগণ ও অনুগতা নারিগণ,সত্যানুসারী পুরুষগণ ও সত্যানুসারিনী নারিগণ,ধৈর্যশীল পুরুষগণ ও ধৈর্যশীলা নারিগণ,(আল্লাহর সামনে) অবনত পুরুষগণ ও অবনতা নারিগণ,ছদকা দানকারিগণ ও ছদকা দানকারিনিগণ,রোযা পালনকারিগণ ও রোযা পালনকারিনিগণ,স্বীয় লজ্জাস্থানের হেফাযতকারিগণ ও হেফাযতকারিনিগণ,অধিকমাত্রায় আল্লাহকে স্মরণকারিগণ ও স্মরণকারিনিগণ;আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।” (সূরা আল আহযাব : ৩৩-৩৫)

খ. নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য ও প্রতিদান

দ্বিতীয়ত কোরআন মাজীদ নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য অভিন্ন নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য এবং প্রতিদান নির্ধারণ করে দিয়ে মানব জাতির সামনে নারী-পুরুষের সমতাকে তুলে ধরেছে। যেমন এরশাদ হয়েছে

وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا

“পুরুষ বা নারী যে-ই উত্তম কাজ সম্পাদন করবে সে যদি ঈমানদার হয়ে থাকে তাহলে তারা বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি তিল পরিমাণও অন্যায় করা হবে না।” (সূরা আন নিসা : ১২৪)

আরো এরশাদ হয়েছে :

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

“পুরুষ বা নারী যে-ই উত্তম কাজ সম্পাদন করবে সে যদি ঈমানদার হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই খুব শীঘ্রই তাকে আমি এক পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যে কাজ সম্পাদন করেছে তদ্দৃষ্টে তাদেরকে সর্বোত্তম প্রতিদানে ভূষিত করব।” (সূরা আন নাহল : ৯৭)

মহান আল্লাহ যদি নারী-পুরুষ উভয়কে মর্যাদা ও মূল্যমানের দিক থেকে সমান ও অভিন্ন গণ্য না করতেন তাহলে নারী-পুরুষের নৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য ও প্রতিদান সম্বন্ধে কোরআন মাজীদে এ ধরনের ঘোষণা দেয়া হতো না।

গ. শিক্ষা

হাদীসে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ের অধিকারের কথা সমভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং উভয়ের প্রতি জ্ঞানার্জনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে কোরআন মাজীদে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মুসলমানকে জ্ঞানার্জনে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ,কোরআন মাজীদ তার পাঠক-পাঠিকাদেরকে পড়া,অধ্যয়ন করা,চিন্তা করা,গবেষণা করা এবং সে সাথে প্রকৃতিতে নিহিত আল্লাহ্তায়ালার নিদর্শনাবলী থেকে শিক্ষা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।

এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে,রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি প্রথম যে আয়াতসমূহ নাযিল হয় তা ছিল জ্ঞানসংক্রান্ত। অতএব,নিঃসন্দেহে একটি কোরআনী সমাজে নারী-পুরুষ ভেদে কারো জন্য জ্ঞানার্জনের ওপর বিধিনিষেধ থাকতে পারে না;বরং একজন মুসলিম নারী বা একজন মুসলিম পুরুষের জন্য সারা জীবনই জ্ঞান অর্জন করা ফরজ,এমন কি এ জন্য তাকে যদি সুদূর চীনেও যেতে হয় তথাপি তাকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। রাসূল (সা.) দাসীদেরকেও শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য আদেশ করেছেন।১০ এছাড়া তিনি তাঁর স্ত্রী হাফসা বিনতে ওমরকে লেখাপড়া শিক্ষাদানের জন্য শিফা বিনতে আবদিল্লাহকে শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন।১১ রাসূল (সা.) যখন খুতবা দিতেন তখন নারী-পুরুষ উভয়ই তা শোনার জন্য হাযির হতেন। নবী করিম (সা.) যখন ইন্তেকাল করেন তখন পণ্ডিত ও জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে অনেক মহিলাও ছিলেন।১২

