ইসলামী সন্ত্রাস : বাস্তবতা না কল্পকথা?

ইসলামী সন্ত্রাস : বাস্তবতা না কল্পকথা?

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রহস্যজনক ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে,বিশেষ করে দেশটির মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। মুসলমানরা এ হামলা চালিয়েছে বলে দাবি ও প্রচার করা হয় এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ এজন্য ক্রুসেড ঘোষণা করেছিলেন। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানসহ কোন কোন দেশ ঐ ঘটনা ঘটার পর পরই সন্ত্রাসী প্রকৃতির ঐ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছিল।

মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন মাজহাব,গ্রুপ ও প্রবণতা সক্রিয় থাকায় কথিত ইসলামী সন্ত্রাসের ব্যাপারে আলোচনার জন্য কট্টর বা র‌্যাডিক্যাল ইসলামপন্থী ও ইসলামী পুনর্জাগরণবাদী তৎপরতাগুলোর স্বরূপ সম্পর্কে জানা দরকার। এসব প্রবণতা ও ধারার মধ্যে কোন্ ধারাটি ইসলামী সন্ত্রাসের সাথে সম্পর্কিত? মুসলমানদের `সন্ত্রাসী’ হিসাবে চিত্রিত করার ক্ষেত্রে তালেবান ও আল-কায়েদা গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষক তথা ওয়াহাবী মতবাদ বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখছে কিনা তাও আমরা বিশ্লেষণ করব।

এটা স্পষ্ট যে,পবিত্র ধর্ম ইসলাম সন্ত্রাসবাদ বা সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরোধী।

নিউইয়র্কে বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের টুইন টাওয়ারে এবং পেন্টাগন ভবনে হামলার পর পাশ্চাত্যে ‘জিহাদ’ শব্দটির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। কোন কোন পশ্চিমা সংবাদ ও গণমাধ্যম আল কায়েদার আর্থিক অবস্থানকে ‘জিহাদিজম’ বলে উল্লেখ করছে। এ হামলার পর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবলিও বুশ ‘ক্রুসেড’ শব্দ ব্যবহার করায় মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে ওয়াশিংটনের নিওকন বা নব্য রক্ষণশীলদের মনোভাব স্পষ্ট হয়। এরই আলোকে মুসলমানদের জড়িয়ে ইসলামী ফ্যাসিস্ট শব্দটিও ব্যবহার করা হচ্ছে। মার্কিন কর্মকর্তারা ও তাদের সহযোগী একদল তাত্ত্বিক ইসলামী আন্দোলনগুলোকে ‘গ্রীন ফ্রন্ট’ বা সবুজ আন্দোলন বলে অভিহিত করছে। এক সময় পাশ্চাত্য কমিউনিস্টদের তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বলে প্রচার করত। আর এখন অনেকটা সে কায়দায় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে গ্রীন ফ্রন্টকে।

শীতল যুদ্ধের পর পুঁজিবাদের কর্তৃত্ব বিস্তারের জন্য কথিত উদারনৈতিক গণতন্ত্র বা লিবারেল ডেমোক্রেসির একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসাবে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া জোরদারের প্রবণতা লক্ষণীয়। একই সাথে পশ্চিমা সভ্যতা নিজের অভ্যন্তরীণ সংহতি ধরে রাখার জন্য বিজাতীয় শত্রুর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। আর এ শত্রু হিসাবেই বেছে নেওয়া হয়েছে ইসলামকে। ফুকোয়ামার নিম্নোক্ত বক্তব্য এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য : ‘ইসলাম একটি রাষ্ট্রীয়,সুশৃঙ্খল ও স্বচ্ছ আদর্শ। এর রয়েছে সুনির্দিষ্ট নৈতিক বিধান এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার সম্পর্কে স্পষ্ট বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি। ইসলামের আবেদন ও আকর্ষণ অত্যন্ত জোরালোভাবে বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিক। কারণ,এ ধর্মের দৃষ্টিতে সকল মানুষই সমান। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম বিশ্বের এক বিশাল অংশে লিবারেল ডেমোক্রেসির ওপর বিজয়ী হয়েছে এবং লিবারেল ব্যবস্থাগুলোর জন্য ইসলাম খুবই মারাত্মক হুমকি। এমনকি যেসব মুসলিম দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় ইসলাম অনুপস্থিত,সে সব দেশেও ইসলাম এক মারাত্মক হুমকি।’

মার্কিন চিন্তাবিদ হান্টিংটনও ইসলামী ও পশ্চিমা সভ্যতা বা জীবনাদর্শের মধ্যে দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকবে বলে উল্লেখ করেছেন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক প্রধান জেমস ওলসি এ দুই সভ্যতার দ্বন্দ্বকেই ‘চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর বিশ্ব রাজনীতিতে সন্ত্রাসবাদবিরোধী কথাবার্তা (পশ্চিমা নেতাদের মুখে,বিশেষ করে মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকারের মুখে) যতটা জোরদার হয়েছে অতীতে আর কখনও এমনটি দেখা যায়নি;বরং এর আগে সন্ত্রাসী অনেক দল ও গোষ্ঠী বৃহৎ শক্তিগুলোর আর্থিক,সামরিক ও নৈতিক সমর্থনও পেয়েছে। ২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরে মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী ১৩৭৩ নম্বর প্রস্তাব অনুমোদন করা সম্ভব হয়। ২০০৩ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ২৮টি দল বা সংগঠনকে সন্ত্রাসী বলে ঘোষণা দেয়। এসব দল বা সংগঠনের মধ্যে ১৮টি দল বা সংগঠনই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক। হোয়াইট হাউজ এ সময় থেকেই ইসলামী র‌্যাডিক্যালিজ্মকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসাবে প্রচার করতে থাকে এবং এর মোকাবিলা করাকেই সার্বিক সমাধান বলে সিদ্ধান্ত নেয়। হোয়াইট হাউজের দৃষ্টিতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধের সময় যেভাবে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসীবাদ এবং শীতল যুদ্ধের সময় কমিউনিজম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হিসাবে বিবেচিত হয়েছে,তেমনিভাবে ইসলামী ফ্যাসিবাদ ও ইসলামী সন্ত্রাসবাদ এ দেশটির জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আর ইসলামী ফ্যাসিবাদ ও ইসলামী সন্ত্রাসবাদের হোতা বা মদদাতা হচ্ছে প্রথম সারিতে আফগানিস্তান,ইরাক,ইরান,সিরিয়া ও লেবানন এবং দ্বিতীয় সারিতে রয়েছে সুদান,লিবিয়া ও ফিলিস্তিন স্বশাসন কতৃপক্ষ। বল প্রয়োগ করে এসব দেশের সরকার পরিবর্তন করা মার্কিন সরকারের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বা প্রাধান্য পাচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রাজনৈতিক ইসলামের মূল কেন্দ্র বা অক্ষ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই ইরানের ইসলামী সরকারকে উৎখাত করাই মার্কিন পদক্ষেপ বা পকিল্পনাগুলোর চূড়ান্ত লক্ষ্য।

