আল হাসানাইন (আ.)

পরিবর্তনশীল জীবন এবং ইসলামী আইন

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

জীবন পরিবর্তনশীল। নতুন যুগের চাহিদাও নতুন। কিন্তু ইসলাম শাশ্বত, চিরন্তন। তাহলে ইসলামের পুরানো আইন ও বিধান কীভাবে মানুষের চিরকালের সমস্যাবলির সমাধান প্রদান করতে সক্ষম হবে? এক কথায় আধুনিক জীবনে ইসলামের কোন ভূমিকা রাখার অবকাশ আছে কি?

এ প্রশ্নটি নিঃসন্দেহে এ যুগের আলোচ্য বিষয়গুলোর অন্যতম। এর উত্তরও দেওয়া হয়েছে বিভিন্নভাবে। তবে সঠিক উত্তর জানা অনেকটা নির্ভর করে ইসলামী বিধি-বিধানসমূহের প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক পরিচয় থাকার ওপর। যদিও এ পরিচয় অর্জন করার জন্য অনেক অধ্যয়ন ও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। ফলে খুব সংক্ষেপে এ প্রশ্নের উত্তর আশা করার অবকাশ নেই।

যুগের আধুনিকতা এবং সে সূত্রে পরিবর্তিত চাহিদাসমূহ পূরণে পুরানো ধর্মীয় বিধি- বিধানের সামর্থ্য কতটুকু- এ প্রশ্নে আমরা নিজেদের দু’টি জিনিসের সম্মুখীন দেখতে পাই। একদিকে ইসলামী বিধি-বিধান, আরেকদিকে আধুনিকতা, যা একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। সমযের চাকা ঘুরবেই, সে সাথে পরিবর্তিত হবে জীবনের ধরন-মান। উন্নত থেকে উন্নততর হবে, ঘটবে বিবর্তন ও প্রসার। এমন নয় যে, এ সমস্যা শুধু আধুনিক কালে এসেই উদ্ভূত হয়েছে; বরং পরিবর্তন, বিবর্তন ও প্রসার হল মানব জীবনের অনিবার্য সঙ্গী। এ পৃথিবীতে মানব পা রাখার দিন থেকেই এ পরিবর্তনের ধারাও শুরু হয়ে যায়। সে ধারায় অনেকগুলো পর্যায় অতিক্রম করেই মানব জীবন আজ এ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। তবে এটি ঠিক যে, আধুনিক কালে এ ধারার লেখচিত্র অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। যেন এক বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। যার নজির আগে কখনও দেখা যায়নি। কিন্তু সমস্যাটা তৈরি হয় এখান থেকে যে, আধুনিকতার এ বিশাল জৌলুসের নজরকাড়া পরিবর্তনের পাদমূলে দাঁড়িয়ে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসাবে আমার করণীয় কী? আমি কি আমার ধার্মিকতা বজায় রেখে এ আধুনিকতাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাব, নাকি অবস্থা এমন বেগতিক যে, যদি একটি বজায় রাখতে চাই তাহলে অবশ্যম্ভাবীরূপে আরেকটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়?

সমাজে সচরাচর তিন শ্রেণীর মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথম শ্রেণীটি হল তারা, যারা আমাদের মত মুসলিমপ্রধান দেশে মূলত ইসলামের পক্ষেই অবস্থান নিয়ে ধর্মকেই আঁকড়ে ধরে। তারা মনে করে, ইসলাম পালন ও ধার্মিক হওয়ার অনিবার্য প্রয়োজন হল আধুনিকতা ও নতুনত্বকে ঘৃণা করা। যা কিছু নতুন, সেটাই ধর্মের পরিপন্থী বলে মনে করতে হবে। এভাবে তারা ক্রমে পেছনের দিকে হাঁটে। মোটকথা, তারা ধর্মের নামে সভ্যতা ও জীবনের আধুনিকতা ও উন্নতি থেকে পশ্চাদমুখী হয়ে চলে।

এর ঠিক বিপরীতে রয়েছে আরেকটি শ্রেণী, যারা আধুনিকতা, বিজ্ঞান ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার ধুয়ো তুলে নিজেদের ধর্ম থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে নেয়। ধর্ম তাদের দৃষ্টিতে সেকেলে ব্যাপার। ‘প্রাচীন’ শব্দটি তাদের দৃষ্টিতে জীর্ণতার সমার্থক। এদের কাছে পুরাতন মানেই অসার, অকেজো, জীর্ণ ও ফেলনার বিষয়। ঠিক এ কারণেই সমাজে আরেকটি শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে- ভারসাম্যপূর্ণ। সুখের বিষয় হল, সমাজে কমবেশি এ শ্রেণীর লোক বিদ্যমান। এখানে আমাদের একটি সামগ্রিক বিশ্লেষণ করে দেখতে হয় বাস্তব অবস্থাটা কী? আসলেই কি মুসলমান ও ধার্মিক থাকা এবং একই সাথে আধুনিক ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলাও সম্ভবপর নাকি তা সম্ভব নয়?

