ইতিহাস ও মানবিক ক্রমবিকাশ

শহীদ আয়াতুল্লাহ্ মোর্তাজা মোতাহ্হারী

অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ইতিহাসে ক্রমবিকাশধারা,বা অন্য কথায়,মানুষের সামাজিক ক্রমবিকাশ ও অগ্রগতি।

বিজ্ঞানমনস্ক লোকেরা দুই ধরনের ক্রমবিকাশের ধারণা পোষণ করেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে জৈবিক ক্রমবিকাশ- যে সম্পর্কে আপনারা জীব বিজ্ঞানে পড়ে থাকতে পারেন এবং জেনে থাকবেন যে,মানুষকে সবচেয়ে উন্নত প্রাণী এবং প্রাণীজগতের ক্রমবিকাশধারার সর্বশেষ সংস্করণ হিসাবে গণ্য করা হয়।

জৈবিক ক্রমবিকাশের তাৎপর্য অত্যন্ত স্পষ্ট। এটা হচ্ছে এমন একটি ক্রমবিকাশ মানুষের কোনরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়াই এবং তাকে জিজ্ঞাসা না করেই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া নিজেই যা সম্পাদন করেছে। এ ব্যাপারে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কারণ,একটি প্রাকৃতিক ও অনিবার্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিটি প্রাণীই ক্রমবিকাশের একটি স্তরে উপনীত হয়েছে। সেই একই প্রক্রিয়া মানুষকে এমন একটি স্তরে নিয়ে এসেছে যে কারণে আমরা তাকে ‘মানবিক সত্তাবিশিষ্ট প্রাণী’ বা ‘মানুষ’ বলে অভিহিত করে থাকি এবং তাকে অন্যান্য প্রজাতি থেকে স্বতন্ত্র ধরনের ও একটি বিশিষ্ট প্রকারের প্রজাতি হিসাবে গণ্য করি।

কিন্তু ঐতিহাসিক ও সামাজিক ক্রমবিকাশ মানে একটি নতুন ধরনের ক্রমবিকাশ প্রক্রিয়া। প্রকৃতি মানুষের জৈবিক ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করে থাকে তার ঐতিহাসিক ও সামাজিক ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে প্রকৃতি সে ভূমিকা পালন করে না। এ ক্রমবিকাশ হচ্ছে একটি অর্জিত ক্রমবিকাশ অর্থাৎ এমন একটি ক্রমবিকাশ স্বয়ং মানুষ তার নিজের চেষ্টা-সাধনার দ্বারা যা অর্জন করেছে এবং যুগে যুগে শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যা পরবর্তী প্রজন্মসমূহের মধ্যে স্থানান্তরিত করেছে,সহজাত উত্তরাধিকার হিসাবে নয়।

মানুষের জৈবিক ক্রমবিকাশ ঘটেছে মানুষের নিজের ইচ্ছা,উদ্যোগ ও চেষ্টাসাধনা ছাড়াই এবং সহজাত উত্তরাধিকার-বিধির আওতায় তা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু মানুষের নিজের চেষ্টাসাধনার বদৌলতে অর্জিত সামাজিক ও ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশ সহজাত উত্তরাধিকার বিধির আওতায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হয়নি। এমনকি এ ধরনের একটি ঘটনা সংঘটিত হবারও সম্ভাবনা নেই; বরং এটা শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতি,বিশেষ করে লিখনরূপ শিল্পের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। আমরা দেখতে পাই যে,কুরআন মজীদে আল্লাহ্ তা‘আলা কলমের এবং লেখার হাতিয়ারের শপথ করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা রাসূলে আকরাম (সা.)-কে সম্বোধন করে বলেন :

إِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ إِقْرَأْ وَ رَبُّكَ الْأَكْرَامُ الّذِيْ عَلَّمَ بَالْقَلَمِ عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

‘(হে রাসূল!) আপনি পড়ুন আপনার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন,সৃষ্টি করেছেন মানুষকে (মাতৃগর্ভে) আটকে থাকা বস্তু থেকে। আপনি পড়ুন,আর আপনার রব পরম মহিমাময় যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন; তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন তা যা সে জানত না।’

এ আয়াতসমূহ থেকে সুস্পষ্ট যে,আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে কলম ব্যবহারের কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি মানুষকে তার ঐতিহাসিক ও সামাজিক ক্রমবিকাশ-ধারায় অগ্রগতি সাধনের ক্ষমতা দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে,মানব সমাজ তার সূচনাকাল থেকে অর্থাৎ সর্বপ্রথম যখন সভ্যতার উৎপত্তি হয় তখন থেকে অব্যাহতভাবে অগ্রগতি লাভ করেছে ও বিকশিত হয়েছে। আমরা জানি যে,জৈবিক ক্রমবিকাশের ন্যায় সামাজিক ক্রমবিকাশও একটি ক্রমায়াত প্রক্রিয়া। তবে এ ক্ষেত্রে একটি পার্থক্য রয়েছে,তা হচ্ছে,কালের প্রবাহের সাথে সাথে তার ক্রমবিকাশের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য কথায়,তার ক্রমবিকাশ একটি ক্রমদ্রুতি প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। এটা কেবল এগিয়েই চলেছে এবং মোটেই যাত্রাবিরতি করছে না,আর তার গতিও একটি সুনির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। ধরুন,একটি গাড়ি নির্দিষ্ট একশ’ কিলোমিটার গতিতে পথ চলতে পারে,কিন্তু ক্রমদ্রুতি প্রক্রিয়া মানে হচ্ছে এর গতির ক্রমবৃদ্ধি- যে ক্ষেত্রে প্রতি মিনিটেই তার গতি পূর্ববর্তী মিনিটের চেয়ে বৃদ্ধি পায়।

যদিও ক্রমবিকাশ ও অগ্রগতিকে একটি অনিবার্য বিষয় বলে মনে হয়,তথাপি আপনারা জেনে বিস্মিত হবেন যে,এমন জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ আছেন যাঁরা যা কিছু ঘটেছে তাকে অগ্রগতি বা ক্রমবিকাশ বলা উচিত কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছেন। এ ব্যাপার আদৌ সন্দেহ করার কোন অবকাশ আছে কিনা ভেবে কেউ কেউ বিস্মিত হতে পারেন। তবে যে সব জ্ঞানী ব্যক্তি এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেছেন তাঁদের সে সন্দেহের পিছনে কারণ ও যুক্তি আছে; এ সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনা করছি।

এখানে আমরা কেবল এতটুকু বলাই যথেষ্ট মনে করছি যে,যদিও আমরা তাঁদের সন্দেহকে যথার্থ বলে মনে করি না এবং আমরা মনে করি যে,মানব সমাজ অব্যাহতভাবে তার সর্বাত্মক ক্রমবিকাশের দিকে এগিয়ে চলেছে এবং তার চূড়ান্ত লক্ষ্য অভিমুখে তার অভিযাত্রা অব্যাহত রয়েছে,তবে সে সাথে আমরা তাঁদের সন্দেহকে একেবারে অমূলক মনে করি না। এতদসত্ত্বেও আমরা ক্রমবিকাশের তাৎপর্যকে পুরাপুরি অনুধাবন করার উদ্দেশ্যে তাঁদের এ সন্দেহের কারণগুলো ব্যাখ্যা করব।

ক্রমবিকাশ কী?