মার্কিন সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে প্রথম পর্যায়ে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে তা দখল করে নেয় এবং আল কায়েদা ও এ সংগঠনের নেতা উসামা বিন লাদেনকে নির্মূলের চেষ্টা চালায়। ফলে পতন ঘটে তালেবান সরকারের এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আল কায়েদা। তালেবানদের পতনে উৎসাহিত বুশ আগেভাগেই হামলা বা অগ্রিম প্রতিরক্ষার নীতি গ্রহণ করে ইরাকে হামলা চালায় ও সাদ্দাম সরকারকে উৎখাত করে। হোয়াইট হাউজ এ যুদ্ধকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় পর্যায় বলে অভিহিত করে। যুক্তরাষ্ট্র কথিত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের তৃতীয় পর্যায়ে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী দলগুলো ও তাদের মদদদাতা দেশগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রামের নীতি ঘোষণা করে। ফুকোয়ামা এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন লেবাননের হিজবুল্লাহ্,ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসলামী জিহাদের মতো দলগুলোকে সামরিক উপায় ছাড়াও রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও মোকাবিলার কৌশল নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ,এসব দলের রয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন। তবে ইসরাইলের লিকুদ দলের নেতারা হিজবুল্লাহ্ বা হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে মার্কিন সরকারকে উস্কানি বা উৎসাহ দিয়ে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নব্য রক্ষণশীলরা কথিত মৌলবাদী আন্দোলনগুলোর মধ্যে শিয়া মুসলমানদের প্রভাবকে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বা চালিকাশক্তি বলে মনে করে। ১৯৭৯ সালে সংঘটিত ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে পশ্চিমা তাত্ত্বিক ও চিন্তাবিদরা ‘মৌলবাদী’ বলে অভিহিত করেছে। ইরানকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবলিও বুশের পক্ষ থেকে ‘এক্সিস অব ইভিল’ বা দুষ্কিৃতির অক্ষ বলে অ্যাখ্যা দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল এ বিষয়টি। নিউ কনজারভেটিভ বা নিওকনদের মতে,ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান মজলুম ফিলিস্তিনীদের এবং লেবাননের গণপ্রতিরোধ আন্দোলন হিযবুল্লাহকেও সহায়তা দেয়। আফগানিস্তানের শিয়ারাও দেশটির সহায়তা পায়। তাই তাদের দৃষ্টিতে মৌলবাদী আল কায়েদা ও ইরানের মধ্যে কোন তফাৎ নেই।

এভাবে ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা ব্যবহার করে গোটা ইসলামী জাহানকেই তারা সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করছে। কিন্তু ইসলাম কি সন্ত্রাসবাদ বা অন্যায় হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে?

ইসলামী সন্ত্রাসবাদ বাস্তবতা,না অলীক কল্পনা?

ভয় দেখিয়ে বা ত্রাস সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টাকেই বলা হয় সন্ত্রাসবাদ। বিরোধীদের দমনের জন্য বা তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সহিংস বা অবৈধ তৎপরতাও সন্ত্রাসবাদ হিসাবে বিবেচিত হয়। এ দ্বিতীয় ধরনের পদক্ষেপকে বলা হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ইসলাম গোপনে কাউকে হত্যা করা বা সন্ত্রাসী পদক্ষেপকে নিষিদ্ধ করেছে। সূরা কাহ্ফ,সূরা মায়েদা ও বনি ইসরাইলে নরহত্যাকে নিষিদ্ধ বলে জানানো হয়েছে। যেমন,সূরা মায়েদার ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,‘এ কারণেই আমি বনি ইসরাইলের প্রতি এ বিধান দিয়েছি যে,কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। আর যে কারও জীবন রক্ষা করে,সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে। আমার পয়গম্বরগণ বনি ইসরাইলের কাছে স্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছে। বস্তুত এরপরও তাদের অনেক লোক পৃথিবীতে সীমালঙ্ঘন করেছে।’

সূরা বনি ইসরাইলের ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,‘সে মানুষকে হত্যা কর না যাকে হত্যা করা আল্লাহ হারাম করেছেন;কিন্তু বৈধ কারণে হত্যা করা ন্যায়সঙ্গত। যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিহত হয়,আমি তার উত্তরাধিকারীকে হত্যার বদলা নেওয়ার বা কাসাসের ক্ষমতা দান করি। অতএব,সে যেন হত্যার ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন না করে। নিশ্চয় সে সাহায্যপ্রাপ্ত।’

আবু সাবাহ্ কানানী নামের এক ব্যক্তি হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করেন,‘আমার এক প্রতিবেশী আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) সম্পর্কে খারাপ কথা বলে,তার ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেওয়ার অনুমতি দেবেন কি?’ তিনি বললেন,‘তুমি কি কিছু করতে পারবে?’ সে বলল,‘আল্লাহর কসম! আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে তার আশপাশে কোথাও গোপনে অবস্থান নেব এবং নাগালের মধ্যে আসা মাত্রই তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করব।’ ইমাম তাকে বললেন,‘হে আবু সাবাহ! তোমার এ কাজ তো গুপ্তহত্যা বা সন্ত্রাস এবং আল্লাহর রাসূল (সা.) তা নিষেধ করেছেন। ইসলাম অবশ্যই গুপ্ত হত্যা বা সন্ত্রাসের বিরোধিতা করে।’

