সূরা আন নিসা; (১৫তম পর্ব)

সূরা আন নিসা; আয়াত ৫৩-৫৭  

সূরা নিসার ৫৩,৫৪ ও ৫৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে,


أَمْ لَهُمْ نَصِيبٌ مِنَ الْمُلْكِ فَإِذًا لَا يُؤْتُونَ النَّاسَ نَقِيرًا (৫৩) أَمْ يَحْسُدُونَ النَّاسَ عَلَى مَا آَتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ فَقَدْ آَتَيْنَا آَلَ إِبْرَاهِيمَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَآَتَيْنَاهُمْ مُلْكًا عَظِيمًا (৫৪) فَمِنْهُمْ مَنْ آَمَنَ بِهِ وَمِنْهُمْ مَنْ صَدَّ عَنْهُ وَكَفَى بِجَهَنَّمَ سَعِيرًا ((৫৫

 

"(মুশরিকদের সাথে জোট বাঁধার জন্য সচেষ্ট) ইহুদীরা কি এটা মনে করে যে, রাষ্ট্রের শাসনে তাদের অংশ আছে ? যদি থাকে, সেখানেও তারা লোকদেরকে এক কনাও দেবে না ৷" (৪:৫৩)
"অথবা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মুসলমানদের যা দিয়েছেন সে জন্য কি তারা হিংসা করে? আমরা ইব্রাহীমের বংশধরদেরও গ্রন্থ এবং বিজ্ঞান দান করেছিলাম৷ তাদেরকে দিয়েছিলাম বিশাল রাজ্য৷" (৪:৫৪)


"তাদের মধ্যে একদল লোক তাওরাত, ইঞ্জিল ও যাবুরে বিশ্বাস করেছে, আর অন্যরা ঈমান তো আনেইনি, বরং অন্যদেরকেও ঈমান আনতে বাধা দিয়েছে৷ জাহান্নামের আগুনই তাদেরকে পোড়ানোর জন্যে যথেষ্ট৷" (৪:৫৫)


আগের আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা বলেছিলাম ইহুদীরা মদীনার মুসলমানদের পরাজিত করতে মক্কার মুশরিকদের সাহায্য চেয়েছিল এবং এজন্যে তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছিল৷ এই আয়াতে তাদের উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে, তোমরা কি রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পাবার আশায় এসব কাজ করছো? অথচ রাষ্ট্র ক্ষমতা পাবার কোন যোগ্যতা তোমাদের নেই৷ কারণ, আধিপত্যের নেশা তোমাদের মধ্যে এত প্রবল যে, তোমরা ক্ষমতায় গেলে কাউকে কোন অধিকারই দেবেনা এবং সমস্ত সুযোগ সুবিধা ও অধিকার তোমরা নিজেরাই ভোগ করবে ! এছাড়াও মুসলমানরা রাষ্ট্র ক্ষমতা পেয়েছে বলে তোমরা হিংসা করছ কেন? এর আগেও আল্লাহ ইব্রাহীম (আ.)'এর বংশধরদের মধ্য থেকে হয়রত মূসা, দাউদ ও সোলায়মান (আ.) সহ অনেক নবীকে কি ধর্মগ্রন্থ ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দেননি? তাই মুহাম্মদ (সা.) ও ইব্রাহীম (আ.)'র বংশধররা যদি ঐশীগ্রন্থ ও রাষ্ট্র ক্ষমতা পেয়ে থাকেন তাহলে অবাক হবার কি আছে? এমনকি ইসলাম বিদ্বেষ তোমাদের এত অন্ধ করে দিয়েছে যে, তোমরা মুশরিকদেরকে মুসলমানদের চেয়েও ভালো মনে করছ? এরপর আল্লাহ মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, অবশ্য মূসা, দাউদ ও সোলায়মান (আ.)'র যুগেও একদল লোক তাদের ওপর ঈমান এনেছিল এবং অন্য একদল তাদের বিরোধীতা করেছিল ৷ তাই এখনও ইহুদীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করায় নিরাশ হয়ো না ৷ জেনে রাখ, এ ধরনের ঘটনা সব যুগেই ঘটেছে৷


এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

 
প্রথমত : মুসলমানদের বোঝা উচিত কারা তাদের শত্রু ৷ এইসব শত্রুর হাত থেকে ইসলাম ধর্ম ও নিজেদের অবস্থানকে রক্ষা এবং তা শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিতে হবে৷ কারণ, ইসলামের শত্রুরা ক্ষমতায় আসলে তারা মুসলমানদেরকে উপেক্ষা করবে৷


দ্বিতীয়ত : কৃপণতা,সংকীর্ণতা ও অন্যায় বিচার বা অপবাদ দেয়া বস্তুপূজা এবং ক্ষমতা লিপ্সারই লক্ষণ৷
তৃতীয়ত : অন্যের কাছে যা আছে তা আল্লাহরই দেয়া নেয়ামত৷ এ জন্যে হিংসা করার অর্থ হলো, আল্লাহর ইচ্ছার ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হওয়া৷ অন্যের সম্পদ বা ক্ষমতা কমে যাক এমনটি আশা করার চেয়ে নিজের জন্যে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ পাওয়ার আশা করা উচিত৷