আমাদের জন্য প্রথমে ‘ক্রমবিকাশ’কে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। বস্তুত কতক বিষয় প্রথমেই এমন সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে,সেগুলোর কোন সংজ্ঞা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু কেউ যখন সেগুলোকে সংজ্ঞায়িত করতে চায় তখন দেখতে পায় যে,বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন এবং এ ক্ষেত্রে সে বহু সমস্যার সম্মুখীন। ক্রমবিকাশ সম্পর্কে দার্শনিকগণ যে সব সংজ্ঞা দিয়েছেন আমি তার সবগুলো এখানে উদ্ধৃত করতে চাই না।

ইসলামী দর্শনে একটি চমৎকার আলোচ্য বিষয় আছে যে সম্পর্কে কুরআন মজীদের দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তি উপস্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিষয়টি হচ্ছে ‘সম্পূর্ণ’ ও পূর্ণ’-এর মধ্যকার পার্থক্য। আমরা ‘সম্পূর্ণ’ শব্দটিকে ‘অসম্পূর্ণ’-এর বিপরীতে ব্যবহার করে থাকি,আবার ‘পূর্ণ’ শব্দটিকেও ‘অসম্পূর্ণ’-এর বিপরীতে ব্যবহার করে থাকি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,‘সম্পূর্ণ’ মানে কি ‘পূর্ণ’? কুরআন মজীদের একটি আয়াতে এ দু’টি পরিভাষা পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়েছে যা ইমামত ও বেলায়াতের প্রশ্নের সাথে সংশ্লিষ্ট। এ আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :

اَلْيَوْمَ أَکْمَلْتُ لَکُمْ دِيْنَکُمْ وَ أَتْمَمْتُ عَلَيْکُمْ نِعْمَتِيْ وَ رَضِيْتُ لَکُمُ الْإِسْلَامَ دِيْنًا

‘(হে ঈমানদারগণ!) আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করে দিলাম,আর তোমাদের ওপর আমার নে‘আমতকে সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসাবে ইসলামকে মনোনীত করে দিলাম।’

এ আয়াতে দেখা যাচ্ছে,কুরআন মজীদ ‘পূর্ণতা’ (ইকমাল) ও ‘সম্পূর্ণতা’ (ইতমাম)-কে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছে। নে‘আমতকে একটি ‘অসম্পূর্ণ’ অবস্থা থেকে ‘সম্পূর্ণ’ করে দেওয়া হয়েছে এবং দীনকে একটি ‘অসম্পূর্ণ’ অবস্থা থেকে ‘পূর্ণ’ করে দেওয়া হয়েছে। তবে এ দু’টি পরিভাষার তাৎপর্যের মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে আলোচনার আগে আমি ‘ক্রমবিকাশ’ ও ‘অগ্রগতি’র মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই; এরপর পুনরায় ‘সম্পূর্ণ’ ও ‘পূর্ণ’-এর মধ্যকার পার্থক্য সংক্রান্ত আলোচনায় ফিরে আসব।

প্রশ্ন হচ্ছে,‘ক্রমবিকাশ’ ও ‘অগ্রগতি’ কি অভিন্ন? দু’টি পরিভাষার তাৎপর্যের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে যা উভয়ের ব্যবহার থেকেই আপনাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়তে বাধ্য।

আমরা অনেক সময় কোন অসুস্থতা সম্পর্কে কথা বলি যাতে অগ্রগতি হচ্ছে,কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমরা বলি না যে,বিকাশ হচ্ছে। কোন সেনাবাহিনী যদি কোন ভূখণ্ডের জন্য যুদ্ধ করে এবং সে যুদ্ধে ঐ ভূখণ্ডের অংশবিশেষ দখল করতে সক্ষম হয় তাহলে আমরা বলি যে,সেনাবাহিনী অগ্রসর হচ্ছে বা যুদ্ধে তাদের অগ্রগতি হচ্ছে,কিন্তু আমরা বলি না যে,সেনাবাহিনী বিকাশ লাভ করছে। এর কারণ কী? কারণ,‘বিকাশ’ বা ‘ক্রমবিকাশ’-এর মধ্যে একটি উচ্চতর বা মহিমান্বিত অবস্থার ভাবধারা নিহিত রয়েছে। কারণ,‘বিকাশ’ বা ‘ক্রমবিকাশ’ হচ্ছে গুণগত দিক থেকে ঊর্ধ্বমুখী অগ্রযাত্রা-গুণগত নিম্নস্তর থেকে উচ্চতর স্তরের দিকে অগ্রগমন। কিন্তু অগ্রগতি বা অগ্রসরতা সব সময়ই আনুভূমিক স্তরে হয়ে থাকে।

একটি সেনাবাহিনী যখন কোন ভূখণ্ড দখল করে নেয় এবং আগে থেকেই যে ভূখণ্ড তার নিয়ন্ত্রণে ছিল তার সাথে এ ভূখণ্ডটি যোগ করে নেয় তখন আমরা বলি যে,সেনাবাহিনীটি অগ্রগমন করেছে বা এগিয়ে গেছে। এর মানে হচ্ছে,সেনাবাহিনীটি সামনের দিকে গতিশীল হয়েছে,তবে সে আগে যে সমতলে ছিল সে সমতলেই। এ ক্ষেত্রে কেন আমরা বলি না যে,সেনাবাহিনীটি বিকাশলাভ করেছে? কারণ,‘ক্রমবিকাশ’-এর ধারণার মধ্যে এক ধরনের মহিমান্বিত অবস্থার তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। সুতরাং আমরা যখন সামাজিক ক্রমবিকাশের কথা বলি তখন তা থেকে মানুষের মহিমান্বিত অবস্থার কথা বুঝিয়ে থাকি,কেবল তার অগ্রগতি ও অগ্রসরতা নয়।

মানব সমাজের গুণগত বিকাশ ও মহিমান্বিত অবস্থা ছাড়াও অনেক কিছুকে মানুষ ও সমাজের অগ্রগতি হিসাবে গণ্য করা চলে। আমরা এ উদ্দেশ্যে এ বিষয়টি উল্লেখ করলাম যে,কিছু সংখ্যক মনীষী যে এ ধরনের অগ্রগতিকে বিকাশ বলা উচিত কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন,তাঁদের সে সন্দেহ একেবারে অমূলক নয়। যদিও আমরা এ ব্যাপারে তাঁদের সাথে একমত নই তথাপি তাঁরা যা বলেছেন তা

অন্তঃসারশূন্য কথা নয়। অতএব,এটা অনস্বীকার্য যে,ক্রমবিকাশ এবং ‘অগ্রগতি ও উন্নয়ন’-এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। (অগ্রগতি ও উন্নতির তাৎপর্য প্রায় অভিন্ন।)