ঘ. আইনগত অধিকার

কোরআন মাজীদে নারী-পুরুষের সমতার চতুর্থ দৃষ্টান্তটি হচ্ছে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত উভয়ের জন্য আইনগত অধিকারের সমতার নিশ্চয়তা বিধান। পাশ্চাত্য জগতে যেখানে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্তও একজন বিবাহিতা নারী নিজের জন্য কোনরূপ সম্পদ সংরক্ষণ করার,অন্য লোকদের সাথে (আর্থিক ব্যাপারে) চুক্তি সম্পাদনের বা স্বামীর অনুমতি ব্যতীত নিজ সম্পদ অন্যকে দান করার অধিকার রাখত না১৩ সেখানে কোরআন মাজীদ সকল নারীর জন্যই ক্রয়-বিক্রয়,চুক্তি সম্পাদন ও অর্থ উপার্জনের অধিকার১৪ এবং স্বীয় ধন-সম্পদ ও অর্থ সংরক্ষণ,নিয়ন্ত্রণ ও ব্যয় ব্যবহারের অধিকার প্রদান করেছে। এ সব অধিকার ছাড়াও কোরআন মাজীদ নারীকে পরিবারের উত্তরাধিকারে অংশীদার করেছে (সূরা আন নিসা : ৭ ও ১১)। তাকে যেন এ উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা না হয় এ জন্য সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে (সূরা আন নিসা : ১৯)। সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে,তার বিবাহের দেনমোহরের মালিকানা শুধু তারই এবং তার স্বামী কখনই তার কাছ থেকে তা কেড়ে নেয়ার অধিকার রাখে না (সূরা আল বাকারা : ২২৯,সূরা আন নিসা : ১৯-২১,২৫) যদি না স্ত্রী স্বেচ্ছায় তাকে তা দান করে। (সূরা আন নিসা : ৪৪)।১৫

নারীকে এ সব অধিকার প্রদানের পাশাপাশি তার ওপরে অনুরূপ দায়িত্বও প্রদান করা হয়েছে। নারী যদি কোন ফৌজদারী অপরাধ করে,কোরআন মাজীদের বিধান অনুযায়ী তার শাস্তি অনুরূপ অপরাধে অপরাধী পুরুষের তুলনায় মোটেই কম নয়। (সূরা আল মায়েদা : ৪১ এবং সূরা আন নূর : ২)। তার প্রতি যদি অন্যায় করা হয় বা তাকে আঘাত করা হয়,তাহলে একজন পুরুষের মতোই সে ক্ষতিপূরণ লাভের অধিকারী হবে।১৬

এটি অত্যন্ত স্পষ্ট বিষয় যে,কোরআন মাজীদ নারী-পুরুষের সমতার জন্য শুধু উপদেশই প্রদান করেনি,বরং একে একটি কোরআনী সমাজের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য করেছে। ইসলাম নারীকে অবমূল্যায়ন করেছে বলে অমুসলিম সমালোচকগণ যে দাবি করেছেন কোরআন মাজীদ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তেমনি ইতোপূর্বে ইহুদী ও খ্রিস্টান সাহিত্যে যা করা হয়েছে তদ্রূপভাবে কতক মুসলিম যে ধর্মীয়,বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক দিক থেকে নারীকে পুরুষের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদা সম্পন্ন বলে দাবি করেছেন কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে তাঁদের উত্থাপিত সে সব যুক্তিও পুরোপুরি প্রত্যাখ্যাত।

দুই : দ্বিলৈঙ্গিক সমাজ

এবার আসুন আমরা কোরআনী সমাজের সেই দ্বিতীয় মৌলিক বৈশিষ্ট্যটি নিয়ে আলোচনা করি যা নারীর অবস্থানকে প্রভাবিত করে। এ বৈশিষ্ট্যটি একলৈঙ্গিক সমাজের১৭ পরিবর্তে দ্বিলৈঙ্গিক সমাজ১৮ গঠনে কোরআন মাজীদের নির্দেশনায় পরিস্ফুট। কোরআন মাজীদ নারী-পুরুষের মূল্য ও মর্যাদার সমতা বজায় রেখেছে,কিন্তু এই সমতাকে সম বা অভিন্ন লৈঙ্গিকতা বলে গণ্য করেনি।