এ বিষয়টি অন্য যে কোন ধর্মের চেয়ে ইসলামের ক্ষেত্রে বেশি তীব্র। কারণ, ইসলামই হল সে ধর্ম, যা একদিকে যেমন ঘোষণা করেছে যে, আর কোন নবী আসবেন না, আর না আসবে কোন শরীয়ত; অপরদিকে সে চিরন্তন ধর্মেরও দাবিদার। অর্থাৎ এ ধর্মে যে আইন ও বিধান ঘোষণা করা হয়েছে তা চিরকালীন, চিরন্তন। ইসলামের জন্য বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায় এর পরিধি ও বিস্তৃতির কারণে। অন্যান্য ধর্মের মত ইসলাম যদি গুটি কতক উপদেশ-বাণী ও নীতিকথার নাম হত তাহলে সমস্যা এতটা ব্যাপক হত না। কিন্তু যখন জীবন ও সমাজের এমন কোন অঙ্গন নেই যা ইসলামের আইন ও বিধানের আওতায় পড়ে না- ধর্মাচার, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, বিচার-আদালত, সমরনীতি, বৈদেশিক সম্পর্ক, সংস্কৃতি, নৈতিকতা ইত্যাদি জীবনের সব অঙ্গনের জন্যই ইসলাম নিয়ে এসেছে স্পষ্ট বিধান। শুধু তা-ই নয়, এ বিধান শাশ্বত ও চিরন্তন, সব যুগের সকল জনপদের জন্য। কাজেই বুঝতে কষ্ট হয় না যে, ইসলামের ওপর দায়ভারটা কতখানি!

এখন আমরা ইসলামের আইন ও বিধানের প্রকৃতি উপলব্ধি করার জন্য কিছু গভীর আলোচনায় প্রবেশ করব। সাথে সাথে সময়ের তালে জীবনে যে পরিবর্তন ও বিবর্তন সাধিত হয় তারও প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করব।

আগেই বলা হয়েছে এখানে আমরা দু’টি বিষয়ের সম্মুখীন। একটি হল যুগ ও ইতিহাসের পরিবর্তন, বিবর্তন ও উন্নয়ন ধারা, এক কথায় যাকে বলা হয় আধুনিকতা। মনুষ্য জীবনে যা অনস্বীকার্য, ছায়ার মত অনুসরণ করে চলে তাকে। আর দ্বিতীয়তটি হল চিরন্তন দীন হিসাবে ইসলামী বিধি-বিধানের শাশ্বত হওয়া।

কোন প্রাণীরই, এমনকি যারা সমাজবদ্ধ হয়ে জীবন যাপন করে (যেমন মৌমাছি) তাদের জীবনও মানুষের জীবনের মত এত পরিবর্তনশীল নয়। আধুনিক গবেষণায় নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, মৌমাছি আজও যে ষড়ভূজাকৃতির বাসা বানিয়ে থাকে, হাজার বছর আগেও ঠিক সেভাবেই বানাত। কিন্তু মানুষের জীবনমান সময়ের পরিক্রমায় বদলে যায় দিনকে দিন। অন্যান্য জীবজন্তু প্রকৃতির স্বভাব তাড়িত হয়ে আদিকাল থেকে সেই একই ধারায় জীবনযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু মানুষ শুরুতে যে দুর্বল জীবনযাত্রার অধিকারী ছিল, ঐশী পুরুষগণের পথ-নির্দেশনা আর নিজস্ব প্রতিভা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে অনেক পথ পাড়ি দিয়েই আজকের এ আধুনিকতায় পা রেখেছে। মানব জীবনের এই পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় অনেক দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে শ্রুতিবহুল তত্ত্বটি হল : ‘এ বিশ্বজগতের অমোঘ নিয়মই হল পরিবর্তনশীলতা।’ এখানে কোন কিছুই নিশ্চল ও স্থির নয়। এক মুহূর্তের আগের অবস্থার সাথে পরের অবস্থার মিল নেই। দার্শনিকরা জগতের এ গতি, যা জগতের essence বা সারসত্তাগত, সে সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছেন। এমনকি মুসলিম দার্শনিকবৃন্দ (হাকিম) জগতের জন্য substantial motion তথা ‘সারবস্তুগত গতি’ তত্ত্বের প্রবক্তা হয়েছেন এবং প্রকৃতিকে গতি ও পরিবর্তনের নামান্তর বলে ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ প্রকৃতি = গতি (পরিবর্তনশীলতা)। এ তত্ত্ব প্রয়োগ করে এ ব্যক্তিরা বলেন, যখন এ জগতের আসল ভিত্তিই গতি ও পরিবর্তনের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এবং এখানকার কোন কিছুই শাশ্বত ও চিরন্তন নয়, অপরদিকে দীনও এ জগতেরই অন্তর্গত বিষয়, সুতরাং দীনও শাশ্বত ও চিরন্তন হতে পারে না। কারণ, এখানে সবকিছুই চিরন্তনতার বিরুদ্ধে।