এ একই পন্থায় ‘পূর্ণ’ ও ‘সম্পূর্ণ’র মধ্যকার পার্থক্য অনুধাবন করা যেতে পারে। কোন কিছু যখন কয়েকটি অংশের সমন্বয়ে গঠিত হয়,যেমন একটি ভবন বা একটি গাড়ি,তাতে যতক্ষণ তার সকল অংশ না থাকে ততক্ষণ আমরা তাকে অসম্পূর্ণ বলি। আর যখন তাতে তার সর্বশেষ প্রয়োজনীয় অংশটি যুক্ত করা হয় তখন আমরা সেটিকে ‘সম্পূর্ণ’ বলি। কোন শিশু যখন তার কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তখন আমরা তাকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বা ‘অসম্পূর্ণ’ বলি,কিন্তু শিশুটি যদি তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সহকারেও জন্মগ্রহণ করে তথাপি তাকে আমরা ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘অসম্পূর্ণ’ বলতে পারি। কারণ,তাকে অনেক কিছু শিখতে হবে এবং  শেখার ও শিক্ষাগ্রহণের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে যেতে হবে-যা তার জন্য এক ধরনের মহিমান্বিত অবস্থা নিয়ে আসবে এবং তা তার জন্য বিকাশের বিভিন্ন স্তর হিসাবে পরিগণিত হয়ে থাকে।

আমরা জৈবিক ও সামাজিক ক্রমবিকাশ বা বিকাশের সংজ্ঞা সংক্রান্ত আলোচনা এখানেই শেষ করছি। এরপর এ প্রসঙ্গে অপর কতকগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। এ ব্যাপারে আমরা যে তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বেছে নিয়েছি তা হচ্ছে :

১. মানবজাতি তার গোটা ইতিহাসে,তার সামাজিক জীবনে বিকাশের ও মহিমান্বিত অবস্থার অধিকারী হয়েছে কি?

২. মানবসমাজ কি এখনও বিকাশের প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং ভবিষ্যতে পরিপূর্ণ বিকাশের অধিকারী হবে কি?

৩. মানবসমাজ যদি বিকাশের প্রক্রিয়াধীনে থেকে থাকে তাহলে আদর্শ সমাজ-প্লেটো যাকে কাল্পনিক আদর্শ মানুষের সমাজ বলেছেন-কোনটি? এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য সমূহ কী কী?

আমরা মানবজাতির ইতিহাসকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বুঝতে পারি,কিন্তু ভবিষ্যতের বিষয়টি কীরূপ? আমরা কি ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে চোখ বন্ধ করে রাখব এবং বলব যে,ইতিহাস অনিবার্যভাবেই এক বিকাশপথে অগ্রসর হবে? প্রকৃতিতে বিকাশ কি সময়ের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া বিষয়? সময়ের জাহাযটি কি মানুষের সামান্যতম হস্তক্ষেপ ছাড়াই এবং তার কোন রকম দায়দায়িত্ব ও করণীয় ছাড়াই ক্রবিকাশের অলঙ্ঘনীয় পথে এগিয়ে চলেছে? মুক্ত ইচ্ছা,নির্বাচনের স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীলতার অধিকারী প্রাণশীল অস্তিত্ব হিসাবে মানুষ কি অতীতে কোন ভূমিকাই পালন করেনি? অতীতে মানুষ যে ভূমিকা পালন করেছে তা কি গৌণ ভূমিকা ছিল এবং সে কি অলঙ্ঘনীয়ভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া ভূমিকা পালন করেছে,নাকি অতীতে কেউ তার জন্য অলঙ্ঘনীয়ভাবে কোন ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয়নি?

বস্তুত মানুষ নিজেরাই তাদের মুক্ত ইচ্ছা,নির্বাচন এবং স্বীয় উদ্যোগ ও সমাজ পরিকল্পনার দ্বারা তাদের সমাজের জন্য ক্রমবিকাশর পথ নির্ধারণ করেছে এবং তাকে এগিয়ে নিয়েছে। অতীতে মানুষের যে মুক্ত ইচ্ছা ও স্বাধীনতা ছিল এ সত্যটি ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অতএব,একদল মানুষ অবশ্যই প্রশংসা ও ভালবাসা পাবার উপযুক্ত। তাঁরা হচ্ছেন সে সব লোক যাঁদের পক্ষে ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার পথ বেছে নেওয়া বা সে ক্রমবিকাশকে স্বীয় সমর্থন ও সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা এবং স্বীয় ব্যক্তিগত উন্নতি-অগ্রগতি ও কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করার স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা মুক্তভাবে ও স্বীয় স্বাধীনতার দ্বারা সামাজিক ক্রমবিকাশের পথ অনুসরণকে বেছে নিয়েছিলেন এবং এজন্য নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। একইভাবে অপর একদল লোককে নিন্দা করা ও ধিক্কার দেওয়া,বরং অভিশাপ দেওয়া প্রয়োজন যারা এ সামাজিক ক্রমবিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল।

আমরা যদি ভবিষ্যতকে চিনতে না পারি এবং এর জন্য আমাদের কোন পরিকল্পনা না থাকে,আমরা যদি ইতিহাস বিনির্মাণের দিকে মনোযোগ না দেই তাহলে আমরাও ভবিষ্যৎ প্রজন্মসমূহের কাছ থেকে নিন্দা ও ধিক্কার লাভের উপযুক্ত। বস্তুত ইতিহাস মানুষেরই তৈরি,মানুষ ইতিহাসের তৈরি নয়। আমাদের যদি ভবিষ্যতের জন্য কোন পরিকল্পনা না থাকে এবং আমরা যদি ইতিহাসের ভবিষ্যতের জন্য আমাদের দায়িত্ব অনুভব না করি তাহলে কেউই এ প্রতিশ্রুতি দিতে পারবে না যে,এ জাহায স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাবে। নিদেন পক্ষে বলা যেতে পারে যে,এ জাহাযটি হয় এগিয়ে যাবে নয়ত পিছন দিকে পিছিয়ে আসবে। এভাবে ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এগিয়ে যাওয়া বা পিছিয়ে আসার সক্ষমতা এ ধারণারই সত্যতা প্রমাণ করে যে,ঘটনাবলিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামনে এগিয়ে নেয় এমন কোন অন্ধ জবরদস্তি শক্তির অস্তিত্ব নেই। এটা এমন একটি বিষয় যাকে ইসলামে,বিশেষ করে শিয়া মাযহাবের চৈন্তিক অঙ্গনে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের অন্যতম সমুন্নত শিক্ষা হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। (এ ব্যাপারে আমি আমার ‘মানুষ ও নিয়তি’ পুস্তকে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।)

বাদা বা পুনর্বিবেচনা প্রসঙ্গ

ইসলামের অন্যতম আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বাদা’ (পূর্ব বিষয় রহিত করে নতুন বিষয় চালু করা)। বাদা’-র একটি বাহ্যিক তাৎপর্য রয়েছে যাকে খুব কম লোকের পক্ষেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা সম্ভব। এমনকি শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা বাদা’-য় বিশ্বাস করে বলে অনেকে শিয়াদের সমালোচনা করেছেন।

বাদা’ কথাটির তাৎপর্য হচ্ছে খোদায়ী ফয়সালায় (ক্বাযা’) পরিবর্তন সংঘটিত হওয়া। এর অর্থ দাঁড়ায়,আল্লাহ্ তা‘আলা মানবিক ইতিহাসের গতিধারার জন্য কোন সুনির্দিষ্ট পথ বেঁধে দেননি। অন্য কথায়,আল্লাহ্ তা‘আলা যেন মানুষকে বলছেন : ‘তোমরা নিজেরাই ঐশী নিয়তি পূর্ণ করার জন্য দায়িত্বশীল এবং তোমরাই ইতিহাসের গতিধারাকে এগিয়ে নিতে পার,থামিয়ে দিতে পার বা বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিতে পার।’ প্রকৃতির ক্ষেত্রে বা মানুষের জীবনে অথবা ঐশী পন্থা নির্ধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে এমন কোন অন্ধ নিয়তি নেই যা ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা হচ্ছে মানুষ,ইতিহাস ও ভাগ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করার একটি পথ।