মাসুম ইমামগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে,ঈমান গুপ্তহত্যা বা সন্ত্রাসে বাধা দেয়। একজন মুমিন কখনও সন্ত্রাসে বা গুপ্ত হত্যায় জড়িত হয় না।’

পবিত্র কুরআনের এসব আয়াত ও এসব নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে বোঝা যায়,একজন খুনী,অপরাধী বা হত্যার যোগ্য অপরাধী বা কাফির সেনাকে কেবল ন্যায়পরায়ণ ইমাম বা তাঁর বিশেষ প্রতিনিধি অথবা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার অনুষ্ঠানের পর প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে তদন্ত ও বিচার কাজও হতে হবে প্রকাশ্যে বা কোন রাখ-ঢাক ছাড়াই। এ ধরনের শাস্তির উদ্দেশ্য হল,সমাজে শৃঙ্খলা বিধান ও জনসাধারণের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা। অন্যদিকে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানো হয় রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে। জননিরাপত্তা ও জনগণের শান্তি-শৃঙ্খলায় ব্যাঘাত ঘটানোর উদ্দেশ্যেও গোপনে এ ধরনের হামলা চালানো হয়। কোন ইমাম এ ধরনের তৎপরতার অনুমতি দেননি।

মহান আল্লাহ্ সূরা নিসার ৮৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন,‘যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে;আর যারা কাফির তারা তাগুতের (শয়তানের) পথে লড়াই্ করে;তাই তোমরা জিহাদ করতে থাক শয়তানের পক্ষাবলম্বনকারীদের বিরুদ্ধে,(দেখবে,) শয়তানের ষড়যন্ত্র একান্তই দুর্বল’

ইসলামী জিহাদের উদ্দেশ্য হল,দুর্বল,বঞ্চিত ও নিপীড়িত লোকদের কুফরি বা তাগুতি শক্তির হাত থেকে মুক্ত করা। শিয়া রাজনৈতিক ফিকাহ শাস্ত্রে সন্ত্রাস বলতে ভয় দেখানোর জন্য অস্ত্র ব্যবহার,প্রতিপক্ষকে অসচেতন বা অসতর্ক অবস্থায় হত্যা করা এবং শত্রুকে আশ্রয় দেওয়ার পরও হত্যা করা বা তার ওপর নির্যাতন করাকে বোঝায়। গোপন প্রতিহিংসা ও অযৌক্তিক বা অন্ধ-বিদ্বেষ এ ধরনের তৎপরতায় প্রেরণা যোগায়। শিয়া ফিকাহ অনুযায়ী এ ধরনের তৎপরতা তথা সন্ত্রাস পবিত্র কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশ ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের খেলাফ।’

পাশ্চাত্যের বিশিষ্ট ইসলাম বিশেষজ্ঞ বার্নার্ড লুইসও মনে করেন ইসলাম খুব স্পষ্টভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করে। এমনকি ইসলাম আত্মহত্যারও বিরোধিতা করে। ইসলামের যুদ্ধনীতি মোতাবেক সব অবস্থাতেই শিশু,বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও বেসামরিক মানুষকে যুদ্ধের সময় নিরাপত্তা দিতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে রাসায়নিক ও পরমাণু বোমার মতো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারও হারাম। বার্নার্ড লুইস বলেছেন,‘ঐতিহ্যবাহী ধারার ইসলামী আইন অনুযায়ী ফতোয়া দেওয়ার যোগ্যতা উসামা বিন লাদেনের নেই। কারণ,তিনি আলেম নন। বিন লাদেনের ফতোয়া দেওয়া হিটলার কর্তৃক পোপ নিয়োগ দেওয়ার কিংবা লেনিনের মাধ্যমে রাশিয়ার অর্থডক্স গীর্জায় নির্দেশনামা জারি করার সমতুল্য।...

পবিত্র কুরআন ও হাদীসে সন্ত্রাস নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তালেবান ও আলকায়দার মতো দলগুলো মুসলিম বিশ্বে আত্মঘাতি হামলা চালিয়ে বা বোমা হামলা চালিয়ে নিরপরাধ ও বেসামরিক মুসলমানদের হত্যা করছে। আর এসব কাজে কুরআন ও হাদীসের সমর্থন রয়েছে বলে দাবি করেছে। আসলে এটা সঠিক বাক্যকে ভুল কাজে ব্যবহারের দৃষ্টান্তের মতো।

‘জিহাদ ধর্মের অন্য কাজগুলোর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ’-এমন মত দেওয়া হয়েছে লেখক ইবনে তাইমিয়ার আসসিয়াসাত আশ শারিয়া গ্রন্থে। উগ্র ইসলামপন্থী মৌলবাদীরা ওয়াহাবীদের সৃষ্ট নানা বিদ‘আতে প্রভাবিত হয়েছেন। আর এরই আলোকে অনেকে ইসলামী সন্ত্রাসের ওপর তত্ত্ব বা থিওরি দাঁড় করাচ্ছেন। এসব তত্ত্বের না আছে বুদ্ধিবৃত্তিক বা যৌক্তিক ভিত্তি,না আছে কুরআন বা হাদীসের বর্ণনার সমর্থন। ফলে পবিত্র জিহাদ বা ইসলামী জিহাদ যে সন্ত্রাসের বিরোধী সেই ধারণা ধোঁয়াশাযুক্ত বা অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আসলে ইসলামের নামে প্রচলিত যেসব ধারা ইসলামের মূল চেতনা তথা তাওহীদের চেতনার সাথে সমন্বিত নয় সেসব ধারা আধুনিক মতবাদগুলোর খপ্পরে পড়বে,এটাই স্বাভাবিক। অতি উগ্র ইসলামী মৌলবাদীদের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। আল কায়েদার ‘পছন্দের ইসলামে’ লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার হিসাবে সন্ত্রাস সমর্থনযোগ্য। অথচ প্রকৃত ইসলামে সৎ বা অসৎ যে কোন উদ্দেশ্যে সন্ত্রাস বৈধ নয়। পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত,রাসূলল্লাহ (সা.)- এর তৎপরতা ও পবিত্র ইমামগণের বর্ণনা থেকে এ বিষয়টি দিবালোকের মতই স্পষ্ট।