তবে যদি ব্যাপারটি কেবল এরূপ এক রসকষহীন দার্শনিক যুক্তির ওপরে রেখে দেখা হয় তাহলে তার উত্তরও খুব সহজ। উত্তরটি হল : জগতে যা কিছু পরিবর্তনশীল সেগুলো হল এর বস্তুগত জিনিস। এগুলো যে পরিবর্তনশীল, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। স্বয়ং দীনের প্রবর্তনকারী যে নবী, তিনিও যেহেতু এ নিয়মের অধীন, এ কারণে তিনিও একটি ক্ষুদ্র নবজাতক হয়েই দুনিয়াতে আসেন। অতঃপর গতি ও পরিবর্তনের ধারায় শৈশব, কৈশোর ও যৌবন পার করে বার্ধক্যে পৌঁছেন। তারপর একসময় মৃত্যবরণ করেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে : ‘নিশ্চয় তুমি মরণশীল, তারাও মরণশীল।’ কিন্তু এখানে বিষয়টি হচ্ছে জগতের নিয়ম-কানুন নিয়ে। জগতের নিয়ম-কানুনগুলোও কি তবে পরিবর্তনশীল? আমাদের এ সূর্যও একদিন নিস্প্রভ হয়ে যাবে সত্য। গ্রহ-নক্ষত্রও তদ্রুপ। বিশ্বের সকল জীবজন্তু, গাছপালা, পাহাড়-পর্বত সবই এ নিয়মের অধীন ঠিকই। কিন্তু এর মানে কি এটা যে, পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের সূত্রগুলোও বদলে যাবে? ইসলাম হচ্ছে নিয়ম-কানুন, কোন (বস্তুগত) জিনিস নয়। আর যা বদলে যায় তা হল বস্তুগত জিনিস। তাই পবিত্র কুরআনও চিরন্তন থাকবে যদিও নবী মৃত্যবরণ করেন। একদিকে আল্লাহ বলছেন, ‘নিশ্চয় তুমি মরণশীল, তারাও মরণশীল’, অপরদিকে কুরআন ও ইসলাম সম্পর্কেও স্বয়ং আল্লাহই বলছেন : ‘নিশ্চয় আমরা কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই তার রক্ষাকারী।’

কুরআনের কাগজ-কালি ও মলাট জীর্ণ হয়ে যাবে ঠিকই। কিন্তু কুরআনের হাকীকত (সারসত্য ও অর্থ) রয়ে যাবে চিরন্তন। ইসলাম হল ভেতরের হাকীকত সদৃশ, বাইরের রূপকাঠামো নয়। কাজেই ইসলাম যেহেতু নিয়ম ও বিধানের এক সমষ্টি, সেহেতু আমাদের জানতে হবে সে নিয়ম ও বিধানসমূহ কতটা স্বভাবিক ও প্রাকৃতিক রূপে বিদ্যমান রয়েছে। অর্থাৎ কতটুকু প্রকৃতির স্বভাব ও গড়নের সাথে সামঞ্জস্যশীল। ইসলাম হচ্ছে নিয়ম ও বিধানের বর্ণনাকারী। ইসলামের এ বিধি- বিধান আসলে কোন আরোপকৃত বা প্রণয়নকৃত বিষয় নয়; বরং তা হল একটি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম-বিধান, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়েছে। এ বিধানে মানবের সামাজিক প্রকৃতিকে বিচেনায় রাখা হয়েছে। এ বিধান মানব জীবনধারার মূল অক্ষকে নির্ধারণ করে দেয়।

এখানে আরেকটি বিষয় মানব জীবনের নিয়ম সম্পর্কে আরও কিছু গভীরতা নিয়ে সামনে আসতে পারে। তা হচ্ছে কেউ এ যুক্তি উপস্থাপন করতে পারে যে, আমরা যে বলি ‘ইসলাম চিরন্তন নয়’- সেটা এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলি না যে, প্রকৃতির নিয়ম- কানুনগুলো পরিবর্তনশীল; বরং সেটা বলি এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে, মূল মানব জীবনের নিয়মই (মানব জীবন হওয়ার কারণেই তা) পরিবর্তনশীল। কেননা, যেহেতু মানুষ হচ্ছে এমন এক অস্তিত্ব, যে নিজেই নিজের জন্য দায়বদ্ধ এবং যেহেতু মানবের জীবন বদলে যায় ও উন্নতি লাভ করে, সুতরাং মানুষের প্রয়োজনসমূহও বদলে যায়। আইন প্রবর্তিত হয় মানুষের প্রয়োজনসমূহ সুশৃঙ্খলভাবে পূরণ করার জন্য। কারণ, আইনই মানুষের প্রয়োজনসমূহ পূরণ করার সম্মানজনক ও ন্যায়নিষ্ঠ উপায় বাৎলে দেয়। কাজেই আইন ও বিধানের মূল প্রোথিত সামাজিক প্রয়োজনসমূহের মধ্যে। সুতরাং মানুষের প্রয়োজনীয় নিয়ম-নীতিগুলোও পরিবর্তনশীল।

