বাহরাইনে ইসলামি জাগরণের বর্তমান ও ভবিষ্যত

বাহরাইনে ইসলামি জাগরণের বর্তমান ও ভবিষ্যত
পারস্য উপসাগরীয় দেশ বাহরাইনে এখনও সরকারবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। রাজতন্ত্র অবসানের দাবিতে সেখানে মাঝে মধ্যেই বিক্ষোভ হচ্ছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হামলায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বাহরাইনের গণ জাগরণের খবরকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। এখানে আমরা বাহরাইনে চলমান আন্দোলনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমাজের নীরবতা এবং দেশটির আন্দোলনের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পাবো।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে উত্তর আফ্রিকায় ইসলামি জাগরণ শুরু হয়। এর দুই মাস পর ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওই জাগরণের ঢেউ বাহরাইনের মজলুম জনতাকে উজ্জীবিত করে। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হওয়ার পরও ওই আন্দোলন সফল হয়নি। গণআন্দোলন সফল না হবার সবচেয়ে বড় কারণটি হলো, বাহরাইনের আলে খলিফা সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক সাহায্য ও সহযোগিতা। গত এক বছর ধরে আন্দোলন চলে আসলেও পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলো এ সংক্রান্ত খবর এড়িয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতেই মিডিয়া এ নীতি গ্রহণ করেছে। পাশ্চাত্য এবং তাদের আঞ্চলিক মিত্র দেশগুলো শুরু থেকেই বাহরাইন ইস্যুতে দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করছে। তারা যে করেই হোক বাহরাইনের রাজাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে চাইছে। কারণ বর্তমান রাজতান্ত্রিক সরকার সব সময় পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহর বাহরাইনে মোতায়েন রয়েছে। সৌদি রাজার প্রতি বাহরাইনের আনুগত্য এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, অনেকে বলছেন দেশটি হয়তো সৌদি আরবের সঙ্গে মিশে যাবে।
বাহরাইন সরকার গণআন্দোলন দমনের জন্য সৌদি সেনাদেরকে নিজ দেশে ডেকে এনেছে। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশে আন্দোলন হয়েছে এবং হচ্ছে,তার কোনটিতেই আর এমন ঘটনা ঘটেনি। উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে গণজাগরণ শুরুর পর যেসব ইউরোপীয় দেশ ভবিষ্যতে স্বার্থের কথা ভেবে স্বৈরাচারদের প্রতি সমর্থন বন্ধ করে দিয়েছিল সেসব দেশও বাহরাইন ইস্যুতে গণবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরামর্শের পর সৌদি আরব বাহরাইনে শত শত সেনা পাঠিয়েছে। সৌদি আরব, বাহরাইনে যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাহরাইনি ও সৌদি সেনারা যৌথভাবে আন্দোলন দমনে নামলেও মুক্তিকামী জনতার কণ্ঠরোধ করতে পারেনি।
বাহরাইনের ইসলামি জাগরণের অন্যতম নেতা আয়াতুল্লাহ শেইখ ঈসা কাসেম সম্প্রতি আন্দোলন শুরুর বার্ষিকীতে বলেছেন, "কোনো কিছুই বাহরাইনের গণবিপ্লবকে স্তব্ধ করতে পারবে না। জনসচেতনতা আরো বাড়বে এবং যারা এখন পর্যন্ত আন্দোলনে যোগ দেয়নি তারাও সজাগ হচ্ছে। খুব শিগগিরি তারাও আন্দোলনে শামিল হবেন।" তার এ ভাষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে,বাহরাইনের আন্দোলনকারীদের মনোবল নষ্ট হয়নি বরং আগের চেয়ে আরো বেড়েছে।
