মুসলিম নারী অধিকার : প্যারিসের ইসলাম বিদ্বেষী নীতির শিকার

পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক মহল গত কয়েক শতক ধরে ধর্মকে কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু গত শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়া পশ্চিমা নাগরিকদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের হার খুব দ্রুত গতিতে বাড়ছে। এ অবস্থায় গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষার দাবিদার পশ্চিমা সরকারগুলো ইসলাম সম্পর্কে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি নানা ঠুনকো অজুহাতে পাশ্চাত্যের মুসলমান নাগরিকদের প্রাথমিক অধিকারগুলোও লংঘন করছে। এক্ষেত্রে পশ্চিমা সরকারগুলোর মধ্যে ফরাসি সরকার সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা বা বেশি সংকীর্ণতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। প্যারিস নারী অধিকারের সমর্থক হবার দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও দেশটিতে মুসলিম নারী সমাজ ফরাসি সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির শিকার হয়েছে।  গত ১১ই এপিল ফ্রান্সে বোরকা নিষিদ্ধ করার আইন কার্যকর করা হয়। এ আইন অনুযায়ী ফরাসি পুলিশ ঘরের বাইরে আসা ঘোমটা বা নেকাব পরা মুসলিম মহিলাদের ১৫০ ইউরো জরিমানা করতে পারবে। এ ছাড়াও এ আইন অনুযায়ী যেসব পুরুষ তাদের স্ত্রী বা বোনকে পর্দা বা ইসলামি শালীন পোশাক পরতে বাধ্য করবে তাদেরকে এক বছরের কারাদণ্ড ও ত্রিশ হাজার ইউরো জরিমানা করা হবে। এর আগে ফরাসি সংসদ ২০০৪ সালে শিক্ষাঙ্গনে পর্দানশীন মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে। প্যারিস ১৯৮৩ সালে নারীর প্রতি বৈষম্য বিরোধী কনভেনশনে যোগ দেয়। ওই কনভেনশনের ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, হিজাব বা ইসলামি পোশাক পরার কারণে কোনো মেয়ে বা নারীকে শিক্ষার সূযোগ এবং যে কোনো ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়া থেকে বিরত রাখা যাবে না। অথচ ফ্রান্সের হিজাবধারী বা ইসলামি শালীন পোশাকধারী মহিলারা এখন কঠোর সীমাবদ্ধতার শিকার হয়েছেন। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সেই মুসলমানদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই দেশটির মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ।
ফরাসি সরকার সেদেশের নেকাবধারী মুসলিম মহিলাদের ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করায় এর নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা এআই। এ সংস্থার বেশ কয়েকজন সদস্য সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ঘোমটা বা নেকাবের ওপর নিষেধাজ্ঞাকে মুসলিম মহিলাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার লংঘন বলে মন্তব্য করেছেন। এআই'' র সদস্য জন ডালহৌসিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রত্যেক মানুষ তার পোশাকের ধরণ বাছাইয়ের ব্যাপারে স্বাধীন, এটা বাক স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার একটি সার্বজনীন সূত্র। তাই সমাজের অন্য কেউ বা অধিকাংশ মানুষও যদি ওই পোশাককে উপযুক্ত কিংবা পছন্দনীয় পোশাক বলে নাও মনে করেন, তবুও তারা ওই পোশাক পরার অধিকার সীমাবদ্ধ করার ক্ষমতা রাখেন না।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো মুখ ঢেকে রাখা পোশাক বা বোরকা পরার ওপর ফরাসি সরকারের নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং এ ধরনের অন্য পদক্ষেপগুলো মানবাধিকার সংক্রান্ত ইউরোপীয় কনভেনশনেরও লংঘন। কারণ এ কনভেনশনে মানুষের প্রাথমিক স্বাধীনতাগুলো নিশ্চিত করার যে কথা বলা হয়েছে এইসব নিষেধাজ্ঞা তার পরিপন্থী।