প্রস্তর ও গুহার যুগের মানুষের প্রয়োজনগুলো ছিল এক ধরনের। আবার কৃষি যুগের প্রয়োজনগুলো অন্য ধরনের। আর আজ আমাদের এ আধুনিক শিল্প যুগে মানুষের প্রয়োজনগুলো শিল্প ও যন্ত্রের প্রভাব অনুযায়ী পরিবর্তনশীল। তাই প্রয়োজনগুলো যখন পরিবর্তিত হয়ে যাবে, তখন আইন ও বিধানগুলোও স্বভাবিকভাবেই বদলে যাবার কথা।

এ বক্তেব্যের যারা প্রবক্তা, তাদের দৃষ্টিতে যুগের চাহিদা বদলে যাবার অর্থ হল মানুষের প্রয়োজনসমূহ পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া। উদাহরণস্বরূপ আজ থেকে তিনশ’ বছর আগে মানুষের জন্য কোন সড়ক ও ট্রাফিক আইন প্রণয়ণের কোন প্রয়োজন ছিল কি? ট্রাফিকের কোন সমস্যা ছিল না। গাড়ি এসে এ সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এ ধরনের হাজারও বিষয় রয়েছে যা আগে ছিল না। কাজেই তার আইনও প্রয়োজন হয়নি। সমস্যাগুলো নতুন, এর নিয়ম-কানুনগুলোও নতুন।

এ কথা ঠিক যে, মানুষের জীবনের অবস্থা ও পরিস্থিতি পরিবর্তন হয় এবং মানুষের প্রয়োজনগুলোও বদলে যায়। কিন্তু বিষয়টিকে এত সরলীকরণ করা যায় না। মানুষের এক শ্রেণীর প্রয়োজন রয়েছে অপরিবর্তনীয় ও চিরন্তন। আরেক শ্রেণীর প্রয়োজন রয়েছে পরিবর্তনশীল ও সাময়িক। মানুষের সকল প্রয়োজনই পরিবর্তনশীল- এ কথা ঠিক নয়। যে প্রয়োজনগুলো মানব জীবনের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কিত সেগুলো অপরিবর্তনীয় ও চিরন্তন। পক্ষান্তরে যে প্রয়োজনগুলো মানব জীবনের ধরন-ধারণ সম্পর্কিত সেগুলোই পরিবর্তনীয় ও সাময়িক। জীবনের ধরন-ধারণ অহরহ বদলে যাচ্ছে বলে এ কথার দোহাই দিয়ে আমরা বলতে পারি না যে, মানব জীবনের প্রাণ বা আত্মাও বদলে যায়। দীনী বিষয়াদি জীবনের আত্মাকে সম্বোধন করে, জীবনের ধরন-পদ্ধতিকে নয়। যদি ইসলামে অনুসন্ধান করে দেখা হয় তাহলে একটি জায়গায়ও পাওয়া যাবে না যেখানে ইসলাম জীবনের ধরন-কাঠামোর ওপর নির্ভর করেছে। কোথাও ইসলাম বলে না যে, ‘জীবনের এ ধরনটাই আমি চাই। এর পরিবর্তন করলে চলবে না।’ বরং সবসময় জীবনের অর্থ ও তাৎপর্য, এক কথায় জীবনের আত্মার ওপরেই ইসলাম নির্ভর করে। এটা ইসলামের স্বাতন্ত্র্য।