অতএব,যতক্ষণ না আমরা ক্রমবিকাশের সম্মুখপথের সাথে এবং মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্যের সাথে পরিচিত হব ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ক্রমবিকাশ সম্পর্কে কথা বলতে পারি না। সে ক্ষেত্রে আমরা কেবল এতটুকুই বলতে পারি যে,মানুষ এগিয়ে চলেছে। সে ক্ষেত্রে সাথে সাথেই এ প্রশ্নটি আসে যে,সে কোনদিকে এবং কোন্ লক্ষ্যাভিমুখে এগিয়ে চলছে? আমরা যদি এ প্রশ্নের জবাব দিতে না পারি তাহলে আমাদের কী অধিকার আছে ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে কথা বলার? আমরা কি ভবিষ্যতের জন্য একটি পথ খুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ইতিহাস অধ্যয়ন করি না? ইতিহাস অধ্যয়ন করে যদি আমরা কেবল এতটুকু ধারণা অর্জন করতে সক্ষম হই যে,ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন পথ দেখানো ছাড়াই ইতিহাস আমাদের তার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ দিচ্ছে তাহলে এ ইতিহাসের প্রয়োজন কী? এটা কী কাজে লাগল?

কিন্তু আমরা কুরআন মজীদে দেখতে পাই যে,এ ঐশী গ্রন্থ ইতিহাসকে এমনভাবে পর্যালোচনা করেছে যে,তা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য পথ দেখাচ্ছে এবং আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে,ভবিষ্যৎ কেমন হওয়া উচিত। সুতরাং আমাদের আলোচ্য বিষয় অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট এবং এরপর তা ভবিষ্যতের সাথে সংশ্লিষ্ট। আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণের প্রশ্ন কেবল তখনি আসে যখন আমরা অতীতের সাথে পরিচিত হবার পর ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও একটি ধারণার অধিকারী হতে পারি।

অতীতে ইতিহাসের ক্রমবিকাশ

আমরা যদি ইতিহাসকে দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করি তাহলে মানুষ বিকাশের অধিকারী না হয়ে থাকলেও সন্দেহাতীতভাবেই অগ্রগতি হাসিল করেছে। এর একটি হচ্ছে যান্ত্রিক উন্নতি ও মানব জীবনে যন্ত্রপাতির ব্যবহার। নিঃসন্দেহে মানুষ যন্ত্রপাতি নির্মাণের ক্ষেত্রে উন্নতি হাসিল করেছে এবং অবশ্যই সে উন্নতি চোখ ধাঁধানো বিস্ময়কর উন্নতি। মানুষ এক সময় অমসৃণ পাথর জমা করত,পরবর্তীকালে সে মসৃণ ও পালিশ করা পাথর জমা করতে থাকে। আর এখন সে প্রযুক্তি,কারিগরি বিদ্যা ও শিল্পের ক্ষেত্রে বর্তমান উন্নত স্তরে উন্নীত হয়েছে। মানুষ কেবল কারিগরি নৈপুণ্যই হাসিল করেনি এবং কেবল যন্ত্রপাতি উৎপাদনের ক্ষেত্রেই অগ্রগতির অধিকারী হয়নি; বরং সে এমনই বিপুল ও বিস্ময়কর অগ্রগতি হাসিল করেছে যে,দুই বা একশ’ বছর আগে আমাদের পূর্বসূরি ও দার্শনিকগণ যদি বলতেন যে,মানুষ একশ’ বা দু’শ’ বছর পরে এ ধরনের উন্নতি করবে (বর্তমানে যে ধরনের উন্নতি করেছে) তাহলে কেউই তাঁদের কথা বিশ্বাস করত না।

একে আপনি ‘অগ্রগতি’ বা ‘বিকাশ’ যা খুশী বলতে পারেন,কিন্তু এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনই অবকাশ নেই যে,মানুষ যন্ত্রপাতি নির্মাণের ক্ষেত্রে দারুণ ও বিস্ময়কর অগ্রগতি হাসিল করেছে। আর এ অগ্রগতির অভিযাত্রা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়,যদি না কোন ঐতিহাসিক বিপর্যয় বা বড় ধরনের দুর্যোগ তার অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে-যে সম্পর্কে কিছু সংখ্যক মনীষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তাঁদের মতে,এমন সম্ভাবনা রয়েছে যে,মানুষের শিল্প ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এমন একটি স্তরে উপনীত হবে যে,সে নিজেকে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তার সকল অর্জন,তার বই-পুস্তকাদি,তার জ্ঞান ও সভ্যতাকে এবং এ সবের সকল চিহ্ন ও নিদর্শনকে ধ্বংস করে ফেলবে। এরপর এ পৃথিবীর বুকে এক নতুন ধরনের মানুষ জীবন যাপন করতে শুরু করবে এমন সম্ভাবনা রয়েছে। এ ধরনের বিপর্যয় সংঘটিত না হলে নিঃসন্দেহে যান্ত্রিক উন্নতি এমন এক পর্যায়ে উপনীত হবে যা আজ কল্পনাও করা যায় না।

এ উন্নতি হচ্ছে মানুষের অভিজ্ঞতা ও তার জ্ঞানের উন্নতিরই ফসল। কারণ,মানুষ তার পরীক্ষামূলক জ্ঞান ও প্রকৃতি সংক্রান্ত জ্ঞানের ক্ষেত্রে এতখানি উন্নতি সাধন করেছে যে,সে প্রকৃতিকে জয় করতে ও তাকে স্বীয় বাধ্যগত ভৃত্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে।

এ হল মানবিক উন্নতি ও অগ্রগতির একটি দিক।

মানুষের বিকাশের (যাকে অবশ্য ‘বিকাশ’ নামে অভিহিত করা খুবই কঠিন) আরেকটি দিক হচ্ছে তার সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্র ও তার সমাজ কাঠামোতে (এখানে ‘সম্পর্ক’ বলতে মানবিক সম্পর্ক বুঝান হচ্ছে না) পরিবর্তন। মানব সমাজে ধীরে ধীরে রূপান্তর সংঘটিত হয়েছে। অতীতে মানব সমাজের যে সহজ-সরল কাঠামো ছিল তার পরিবর্তে জটিল ধরনের কাঠামোর উদ্ভব ঘটেছে। অন্য কথায়,শিল্প ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে সে যেভাবে গতকালের সাদামাটা ধরনের গাড়ি থেকে আজকের দিনের বিমান ও অত্যাধুনিক মহাশূন্য যানের পর্যায়ে অগ্রগতি সাধন করেছে ঠিক একইভাবে তার সমাজ একটি জটিল সমাজে পরিণত হয়েছে। একে প্রাকৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে এক কোষবিশিষ্ট জীবের সহজ-সরল কাঠামোর বিপরীতে মানবদেহের মত অত্যন্ত জটিল শারীরিক কাঠামোর সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