সম্ভবত আপনাদের সকলেই সমকালীন একলৈঙ্গিক প্রবণতার সাথে পরিচিত। বর্তমানে একলৈঙ্গিক পোশাক-পরিচ্ছদ,একলৈঙ্গিক জুতা,একলৈঙ্গিক অলঙ্কারাদি,সাজসজ্জা ও চুলের স্টাইল এবং একলৈঙ্গিক কাজকর্ম,বিনোদন ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। বস্তুত বর্তমানে আমেরিকায় একজন লোকের পক্ষে প্রায়শঃই বুঝে ওঠা কঠিন হয় যে,সে তার সামনে একটি ছেলেকে দেখছে,নাকি একটি মেয়েকে। এর কারণ হলো,বর্তমানে পাশ্চাত্য সমাজে এ ধারণা বিদ্যমান যে,শারীরিক,বুদ্ধিবৃত্তিক ও ভাবাবেগগত বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে যদি কোন পার্থক্য থেকেও থাকে তা হলে সে পার্থক্য খুবই সামান্য। অতএব,তাদের কাজকর্ম ও সমাজে তাদের ভূমিকায় কোন পার্থক্য থাকা উচিত নয়।১৯

বস্তুত তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও কাজকর্ম তাদের মন-মগজে দৃঢ়মূল হয়ে গেঁড়ে বসা ধ্যান-ধারণারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কারণ পাশ্চাত্য সমাজে গতানুগতিকভাবে নারী সম্পর্কে যে নীচু ধারণা পোষণ করা হতো,নারীর গুণাবলী ও ভূমিকা সম্পর্কে সে নীচ ধারণা বজায় রেখেই এবং এ ধারণার প্রতিক্রিয়াস্বরূপই বর্তমান ধ্যান-ধারণা একটি একলৈঙ্গিক সমাজের জন্ম দিয়েছে যে সমাজে কেবল পুরুষের ভূমিকার প্রতিই সম্মান দেখানো হয় এবং কেবল পুরুষের ভূমিকা পালনেরই চেষ্টা করা হয়।২০ যদিও মনে করা হয় এবং দাবি করা হয় যে,নারীর স্বার্থে সমতার একটি ব্যাপকতর মানদণ্ড গ্রহণ করা হয়েছে,তথাপি নারী-পুরুষকে শুধু মানুষ হিসেবেই সমান নয়, বরং সমরূপ ও অভিন্ন গণ্য করার এ ধারণা প্রকৃতপক্ষে নারীকে পুরুষের ভূমিকায় অভিনয় করার এবং এমনকি স্বীয় নারীত্বকে ঘৃণা করার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এভাবে এক নতুন ধরনের ‘পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের’ ধারণা সৃষ্টি করা হচ্ছে। মারাত্মক সামাজিক চাপ নারীকে তার পূর্বতন ভূমিকা ও দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে এবং তাদেরকে ব্যক্তিত্বহীন ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধহীন জীবন যাপনে বাধ্য করছে।

এর বিপরীতে কোরআন ভিত্তিক সমাজ হচ্ছে একটি দ্বিলৈঙ্গিক সমাজ যেখানে নারী-পুরুষ উভয়ের ওপর বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব-কর্তব্য অর্পিত হয়েছে। এর ফলে সমাজের সকল সদস্যের কল্যাণে সুষ্ঠু কর্মতৎপরতা নিশ্চিত হয়। এভাবে যে কর্মবিভাজন করা হয়েছে তাতে পুরুষদের ওপরে অধিকতর অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে (সূরা আল বাকারা : ২৩৩,২৪০-২৪১ এবং সূরা আন নিসা : ৩৪)। অন্যদিকে নারীদের কাছ থেকে আশা করা হয় যে,তারা সন্তান ধারণ ও লালন-পালনের দায়িত্ব পালন করবে (সূরা আল বাকারা : ২৩৩,সূরা আল আ’রাফ : ১৮৯)।