মানুষ ও জগৎ একই রকম। এই যে বলা হয় জগতের সবকিছুই পরিবর্তনশীল- এখানে ‘সবকিছু’ এভাবে বলা সঠিক নয়। প্রকৃতি হল জগতের পরিবর্তনশীল দিকের নাম। কিন্তু জগতের যদি একটি অপরিবর্তনীয় দিকও না থাকত, তাহলে এ নামটি ধারণ করাও অসম্ভব ছিল। যদি ‘সবকিছুই’ পরিবর্তনশীল হয়, (যেমনটা প্রাচীন যুগে হিরাক্লিটাস বলেছেন এবং আমাদের এ যুগেও অনেকে সে কথারই অনুসরণ করে চলেছেন) এবং কোন কিছুই যদি কোন অবস্থায় ও কোন দিক থেকেই দু’টি মুহূর্তে একরূপ থাকা অসম্ভব হয়, তাহলে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে কোন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না এবং জগতে কোন নিয়ম-কানুনই বিদ্যমান থাকতে পারে না। কিন্তু এ জগতের এতসব পরিবর্তনশীল চেহারার পরও এর একটি অপরিবর্তনশীল চেহারও রয়েছে, যা জগতের পরিবর্তনশীল রূপটাকে বয়ে বেড়ায়। অর্থাৎ যদি উক্ত স্থির ও অপরিবর্তনীয় দিকটি না থাকত তাহলে এ পরিবর্তনশীল দিকটিরও অস্তিত্ব থাকত না। মুসলিম দার্শনিকবৃন্দ, যাঁরা সারবস্তুগত গতি (substantial motion) তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন, তাঁরাও জগতের এ অপরিবর্তনশীল দিকটির প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন। তাঁরা বলেছেন, প্রকৃতি পরিবর্তনশীল। তবে এ প্রকৃতির একটি আত্মা রয়েছে, যে আত্মা শাশ্বত, চিরন্তন। মাওলানা রুমী এ সম্পর্কে তাঁর কবিতায় বলেছেন :

‘শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গেল হে মহাবীর!

আর এসব গুঢ় কথা রয়ে গেল অমলিন, শাশ্বত

এ পানির নালায় বদলে গেছে পানির ধারা, কতবার,

বিপরীতে ঐ সূর্য দেখ অপরিবর্তিত, চির স্থির।’

গোটা বিশ্বে কিছু গুঢ় সত্য আছে যা অপরিবর্তনীয়। আরেকটি দিক আছে পরিবর্তনশীল। মানুষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের যদি একটি আত্মা ও একটি অপরিবর্তনশীল জীবন ও নির্দিষ্ট মন-মানস না থাকত তাহলে এ পরিবর্তনশীল তনুদেহও থাকত না। আজ যে আমরা আছি- সেই চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছরের আগের মানুষটাই তো আছি। এ সময়ের মধ্যে আমাদের এ গোটা শরীর কতবার পরিবর্তন হয়ে গেছে ও ঝরে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। কিছু অংশ ঝরে গেছে নখ ও দাঁত রূপে, যেগুলোর স্থান হয়েছে ময়লার আস্তাকুড়ে। আর কিছু অংশ রয়ে গেছে অন্যরূপে। যেমন আমাদের ত্বকের কোষগুলো খোসার মত ঝরে পড়েছে এবং নতুন কোষ সেখানে স্থান দখল করে নিয়েছে। এভাবে দেখা যাবে আমাদের সেই দশ বছর আগেকার দেহটি এতদিনে কোন আস্তাকুঁড়ে চলে গেছে তা আল্লাহই ভাল জানেন। কিন্তু তারপরও আমরা আছি। এর কারণ হল আমাদের আত্মা অক্ষুন্ন রয়েছে। মানবের সামাজিক জীবনও হুবহু এরূপ। মানুষের দেহের ন্যায় এবং গোটা জগতের ন্যায় তারও একটি আত্মা রয়েছে, যেমন রয়েছে একটি পরিবর্তনশীল দেহ।

ফিরে আসি প্রশ্নের কথায়। উপযুক্ত ভূমিকা সামনে রাখলে ইসলামের বিধি-বিধানের শাশ্বত হওয়ার রহস্য অনুধাবন করা কষ্টকর হবে না। পবিত্র কুরআন বলতে গেলে একটি মাত্র আয়াতেই এ রহস্য উন্মোচন করে দিয়েছে। অর্থাৎ ইসলাম হল এমন একটি দীন যা সৃষ্টির নিয়ম থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এক কথায়, এসব নিয়ম ও বিধানের প্রণেতা স্বয়ং তিনিই যিনি সৃষ্টিরও স্রষ্টা। কাজেই এ নিয়ম ও বিধানাবলিকেও তিনি প্রণয়ন করেছেন সৃষ্টির অন্তর্নিহিত প্রয়োজনের সাথে সমন্বয় ও সামঞ্জস্যশীল করে। ইরশাদ হচ্ছে :

فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا ۚ فِطْرَ‌تَ اللَّـهِ الَّتِي فَطَرَ‌ النَّاسَ عَلَيْهَا

‘তুমি আল্লাহর প্রকৃতি অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলতে চান, দীন হল খোদায়ী সৃষ্টি। স্বয়ং দীন হল খোদায়ী সৃষ্টির সহজাত প্রকৃতি অনুযায়ী ও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