অনেকে ক্রমবিকাশকে দু’টি স্তরবিশিষ্ট একটি প্রক্রিয়া হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। প্রথম পর্যায় হচ্ছে আকর্ষণ বা একত্রকরণ এবং বিভাজনের মাধ্যমে অংশসমূহের বহুত্বকরণ। একে এককত্ব বা একমুখিতা থেকে বহুমুখিতা অভিমুখে অভিযাত্রা নামে অভিহিত করা যেতে পারে। অন্য কথায়,একটি একক সম্পর্কের মাধ্যমে বিভিন্ন অংশকে বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে পরস্পর সংযুক্তকরণের মাধ্যমে একটি নতুন ও জটিল এককের উদ্ভব হওয়া। উদাহরণ স্বরূপ,আমরা জানি যে,ভ্রুণ সঞ্চারের প্রক্রিয়া হচ্ছে,প্রথমে পুরুষের একটি শুক্র কীট ও নারীর একটি ডিম্ব একত্র হয়ে একটি সহজ-সরল সাধারণ কোষ তৈরি হয়। এরপর এটিতে বিভাজন প্রক্রিয়া শুরু হয় অর্থাৎ তা তার পারিপার্শ্বিকতা থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপাদান আকর্ষণ করে পরিপুষ্টি ও পরিবৃদ্ধি হাসিলের পর বিভাজিত হয়; প্রথমে সেই একক কোষটি বিভাজিত হয়ে দু’টিতে পরিণত হয়,এরপর দু’টি কোষ চারটিতে,চারটি আটটিতে ও আটটি ষোলটিতে পরিণত হয় এবং এভাবে চলতে থাকে। কিন্তু এটা হচ্ছে কেবল সংখ্যাগত দিক থেকে বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। অতঃপর একটি স্তরে গিয়ে তাতে অন্য এক ধরনের বিভাজন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এ পর্যায়ে একটি অংশ স্নায়ুমণ্ডলিতে পরিণত হয়,অন্য একটি অংশ হৃদপিণ্ডে পরিণত হয়,আর কতক কোষ রক্তে পরিণত হয় এবং গোটা শরীরে রক্তপ্রবাহের একটি প্রক্রিয়ার উদ্ভব ঘটে। আর সবগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরস্পর সংযুক্ত ও সক্রিয় থেকে একটি মানব দেহ গঠন করে।

মানবসমাজও একইভাবে অগ্রগতি হাসিল করেছে,তা আপনারা একে বিকাশ নামে অভিহিত করুন বা না-ই করুন। অর্থাৎ মানবসমাজের কাঠামো একটি সহজ-সরল অবস্থা থেকে পরিবর্তিত হয়ে একটি জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে।

প্রাথমিক পর্যায়ের মানবসমাজ বা গোত্রীয় সমাজের কাঠামো ছিল খুবই সহজ-সরল। এ ধরনের সমাজ কাঠামোতে অল্প কিছু সংখ্যক লোক নিয়ে গঠিত একটি গোত্রে একজন গোত্রপতি থাকত। আর গোত্রপতি গোত্রের লোকদের মধ্যে সাধারণ বা সর্বজনীন কাজগুলো বণ্টন করে দিত এবং এ ধরনের কাজের সংখ্যাও ছিল খুবই কম। কিন্তু আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে এ ধরনের কর্মবিভাজন জটিল রূপ ধারণ করেছে। কারণ,বর্তমানে কাজের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে এবং কাজ করার মত লোকের সংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান কালের কাজকর্ম,চাকরি,শিল্পকর্ম ও অন্যান্য পেশার বিভিন্ন ধরন ও প্রকরণের সাথে এমনকি একশ’ বছর আগের এসব বিষয়ের তুলনা করলেও বিষয়টি আপনাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে।

এ ব্যাপারে আমরা প্রশাসনিক ও জ্ঞানগত পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও তার বিভিন্ন

স্তরের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। অতীতে কোন ব্যক্তির পক্ষে স্বীয় যুগে বিদ্যমান সকল প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করা সম্ভবপর ছিল। ফলে সে ব্যক্তির পক্ষে ইবনে সীনা বা অ্যারিস্টোটল হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক বেশি বিভাগ ও উপবিভাগের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আমরা দেখতে পাই যে,আমাদের যুগে এখন অ্যারিস্টোটল ও ইবনে সীনার মত শত শত ব্যক্তি আছেন,তবে তাঁদের প্রত্যেকেই কেবল নিজ নিজ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ-যাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা-প্রশাখার সাথে মোটেই পরিচিত নন; এমনকি তাঁরা বর্তমান বিশ্বে বিদ্যমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক শাখা-প্রশাখার অস্তিত্ব সম্পর্কেও অবগত নন।

এ হচ্ছে আমাদের যুগের একটি বৈশিষ্ট্য। এটা এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা মানুষের মধ্য থেকে সমরূপতা ও সুসঙ্গতিকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে এবং পার্থক্য ও বিশিষ্টতাকে তার স্থলাভিষিক্ত করেছে। কারণ,মানুষ যেমন কাজ সৃষ্টি করে,তেমনি কাজও মানুষকে গড়ে তোলে। ফলত যদিও একটি সমাজে বসবাসকারী সকলেই মানুষ,কিন্তু মনে হচ্ছে যেন তারা বিভিন্ন ধরনের প্রকৃতির অধিকারী। কারণ,প্রত্যেকেই এমন একেকটি কাজ করছে যে সম্পর্কে অন্য কাজে ব্যস্ত অপর ব্যক্তি কিছুই জানে না। মনে হচ্ছে যেন তাদের প্রত্যেকেই একেকটি স্বতন্ত্র জগতের বাশিন্দা। এর ফল হচ্ছে এই যে,মানুষ পরস্পর থেকে ভিন্ন ধরনের হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা যদি সমাজ,সংগঠন,কর্মবিভাজন,দক্ষতা ও মেধা-প্রতিভা প্রসঙ্গে অগ্রগতি বা বিকাশের কথা বলতে চাই তাহলে বলতে হবে যে,মানবসমাজের কাঠামো একটি সহজ-সরল অবস্থা থেকে পরিবর্তিত হয়ে একটি জটিল ও চরমভাবে পরস্পর বিজড়িত অবস্থা পরিগ্রহণ করেছে।

এ সব মন্তব্য থেকে নিঃসন্দেহে আপনারা অনুভব করতে পারছেন যে,সব কিছু যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে অনেক ধরনের পার্থক্যের উদ্ভবজনিত একটি বিপদ দেখা দেবে যার ফলে মানবজাতি হুমকির সম্মুখীন হবে। অর্থাৎ মানুষে মানুষে কেবল তাদের বাহ্যিক চেহারায় মিল ও সমরূপতা থাকবে,কিন্তু তাদের মানসিক,আধ্যাত্মিক,ভাবাবেগ ও শিক্ষাগত কাঠামো পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হবে; আর এটা হবে মানব জাতির জন্য একটা বিরাট বিপদ। এ কারণেই বলা হয় যে,প্রযুক্তিগত উন্নতি মানুষকে তার নিজের কাছেই অপরিচিত করে তুলেছে। এ বিষয়ের উন্নতি তাকে তার চাকরি ও পেশার জন্য প্রয়োজনীয় একটি প্রাণীরূপে গড়ে তুলেছে এবং তার মানবিক বৈশিষ্ট্য ধ্বংস করে দিয়েছে। স্বয়ং এ অবস্থাই একটা বড় সমস্যা।