কোরআন মাজীদ নারী ও পুরুষের এ বিশেষ ভূমিকা ও দায়িত্বের স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং এর ফলে সমাজের পুরুষ সদস্যদের যে বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রয়োজন সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে নারীর তুলনায় তাকে বেশি অংশ প্রদান করেছে। অন্যদিকে নারী পরিবারের সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক কল্যাণ সাধনে যে অবদান রাখে এবং সন্তানের লালন-পালন করে থাকে তার বিনিময়ে কোরআন তার ভরণপোষণ লাভের নিশ্চয়তা বিধান করেছে।

একলৈঙ্গিক চিন্তা ও মতাদর্শ নারী ও পুরুষের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি করে। আমেরিকায় আমরা এ ধরনের অবস্থা দেখতে পাই এবং তা সমাজের সকল সদস্যের জন্যই বিপর্যয়কর প্রমাণিত হয়েছে। শিশু,বৃদ্ধ,সন্তান ও পিতামাতা,কুমার ও বিবাহিত,পুরুষ ও নারী নির্বিশেষে সকলেই এ বিপর্যয়ের শিকার। এর বিপরীতে লৈঙ্গিক সম্পর্ক থেকে উদ্ভূত প্রশ্নের অধিকতর প্রাকৃতিক জবাব হচ্ছে দ্বিলৈঙ্গিক সমাজ। এ হচ্ছে এমন একটি পরিকল্পনা যা নারী-পুরুষের মধ্যে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতাকে উৎসাহিত করে। এ হচ্ছে এমন একটি পরিকল্পনা যা মানব জাতির ইতিহাস জুড়ে অসংখ্য সমাজে যথোপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। কেবল অতি সাম্প্রতিক কালে লৈঙ্গিক পার্থক্যহীনতা বা অভিন্নতার ধারণাকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হয় এবং এরপর প্রাথমিকভাবে পাশ্চাত্য সমাজে এ ধারণা প্রাধান্য লাভ করে। এমনকি এ ধারণার প্রাধান্যের কারণে পাশ্চাত্যে নারী-পুরুষের মানসিক ও ভাবাবেগগত পার্থক্য নির্দেশক চিকিৎসা শাস্ত্রীয় তথ্য প্রামাণাদি পর্যন্ত চেপে যাওয়া হয়। কারণ ভয় করা হয় যে,এ সব তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ করা হলে তার ফলে (পাশ্চাত্য) সমাজে বিদ্যমান চিন্তাধারা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে।

দেউলে চিন্তাধারা হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হবার পূর্বে সামাজিকভাবে বিপর্যয়কর এ আন্দোলন পাশ্চাত্যে আর কতদিন অব্যাহত থাকবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে মুসলিম আমাদেরকে অবশ্যই এর দুর্বল দিকসমূহ ও বিপজ্জনক পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং আমাদের সমাজকে,বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে এ চিন্তাধারা সৃষ্ট বিপর্যয় সম্বন্ধে সচেতন করতে হবে।

একলৈঙ্গিক সমাজের শীর্ষ প্রবক্তারা দ্বিলৈঙ্গিক সমাজের নিন্দা করে থাকে। তাদের মতে,দ্বিলৈঙ্গিক সমাজ নারীর কল্যাণ ও স্বার্থের জন্য ভয়ঙ্কর। অবশ্য দ্বিলৈঙ্গিকতার মানে যদি এই হয় যে,একজনের তুলনায় আরেকজন শ্রেষ্ঠ ও উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী তাহলে অবশ্যই এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। কিন্তু কোরআনী সমাজে-আমরা সবাই যাতে উপনীত হবার প্রত্যাশা পোষণ করি,সেখানে এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া সম্ভব নয়।

