ইসলামে নেতার গুরুত্ব

ইমাম একটি আরবী শব্দ যার অর্থ হচ্ছে নেতা, এর বহুবচন হচ্ছে, ‘আইম্মাহ’-ইমামগণ

আরবী ভাষার বিশিষ্ট অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ বলা হয়েছে, ‘মানুষ যার অনুসরণ করে, তাকে ইমাম বলে’।

মহান আলআহ রাব্বুল আলামিন তার একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলামে মানুষের ইহলৌকিক পারলৌকিক জীবনের প্রতিটি স্তরের দিক নির্দেশনা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দিয়েছেন।

কোন দেশ,কোন রাষ্ট, কোন শহর গ্রাম বা গোত্র এমনকি একটি সংসারও একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া চলতে পারে না। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজের চাকা সচল রাখা সম্ভব নয়। একজন নেতার ইচ্ছাই সমাজের অসংখ্য ব্যক্তির ইচ্ছার উপর প্রভুত্ব করে। এভাবে সে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে তার সামাজিক দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির নেতৃত্ব ছাড়া সমাজের গতি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যেই নেতাহীন ঐ সমাজ ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য।

যার ফলে এক ব্যাপক অরাজকতা ঐ সমাজকে ছেয়ে ফেলবে। সুতরাং, উক্ত যুক্তির উপর ভিত্তি করে নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় যে, সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত (সে সমাজ বৃহত্তরই হোক অথবা ক্ষুদ্রতরই হোক) নেতা, সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে যার অবদান অনস্বীকার্য তিনি যদি কখনও অস্থায়ীভাবে অথবা স্থায়ীভাবে তার পদ থেকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে অবশ্যই তার ঐ অনুপস্থিতকালীন সময়ের জন্যে অন্য কাউকে দায়িত্বশীল হিসেবে নিয়োজিত করে যাবেন। এধরণের দায়িত্বশীল কোন নেতা কোনক্রমেই এমন কাজ করতে প্রস্তুত হবেন না, যার ফলে নিজের দায়িত্বের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণে নেতার অভাবে ঐ সমাজের অস্তিত্ব ধ্বংসোন্মুখ হয়ে পড়বে। কোন পরিবারের কর্তাব্যক্তিও যদি কিছুদিনের জন্যে অথবা কয়েক মাসের জন্যে পরিবারের সদস্যদের ত্যাগ করে দূরে কোথাও ভ্রমনে যান। তখন অবশ্যই তিনি তার অনুপস্থিতকালীন সময়ে সংসার পরিচালনার জন্যে পরিবারের কাউকে (অথবা তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে) দায়িত্বশীল হিসাবে নিয়োগ করে যান। কোন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বা স্কুলের প্রধানশিক্ষক অথবা দোকানের মালিক, যাদের অধীনে বেশ ক’জন কর্মচারী কর্মরত, তারা যদি অল্প ক’ঘন্টার জন্যেও কোন কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করেন, তাহলে অধীনস্থ কাউকে তার অনুপস্থিতকালীন সময়ে তার দায়িত্ব পালনের জন্যে নিযুক্ত করে যান। আর অন্যদেরকে ঐ নবনিযুক্ত দায়িত্বশীলের আনুগত্য করার নির্দেশ দেন।