وَأَمَّا مَا يَنفَعُ النَّاسَ فَيَمْكُثُ فِي الْأَرْ‌ضِ

‘আর যা মানুষের জন্য উপাদেয় তা জমিনে থেকে যায়।

এ অবশিষ্ট থেকে যাওয়ার কারণ হল তা মানুষের জন্য উপাদেয়। এটি একটি সামগ্রিক ব্যাপার। এখন দেখতে হবে যে, ইসলামে কী কী জিনিস রয়েছে যা এ দীনকে সৃষ্টির সাথে ও সৃষ্টির অন্তর্নিহিত বিষয়াবলির (principles) সাথে সামঞ্জস্যশীল করেছে।

প্রথমত ইসলাম আকল তথা বুদ্ধিবৃত্তির মৌলিকত্বে বিশ্বাস করে। নিঃসন্দেহে ইসলামের ন্যায় অন্য কোন দীন ও ঐশী গ্রন্থ পাওয়া যাবে না যেখানে আকলকে এমন মৌলিকত্ব ও মূল্য দেওয়া হয়েছে। দুঃখের বিষয়, আমরা আমাদের দীন সম্পর্কে ভাল প্রচারক হতে পারিনি। আপনি যখন ইসলামী ফেকাহর বই কিতাব খুলবেন, দেখতে পাবেন যে, যখন ইজতিহাদ ও ফতোয়া বের করার প্রক্রিয়ায় এর উৎসসমূহের তালিকা বর্ণনা করা হয়, তখন বলা হয়, উৎস চারটি। যথা- কিতাব, সুন্নাহ, ইজমা ও আকল। অর্থাৎ আকলকে স্বতন্ত্রভাবে কিতাব, সুন্নাহ ও ইজমার কাতারে স্থান দেওয়া হয়েছে।

আসলে, এটা ইসলামের একটি বড় গৌরবের বিষয় যে, সেই সূচনাকাল থেকেই এর আলেমগণ বলেছেন : আকল ও শরীয়তের মধ্যে পূর্ণ সমন্বয় ও সামঞ্জস্য রয়েছে। একটি মূলনীতি (principles) স্থির করে তাঁরা বলেন :

كل ما حكم به العقل حكم به الشرع و كل ما حكم به الشرع حكم به العقل

‘আকল (বুদ্ধিবৃত্তি) যা নির্দেশ করে, ধর্মের শরীয়ত (শারয়) তা-ই নির্দেশ করে। আর শরীয়ত যা নির্দেশ করে, আকলও তা-ই নির্দেশ করে।’ এ কথা দ্বারা তাঁদের উদ্দেশ্য হল : যদি সত্যই আকল একটি জিনিসকে উদ্ঘাটন করে, আর ধরুন আমাদের হাতে উক্ত বিষয়ে কোন কুরআন-হাদীসভিত্তিক সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকে, তাহলে আকলের ঐ নির্দেশই আমাদের এটা বুঝার জন্য যথেষ্ট যে, এটা ইসলামের নির্দেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আর শারয় অলঙ্ঘনীয়ভাবে যা নির্দেশ করে, আকলও সেটাই নির্দেশ করে- এ কথার অর্থ হল কিছু গুঢ় জ্ঞান ও সংকেত রয়েছে, যদি আকল সেগুলো অনুধাবন করতে পারে তাহলে তা স্বীকার করে। অর্থাৎ ইসলামের বিধি-বিধান অপরিচিত ও ভিন্ন জগতের কিম্বা মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধির নাগালের বাইরের কোন নিয়মের ভিত্তিতে প্রবর্তিত নয়; বরং মানুষের জীবনের প্রকৃত কল্যাণ ও অকল্যাণের ভিত্তিতে প্রণীত, যা মনুষ্য বুদ্ধি দ্বারা অনুধাবনযোগ্য। কাজেই ‘শারয় যা নির্দেশ করে, আকলও তাই নির্দেশ করে’- এ নীতি বলতে চায় যে, ইসলাম হল যুক্তিনির্ভর ধর্ম। খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীরা ত্রিত্ববাদ সম্পর্কে কথা বলে থাকে যে, এ ক্ষেত্রে ঈমান হল আকল থেকে ভিন্ন। আসলে ঈমান থেকে আকল ভিন্ন নয়। ঈমান আকল থেকে ভিন্ন হবে, এমন কোন বক্তব্য ইসলামে নেই। আর এ ব্যাপারটিই ইসলামের ফেকাহর মধ্যে অপূর্ব এক শক্তি সঞ্চারিত করেছে। এ বিষয়টিই ইসলামী আলেম ও পণ্ডিতবৃন্দের জন্য একটি উন্মুক্ত ক্ষেত্রের সুযোগ করে দিয়েছে, যেখানে তাঁরা সমস্যাবলির বিধান নির্ধারণে আকল তথা বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রয়োগ করতে পারেন। অতীতের বিভিন্ন যুগে ইসলামী ফেকাহর বিজয়ের পেছনে এটাই ছিল অন্যতম কারণ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অঙ্গনে যাঁরা ইসলামী ফেকাহ নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন তাঁরা এর নমনীয়তা ও খাপ খাওয়ানোর অভাবনীয় গুণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