আমরা ইতোপূর্বেই যেমন দেখেছি,কোরআন মাজীদ নারী-পুরুষের মর্যাদার সমতার প্রবক্তা এবং একই সাথে তাদের প্রকৃতি ও কর্মক্ষেত্রের সাধারণ পার্থক্যকে স্বীকার করে। এভাবে কোরআন মাজীদ ধর্মীয়,নৈতিক,বুদ্ধিবৃত্তিক ও আইনগত দিক থেকে নারী-পুরুষের সমতার স্বীকৃতি প্রদান করে ও কখনই উভয়কে অভিন্ন ও পরস্পরের সমরূপ গণ্য করেনি। নারী-পুরুষের ওপর বিভিন্ন স্বতন্ত্র দায়িত্ব অর্পণ করে এবং এ দায়িত্বের সাথে সঙ্গতি রেখে উত্তরাধিকার আইন প্রণয়ন ও ভরণপোষণের অধিকার নির্ধারণ করে দিয়ে কোরআন মাজীদ উভয়ের মধ্যকার এ পার্থক্যের যথার্থতা প্রতিপন্ন করেছে।

(চলবে)

পাদটীকা :

১. প্রবন্ধটি ১৯৮৪ সালের ৪ থেকে ৬ ফ্রেব্র“য়ারী তেহরানে ‘কোরআন ও তার বিভিন্ন দিক’ বিষয়ে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ইসলামী চিন্তাধারা সম্মেলনে পঠিত হয়। প্রবন্ধটির লেখিকা তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ছিলেন। তেহরান থেকে প্রকাশিত ধর্মীয় জ্ঞান গবেষণা বিষয়ক ইংরেজি সাময়িকী Al-Tawhid-এর জুলাই ১৯৮৪ (শাওয়াল ১৪০৪) সংখ্যায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। (Al-Tawhid)

২. স্মর্তব্য,প্রবন্ধটি ১৯৮৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে লেখা। বর্তমানে এরূপ দেশের সংখ্যা অর্ধ শতাধিক। অনুবাদক

৩. Zoo Theory

৪. ‘বাইবেল’কে সাধারণত একটি মাত্র গ্রন্থ মনে করা হয়;বিশেষভাবে অনেকে ‘বাইবেল’ মানে ‘ইঞ্জীল’ মনে করে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ‘বাইবেল’ হচ্ছে অনেকগুলো পুস্তকের সংকলন। এ পুস্তকগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে;প্রথম ভাগকে ‘Old Testament’ (পুরাতন নিয়ম/পুরাতন অঙ্গীকার) ও দ্বিতীয় ভাগকে ‘New Testament’ (নতুন নিয়ম/ নতুন অঙ্গীকার) নামকরণ করা হয়েছে। ‘পুরাতন নিয়ম’-এর পুস্তকগুলোকে বিভিন্ন নবী-রাসূলের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে দাবি করা হয়। এর প্রথম পাঁচটি পুস্তককে হযরত মূসা (আ.)-এর ওপর নাযিলকৃত ‘তওরাত’ এর পাঁচটি খণ্ড বলে দাবি করা হয়। অন্যদিকে ‘নতুন নিয়ম’-এর প্রথম চারটি পুস্তককে চারজন লেখকের দ্বারা লিখিত হযরত ঈসা (আ.)-এর ওপর নাযিলকৃত ‘ইঞ্জীল’-এর চারটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য বলে দাবি করা হয়;বাকী পুস্তকগুলো ‘নবী নন’ পুরোপুরি এমন লোকদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে বাইবেলের কোন পুস্তকই হুবহু আল্লাহর কিতাব নয়। বরং এগুলো হচ্ছে আল্লাহর কিতাবের বিভিন্ন খণ্ডিত অংশ (যার কতক বিকৃত করা হয়েছে),সংশ্লিষ্ট নবী-রাসূলগণের খণ্ডিত ও বিকৃত জীবনকাহিনী,বনি ইসরাইলের ইতিহাস এবং সংশ্লিষ্ট লেখকদের (যারা নবী ছিলেন না) নিজস্ব মতামত ও ধ্যান-ধারণার সংমিশ্রণ। বাইবেল মনোযোগ সহকারে পাঠ করলে যে কারো কাছেই তা সুস্পষ্ট ধরা পড়তে বাধ্য।-অনুবাদক

