সূরা আন নিসা;(৭ম পর্ব)

সূরা আন নিসা; আয়াত ২৪-২৫

সূরা নিসার ২৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন,

 
وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَاءِ إِلَّا مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ كِتَابَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَأُحِلَّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَلِكُمْ أَنْ تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُمْ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ فَمَا اسْتَمْتَعْتُمْ بِهِ مِنْهُنَّ فَآَتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا تَرَاضَيْتُمْ بِهِ مِنْ بَعْدِ الْفَرِيضَةِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا ((২৪
 


"নারীদের মধ্যে তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী তথা কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধে অধিকার করা বন্দিনী ছাড়া সকল সধবা নারী তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ। তোমাদের জন্য এটি আল্লাহর বিধান। উল্লেখিত নারীরা ছাড়া অন্য নারীদের অর্থ ও মোহরানার বিনিময়ে বিয়ে করা তোমাদের জন্য বৈধ। এসব বিয়ের উদ্দেশ্য পবিত্রতা ও সম্ভ্রম রক্ষা অবৈধ যৌন সম্পর্ক নয়। আর যে সব নারীকে তোমরা অস্থায়ীভাবে বিয়ের পর সম্ভোগ করেছ তাদেরকে নির্ধারিত মোহর দেয়া তোমাদের জন্য অবশ্য পালনীয় কতর্ব্য। মোহর নির্ধারনের পর কোন বিষয়ে পরস্পরে রাজী হলে তাতে তোমাদের কোন দোষ নেই। আল্লাহ সর্বজ্ঞ এবং প্রজ্ঞাময়।" (৪:২৪)