ইসলামে জিহাদের ধারণা

ইসলামে জিহাদ কারও কারও দৃষ্টিতে কেবল প্রতিরক্ষামূলক ও প্রাথমিক। প্রাথমিক জিহাদকেই অনেকে প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ বলে মনে করেন। আবার কেউ কেউ এ ধরনের জিহাদকে পথ নিষ্কণ্টক করার জিহাদ বলে মনে করেন। বিজাতীয়রা যদি ইসলামী রাষ্ট্রে হামলা চালায় তখন এ ধরনের প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ ফরয হয়ে পড়ে। বিজাতীয়দের হামলা যদি সাংস্কৃতিক হয় বা প্রচারণাগত হয় এবং এসবের প্রভাবে যদি সমাজে মূর্তিপূজা ও শিরক প্রচলিত হয় তাহলে একত্ববাদকে রক্ষার জন্য বিদ্রোহ করা যায় বলে অনেকে মনে করেন। আর এ ধরনের জিহাদের চেতনাও মূলত প্রতিরক্ষামূলক এবং এ ধরনের জিহাদকে প্রাথমিক হিজাদ বলে তাঁরা উল্লেখ করেছেন।

ব্যাপকতর অর্থে আল্লাহর রাস্তায় যে কোন প্রচেষ্টাই জিহাদ। ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুসলমানের পুরো জীবনটাই জিহাদী জীবন। সৎ কাজ করা ও পাপ বা মন্দ থেকে দূরে থাকার জন্য প্রচেষ্টা চালানো জরুরি। ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মীয় ও পার্থিব বা দুনিয়াবী কাজকর্ম পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই মুমিনের পুরো জীবনটাই জিহাদ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের দেশ থেকে বের করেনি,তাদের সাথে সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ্ তোমাদের নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ্ ইনসাফকারীদের ভালবাসেন। আল্লাহ্ কেবল তাদের সাথে বন্ধত্ব করতে নিষেধ করেন,যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে,তোমাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে এবং এ কাজে সহায়তা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে তারাই জালেম।’

শিয়া মুসলমানদের সমস্ত ফিকাহ্ ও সুন্নি মুসলমানদের বেশিরভাগ ফিকাহ,বিশেষ করে বর্তমান যুগে কেবল প্রতিরক্ষামূলক জিহাদকেই সমর্থন করে। সুন্নী আলেম মুহাম্মাদ শালতুতের ফতোয়াও এর দৃষ্টান্ত।

খ্রিস্টীয় ১২৫৮ সালে মোঙ্গলরা বাগদাদ দখল করে। ফলে মুসলিম বিশ্বের ওপর বাগদাদের কয়েক শতকের কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। এ অবস্থায় ওয়াহাবী মতবাদের প্রধান পূর্বসূরি বা পথিকৃৎ ইবনে তাইমিয়া মোঙ্গল শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তাঁর মতে মোঙ্গলরা ইসলামের সীমানা লঙ্ঘন করেছিল। তিনি জিহাদকে হজ্জ ও নামাযের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন এবং যারা জিহাদে অংশ নেবে না তারা কালেমা শাহাদাত উচ্চারণকারী হওয়া সত্ত্বেও কাফির ও তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে বলে তিনি ঘোষণা করেন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে দেশটি দখল করে নেওয়ার পর ইসলামী উগ্রপন্থীদের জিহাদী ও রাজনৈতিক তৎপরতায় বড় ধরনের পরিবর্তন বা গতিশীলতা দেখা দেয়। পরবর্তীকালে এরই ভিত্তিতে ধর্মীয় সহিংসতাও দানা বাঁধে ।

ইসলামী জাগরণবাদী রাজনৈতিক ধারার মধ্যে দু’টি দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট। একটি হচ্ছে কট্টর বা উগ্র ইসলামী মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্যটি শিয়া মুসলমানদের ইসলামী বিপ্লব। এ দুই ধারা সম্পর্কে এখন আমরা আলোচনা করব।

ইসলামী মৌলবাদ

ইসলামী মৌলবাদ বলতে মূলত ইসলামের মূলনীতির দিকে ফিরে যাওয়াকে বোঝানো হয়। বিংশ শতকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রোটেস্টান্ট আন্দোলনের ঘরোয়া বিতর্কে ফান্ডামেন্টালিজম বা মৌলবাদ শব্দের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইয়াহুদী,ইসলামী,বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের কিছু ধারা জোরদার হয়ে ওঠে। এ ধারাকে পিটরাল বার্গার ধর্মনিরপেক্ষতাবিরোধী ধারা বলে উল্লেখ করেছেন। এ সময় থেকেই মৌলবাদ বা মৌলবাদী শব্দটির ব্যবহার বাড়তে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও বিশেষ করে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর থেকে এ শব্দের ব্যবহার আরও ছড়িয়ে পড়ে। এ পর্যায়ে হান্টিংটন ও বার্নার্ড লুইসের মতো কোন কোন চিন্তাবিদ এ তত্ত্ব তুলে ধরেন যে,ভবিষ্যতের দ্বন্দ্ব বা সংঘাত হবে ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মধ্যে।

ইসলামী মৌলবাদ স্যেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে পশ্চিমা সভ্যতার অবদান বলে মনে করে এবং উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো এ মতবাদকে মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করে। ইসলামী মৌলবাদ ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে সুদৃঢ় বন্ধনের কথা বলে। মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিষ্ঠাতা হাসান আল বান্না ধর্ম ও রাজনীতিকে অবিচ্ছেদ্য বলে উল্লেখ করেছেন। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা ও পাকিস্তানের ধর্মীয় সংস্কারক সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী বিশ্বাস করতেন যে,ইসলাম মানুষ ও সামাজিক জগতের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং কর্তৃত্বশীল রয়েছে। মিশরের ইসলামপন্থী নেতা সাইয়্যেদ কুতবও ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে বন্ধন বা সম্পর্কের প্রতি বৈপ্লবিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন।