সে যা-ই হোক,আমরা বলতে পারি যে,সামাজিক কাঠামোর দৃষ্টিকোণ থেকেও সমাজ সমূহ অতীতে বিকাশপ্রাপ্ত হয়েছে। অবশ্য এখানে প্রকৃতির ওপর মানুষের ক্ষমতা ও আধিপত্য ছাড়াও এবং মানব সমাজ ও সামাজিক সংগঠনসমূহের কাঠামোর পাশাপাশি এমন আরও কতকগুলো সমস্যা আছে যা মানবিক প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত; আর তা হচ্ছে ব্যক্তি মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক।

মানবিক সম্পর্কসমূহ

প্রশ্ন হচ্ছে,মানুষ যেভাবে যন্ত্রপাতি উৎপাদনের ক্ষেত্রে উন্নতি ও অগ্রগতি হাসিল করেছে সে কি মানুষে মানুষে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক ও সমাজকাঠামোর জটিলতার ক্ষেত্রে একইভাবে গুণগত দিক থেকে উন্নতি সাধন করেছে? সে যদি তা করে থাকে তাহলে আমরা একে বিকাশ বলে অভিহিত করতে পারি।

মানুষ কি পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করেছে? আজকের মানুষ কি অন্যদের প্রতি অতীতের মানুষের তুলনায় অধিকতর সহযোগিতার অনুভূতি পোষণ করে? অন্য মানুষের প্রতি দায়িত্ব অনুভব করার ক্ষেত্রে সে কি আনুপাতিক হারে অগ্রগতি হাসিল করেছে? মানুষের দ্বারা অন্য মানুষদের শোষণ কি আসলেই হ্রাস পেয়েছে? নাকি কেবল শোষণের ধরন পাল্টেছে এবং মাত্রাগত ও পরিমাণগত দিক থেকে শোষণ বৃদ্ধি পেয়েছে? অন্যদের অধিকারের বিরুদ্ধে মানুষের আগ্রাসন ও সীমালঙ্ঘন কি হ্রাস পেয়েছে? যন্ত্রপাতি নির্মাণের ক্ষেত্রে মানুষ যেভাবে উন্নতি করেছে এবং সামাজিক কাঠামোর জটিলতা যে মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে সে অনুপাতে কি মানুষের পরস্পরিক মানবিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে নাকি এ সব সমস্যা আগের মতই একই অবস্থায় রয়ে গেছে? নাকি কতক লোকের পক্ষে দাবি করা সম্ভব যে,এ ব্যাপারে যে শুধু উন্নতি সাধিত হয়নি শুধু তা-ই নয়; বরং এ ক্ষেত্রে মানুষ অনেক পিছিয়ে গেছে? অন্য কথায়,সাধারণভাবে কি এটা বলা যেতে পারে যে,মানবিক মূল্যবোধসমূহ এবং যা কিছু মানুষের মানবিকতার মানদণ্ড তা আনুপাতিক হারে অগ্রগতি লাভ করেছে?

এ ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছু সংখ্যক লোক বিশ্বনিন্দুকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন; মানুষ এ ক্ষেত্রে আদৌ কোন অগ্রগতি হাসিল করেছে-এ কথা তাঁরা অস্বীকার করে থাকেন। তাঁরা বলেন,উন্নতি-অগ্রগতির মানদণ্ড যদি হয়ে থাকে কল্যাণ ও সুখ-শান্তি,তাহলে আমাদের পক্ষে এ কথা বলা কঠিন যে,মানুষ উন্নতি করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে,এমনকি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও সন্দেহ আছে যে,তা মানুষের কল্যাণ সাধন করেছে কিনা। যে সব ক্ষেত্রে খুবই অগ্রগতি হাসিল হয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে গতি-যা টেলিফোন,বিমান ও এ জাতীয় অন্যান্য জিনিসের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে,মানবিক কল্যাণের মানদণ্ডে পরিমাপ করলে গতির এ উন্নতিকে কি অগ্রগতি বলা যেতে পারে নাকি,যেহেতু গতি হচ্ছে একটি মাধ্যম,সেহেতু তা এক হিসাবে যেমন মানুষকে আরাম দিয়েছে,অন্য অনেক কিছুর বিচারে তা মানুষকে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করেছে? কারণ,গতির এ উন্নতি একদিকে যেমন একজন ভাল মানুষকে দ্রুত তার লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায়,ঠিক সেভাবেই তা একজন দুষ্ট লোককে তার লক্ষ্যের ও অসদুদ্দেশ্য সাধনের দিকে নিয়ে যায়। গতির এ উন্নতির ফলে একজন সুস্থ ও সৎ মানুষের হাত দু’টি অধিকতর শক্তিশালী ও তার পা দু’টি দ্রুততর হয়েছে। অন্যদিকে একজন দুষ্ট লোকও একই সুবিধা লাভ করেছে। মাধ্যমের এ দ্রুততার ফলে একজন অপরাধীর পক্ষে হাজার হাজার,এমনকি লক্ষ লক্ষ মানুষকে একবারে হত্যা করার জন্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে।

তাহলে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত উপসংহার কী? যদিও আমি এ ধরনের বিশ্বনিন্দুক অভিমতের সমর্থক নই,তথাপি আমি এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে চাই যে,কেন কিছু সংখ্যক লোক এ ধরনের অভিমত ব্যক্ত করছেন। উদাহরণ স্বরূপ,ঔষধ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে উন্নতি কি প্রকৃত উন্নতি? দৃশ্যত তা-ই। কারণ,আমরা দেখতে পাচ্ছি যে,একটি শিশু যখন ডিপথেরিয়ায় ভোগে তখন তার জন্য বর্তমানে যথাযথ ওষুধ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা উন্নতি। কিন্তু অ্যালেক্সিস ক্যারলের মত কতিপয় লোক এ সব বিষয়কে মানবতার মানদণ্ডের দ্বারা পরিমাপ করেন। তাঁরা মনে করেন যে,ওষুধপত্র ক্রমান্বয়ে মানব প্রজাতিকে দুর্বলতর করে ফেলছে। তাঁরা বলেন,অতীতে মানুষের শরীরে রোগব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি ছিল। এ কারণে দুর্বল ধ্বংস হয়ে যেত ও সবল বেঁচে থাকত এবং এর ফলে পরবর্তী প্রজন্মসমূহ অধিকতর শক্তিশালী ও রোগ প্রতিরোধী হত। শুধু তা-ই নয়,এর ফলে অপ্রয়োজনীয় জনসংখ্যা বৃদ্ধিও রোধ হত। কিন্তু বর্তমানে ওষুধপত্র কৃত্রিম পন্থায় দুর্বল লোকদেরকে টিকিয়ে রাখছে,নচেৎ তারা প্রকৃতির সিদ্ধান্তের ফলে প্রকৃতই মৃত্যুবরণ করত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। ফলে তাদের পরবর্তী প্রজন্মসমূহ আর টিকে থাকার উপযুক্ত নেই এবং এভাবে প্রতি পরবর্তী প্রজন্ম তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় দুর্বলতর হচ্ছে। মাতৃগর্ভে আগমনের পর সপ্তম মাসে জন্মগ্রহণকারী একটি শিশু প্রকৃতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মৃত্যুবরণ করার কথা। কিন্তু বর্তমানে ওষুধপত্র ও চিকিৎসা উপকরণের উন্নতির ফলে এ সবের সাহায্যে তাকে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে পরবর্তী প্রজন্মের অবস্থা কী হবে? অধিকন্তু অতি-জনসংখ্যার প্রশ্নও আসে। এর ফলে যা ঘটছে তা হচ্ছে,মানবজাতির উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থে যারা বেঁচে থাকার জন্য অধিকতর উপযুক্ত তাদেরও অনেকে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং যারা এ বিকাশে অবদান রাখতে সক্ষম নয় তাদের অনেকে কোন না কোনভাবে বেঁচে যাচ্ছে।