দ্বিতীয় বিষয়টি হল, ইসলাম জীবন যাপনের বিশেষ কোন রূপ বা ধরনের দিকে দেখে না; বরং জীবনের আত্মার দিকেই তার দৃষ্টি। অর্থাৎ দ্বিতীয় যে কারণটি ইসলামের মধ্যে রয়েছে এবং যার সুবাদে জগতের পরিবর্তন ও উন্নতির সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়, সেটা হল, ইসলাম জীবনের ধরন-পদ্ধতির দিকে লক্ষ্য করে না। কোন এক ধরনের বা এক ধাঁচের জীবনকে ইসলাম স্থায়ীভাবে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয় না। ইসলামের লক্ষ্য জীবনের আত্মার দিকে। আর সে কারণেই ইসলাম জীবনের অগ্রযাত্রার সাথে কখনও সংঘর্ষে জড়ায় না। কেননা, বিজ্ঞান, শিল্প ও প্রযুক্তি যে কাজটা করে তা হল জীবনের বাইরের উপকরণ ও ধরন-পদ্ধতিকে উন্নত করে দেয়।

এ পর্যায়ে দু’টি উদাহরণের সাহায্যে আধুনিকতার প্রশ্নে ইসলামের অবস্থানকে স্পষ্ট করার প্রয়াস চালান যাক।

এক. পবিত্র কুরআনের একটি বিধান হল :

وَلَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُم بَيْنَكُم بِالْبَاطِلِ

‘তোমরা একে অন্যের ধন বাতিল ভাবে ভক্ষণ কর না।’

মূলত অবৈধ লেনদেন এবং তদসূত্রে অর্থ গ্রহণের বিষয়ে এ নিষেধাজ্ঞা। ফকীহগণ বলেন, ইসলাম যেহেতু নাপাক দ্রব্যসমূহ হারাম করেছে, কাজেই তা কেনা-বেচা জায়েয নয়। এটা বাতিল লেনদেনের মধ্যে গণ্য হয়। যেমন রক্ত। সে যুগে রক্তের ব্যবহার ছিল পান করার কাজে। ইসলাম রক্তপান নিষিদ্ধ করেছে। কাজেই সে যুগে রক্তের বেচাকেনা স্বভাবতই নিষিদ্ধ করা হত। কিন্তু যদি সময় বদলে যায় এবং রক্তের হারাম ব্যবহারের পরিবর্তে নানাবিধ উপকারী ও জীবনদায়ক ব্যবহার আবিষ্কৃত হয়, যা ইসলাম অনুমোদন করে, তাহলে এর বেচাকেনার হুকুমও বদলে যাবে স্বাভাবিকভাবেই। যেমন এ রক্তের কথাই ধরুন। বর্তমানে এক মানুষের রক্ত অন্য মানুষের দেহে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইসলামের নিষেধাজ্ঞা ছিল, রক্ত অপবিত্র এবং অপবিত্র জিনিস খাওয়া হারাম। কাজেই খাওয়ার উদ্দেশ্যে রক্ত কেনা-বেচা করা হারাম এবং এতদ উপায়ে অর্জিত অর্থও হারাম। কিন্তু রক্তের অন্যান্য উপকারী ব্যবহার, যেমন মেডিকেল পদ্ধতিতে একের রক্ত অন্যের দেহে ব্যবহার করে জীবন রক্ষা করা, তাহলে সেক্ষেত্রে রক্ত কেনাবেচা নিষিদ্ধ হবে না। অতএব, দেখা গেল, উল্লিখিত আয়াতের নির্দেশ মতে রক্ত কেনাবেচা যদি নিষিদ্ধ হয়ে থাকে, আজ তা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখন তা আর বাতিল লেনদেনের মধ্যে গণ্য নয়। কাজেই নিষিদ্ধ নয়। এখানে কুরআনের বিধান অক্ষুন্ন ও শাশ্বত রয়েছে, বদলে গেছে শুধু হুকুমের বিষয়বস্তু। আর সেসূত্রে ঐ বিষয়ের বিধানও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এটা ইসলামের নাসখ (রহিত) হয়ে যাওয়া নয়। ইসলামের বিধি-বিধান অপরিবর্তনীয় ও শাশ্বত। বদলে যায় বিষয়বস্তু। তখন উক্ত বিষয়বস্তুর হুকুমও বদলে যায়।