মুসলমানদের ক্ষেত্রে মৌলবাদী শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়েছে বিভ্রান্তিকর অর্থে। মৌলবাদ-সংশ্লিষ্ট নয় এমন অনেক বৈশিষ্ট্য বা উপাদানকে এর সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। যাই হোক,কথিত ‘মৌলবাদী বা জাগরণবাদী’ ধারাগুলোর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা উচিত। পাশ্চাত্য র‌্যাডিক্যাল বা কট্টর ইসলামপন্থী বলতে এমন মুসলমানদের বোঝায় যারা রাজনীতিতে ধর্মীয় মূল্যবোধের হস্তক্ষেপের সমর্থক এবং অতি মাত্রায় ফাংশনালিস্ট। এদেরকে উগ্র মৌলবাদী বলেও অভিহিত করা যেতে পারে। এ ধারার অনুসারী মুসলমানরা ধর্মের অন্য যে কোন অংশের চেয়ে জিহাদকে বেশি গুরুত্ব দেয় এবং কোন ধরনের হতাশাবোধকে তারা সহ্য করে না। ইসলামী জাগরণবাদী বলতে যাদের বোঝায় তারাও রাজনীতি ও ধর্মের সম্পর্ককে স্বীকার করে,তবে এসব ইসলামপন্থী সবাই একই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেন না। পুরনো ইসলামী প্রথা বা ঐতিহ্যপন্থীদের সাথে কট্টর ইসলামপন্থীদের মিল থাকলেও তাদের মধ্যে মৌলিক তফাৎও রয়েছে। ধর্মের মূল স্পিরিট বা চেতনার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া ও শুধু ধর্মের বাহ্যিক দিককে গুরুত্ব দেওয়ার বিরোধিতা ইসলামী প্রথা বা ঐতিহ্যপন্থীদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এ ধরনের ঐতিহ্যপন্থীদের অন্যতম হলেন রেনে গেনন,এফ শোয়ান,অধ্যাপক সাইয়্যেদ হাসান নাসর প্রমুখ। এ দুই ধারার মধ্যে প্রধান মিল ও অমিলগুলো হল : উভয় ধারাই আধুনিকতার বা আধুনিকতাবাদের বিরোধী,তবে কট্টর ইসলামপন্থীরা আধুনিকতার বাস্তবতা সম্পর্কে অসচেতন। এরা মূল উৎসের দিকগুলো ও এর পরিণাম সম্পর্কে তেমন মাথা ঘামায় না। তারা মনে করে,আধুনিক যুগে ধর্ম ও নৈতিকতায় বিচ্যুতি সৃষ্টি হয়েছে। কট্টর ইসলামপন্থীদের আধুনিক যুগের সূচনার দিকের ক্যাথলিকদের সাথে তুলনা করা যায়। আধুনিকতার ব্যাপারে ক্যাথলিকদের ওই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ত্রয়োদশ পোপ লুই বিশেষ কিছু ফতোয়া জারি করেছিলেন। অন্য কথায় আধুনিকতার ব্যাপারে এদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট নয়। একদিকে তারা আধুনিকতাকে শয়তানের কাজ বলে মনে করে;অন্যদিকে আধুনিকতার সুফল পুরোপুরি ভোগ করে যাচ্ছে। কিন্তু ঐতিহ্যপন্থীরা আধুনিকতাকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বলে মনে করে এবং তারা বর্তমান যুগে এ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করাকে জরুরি বলে ভাবে।

প্রতিটি ধর্মেরই রয়েছে তিনটি দিক : শরীয়ত,তরীকত ও হাকীকত। কট্টর ইসলামপন্থীরা কেবল ধর্মীয় বিধান বা শরীয়তের বাহ্যিক দিকগুলোর ওপরই গুরুত্ব দেয়,অন্যদিকে ঐতিহ্যপন্থীরা ধর্মের তরীকতের দিকগুলোকে শরীয়তের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয় এবং এজন্যই তারা ধর্মের ভাষাকে প্রতীকী মনে করে ও এসবের সুপ্ত অর্থ রয়েছে বলে ধারণা করে।

রাজনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্রেও উগ্র মৌলবাদীরা যখন ধর্মের কথা বলে,তখন তারা ধর্ম বলতে শরীয়তকেই বোঝায় এবং যখন শরীয়তের কথা বলে তখন মূলত তাদের পছন্দনীয় বিধি-বিধানগুলোকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এদের মতে ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে বড় মূলনীতি হল,সৎ কাজের আদেশ,আর অসৎ কাজের নিষেধ বা প্রতিরোধ। কল্যাণকামিতার যুক্তিতে তারা এ তৎপরতা চালায় না;বরং তাদের এ তৎপরতা হাত ও মুখের ভাষাতেই সীমিত। অন্যদিকে ঐতিহ্যপন্থীরা একদিকে সুলুক বা খোদাপ্রেমের পথিক ও অন্যদিকে জিহাদেও সক্রিয়।

কট্টর মৌলবাদীরা প্রথম থেকেই ব্যাপক সহিংসতা ও সন্ত্রাসের সমর্থক ছিল। গত শতকের ৯০-এর দশকের পর থেকে মাজহাবী বা ফেরকাগত সহিংসতা জোরদার হয়ে ওঠে।

ইসলামী মৌলবাদ,সন্ত্রাসবাদের আত্মপ্রকাশ ও মাজহাবী বা ধর্মীয় সহিংসতা

আরব বিশ্বের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে রাজনৈতিক ইসলামের চর্চা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। অন্যান্য আরব অঞ্চলও এতে প্রভাবিত হচ্ছে। মিশর ও সৌদি আরব এরকম দু’টি অঞ্চলের দৃষ্টান্ত। এ দুই অঞ্চলেই বিংশ শতাব্দীর ২০-এর দশকে ব্যাপক মাত্রায় ইসলামী রাজনৈতিক ধারা বা আন্দোলন গড়ে ওঠে। এসব আন্দোলন আশপাশের আরব দেশগুলোকেও প্রভাবিত করেছে।

গত তিন দশকে উগ্র মৌলবাদ ও সহিংসতার মাত্রা তীব্রতর হয়েছে। ষাটের দশকের শেষের দিকে ও সত্তরের দিকে আরব বিশ্বের পশ্চিমাঞ্চলে সাইয়্যেদ কুতবের লেখার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ইসলামপন্থী গ্রুপগুলো ইসলামী র‌্যাডিক্যালিজমকে জোরদার করে। এ গ্রুপগুলো সে সময় আরব বিশ্বের সরকারগুলোর বিরুদ্ধে মারমুখী হতে চেয়েছে। আশির দশকের শেষের দিকে মিশরের ইসলামী গ্রুপগুলো দেশটির সরকারী নেতাদের হত্যা করার ও শারীরিক হামলার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ সময় তাদের কর্মী ও সমর্থকরা পুলিশের সাথে রাস্তায় রাস্তায় ব্যাপক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