ওষুধ ও চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতি মানুষের প্রকৃত উন্নতি কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণের এ-ও অন্যতম কারণ।

অন্য একটি দৃষ্টান্ত

প্রচারমাধ্যম প্রসঙ্গে কেউ মনে করতে পারেন যে,ঘরের কোণে বসে তাঁর আগ্রহের কোন বিষয়ের সংবাদ সাথে সাথে শুনতে পারা একটা চমৎকার ব্যাপার। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে,একই বিষয় মানুষের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগ ও ভীতির সৃষ্টি করছে। কারণ,অনেক ক্ষেত্রে মানুষের জন্য এ ধরনের সংবাদ না শোনাই কল্যাণকর। উদাহরণস্বরূপ,অতীতে যে সব লোক শীরাযে বসবাস করত তারা গূচানে সংঘটিত প্লাবনের খবর সম্পর্কে-যাতে বহু লোক মারা যায় ও আরও অনেক লোক গৃহহীন হয়ে পড়ে-অবগত ছিল না। কিন্তু এখন তারা সাথে সাথে এ ধরনের খবর জানতে পারে এবং এ কারণে দুঃখ অনুভব করে ও উদ্বিগ্ন হয়। বিশ্বের বিভিন্ন অংশে এ ধরনের হাজার হাজার দুঃখজনক ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে।

এটা মানবিক কল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকাশিত একটি অভিমত; মানবিক কল্যাণের মানদণ্ড থেকেই অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি গতির দ্রুতায়ন আদৌ উন্নতি বা বিকাশের পরিচায়ক কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

সে যা-ই হোক,এ সব সমস্যার ব্যাপারে আমাদের কোন করণীয় নেই। কারণ,আমরা মনে করি যে,সার্বিকভাবে একটি বিকাশ সংঘটিত হচ্ছে এবং এ সব সমস্যাকে অতিক্রম করা সম্ভব। এ ব্যাপারে আমরা পরে আলোচনা করব।

মোদ্দা কথা,যন্ত্রপাতি,চিকিৎসাবিজ্ঞান ও অন্যান্য বস্তুগত উন্নতির ফলে মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনরূপ উন্নতি বা বিকাশ সাধিত হয়েছে এমন কথা আমরা বলতে পারি না এবং যদি হয়েও থাকে তাহলে সে উন্নতি বা বিকাশ যান্ত্রিক আবিষ্কার ও সামাজিক সংগঠনসমূহ গড়ে ওঠার সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে হয় নি।

স্বয়ং নিজের সাথে মানুষের সম্পর্ক

আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে স্বয়ং নিজের সাথে মানুষের সম্পর্ক-যাকে নৈতিকতা বলে অভিহিত করা হয়। যদি আমরা বলতে না চাই যে,মানুষের পুরা সুখশান্তি তার নিজের সাথে একটি উত্তম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ওপর নির্ভরশীল (আর আসলেও আমরা তা বলছি না। কারণ,তা হবে অতিকথন বা বাড়াবাড়ি),তাহলে আমরা বলতে পারি,মানুষের সুখশান্তির উপকরণগুলোকে তার সুখশান্তিতে ভূমিকা পালনের দৃষ্টিতে শতকরা হারে পরস্পরের সাথে তুলনা করলে নিঃসন্দেহে দেখা যায় যে,এ সুখশান্তির বৃহত্তর অংশই তার নিজের সাথে সম্পর্ক-অন্য কথায়,তার নাফ্স-এর বা তার প্রাণীসত্তার সাথে সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। কারণ,মানুষের মানবিক সত্তা ও তার প্রকৃতিতে নিহিত মানবিক মূল্যবোধ সমূহের পাশাপাশি সে একটি প্রাণীও বটে। অর্থাৎ সে হচ্ছে একটি প্রাণী যার মধ্যে মানবিকতা প্রদান করা হয়েছে। অন্য কথায়,সে হচ্ছে একটি প্রাণী এবং সে তার প্রাণিসুলভ বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি মানবিকতারও অধিকারী।

এখন প্রশ্ন জাগে,মানুষের মানবিকতা কি তার প্রাণীসত্তার অধীন,নাকি তার প্রাণীসত্তা তার মানবিকতার অধীন?

কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَکَّاهَا وَ قَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا

‘যে তাকে (স্বীয় সত্তা বা নাফ্সকে) পরিশুদ্ধ করেছে সে সফলকাম হয়েছে এবং যে তাকে কলুষিত করেছে সে ব্যর্থ হয়েছে।’

এখানে সমস্যা হচ্ছে আত্মশুদ্ধির সমস্যা। এর মানে হচ্ছে,ব্যক্তি যেন তার নাফসের লোভ-লালসা ও কামনা-বাসনা তথা প্রবৃত্তির হাতে বন্দী হয়ে না পড়ে। যতক্ষণ পর্যন্ত না একজন মানুষ নৈতিকভাবে বিকাশপ্রাপ্ত ও উন্নত হবে এবং স্বীয় প্রাণীসত্তা বা পশুসত্তা থেকে অভ্যন্তরীণ মুক্তি হাসিল করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার পক্ষে অন্য মানুষের সাথে উত্তম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কেবল তখনই কারও পক্ষ থেকে উত্তম মানবিক সম্পর্ক উদ্ভূত হতে পারে যখন সে নিজেকে অন্য মানুষের কবলে বন্দী থাকা অবস্থা থেকে মুক্ত করে এবং অন্য মানুষকে নিজের অধীন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়।

এ পর্যন্ত আমরা চারটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। তা হচ্ছে :

১. প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক-যে ক্ষেত্রে সে অগ্রগতি হাসিল করেছে।

২. সমাজের সাথে মানুষের সম্পর্ক-যে ক্ষেত্রে সমাজ কাঠামো ও সংগঠনের দৃষ্টিকোণ থেকে সে অগ্রগতি হাসিল করেছে।

৩. অন্য মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং অন্য মানুষের সাথে তার সম্পর্কের গুণগত অবস্থা-যে বিষয়টি তার আধ্যাত্মিকতার ওপর নির্ভরশীল এবং তার মানবিকতার মূল মর্মের সাথে সম্পৃক্ত। এ ক্ষেত্রে সন্দেহ রয়েছে যে,সে অগ্রগতি হাসিল করছে কিনা। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে তার অগ্রগতি তার অন্যান্য দিকের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। এখানে মূল প্রশ্ন হচ্ছে,আদৌ সে অগ্রগতি হাসিল করেছে কিনা।