সূরা নিসার ৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,


إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآَيَاتِنَا سَوْفَ نُصْلِيهِمْ نَارًا كُلَّمَا نَضِجَتْ جُلُودُهُمْ بَدَّلْنَاهُمْ جُلُودًا غَيْرَهَا لِيَذُوقُوا الْعَذَابَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَزِيزًا حَكِيمًا ((৫৬
 

"যারা আমার নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করেছে, তাদেরকে আমি শিঘ্রই দোযখের আগুনে প্রবেশ করাবো৷ যখন তাদের চামড়া পুড়ে যাবে,তখন আমি তাদের চামড়া বদলে দেব, যেন তারা শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করে৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রান্ত,প্রজ্ঞাময় ৷" (৪:৫৬)

সূরা নিসার আগের কয়েকটি আয়াতে নবী রাসূল ও তাঁদের প্রতি একদল মানুষের শত্রুতা এবং হিংসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ৷ ৫৫ নম্বর আয়াতে এসব লোকদের জন্য জাহান্নামের আগুনই যথেষ্ট বলে আল্লাহ মন্তব্য করেছেন ৷ এই আয়াতে তাদের কুফরির উপযুক্ত ও কঠোর শাস্তির কথা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যারা সারাজীবন ধরে সত্যের বিরোধীতা করেছে এবং প্রতি মুহূর্তে যাদের খোদাদ্রোহীতা বৃদ্ধি পেয়েছে তারা চিরকাল শাস্তি পাবার যোগ্য৷ অর্থাৎ কাফের ও পথভ্রষ্টরা যেন এ ধারণা না করে যে পরকালে দোযখের আগুন তাদেরকে একবারই দগ্ধ করবে না বরং বারবার তাদের শরীরে নতুন চামড়া দেখা দেবে এবং এভাবে তারা স্থায়ীভাবে দগ্ধ হতে থাকবে৷

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,


প্রথমত : পরকালের স্থায়ী শাস্তির যন্ত্রণা দুনিয়ার মত কিছুকাল পর কমে যায় না৷
দ্বিতীয়ত : পরকালে মানুষের পুনরুত্থান হবে দৈহিক ও আত্মিক ৷ তাই পাপী মানুষের চামড়া ও শরীরের অন্যান্য অংশ শাস্তির যন্ত্রণা ভোগ করবে৷ তাই পরকালে শুধু আত্মিক শাস্তি দেয়া হবে এমন ধারণা ঠিক নয়৷

তৃতীয়ত : পরকালের শাস্তি আমাদের কাজের ফল হিসেবেই দেখা দেবে, কারণ, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ওপর জুলুম করেন না ৷ আল্লাহ ন্যায় বিচারক ও প্রজ্ঞাময় এবং বান্দাদের সাথে তাঁর আচরণও প্রজ্ঞাপূর্ণ৷

সূরা আন নিসার ৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا لَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَنُدْخِلُهُمْ ظِلًّا ظَلِيلًا ((৫৭

"যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কাজ করে, নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে এমন বেহশতে প্রবেশ করাবো, যার বাগানের নীচ দিয়ে নদী প্রবাহিত ৷ সেখানে তারা চিরকাল থাকবে৷ সেখানে তাদের জন্য পবিত্র সঙ্গিনী থাকবে এবং তাদেরকে চিরস্নিগ্ধ ছায়ায় স্থান দেয়া হবে ৷" (৪:৫৭)

আগের আয়াতে পরকালে অবিশ্বাসীদের কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখের পর এ আয়াতে মুমিনদেরকে মহাপুরস্কার দেয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে ৷ এ আয়াতে বলা হচ্ছে, "যদি তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের ওপর ঈমান আন এবং সৎ কাজ কর, তাহলে পরকালে এমন বেহেশত দেয়া হবে যার সবুজ শ্যামল ও বৃক্ষ শোভিত বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে যাবে নদী৷ সেখানে শাখা প্রশাখা যুক্ত গাছের ছায়া হবে খুবই স্নিগ্ধ৷ এছাড়াও তাদের আনন্দ পূর্ণতর করার জন্য সেখানে থাকবে সঙ্গিনী ৷ যারা পৃথিবীতে প্রচুর ভোগ ও বিলাসিতা বর্জন করেছে এবং অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থেকেছে তারাই পবিত্র বেহেশতে স্থান পাবে ৷"

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : মানুষ পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন হলেও কাজের পুরস্কার বা শাস্তি ভোগের ক্ষেত্রে স্বাধীন নয়৷ কুফরীর পরিণতি হলো, শাস্তি ও যন্ত্রণা এবং ঈমানের ফল হলো প্রশান্তি ও নিরাপত্তা৷
দ্বিতীয়ত : পবিত্রতা ও পবিত্র চরিত্র নারী এবং পুরুষ সবার জন্যেই সমান গুরুত্বপূর্ণ ৷ আর এ জন্যেই আল্লাহ বেহেশতের সঙ্গিনীদের সৌন্দর্যের কথা উল্লেখ না করে তাদের পবিত্রতার কথা উল্লেখ করেছেন।