গত ৭০-৮০ বছরে ইসলামী আন্দোলনগুলো অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের সম্মুখীন হয়েছে। এ সময়ে অর্থাৎ মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমিন সংগঠন গড়ে ওঠার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তিন ধরনের সহিংসতা দেখা গেছে। এক. প্রতিক্রিয়ামূলক সহিংসতা। দুই. আদর্শিক বা মতাদর্শগত সহিংসতা। তিন. মাজহাবী বা ফেরকাগত সহিংসতা। প্রতিক্রিয়ামূলক সহিংসতা ঘটেছে ১৯৪০ থেকে ১৯৬০-এর দশকে সরকারগুলোর দমন নীতির জবাবে। মতাদর্শগত সহিংসতা ঘটে ১৯৬০ থেকে ১৯৮০-এর দশকে রাজনৈতিক সরকারগুলোকে উৎখাতের লক্ষ্যে। তৃতীয় পর্যায়ের সহিংসতা লক্ষ্য ও হতাহতের দিক থেকে প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের সহিংসতার তুলনায় খুবই ব্যাপক। বহু নিরপরাধ ও সাধারণ মানুষ এ শেষোক্ত সহিংসতায় উগ্র ইসলামপন্থীদের হাতে নিহত হয়েছে।

আরব উপদ্বীপ (জাজিরাতুল আরব) ও তার আশপাশের অঞ্চলে ওয়াহাবীরা অন্যদের চেয়ে নিজেদের উন্নত মুসলমান বলে মনে করে। এরা অন্য মুসলমানদের,বিশেষ করে শিয়া মাযহাবের অনুসারীদের বিশ্বাস ও চিন্তাধারার কঠোর বিরোধী। তারা শিয়াদের শুধু বিদ‘আত বা কুপ্রথাপন্থী বলেই মনে করে না,একই সাথে তাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ,নির্মূল অভিযান ও তাদের পবিত্র ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোকেও ধ্বংস করার পদক্ষেপ নিয়েছে। উনিশ শতকের শেষের দিকে ও বিশ শতকের প্রথম দিকে ইরাকে অবস্থিত মুসলমানদের পবিত্র স্থানগুলোর ওপর হামলা চালায় ওয়াহাবীরা। তারা সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালায় ও ইমামগণের মাজার ধ্বংস করে। ১৯৯৭ সালে আফগানিস্তানের মাজার শরীফে হত্যা করা হয় বেশ কয়েকজন ইরানী কূটনীতিককে। ওয়াহাবী চিন্তাধারায় প্রভাবিত গ্রুপগুলো এখনও ইরাক ও পাকিস্তানে মুসলমানদের ওপর প্রায়ই সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে। (এমনকি বাংলাদেশেও নিরীহ অনেক সুন্নী মুসলমান উগ্র ওয়াহাবী চিন্তাধারায় প্রভাবিত গ্রুপ জেএমবি’র হামলায় নিহত হয়েছে।-অনুবাদক) ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের ঘটনাবলী এবং ওয়াহাবী মতবাদের পৃষ্ঠপোষক সৌদি সরকারের অর্থনৈতিক সামর্থ্য ও প্রচারণার জোরে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ওয়াহাবী চিন্তাধারা ছড়িয়ে পড়েছে। সহিংসতাকামী মুসলিম গ্রুপগুলোর বিস্তারের পেছনে কেবল এ দু’টি কারণই কাজ করছে বলে মনে করা যায় না। কারণ,অতীতে বর্তমান যুগের সহিংসতার মতো সহিংসতা দেখা যায়নি।

১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার আগের বিবৃতিগুলো পর্যালোচনা করলে এটা বোঝা যাবে যে,আল কায়েদা যতটা ধর্মকেন্দ্রিক দল,তার চেয়েও বাস্তবে বেশি রাজনৈতিক দল। হান্টিংটনের ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ শীর্ষক তত্ত্বের সাথে সুর মিলিয়ে বিন লাদেনও তার যুদ্ধের বৈশিষ্ট্যকে ‘মুসলিম জাতিগুলোর বিরুদ্ধে মার্কিন ক্রুসেডের যুদ্ধ’ বলে নামকরণ করেন। বিন লাদেন তার যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর সাথে মুসলিম বিশ্বের যুদ্ধ বলে মনে করেন।

বিন লাদেন ১৯৯৬ সালের ২২ আগস্টের এক ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রকে দুই পবিত্র বা পুণ্যভুমির দেশ দখলকারী বলে অভিহিত করেছেন। তার ঐ ‘বিশ্ব-ঘোষণায়’ এটাও বলা হয় যে,সৌদি সরকার ইসলামী আইন উপেক্ষা করায় ও মার্কিন ক্রুসেডারদের এই দেশ দখলের সুযোগ দেওয়ায় বৈধতা হারিয়েছে। ১৯৯৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির এক ফতোয়ায় বিন লাদেন ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ইসলামী জিহাদ ফ্রন্ট গড়ার ঘোষণা দেন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো আল্লাহ্,তাঁর নবী ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করায় এসব দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কথা বলা হয় এ ফতোয়ায়।

আল কায়েদা পাশ্চাত্যকে ধ্বংসের চেষ্টা করছে বলে অনেক গবেষক মনে করেন। কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন এ ধারণা ঠিক নয়। অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক জে. বুর্ক মনে করেন,পশ্চিমা সভ্যতাকে ধ্বংস করা ইসলামী প্যারামিলিশিয়াদের লক্ষ্য নয়;বরং তারা পাশ্চাত্যকে আগ্রাসী বলে মনে করে এবং পাশ্চাত্যকে আক্রমণাত্মক অবস্থান বা আগ্রাসন থেকে পিছু হটতে বাধ্য করাই তাদের উদ্দেশ্য। তারা আরও মনে করে পাশ্চাত্য তার বিশেষ প্রকল্প বা পরিকল্পনা পরিপূর্ণ করার চেষ্টা করছে যার অংশ ছিল ক্রুসেডের যুদ্ধগুলো ও এরপর উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা। এ প্রকল্পের ফলে মুসলিম বিশ্ব খণ্ড-বিখণ্ড ও অপদস্থ হয়।