পূর্ববর্তী আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে আরো দুই ধরনের বিয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং আল্লাহ তা'লা এই দুই ধরনের বিয়েকে বৈধ করে মুমিনদেরকে আল্লাহর বিধান মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। যুদ্ধ মানব সমাজের একটি তিক্ত বাস্তবতা। যুদ্ধে জড়িত উভয় পক্ষের বহু পুরুষ প্রাণ হারায় বলে বহু নারী ও পরিবার অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, যুদ্ধ বিগ্রহের প্রাচীন প্রথায় যুদ্ধ-বন্দীদের রাখার জন্য কোন স্থান বা বিশেষ কারাগার ছিল না বলে পুরুষ যুদ্ধ-বন্দীদেরকে দাস এবং বন্দিনী নারীদেরকে দাসীতে পরিণত করা হত। ইসলাম এই প্রথাকে একতরফাভাবে নিষিদ্ধ না করলেও মুক্তিপণ প্রথার মত বিভিন্ন নিয়মের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বন্দী মুক্তির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ইসলাম নারী বন্দিনীদের বিয়ে করাকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ,তাঁরা এর ফলে স্ত্রী ও মায়ের মর্যাদা পাচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় সে সব নারী বন্দিনীদের ভবিষৎ নিয়ে যাদের স্বামী জীবিত রয়েছে। ইসলাম তাদের বন্দিদশাকে স্বামী থেকে বিচ্ছিন্নতা বা তালাকের মত বলে ধরে নিয়েছে এবং এ ক্ষেত্রেও তারা অন্তসত্ত্বা কিনা তা স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত পুণরায় তাদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়নি। বন্দিনী মহিলাদেরকে তাদের নিজেদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়া বা তাদের স্বাভাবিক চাহিদার প্রতি গুরুত্ব না দেয়ার চেয়ে ইসলামের এই বিধান বেশী যৌক্তিক ও উন্নত। অন্যদিকে বহু মুসলমান পুরুষও শহীদ হওয়ায় তাদের পরিবারবর্গ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। ইসলাম এই সমস্যা সমাধানের জন্য দুই ধরনের পদ্ধতি পেশ করেছে। একটি হলো, পুরুষদেরকে বহু স্ত্রী রাখার অনুমতি দেয়া। আর দ্বিতীয় বিধান হলো,স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করা এবং তাদের সাথে প্রথম স্ত্রীর মত আচরণ করা। পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত এ ধরনের পরিকল্পনার বিষয়ে আমরা আগেও আলোচনা করেছি।
এই আয়াতে আরো একটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর এটি হলো,অস্থায়ী বিয়ে। স্থায়ী বিয়ের মত এ বিয়ের চুক্তিকেও আল্লাহ বৈধ এবং শর্তযুক্ত করেছেন। অস্থায়ী বিয়ের সময়সীমা সীমিত বা নির্ধারিত হলেও তা নবায়নযোগ্য। তবে অনেক বুদ্ধিজীবী ও পাশ্চাত্য পন্থী ব্যক্তি ইসলামের এই রীতি তথা অস্থায়ী বিয়েকে উপহাস করে একে মহিলাদের প্রতি অসম্মান বলে মন্তব্য করেছেন। অথচ পাশ্চাত্যে নারী ও পুরুষের সম্পর্কে কোন লাগাম ও নিয়ন্ত্রণ নেই। পাশ্চাত্যে বহু পুরুষের সাথে একজন নারীর অবাধ ও গোপন সর্ম্পককে বৈধ মনে করা হয়। তাহলে কি নারী ও পুরুষের লাগামহীন সম্পর্ক এবং তাদের মধ্যে পাশবিক তাড়নার সম্পর্ক নারী অধিকারের লঙ্ঘন নয়? আর নারী ও পুরুষের সম্পর্ক যদি বিয়ের চুক্তির মত নীতিমালার আওতায় পবিত্র থাকে তা কেন নারীর প্রতি অসম্মান হবে ?
দুঃখজনকভাবে, আল্লাহর এই বিধানের ব্যাপারে ইসলামের প্রাথমিক যুগেই দৃষ্টিভঙ্গীগত মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল এবং অস্থায়ী বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে গোপন সম্পর্ক ও ব্যভিচারের পথ প্রশস্ত হয়। কারণ, অস্থায়ী বিয়ে নিষিদ্ধ করা হলেও মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা বন্ধ হয়ে যায়নি এবং অনেক মানুষ এই চাহিদা মেটানোর জন্য অবৈধ পস্থার আশ্রয় নেয়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : সামাজিক ও পারিবারিক বিষয়ে বাস্তববাদী হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিরুচি বা গোষ্ঠীগত দৃষ্টিভঙ্গীর অনুসরণ না করে আল্লাহর বিধানই মেনে নেয়া উচিত। কারণ, আল্লাহ মানুষের স্রষ্টা ও সর্বজ্ঞ হিসেবে তাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক চাহিদা সম্পর্কে বেশী অবগত।
দ্বিতীয়ত : বিয়ে স্থায়ী বা অস্থায়ী যাই হোক না কেন, তা নারী ও পুরুষের সম্ভ্রম এবং চারিত্র্যিক পবিত্রতা রক্ষার এক শক্তিশালী দূর্গ।
তৃতীয়ত : বিয়ের মোহরানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সন্তুষ্টিই এর বৈধতার মূল শর্ত। শুধু পাত্র পক্ষই মোহরানা নির্ধারনের অধিকারী নয়।

সূরা নিসার ২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-


وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ مِنْكُمْ طَوْلًا أَنْ يَنْكِحَ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ فَمِنْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ مِنْ فَتَيَاتِكُمُ الْمُؤْمِنَاتِ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِإِيمَانِكُمْ بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ فَانْكِحُوهُنَّ بِإِذْنِ أَهْلِهِنَّ وَآَتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ مُحْصَنَاتٍ غَيْرَ مُسَافِحَاتٍ وَلَا مُتَّخِذَاتِ أَخْدَانٍ فَإِذَا أُحْصِنَّ فَإِنْ أَتَيْنَ بِفَاحِشَةٍ فَعَلَيْهِنَّ نِصْفُ مَا عَلَى الْمُحْصَنَاتِ مِنَ الْعَذَابِ ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ الْعَنَتَ مِنْكُمْ وَأَنْ تَصْبِرُوا خَيْرٌ لَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ((২৫