৫. লেখিকা نفس واحدة এর অর্থ করেছেন Single Soul or Self (একটি একক আত্মা বা সত্তা)। তাঁর এ উক্তি থেকে এরূপ ধারণা হতে পারে যে,মানুষ সৃষ্টির পূর্বে একটি আত্মা বা সত্তা সৃষ্টি করা হয় এবং তা থেকে বা তাকে অবলম্বন করে একই সময় হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে প্রথমে হযরত আদম (আ.)-কে ও পরে হযরত হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়। উদ্ধৃত আয়াতাংশদ্বয়েও তার আভাস রয়েছে। কারণ نفس মানে ‘ব্যক্তিসত্তা’ এবং نفس واحدة মানে ‘এক ব্যক্তি’। আর خلقکم نفس واحدة (তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন) বলার পর সূরা আল আ’রাফে বলা হয়েছে و جعل منها زوجها এবং সূরা আন নিসায় বলা হয়েছে خلق منها زوجها (আর তার থেকে তার জুটি সৃষ্টি করেছেন)। অর্থাৎ দু’জনকে একবারে সৃষ্টি করা হয়নি,বরং অগ্র-পশ্চাৎ করে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রথম যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তার থেকেই তাঁর জুটি দ্বিতীয় ব্যক্তিকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্যান্য আয়াত থেকে জানা যায় যে,হযরত আদম (আ.)-কেই প্রথম সৃষ্টি করা হয়। হযরত হাওয়া (আ.)-কে কিভাবে হযরত আদম (আ.) থেকে সৃষ্টি করা হলো তা বড় কথা নয়। কারণ যেভাবেই সৃষ্টি করা হোক না কেন কোরআন মাজীদের দৃষ্টিতে নারী ও পুরুষ হবার কারণে আল্লাহর নিকট দু’জন মানুষের মর্যাদার কোন পার্থক্য নেই,বরং পার্থক্যের ভিত্তি হচ্ছে ঈমান ও আমল।-অনুবাদক

৬. আল্লাহ্তায়ালার উপদেশ ভুলে গিয়ে অনুচিত কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে উভয়ের সমান ভূমিকার ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু এই অনুচিত কাজ করার মাধ্যমে হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়া (আ.) গুনাহ করেছিলেন কিনা এ বিষয়ে বিতর্ক আছে। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে আল্লাহর হুকুম অমান্য করা গুনাহর কাজ ছিল বটে,কিন্তু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়া (আ.) এর কাজ সম্পর্কে ভিন্ন উপসংহারে উপনীত হতে হয়। এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয়গুলো হচ্ছে : (১) ‘জুলম’ ‘তওবা’ ইত্যাদি পরিভাষাসমূহের একাধিক অর্থ আছে এবং শব্দগতভাবে যা আদেশ তার তাৎপর্য আইনগত আদেশ (যা লঙ্ঘন করলে শাস্তি প্রযোজ্য হয়) বা উপদেশ/পরামর্শ (যার লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়) উভয়ই হতে পারে। (২) নবী-রাসূলগণ কোন রূপ গুনাহর কাজ করতে পারেন না;আল্লাহ্তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁদেরকে পাপমুক্ত রাখা অপরিহার্য,অন্যথায় নবীর গুনাহর কারণে কারো মনে তাঁর নবী হওয়া সম্পর্কে অবিশ্বাস সৃষ্টি হলে সেজন্য তাকে দায়ী করা যাবে না। আর হযরত আদম (আ.) যেহেতু নবী ছিলেন তাই তাঁর পাপমুক্ততা অপরিহার্য। ৩. আলোচ্য আদেশ বা উপদেশ লঙ্ঘনের বিষয়টি ঐ সময়কার যখন দীন ও শরীয়ত নাযিল হয়নি। অতএব, এ ক্ষেত্রে গুনাহ বা পাপ কথাটি প্রযোজ্য হতে পারে না। বিষয়টি কোন শিশুকে ক্ষতিকর কাজ থেকে নিষেধ করার সাথে তুলনীয় যার কোন আইনগত গুরুত্ব নেই। শিশু নিষেধকৃত কাজটি সম্পাদন করলে সে প্রাকৃতিক ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার শিকার হবে ঠিকই,কিন্তু তাকে আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে না। তাই একে পাপ বা অপরাধ বলা যাবে না। অন্যদিকে হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়াকে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং ত্রুটি ক্ষমা করার পরেই পৃথিবীতে পাঠানো হয়,শাস্তি  স্বরূপ নয়। -অনুবাদক।