ইসলাম এমন এক ধর্ম, যা আল্লাহ প্রদত্ত মানব প্রকৃতি অনুযায়ী পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ্‌র ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলাম একটি সামাজিক আদর্শ যার প্রকৃতি এমন এক দৃষ্টান্তমূলক যে, পরিচিত ও অপরিচিত সবাই ঐ আদর্শের দর্পন থেকে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। মহান আল্লাহ‌ ও বিশ্বনবী (সা.) এই আদর্শের সামাজিকতার ক্ষেত্রে যে মহান অবদান রেখেছেন, তা সবার কাছেই অনস্বীকার্য। এই ঐশী আদর্শ পৃথিবীর অন্য কিছুর সাথেই তুলনাযোগ্য নয়। মহানবী (সা.)-ও ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন সামাজিক বিষয়ই পরিত্যাগ করতেন না। যখনই কোন শহর বা গ্রাম মুসলমানদের দ্বারা বিজিত হত, সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত সময়ে বিশ্বনবী (সা.) তার পক্ষ থেকে কাউকে ঐ অঞ্চলের শাসনকর্তা ও স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে পাঠাতেন। এমনকি জিহাদ পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রেরিত সেনাবাহিনীর জন্যে প্রয়োজন বোধে (অত্যাধিক গুরুত্বের কারণে) একাধিক সেনাপতিও তিনি নিযুক্ত করতেন। এমনকি ঐতিহাসিক ‘মুতার’ যুদ্ধে বিশ্বনবী (সা.) চারজন সেনাপতি নির্বাচন করেছিলেন। যাতে প্রথম সেনাপতি শাহাদত বরণ করলে দ্বিতীয় সেনাপতি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। দ্বিতীয়জন শাহাদত বরণ করলে তৃতীয়জন দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। আর এইভাবে এ ধারা বাস্তবায়িত হবে। রাসুল (সা.)-এর এসকল কার্যের মাধ্যমেই নেতা নিয়োগের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যায়। একইভাবে বিশ্বনবী (সা.) তার স্বীয় উত্তরাধিকারের বিষয়েও সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। তিনি স্বীয় উত্তরাধিকারী নির্ধারণের ব্যাপারে কখনোই পিছপা হননি। যখনই তিনি প্রয়োজন বোধে মদীনার বাইরে যেতেন, তখনই তিনি কাউকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন এমন কি যখন তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা নগরী ত্যাগ করে ছিলেন, যখন কেউই সে সংবাদ সম্পর্কে অবহিত ছিল না তখনও মাত্র অল্প ক’দিনের জন্য স্বীয় ব্যক্তিগত দায়িত্ব পালন ও জনগণের গচ্ছিত আমানত দ্রব্যাদি মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে মক্কায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান। এভাবেই বিশ্বনবী (সা.) মৃত্যুর পূর্বে স্বীয় ঋণ পরিশোধ ও বিশ্বাসগত অসমাপ্ত কার্যাবলী সম্পাদনের জন্যে ইমাম আলী (আ.)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। তাই শীয়ারা বলে: উপরোক্ত দলিলের ভিত্তিতে এটা আদৌও কল্পনাপ্রসূত নয় যে, বিশ্বনবী (সা.) মৃত্যুর পূর্বে কাউকে তাঁর উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচিত করে যাননি। মুসলমানদের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা এবং ইসলামী সমাজের চালিকা শক্তি নিয়ন্ত্রণের জন্যে কাউকেই মহানবী (সা.) মনোনীত করে যাননি, এটা এক কল্পনাতীত ব্যাপার বটে। এক শ্রেণীর আইনকানুন ও কিছু সাধারণ আচার অনুষ্ঠান, যা সমাজের অধিকাংশ জনগণের দ্বারা বাস্তবে স্বীকৃত ও সমর্থিত, তার উপর ভিত্তি করেই একটি সমাজের সৃষ্টি হয়। আর ঐ সমাজের অস্তিত্ব টিকে থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ রূপে ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও দায়িত্বশীল একটি প্রশসানের অস্তিত্বের উপরই নির্ভরশীল। এটা এমন কোন বিষয় নয় যে, মানব প্রকৃতি এর গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে। কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির কাছেও এটা কোন অজ্ঞাত বিষয় নয় এবং এটা ভোলার বিষয়ও নয়, কারণ, ইসলামী শরীয়তের (বিধান) সূক্ষ্মতিসূক্ষতা ও বিস্তৃতি একটি সন্দেহাতীত ব্যাপার। আর এ ব্যাপারটিও অনস্বীকার্য যে, বিশ্বনবী (সা.) এ ব্যাপারে অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করতেন এবং এপথে তিনি নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন। তাঁর ঐ আত্মত্যাগ, অসাধারণ চিন্তাশক্তি, প্রজ্ঞার শ্রেষ্ঠত্ব, সূক্ষ্ম ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ ক্ষমতার (ওহী ও নবুয়তের সাক্ষ্য ছাড়াও) বিষয়টি নিঃসন্দেহে বির্তকের উর্ধ্বে। শীয়া ও সুন্নী উভয় দলেরই মত নির্বিশেষে বর্ণিত ‘মুতাওয়াতির’ (বিশ্বস্ত) হাদীস অনুযায়ী (‘ফিৎনা’ অধ্যায়ের হাদীস) বিশ্বনবী (সা.) তাঁর অন্তর্ধানের পর ইসলামী সমাজ যেসব র্দূনীতিমূলক সমস্যায় আক্রান্ত হবে, তার ভবিষ্যতবাণী করেছেন। ঐসব সমস্যার মধ্যে যেসব সমস্যাগুলো ইসলামকে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, উমাইয়া বংশ সহ আরও অন্যান্যদের খেলাফত লাভের বিষয়টি তার মধ্যে অন্যতম। কারণ: তারা ইসলামের পবিত্র আর্দশকে তাদের বিভিন্ন ধরণের অপবিত্রতা ও অরাজকতামূলক জঘণ্য কাজে ব্যবহার করেছে। এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) তাঁর হাদীসে বিস্তারিতভাবে ভবিষ্যতবাণী করেছেন। বিশ্বনবী (সা.) তাঁর মৃত্যুর হাজার হাজার বছর পরের ইসলামী সমাজের খুঁটিনাটি বিষয়াদি ও সমস্যা সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন এবং সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ভবিষ্যতবাণীও করে গেছেন। তাহলে এটা কি করে সম্ভব যে, যিনি তাঁর পরবর্তী সুদুর ভবিষ্যতের ব্যাপারে এত সচেতন, অথচ স্বীয় মৃত্যু পরবর্তী মূহুর্তগুলোতে সংঘটিত ঘটনাবলীর ব্যাপারে আদৌ সচেতন নন?! বিশ্ব নবী (সা.)-এর পরবর্তী উত্তরাধিকারের মত এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কি তাহলে তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে অবহেলা করেছেন, অথবা এটাকে গুরুত্বহীন একটি বিষয় হিসেবে গণ্য করেছেন? এটা কেমন করে সম্ভব যে, খাওয়া পরা, ঘুমানো এবং যৌন বিষয়াদির মত মানব জীবনের শতশত খুঁটিনাটি বিষয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ তিনি জারী করেছেন, অথচ ঐ ধরণের একটি অতি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণরূপে নীরবতা পালন করেছেন? নিজের উত্তরাধিকারীকে তিনি মনোনীত করে যাননি? ধরে নেয়া যাক (যদিও এটা অসম্ভব একটি ধারণা) যে, মহানবী (সা.) তাঁর স্থলাভিষিক্ত নির্বাচনের দায়িত্বভার মুসলমানদের উপরে ছেড়ে দিয়েছেন, তাহলে এ ব্যাপারে অবশ্যই বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বর্ণনা থাকার কথা। এ ব্যাপারে অবশ্যই জনগণের প্রতি তাঁর প্রয়োজনীয় নির্দেশনা থাকা উচিত। কারণঃ ইসলামী সমাজের অস্তিত্ব ও বিকাশ এবং ইসলামী নির্দশনাবলীর অস্তিত্ব এ বিষয়টির উপর সম্পূর্ণ রূপে নির্ভরশীল। তাই এ ব্যাপারে সমগ্র মুসলিম উম্মতকে সদা সচেতন থাকতে হবে। অথচ, এব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণঃ যদি এমন সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনার অস্তিত্ব থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই বিশ্ব নবী (সা.)-এর পরে তার স্থলাভিষিক্তের পদাধিকারী নির্ধারণের ব্যাপারে এত মতভেদের সৃষ্টি হত না। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, প্রথম খলিফা ওসিয়তের (উইল) মাধ্যমে দ্বিতীয় খলিফার কাছে খেলাফত হস্তান্তর করেছিলেন।