বিন লাদেন ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০১ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অর্থশক্তি ব্যবহার করে সারা বিশ্বের সমস্ত র‌্যাডিক্যাল ইসলামপন্থীকে নিজের দলে সমবেত করেন। মিশর,জর্দান,আলজেরিয়া,ইয়েমেন,সুদান,সিরিয়া,এমনকি ইরানের কিছু বালুচকেও নিজ দলের আওতাভুক্ত করেন। আসলে র‌্যাডিক্যাল সুন্নি ইসলামপন্থীরা পাশ্চাত্যের সোশাল ডারউইনিজমের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অভিজ্ঞতাবাদ ও ইসলামী বাস্তবতাবাদের প্রয়োগে লিপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ তারা হত্যা ও সহিংসতাকে লক্ষ্য হাসিলের প্রথম ও শেষ পন্থা তথা একমাত্র পথ বলে মনে করেন। অন্য কথায় তারা দৃশ্যত পাশ্চাত্যকে নিজের শত্রু বলে মনে করলেও বাস্তবে ম্যাকিয়াভেলীসুলভ পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাদের এসব পদক্ষেপ যতটা না বুদ্ধিবৃত্তিক বা মূল্যবোধভিত্তিক তার চেয়েও বেশি আবেগপ্রসূত। আর তাই বিন লাদেনের মত ক্যারিজমাটিক ব্যক্তির প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছে তারা। ইসলামপন্থীদের এ ধারা এ ব্যাপারে অসচেতন যে,তারা আসলে সহিংসতা দূর করার নামে অবাধ সহিংসতাকেই পুরোপুরি অনুমোদন করেছে,যা সম্পূর্ণ স্ববিরোধী ও ভুল।

পশ্চিমা চিন্তাবিদদের মতে ইসলামী মৌলবাদ উদ্ভবের কারণ

এক. ইসলামী সভ্যতার জন্য দু’টি মৌলিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছিল দুই দিক থেকে। একটি হল এর অভ্যন্তরীণ অবক্ষয়। আর দ্বিতীয়টি হল গত দুই শতকে মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমা আধুনিকতাবাদের সর্বাত্মক হামলা। ইসলামপন্থীরা মনে করে বর্তমান সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হল ইসলামের ঐতিহ্য ও অতীতের দিকে ফিরে যাওয়া। পশ্চিমা চিন্তাবিদদের সমালোচনার কারণে ঘরের ভেতরই পশ্চিমা আধুনিকতাবাদের মধ্যে চিন্তাগত বিভেদ দেখা দিয়েছে এবং জন্ম নিয়েছে পোস্ট মডার্নিজম বা উত্তর-আধুনিকতাবাদ। এছাড়াও বিশ্বায়নের ফলে ইসলামকে এর সকল দিকসহ পুনরুজ্জীবিত করার উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

জিল কিলের দৃষ্টিতে ইসলাম এক নবীন ও অক্লান্ত শক্তি। এ শক্তি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা ব্যবহার করে। তৃতীয় বিশ্বের এক বিশাল অঞ্চলে এ শক্তি সমীহ বা সম্মান পাবার দাবিদার। তাঁর মতে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার ঘটনাকে কেবল রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান ও পতনের আলোকে অনুধাবন করা সম্ভব। ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী শ্রেণী,আঘাত পাওয়া শহুরে যুব সমাজ এবং ইসলামপন্থী চিন্তাবিদদের মতো তিনটি স্পর্শকাতর শ্রেণীতে রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান ঘটেছে।

বরার্ট ভলটারিংয়ের মতে মুসলিম বিশ্বে মার্কিন সরকার সম্পর্কে খারাপ ধারণার কারণ হল বিশ্বের পরাশক্তি হিসাবে এ সরকার মুসলিম বিশ্বে তার স্বার্থ রক্ষার জন্য দমন-নিপীড়নে অভ্যস্ত সরকারগুলো টিকিয়ে রাখছে।

জার্মান রাজনীতিবিদ উইলি ব্রন্ট ৭০-এর দশকেই এ মত পোষণ করতেন যে,বৈষম্য পৃথিবীকে হুমকিগ্রস্ত করেছে এবং পাশ্চাত্য বিশ্বের একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সহিংসতা প্রজ্বলিত হয়ে উঠবে। বিখ্যাত জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস বলেছেন,এ সহিংসতা এখন সন্ত্রাসবাদের রূপ নিয়ে আমাদের ওপর চড়াও হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করেন,মধ্যপ্রাচ্যের আরব সমাজে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার অভাব,উপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের অভাব,গণতন্ত্র না থাকা এবং মধ্যপ্রাচ্য সংক্রান্ত মার্কিন নীতির জনপ্রিয়তা হ্রাস ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার কিছু কারণ।

দুই.

ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও শিয়া মাযহাবের রাজনৈতিক ইসলামের নিশান

যুক্তরাষ্ট্রের নিউকনজারভেটিভ বা নব্য-রক্ষণশীলরা মৌলবাদী ধারাগুলোর মধ্যে শিয়াদের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোতে বিশেষ অবস্থান নেওয়ার কারণে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বে লাইম লাইটে রয়েছে। শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা প্রথমবারের মতো ইরানের ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল সাফাভী যুগে। তাদের শাসনামল ছিল ১৫০১ সাল থেকে ১৭৩৬ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। সাফাভীদের কর্তৃত্ব ইরানের সীমানা ছাড়িয়ে লেবানন ও দক্ষিণ ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অটোমান বা ওসমানীয় তুকীদের মাধ্যমে মুসলিম শক্তির ক্ষমতা যখন সর্বোর্চ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্য যখন ইউরোপের নানা অঞ্চল দ্রুত জয় করছিল তখন ব্রিটেন শিয়া-সুন্নি মতবিরোধকে ব্যবহার করে ইরান ও তুরস্কের মধ্যে বিভেদ তথা গোটা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভেদ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। এটাই ছিল তৎকালীন ব্রিটেনের প্রধান নীতি এবং বর্তমানেও ব্রিটেন একই উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্যে একটি শিয়া বলয় বা ক্রিসেন্ট গড়ে ওঠার হুমকির কথা প্রচার করছে। দখলদার ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সরকারের সহযোগিতার ব্যাপারে মুসলিম জাতিগুলো সচেতন হয়ে ওঠায় শিয়া-সুন্নী বিভেদ উস্কে দেওয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর জন্য আরও জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ,লেবানন,ইরান ও ইরাকের শিয়া মুসলমানদের মধ্যে গত দুই শতকের সহযোগিতা লক্ষণীয়।