৭. অনুরূপভাবে অভিন্ন অপরাধের জন্য নারী-পুরুষ উভয়কে অভিন্ন শাস্তির উপযুক্ত গণ্য করা হয়েছে। যেমন এরশাদ হয়েছে :

وَعَدَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا هِيَ حَسْبُهُمْ وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُقِيمٌ

“আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং কাফেরদের জন্য জাহান্নামের আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন;তারা সেখানে চিরদিন পড়ে থাকবে। এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট,আর আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী শাস্তি।” (সূরা আত তাওবা : ৬৮)

৮.নৈতিক সুকৃতি ও কুকৃতি উভয় ক্ষেত্রেই নারী ও পুরুষের পুরস্কার ও শাস্তির অভিন্নতা প্রসঙ্গে সূরা আত তাওবার ৬৭-৭৩ নং আয়াতেও উল্লেখ রয়েছে।

৯.এ বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর হাদীসে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ইজ্জাত দারওয়াজা লিখিতالمرأة فی القرآن و السنّة  (বৈরুত : আল মাকতাবাহ্ আল আসরিয়াহ্,১৯৮০) গ্রন্থে (পৃ. ৪৪,৪৭ ও ৫১) বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য।

১০.মুহাম্মদ ফুআদ আবদুল বাকী লিখিত গ্রন্থ  اللؤلؤ و المرجان فی ما أنفقا الشیخان(বৈরুত : দারুল কুতুব আল জাদীদ,১৯৭০) এর প্রথম খণ্ডে (পৃ. ৩০-৩১) বিস্তারিত দ্রষ্টব্য।

১১.হাজী ফয়সল ইবনে হাজী উসমান লিখিত ‘Women and Nation Building: Systematic and Contemporary Analysis of the Problem of Women in Contemporary Malay Muslim Society’ (টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে পি. এইচ. ডি-এর জন্য পেশকৃত থিসিস),পৃ. ৮৫।

১২. মুহাম্মদ খায়রাত লিখিত مرکز المرء فی الإسلام (কায়রো : দারুল মা’আরিফ,১৯৭৫),পৃ. ১০৮।

১৩. Monard G. Paulser ‘Women, Legal Rights of,’ Encyclopedia Americana (Dabury, Conn: Americana corp. 1980), Vol. 29, pp. 108-109.

১৪. কোরআন মাজীদে এরশাদ হয়েছে :

للرجال نصیب ممااکتسبوا،و للنساء نصیب مما اکتسبن

“পুরুষরা যা অর্জন করেছে তা তাদের অংশ এবং নারীরা যা অর্জন করেছে তা তাদের অংশ।” (সূরা আন নিসা : ৩২)

১৫. এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন মুস্তাফা আস-সিবা’ঈ লিখিতالمرءة بین الفقه و القانون (আলেপ্পো: আল-মাকতাবা আল আরাবিয়্যাহ্,১৯৭৬),পৃ. ৩৮ এবং মুহাম্মদ ইজ্জাত দারওয়াজাহ্ লিখিত الدستور القرآنی فی شئون الخیرات (কায়রো : ‘ঈসা আল-আবিল হালাবী,পৃ. ৭৮)।

১৬. আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَرِثُوا النِّسَاءَ كَرْهًا وَلَا تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُوا بِبَعْضِ مَا آتَيْتُمُوهُنَّ إِلَّا أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا

“হে ঈমানদারগণ! এটা তোমাদের জন্য হালাল নয় যে,তোমরা জোরপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকার গ্রহণ করবে। আর তোমরা তাদেরকে যা দান করেছ তার অংশ বিশেষ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করো না যদি না তারা প্রকাশ্যে বেহায়াপনায় লিপ্ত হয়। আর তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন কর। আর তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ করে থাক তা হলে (জেনে রেখো) হয়তো তোমরা এমন কিছুকে অপছন্দ করছ আল্লাহ্তায়ালা যাতে অনেক কল্যাণ সৃষ্টি করে দেবেন।” (সূরা আন নিসা : ১৯)