দুই. ইসলামের ফেকাহ শাস্ত্রে একটি অধ্যায় রয়েছে ‘সাব্ক ওয়া রামায়াহ্’ শিরোনামে। এর অর্থ হল ‘সওয়ারী বিদ্যা ও তীরন্দাজি।’ প্রত্যেক মুসলমানের জন্য মুস্তাহাব কাজ হল অশ্ব চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা। তীরন্দাজিও একটি মুস্তাহাব কাজ। এখন কেউ বলতে পারে, ইসলামী ফেকাহর এ অধ্যায়টি আধুনিক যুগে অকেজো হয়ে গেছে। কারণ, এ যুগে না অশ্ব চালনার কোন প্রয়োজন পড়ে, আর না তীরন্দাজির। অথচ গভীর গবেষণায় দেখা যাবে, এ বিধানের আবেদন আধুনিক যুগে বিন্দুমাত্র হ্রাস তো পায়নি, উপরন্তু এর অপরিহার্যতাই প্রমাণিত হবে। কারণ, ‘সাব্ক ওয়া রামায়াহ’ অধ্যায়টি ফেকাহ্য় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কুরআনের একটি শাশ্বত বিধানের প্রেক্ষিতে। ইরশাদ হচ্ছে :

وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّ‌بَاطِ الْخَيْلِ

 ‘এবং তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য যথাসম্ভব শক্তি ও অশ্ব প্রস্তুত কর।

ইসলাম একটি সামাজিক ধর্ম এবং মুসলিম জাতির প্রতিরক্ষায় একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। মুসলমানরা শত্রুর মোকাবিলায় সর্বোচ্চ শক্তির অধিকারী থাকবে। তাই সেদিন অশ্বচালনা ও তীরন্দাজি সুন্নাত করা হয়েছিল যাতে তার সৈন্যরা রণাঙ্গণে অস্ত্রসজ্জিত ও শক্তিশালী থাকে। এ বিধানের একটি আত্মা রয়েছে যার ওপরে অশ্বচালনা ও তীরন্দাজির জামা পরানো হয়েছে। আত্মা অপরিবর্তনীয়, রহিত হওয়ার নয়। কিন্তু ওপরের জামাটা পরিবর্তনীয়। পরবর্তীকালে যখন ‘তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য যথাসম্ভব শক্তি ও অশ্ব প্রস্তুত কর’ নির্দেশটি বাস্তবায়নের জন্য অন্য কোন ধরন-পদ্ধতি এসে সে স্থান দখল করবে, তখন এ হুকুম তার জন্য পরিবর্তিত হবে।

পরিশেষে বলা যায়, ইসলাম মানব জীবন ও সমাজের প্রয়োজনগুলোকে দু’ধরনের মনে করে : পরিবর্তনশীল এবং অপরিবর্তনশীল। যে প্রয়োজনগুলো পরিবর্তনশীল তার জন্য ইসলামের বিধানগুলোও পরিবর্তনশীল ও অতিশয় নমনীয়। কিন্তু যেগুলো অপরিবর্তনশীল, সেগুলোর বিধান অপরিবর্তনীয় রেখেছে। সর্বোপরি, উক্ত পরিবর্তনশীল বিধানগুলোকে বিজড়িত করেছে অপরিবর্তনশীল বিধানগুলোর অধীনে। ফলে একজন মুসলিম পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীর জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, তিনি বলবেন, এখন বিষয় বদলে গেছে। তিনি বলে দিবেন : এখন আগ্নেয়াস্ত্রের সময় এবং জঙ্গি বিমান, মিগ ও ফ্যান্টমের যুগ। তাই সেটাই প্রস্তুত কর। কারণ, তীর বা ধনুকের প্রতি ইসলামের আলাদা কোন আকর্ষণ নেই। ইসলাম শক্তি অর্জন ও সংহতির কথা বলে। এটাই এ বিধানের আত্মা। আর তীরধনুক সংগ্রহ করবে নাকি আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করবে, এটা দেহ ও শরীরতুল্য, যা যুগের প্রয়োজন অনুযায়ী নির্ধারিত হবে।

তথ্যসূত্র ও টীকা

১. সূরা যুমার, আয়াত নং ৩০

২. সূরা হিজর, আয়াত নং ৯

৩. সূরা রূম, আয়াত নং ৩০

৪. সূরা রা’দ, আয়াত নং ১৭

৫. পরিবর্তন হল সৃষ্টির এরূপ একটি বিষয় (principle)।

৬. সূরা বাকারা, আয়াত নং ১৮৮

৭. শখের বশে কিম্বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের কথা ব্যতিক্রম।

৮. সূরা আনফাল, আয়াত নং ৬০

৯. আজ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বাধুনিক সামরিক শক্তিকে সজ্জিত হওয়ার কথা এখানে প্রণিধানযোগ্য।  

(সূত্র:প্রত্যাশা,১ম বর্ষ,৪র্থ সংখ্যা)

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)