শিয়াদের অভ্যন্তরীণ সুপ্ত ক্ষমতাগুলো ছাড়াও সামাজিক ন্যায়বিচার,ন্যায়পরায়ণ ইমামের শাসন এবং শাহাদাত,ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অদৃশ্য থাকা,তাঁর আবির্ভাবের জন্য প্রতীক্ষা,নিষ্পাপ নয় এমন সাহাবীদের শাসনকে অবৈধ মনে করা,রাজনীতিতে ধর্মের বিপ্লবী ভূমিকা প্রভৃতি বিষয়ের কারণে রাজনৈতিক ইসলামে তাদের আধিপত্যের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য শিয়া ও সুন্নী মুসলমানদের মধ্যে অভিন্নতা বা ঐক্যের অনেক উপাদান থাকায় লেবানন ও ইরাকের মতো দেশগুলোতে তাদের যৌথ সরকার গঠন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের বিভেদকামী নীতি ও এ সংক্রান্ত সাজানো কিছু ঘটনা ইসলামী ধারাগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। জ্বালানি তেলের ওপর কর্তৃত্ব ও ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটেন,ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত জোটের উদ্দেশ্য। আর এরই প্রতিক্রিয়ায় জেগে উঠেছে মুসলমানরা। মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে এ শক্তিগুলোর উপনিবেশকামী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মুসলমানরা সচেতন হয়ে উঠেছে। হোয়াইট হাউজ ও ইসরাইলের নেতারা মনে করে,পারস্য উপসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের পাশে অবস্থিত ইরানের মতো একটি ইসলামী রাষ্ট্র একবিংশ শতকে পাশ্চাত্যের নানা স্বার্থ,লক্ষ্য ও কৌশলগুলোর জন্য বিপজ্জনক। কারণ,বিশ্বের শতকরা ৬৮ ভাগ জ্বালানি সম্পদ রয়েছে ইরানের ভাণ্ডারে।

মার্কিন সরকার মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া জনগোষ্ঠীগুলোর সাথে ইরানের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইরাকে বাথিস্টদের (বাথপন্থীদের) পতনের পর শিয়া মুসলমানরা এ দেশটির ক্ষমতার প্রধান অংশ বা সিংহভাগ আয়ত্ত করেছে। লেবাননীদের মধ্যে বিভক্তির চেষ্টা সত্ত্বেও হিজবুল্লাহ ৩৩ দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের মোকাবিলায় বিজয়ী হয়েছে। এসব বিষয় ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের দুঃশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে।

পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন শিয়া আলেমদের নেতৃত্বে শিয়ারা সব সময়ই রাজনীতির ময়দানে সক্রিয়। এ কারণে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মার্কিন বিরোধী। শিয়াদের আদর্শিক কাঠামো বিশেষ দেশ ও সীমারেখার বাইরেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিস্তৃত। এজন্য ইসলামী ইরান বিশ্বের যে কোন দেশের শিয়া দলগুলোর ওপর গভীর প্রভাব রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক পরিষদের প্রধান জার্মান ম্যাগাজিন স্পিগ্যালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,ইরান এ অঞ্চলের একটি শক্তিশালী দেশে ও একটি ক্লাসিক রাজকীয় শক্তিতে পরিণত হবে এবং ইসলাম এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও চিন্তাগত শূন্যতা পূরণ করবে। তিনি আরও বলেন,ইরানের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তন ঘটানোর সময় এসেছে।

মার্কিন কর্মকর্তারা এটাও বলছেন যে,ইরানের ইসলামী বিপ্লব রপ্তানি প্রতিরোধের কোন নিশ্চয়তা নেই। ইরানের নেতারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে লেবাননের হিজবুল্লাহ্সহ এ অঞ্চলের শিয়াদের সহায়তা করছে। ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের দুঃশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ইরাকের শিয়াদের সাথে ইরানের শিয়াদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় দেশটির ওপর ইরানের ব্যাপক প্রভাব থাকবে এবং আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের কারণে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য শিয়া গ্রুপ ও জনগোষ্ঠী,বিশেষ করে কুয়েত,বাহরাইন,ও তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবের শিয়ারা শক্তিশালী হবে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়াদের ক্ষমতা জোরদার হওয়ায় ওয়াহাবীরা আতংকিত হয়ে পড়েছে।

কোন কোন মার্কিন জেনারেল মনে করেন,শিয়া অধ্যুষিত ইরান,ইরাক ও লেবানন ছাড়াও সিরিয়া,ফিলিস্তিন এবং সৌদি আরবের শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে গণতন্ত্রের ক্রিসেন্ট গড়ে ওঠা এমন এক বড় ঝুঁকি যার পরিণতি আঁচ করা সম্ভব নয়। এসব অঞ্চলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে শিয়াদের জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখার পথ খুলে যাবে। সৌদি আরব ও বাহরাইনের পৌরসভার নির্বাচনের ফলাফলই এর প্রমাণ।

শিয়া রাজনৈতিক ইসলামের বিপ্লবী,আদর্শিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসগত নানা শক্তি ছাড়াও রয়েছে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব। ফলে এ ইসলাম পাশ্চাত্যের জন্য মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনা এবং নীতিতে প্রভাব রাখছে শিয়ারা। জ্বালানি তেলক্ষেত্রও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে পড়েছে। গ্রাহাম ফুলারের মতো লেখক ‘বিস্মৃত আরব শিয়া মুসলমান’ শীর্ষক বইয়ে শিয়াদের কৌশলগত ও ভৌগোলিক অবস্থান তুলে ধরে বলেছেন,জ্বালানি স্বার্থসহ দীর্ঘ মেয়াদী নানা স্বার্থ রক্ষার জন্য মার্কিন সরকারের উচিত শিয়াদের সাথে সংলাপে বসা।

(সূত্র: প্রত্যাশা, বর্ষ ২, সংখ্যা ২)