"তোমাদের মধ্যে যারা স্বাধীন ও ঈমানদার নারী বিয়ে করার মত আর্থিক সঙ্গতি রাখে না, তারা নিজেদের অধিকারভুক্ত ঈমানদার ক্রীতদাসীদের বিয়ে করবে। আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্পর্কে বেশী জানেন। তোমরা একে অপরের সমান। সুতরাং তাদেরকে বিয়ে করবে তাদের মালিকের অনুমতি নিয়ে। তারা ব্যভিচারী অথবা উপপতি গ্রহণকারিণী না হয়ে সতী-সাধ্বী হয়ে থাকলে তাদের মোহরানা ন্যায় সঙ্গতভাবে দেবে। বিয়ের পর তারা যদি ব্যভিচার করে, তবে তাদের শাস্তি স্বাধীন নারীর অর্ধেক । এ ধরনের বিয়ে তাদের জন্যেই, যারা স্ত্রী না থাকার কারণে পাপে লিপ্ত হতে পারে বলে ভয় করে। কিন্তু ধৈর্য ধরা ও স্বাধীন নারীদের বিয়ে করাই তোমাদের জন্য উত্তম। আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং দয়ালু।" (৪:২৫)

আগের আয়াতে দাসী ও যুদ্ধ বন্দিনী নারীদের বিয়ে করাকে বৈধ বলে উল্লেখের পর এ আয়াতে মোহরানার অর্থ পরিশোধে অক্ষম মুসলিম পুরুষদেরকে যুদ্ধ বন্দিনী নারীদের বিয়ে করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এই উভয় শ্রেণীর নারী ও পুরুষ যাতে অনৈতিক পন্থায় জৈবিক চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকে, সে জন্যেই আল্লাহ এ নির্দেশ দিচ্ছেন। উপরন্তু এ ব্যবস্থার ফলে বন্দিনীরা স্বামীহীন অবস্থায় থাকবে না। একটি লক্ষণীয় দিক হলো,ইসলাম যে কোন নারী ও পুরুষের বিয়ের জন্য ঈমানদার হওয়াকে মূল শর্ত বলে উল্লেখ করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, যদি কোন ঈমানদার যুবক ও ঈমানদার যুবতি সম্পূর্ণ অপরিচিতও হয় এবং সামাজিক ক্ষেত্রে তারা একই শ্রেণীর নাও হয়ে থাকে তবুও তারা দাস্পত্য জীবনে সুখী হতে পারে। কিন্তু তাদের যদি ঈমানই না থাকে,তাহলে তারা যত সুন্দর বা সুন্দরী এবং অর্থ সম্পদ ও উচ্চ পদের অধিকারী হোক না কেন তাদের সুখ বা সুন্দর জীবনে স্বপ্নই থেকে যাবে। কারণ,সময়ের পরিক্রমায় এসব বাহ্যিক দিকগুলো বিলীন হয়ে যায়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমতঃ প্রয়োজনে দাসীকে বিয়ে করার বিষয়টি মেনে নেয়া উচিত। কিন্তু পাপের কলঙ্কে লিপ্ত হওয়া কখনও উচিত নয়।
দ্বিতীয়তঃ যারা বিয়ের খরচ বহন করতে অক্ষম,ইসলামে তাদের জন্যেও অচলাবস্থার কোন অবকাশ নেই।
তৃতীয়তঃ বিয়ের মূল ভিত্তি ও এর স্থায়ীত্বের শর্ত হলো, চারিত্রিক পবিত্রতা বজায় রাখা এবং অবৈধ সম্পর্ক থেকে দূরে থাকা।
চতুর্থতঃ অসৎ চরিত্রের লোকেরা সমাজেও অসৎ কাজের বিস্তার ঘটায়। এইসব লোকদেরকে আল্লাহ পরকালে কঠোর শাস্তি দিবেন। এ ধরনের অসৎ লোকদের এ পৃথিবীতেও শাস্তি দেয়া উচিত, যাতে তাদের দেখে অন্যরাও শিক্ষা পেতে পারে।