বাহরাইনের ইসলামি জাগরণের সাফল্য ও ব্যর্থতার ওপর অনেকগুলো বিষয় নির্ভর করছে। বাহরাইনে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সরকারের পতন হলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র আরো একটি মিত্র হারাবে যা ইসরাইলের জন্যও মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনবে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দেশগুলো বাহরাইনের গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তারা একদিকে সিরিয়ায় গণতন্ত্রের কথা বলে দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছে। আর অন্যদিকে বাহরাইনে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলরত জনতাকে দমন করতে স্বৈরাচারী রাজাকে অস্ত্র দিচ্ছে। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান এ সম্পর্কে লিখেছে," বাহরাইনে আন্দোলন শুরুর পর কয়েক মাসেই দেশটির সরকারকে দশ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের অস্ত্র সরবরাহ করেছে ব্রিটেন। ব্রিটেনের সরবরাহকৃত অস্ত্র হালকা ধরনের এবং এসব অস্ত্র আন্দোলন দমনে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে পত্রিকাটি জানিয়েছে।
বাহরাইন হচ্ছে সাতশ' বর্গ কিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট একটি ছোট্ট দ্বীপদেশ এবং এর জনসংখ্যা মাত্র দশ লাখ। কিন্তু কৌশলগত দিক থেকে বাহরাইনের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। কৌশলগত গুরুত্বের কারণে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিতে তার পঞ্চম নৌবহর মোতায়েন রেখেছে। বাহরাইনে বসেই মার্কিন কমাণ্ডারেরা পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর ও আফ্রিকা উপকূলে মোতায়েন তাদের যুদ্ধজাহাজগুলোকে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। বাহরাইনের রাজধানী মানামার অদূরে জুফাইর এলাকায় ৩০টি যুদ্ধ জাহাজ এবং তিন হাজার নাবিক মোতায়েন রেখেছে তারা। এছাড়া, মার্কিন নৌ বাহিনী বাহরাইনে তাদের নৌঘাঁটি সম্প্রসারণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ২৮ হেক্টর জমিতে চার পর্বে ওই সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে এবং এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৮ কোটি ডলার। বাহরাইনে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখাও দেশটির রাজতান্ত্রিক সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের একটা বড় কারণ। তবে শুধু সামরিক নয় রাজনৈতিক দিক থেকেও বাহরাইনের গুরুত্ব রয়েছে। বাহরাইন হচ্ছে পারস্য উপসাগরীয় দেশ। এ কারণে দেশটি পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা পিজিসিসি'র অন্যতম সদস্য। এ পরিষদের অন্য সদস্য দেশগুলো হচ্ছে সৌদি আরব, কুয়েত,কাতার, ওমান এবং আরব আমিরাত। প্রতিটি দেশেই রয়েছে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এবং প্রতিটি দেশের সরকার মার্কিন সমর্থনপুষ্ট। এর একটি দেশে যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে তা অন্য সদস্য দেশগুলোতেও এর প্রভাব পড়বে এবং ওই সব দেশেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি উঠবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চায় না ওই সব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিক হোক। ওই সব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ইসরাইলের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হবে। বাহরাইনে গণআন্দোলন সফল হলে সৌদি আরবেও আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে পাশ্চাত্যের আশংকা। কারণ এরইমধ্যে সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে ইসলামি জাগরণ শুরু হয়ে গেছে এবং সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে সেখানে এ পর্যন্ত বহু বিক্ষোভকারী হতাহত হয়েছে। তবে আন্দোলন থেমে নেই।
আসলে জনগণের দাবি-দাওয়াকে উপেক্ষা করে ক্ষমতায় টিকে থাকার যুগ শেষ হয়ে গেছে। এ কারণে হত্যা-নির্যাতন চালিয়ে আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্যকে কিছুটা বিলম্বিত করা গেলেও স্বৈরাচারীদের পতন অনিবার্য। এ কারণেই বাহরাইনে সরকারি বাহিনীর ব্যাপক দমন-নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ সত্ত্বেও আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে এবং আগে হোক পরে হোক গণআন্দোলন বিজয় লাভ করবেই। দেশটির ইসলামপ্রিয় মানুষ,তাদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেছে।(রেডিও তেহরান)