এখানে মৃত স্বজনদের নারী উত্তরাধিকারীদেরকে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে তা শুধু পুরুষ উত্তরাধিকারীদের ভাগ করে নেয়াকে হারাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে-(লেখিকা) অবশ্য আয়াতের উক্ত অংশের অর্থ এ-ও হতে পারে যে,মৃত স্ত্রীর উত্তরাধিকার ফারায়েয মোতাবেক বণ্টন না করে স্বামী যেন একাই দখল করে না নেয়;নিলে তা হালাল হবে না। আর আয়াতে যেখানে দানকৃত জিনিস দুর্ব্যবহারের মাধ্যমে ফেরত নিতে নিষেধ করা হয়েছে অনেকে তাকে দেনমোহর বলে মনে করলেও আয়াতের ভাষা থেকে মনে হয়,এখানে দেনমোহর ব্যতীত অন্যান্য উপঢৌকন,শখের সামগ্রী ও অলংকারাদির কথা বলা হয়েছে। নচেৎ কোন আয়াত থেকেই দেনমোহর ফেরত নেয়ার ধারণার প্রতি সমর্থন মেলে না। কেবল স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক দানের ক্ষেত্রেই স্বামী দেনমোহর ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করতে পারে।-অনুবাদক

১৭. Unisex Society.

১৮. Dual Sex Society.

১৯. আমেরিকার নারী স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ক্যারোলিন বার্ড লিখেছেন যে,‘এ সব রীতিনীতি (অর্থাৎ বিবাহ,পরিবার,নারী-পুরুষ সম্পর্ক ইত্যাদি)-এর যথার্থতা প্রমাণ করতে গিয়ে সাধারণভাবে পুরুষ ও নারীর প্রকৃতিতে নিহিত যে পার্থক্যসমূহের কথা বলা হয় তাদের উচিত এ ধারণার বিলোপ সাধন করা।” (Women’s Liberation’, Encyclopedia Americana, vol. 29, p. 111a)

২০. বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। যেহেতু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী পাশ্চাত্য সমাজে ঐতিহ্যগতভাবে কখনই নারী ও পুরুষকে পরস্পর থেকে পৃথক হওয়া সত্ত্বেও মানুষ হিসেবে জন্ম সূত্রে সমমর্যাদা সম্পন্ন এবং মর্যাদার পার্থক্যের ভিত্তি শুধু অর্জন বলে মনে করা হতো না,বরং নারীকে জন্মসূত্রেই পুরুষের তুলনায় হীন,নীচ,ঘৃণ্য ও পাপের কারণ এবং মানব প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে একটি অপরিহার্য মন্দ সত্তা (Necessary Evil) মনে করা হতো,সেহেতু নারী-পুরুষের অধিকার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য তারা নারী-পুরুষের শারীরিক ও মানসিক প্রকৃতিগত পার্থক্যকে অস্বীকার করে নারীকে বাহ্যিকভাবে (পোশাক-পরিচ্ছদে) ও কাজে-কর্মে পুরুষের ভূমিকায় নামিয়েছে। কিন্তু এর ফলে নারী পুরুষের তুলনায় বহুগুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে অবাধ মেলামেশা,লিভ টুগেদার ইত্যাদির অমোঘ পরিণতি নারীকেই বহন করতে হচ্ছে। কারণ তাদের দাবির বিপরীতে নারী-পুরুষের শারীরিক-মানসিক পার্থক্য কোন গৌণ পার্থক্য নয়। অন্যদিকে ইসলাম নারী-পুরুষের এ পার্থক্যকে গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করে ও মানুষ হিসেবে উভয়কে জন্মগতভাবে সমমর্যাদা সম্পন্ন ও সমানাধিকারী গণ্য করেছে এবং নারীর জন্য দেনমোহর ও ভরণপোষণসহ বিশেষ অধিকার সংরক্ষণ করেছে।-অনুবাদক

(জ্যোতি বর্ষ ২ সংখ্যা ২)