হিজাব বা পর্দা করা মুসলিম মহিলাদের ধর্মীয় কর্তব্য। অথচ ফরাসি সরকার এই ধর্মীয় আইনকে অবজ্ঞা করছে এবং এ বিষয়টিকে কেবল রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখছে। মুসলিম নারীর হিজাব সম্পর্কে পশ্চিমা রাজনীতিবিদদের সংকীর্ণ ও ভুল দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে " ভিইল" বা "ঘোমটা" শীর্ষক ইংরেজি বইয়ে। এ বইয়ের একাংশে সাবেক মার্কিন উপপরাষ্ট্রমন্ত্রী কারেন হিউজের সাথে মুসলিম মহিলাদের কিছু সংলাপ তুলে ধরা হয়েছে। এই মহিলারা হিউজকে খুব স্পষ্ট ভাষায় এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, হিজাব তাদের সম্মান ও কর্মক্ষমতা কমায় না এবং পাশ্চাত্যের জানা উচিত বিশ্বব্যাপী নারী অধিকারের সবচেয়ে বড় শত্রু ধর্ম বা ধর্মীয় প্রতীক কিংবা চিহ্নগুলো নয়, বরং যুদ্ধ, দারিদ্র, শিক্ষার অভাব ও নব্য উপনিবেশবাদই নারী অধিকারের সবচেয়ে বড় শত্রু।
পোশাক মানুষের সংস্কৃতি ও বিশ্বাব বা চিন্তাধারাকে তুলে ধরে। মুসলিম নারীর হিজাব বা পর্দার অর্থ হল তারা সমাজে নিজ শরীর ঢেকে রাখতে চান। নারীকে যেন মানুষ হিসেবে দেখা হয়, সেজন্যই ইসলাম নারীর পর্দার ওপর জোর দিয়েছে। হিজাব নারীকে অসুস্থ মনের পুরুষদের অশালীন দৃষ্টি ও আশোভনীয় আচরণ থেকে রক্ষা করে এবং এভাবে সমাজ সুস্থ থাকে ও নারী নির্বিঘ্নে সামাজিক তৎপরতায় অংশ নিতে পারে। কিন্তু পাশ্চাত্য নারীর স্বাধীনতার নামে সমাজে সৃষ্টি করেছে লাগামহীনতা ও যৌন অনাচার। পাশ্চাত্যের কথিত এই নারী স্বাধীনতায় নারীকে কেবল ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ অবস্থায় ইসলামের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ঠেকানোর জন্য পাশ্চাত্য হিজাবকে টার্গেট করেছে এবং নারীকে অশালীন জীবনের পংকিলতায় ডুবিয়ে ইসলামের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব হবে বলে আশা করছে। অষ্টাদশ শতকের কুখ্যাত বৃটিশ গোয়েন্দা হামফ্রে মুসলিম বিশ্বে নারীকে বেপর্দা করার  পশ্চিমা পদক্ষেপের অশুভ উদ্দেশ্য তুলে ধরে বলেছেন, "মুসলিম মহিলারা খুবই পর্দানশীন হওয়ায় তাদের মধ্যে অশালীনতা বা ব্যাভিচারের ধারা চালু করা অসম্ভব। এ অবস্থায় মুসলিম মহিলাদেরকে ধোঁকা দিয়ে তাদেরকে পর্দা বা বোরকার আচ্ছাদন থেকে বের করে আনতে হবে।"
মহান আল্লাহ সুরা নুরের ৩১ নম্বর এবং সুরা আহজাবের ৫৯ নম্বর আয়াতে নারীকে নিজ সম্ভ্রম রক্ষা করতে ও যাদের সামনে খোলামেলা হওয়া বৈধ নয় তাদের সামনে পর্দা করার বা শরীর ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে তারা অসৎ লোকদের অশালীন দৃষ্টি বা উৎপীড়নের শিকার না হয়। বর্তমান বিশ্বে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, হিজাব নারীকে নিরাপত্তা দেয়, তাদেরকে দেয় সম্মান এবং আত্মবিশ্বাস। আধুনিক যুগের মুসলিম মহিলারা নিজেদের মানবিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন। ফলে ফ্রান্সসহ ও পাশ্চাত্যের অনেক দেশে হিজাব বা পর্দার ওপর নানা সীমাবদ্ধতা আরোপ সত্ত্বেও পশ্চিমা নারী সমাজের মধ্য ইসলামের প্রতি ও ইসলামি শালীন পোশাকের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। মার্কিন লেখিকা উইন্ডি শিলিট বলেছেন, "পাশ্চাত্যের লাগামহীন বা বলগাহীন জীবন-যাপন পদ্ধতি মাত্রাতিরিক্তি উস্কানীমূলক এবং এর ফলে ধ্বসে পড়ছে পরিবার-ব্যবস্থা ও দেখা দিয়েছে আদর্শিক অচলাবস্থা। বর্তমান প্রজন্মের মানুষ এই লাগামহীন স্বাধীনতায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে এবং তারা স্বাভাবিক মানবীয় প্রকৃতির মাধুর্যের স্বাদ পুণরায় পেতে চায়।"
ফরাসি সরকার নেক্বাব বা ঘোমটার জন্য পুরুষদের জরিমানার পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে এটা দেখাতে চায় যে, মুসলিম মহিলারা স্বেচ্ছায় হিজাব করেন না বরং তাদের স্বামী বা অভিভাবকরা জোর করে তাদের ওপর হিজাব চাপিয়ে দিয়েছেন। অথচ বাস্তবতা হল, হিজাবের নানা সুফলের কারণে মুসলিম মহিলারা স্বেচ্ছায় তা বেছে নিয়েছেন। এটা স্পষ্ট ফরাসি সরকার মুসলিম মহিলাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে শুধু ফরাসি মুসলিম সমাজের নয়, বিশ্বের প্রায় দেড়শ' কোটি মুসলমানকেই ক্ষুব্ধ করেছে।(রেডিও তেহরান)