৪. মানুষের নিজের সাথে তার সম্পর্ক-যা নৈতিকতার শর্তাধীন।

ঐতিহাসিক বিকাশে নবিগণ ও ধর্মের ভূমিকা

অতীতের মানুষ তার প্রাণীসত্তা বা পাশবিক সত্তাকে যতখানি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল আজকের মানুষ কি তার চেয়ে বেশি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে এবং তার অস্তিত্বের ভিতরে কি উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধসমূহ অর্জিত হয়েছে নাকি মানবিক অস্তিত্বের গুণগত বৈশিষ্ট্য অতীতে বর্তমানের চেয়ে উন্নততর ছিল? ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশে নবী-রাসূলগণের ভূমিকা এবং এ ব্যাপারে তাঁদের অতীত ও ভবিষ্যৎ ভূমিকা অত্যন্ত স্পষ্ট। এখানে আমরা অতীতে ধর্ম কী ভূমিকা পালন করেছে তা উদ্ঘাটন করতে পারি এবং তা থেকে এর ভবিষ্যৎ ভূমিকা সম্বন্ধেও ধারণা লাভ করতে পারি। বৈজ্ঞানিক ও সমাজতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা অনুমান করতে পারি যে,মানুষের ভবিষ্যৎ বিকাশের জন্য ধর্মের প্রয়োজন আছে কিনা। কারণ,প্রত্যেক মানুষের টিকে থাকা ও বিলুপ্ত হওয়া তার মানবিক প্রয়োজন পূরণ হওয়ার ওপর নির্ভরশীল। এ তত্ত্বটি কুরআন মজীদে বিবৃত হয়েছে এবং বিজ্ঞানও তা স্বীকার করেছে। কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

...فَأَمَّا الزَّبَدُ فَيَذْهَبُ جُفَاءً وَ أَمَّا مَا يَنْفَعُ النَاسَ فَيَمْکُثُ فِي الْأَرْضِ...

...‘অতএব,ফেনা শুকিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায় এবং যা কিছু মানুষের জন্য কল্যাণকর তা ধরণীর বুকে অবশিষ্ট থেকে যায়...।’

একটি উপমা আছে যা আমি আমার বিভিন্ন বক্তৃতায় বহু বার উল্লেখ করেছি। তা হচ্ছে প্লাবন ও পানির ওপরের ফেনা। এ উপমায় বলা হয়েছে যে,ফেনা অত্যন্ত দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায় কিন্তু পানি থেকে যায়। সঠিক ও ভুলকে পানি ও ফেনার সাথে তুলনা করা হয়; যা কিছু কল্যাণকর তা থেকে যায় এবং যা কিছু অর্থহীন তা তিরোহিত হয়ে যায়।

ভবিষ্যতে ধর্ম টিকে থাকবে কিনা তা নির্ভর করে মানবিক বিকাশে অর্থাৎ তার অভ্যন্তরীণ মূল সত্তার বিকাশ,তার আধ্যাত্মিকতা ও মানবিকতার বিকাশ এবং তার নিজের সাথে ও অন্য মানুষের সাথে তার সম্পর্কের বিকাশের ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকার ওপর। আর এটা এমন একটি বিষয় যাকে অন্য কোন কিছু দ্বারা না বর্তমানে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব,না ভবিষ্যতে।

এমতাবস্থায় প্রশ্ন জাগে,ভবিষ্যতে কি সম্মিলিত আত্মহত্যার পরিণামে মানবসমাজ বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং মানব প্রজাতি ধরণীর বুক থেকে মুছে যাবে,অথবা মানবসমাজ তার প্রকৃত লক্ষ্য খুঁজে পাবে- যা হবে একটি সর্বাত্মক বিকাশ (প্রকৃতির সাথে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিকাশ এবং সচেতনতার বিচারে,শক্তির বিচারে,মুক্তির বিচারে,ভাবাবেগের দিক থেকে ও অন্যান্য মানবিক অনুভূতির দিক থেকে বিকাশ)? আমরা মনে করি,এ বিকাশ অর্জিত হবে। আর আমাদের এ দৃঢ় বিশ্বাসের উৎস হচ্ছে আমাদের দীনী শিক্ষা।

ইতঃপূর্বে আমি আমার ‘মানবজীবনে জ্যোতিষ শাস্ত্রীয় সহায়তা’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় বলেছি যে,মানবতার ভবিষ্যৎ ও মানবিক বিকাশ এবং চূড়ান্ত ধ্বংসের প্রান্তসীমায় পৌঁছা থেকে মানব প্রজাতিকে রক্ষা করা একমাত্র ধর্ম ছাড়া অন্য কোন কিছুর পক্ষে সম্ভব নয়। কেবল মানবজীবনে ধর্মের ভূমিকাই মানুষের অস্তিত্বে নিহিত মূল মানবিক সত্তার বিকাশের নিশ্চয়তা বিধান করতে সক্ষম।

তথ্যসূত্র :

১. সূরা আল্ ক্বালাম-এর ১ম আয়াত। আয়াতটি হচ্ছে : ن وَ الْقَلَمِ وَ مَا يَسْطَرُوْنَ ‘নূন্; শপথ কলমের এবং সেসব জিনিসের যেগুলো লেখার কাজ করে।’ লক্ষণীয়,এ আয়াতে ‘যেগুলো লেখার কাজ করে’ উল্লেখের মাধ্যমে কুরআন নাযিলের পরবর্তীকালে কলম বহির্ভূত লেখার উপকরণাদি (যেমন টাইপ-রাইটার ও কম্পিউটার) আবিষ্কার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে- যা ইতোমধ্যেই বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করেছে।- বাংলা অনুবাদক

২.সূরা আল্-‘আলাক্ব : ১-৫।

৩.সূরা আল্-মায়েদাহ্ : ৩।

৪.এটি পুস্তকটির নামের অনুবাদ মাত্র।- বাংলা অনুবাদক

৫.বাদা’ শব্দটির আভিধানিক তাৎপর্য হচ্ছে প্রকাশিত হওয়া। একজন মানুষের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য হচ্ছে : কোন কাজ সম্পর্কে মানুষের মনে এমন কোন ধারণার উদ্ভব হওয়া যে সম্পর্কে সে ইতঃপূর্বে অবগত ছিল না এবং তা তার মনে এমনভাবে জাগ্রত হয় যে,তা সংশ্লিষ্ট কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ এমন কিছু ঘটে যা ঐ কাজ সম্পর্কে তার ধারণা ও ইচ্ছাকে পরিবর্তিত করে দেয়। নিঃসন্দেহে মানুষের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তে এ ধরনের পরিবর্তনের কারণ হচ্ছে তার অজ্ঞতা অথবা তার জ্ঞান ও ধারণার সীমাবদ্ধতা। এ অর্থে আল্লাহ্ তা‘আলার ক্ষেত্রে বাদা’ একটি অসম্ভব ব্যাপার। কারণ,সাধারণ মানুষের মত ঐশী ইচ্ছায় পরিবর্তন ও প্রতিস্থাপনের প্রশ্নই ওঠে না।

৬.দক্ষিণ ইরানের একটি শহর।

৭.ইরানের একটি শহর।

৮.সূরা আশ্-শামস : ৮-১০।

৯.সূরা আর-রা‘দ্ : ১৭।

(প্রত্যাশা,১ম বর্ষ,২য় সংখ্যা)