দ্বিতীয় খলিফা তার মৃত্যু পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে একটি ‘খলিফা নির্বাচন কমিটি’ গঠন করেছিলেন। ছয় সদশ্য বিশিষ্ট ঐ কমিটির প্রতিটি সদস্যই দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা মনোনীত হয়েছিলেন। ঐ কমিটির খলিফা নির্বাচন সংক্রান্ত মূলনীতিও তিনি নিজেই নির্ধারণ করেছিলেন। যার ভিত্তিতেই তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন। তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর চতুর্থ খলিফা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। পঞ্চম খলিফা চতুর্থ খলিফার ওসিয়তের (উইল) মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এরপর মুয়াবিয়া যে পঞ্চম খলিফা হযরত ইমাম হাসান (আ.)-কে বলপূর্বক সন্ধিচুক্তিতে বাধ্য করার মাধ্যমে খেলাফতের পদটি ছিনিয়ে নেন। তারপর থেকেই খেলাফত রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। আর তখন থেকেই জিহাদ, সৎকাজে আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ, ইসলামী দন্ড বিধি প্রয়োগ, ইত্যাদি ইসলামী নির্দেশনাবলী একের পর এক ক্রমান্নয়ে ইসলামী সমাজ থেকে উধাও হতে থাকে। এভাবে বিশ্বনবী (সা.)-এর সারা জীবনের লালিত সাধনা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। [উপরোক্ত বিষয়টি নিম্নোক্ত গ্রন্থ সমূহে বর্ণিত হয়েছে। তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ২৬-৬১ নং পৃষ্ঠা। সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, ২২৩-২৭১ পৃষ্ঠা। তারীখে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড ১২৬ নং পৃষ্ঠা। গায়াতুল মারাম, ৬৬৪ নং পৃষ্ঠা---ইত্যাদি।]শীয়ারা আল্লাহ‌ প্রদত্ত মানব প্রকৃতি এবং জ্ঞানী ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ অনুযায়ী এ বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান চালায়। তারা ফিৎরাত বা মানব প্রকৃতি সঞ্জীবনী ইসলামী আর্দশের মূল দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত, মহানবী (সা.)-এর অনুসৃত সামাজিক পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ এবং মহানবী (সা.)-এর মৃত্যু পরবর্তী দুঃখজনক ঘটনাবলী অধ্যয়ন করে। মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর ইসলাম ও মুসলমানরা যেসব র্দূদশা ও জটিল সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিল তারও আদ্যোপান্ত আলোচনা করে। এছাড়াও ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইসলামী প্রশাসকদের ইসলামের ব্যাপারে ইচ্ছাকৃত উদাসীনতার বিষয়টিও সূক্ষ্মা তিসূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করে। উক্ত গবেষণার মাধ্যমে শীয়ারা একটি সুনিশ্চিত ফলাফলে পৌঁছুতে সক্ষম হয়। আর তা হচ্ছে এই যে, বিশ্বনবী (সা.)-এর পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের ব্যাপারে তাঁর পক্ষ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ বর্ণনার অস্তিত্ব ইসলামে বিদ্যমান। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত এবং বিশ্বনবী (সা.)-এর বর্ণিত অসংখ্য হাদীস রয়েছে, যার সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা অকাট্যরূপে প্রমাণিত ও সর্বজনস্বীকৃত। এ ব্যাপারে ‘বিলায়ত’ সংক্রান্ত আয়াত এবং গাদীরে খুমের হাদীস, ‘সাফিনাতুন্‌ নুহ’-এর হাদীস, ‘হাদীসে সাকালাইন্তু ‘হাদীসে হাক্ক’ ‘হাদীসে মান্‌যিলাত’ নিকট আত্মীয়দের দাওয়াত সংক্রান্ত হাদীস সহ আরও অসংখ্য হাদীসের কথা উল্লেখযোগ্য। [ । রাসুল (সা.) এর উত্তরাধিকারী হিসেবে হযরত ইমাম আলী (আ.) এর অধিকার সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বেশ কিছু আয়াত উল্লেখযোগ্য। যেমন, মহান আল্লাহ্‌ বলেন: “তোমাদের অভিভাবক (পথ নির্দেশক) তো আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুল এবং মু’মিন বান্দাদের মধ্যে যে নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং রুকু অবস্থায় যাকাত প্রদান করে।” (-সুরা মায়েদা, ৫৫ নং আয়াত।) সুন্নী ও শীয়া উভয় তাফসীরকারকগণই এ ব্যাপারে একমত যে, পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত আয়াতটি একমাত্র হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর মর্যাদায়ই অবর্তীণ হয়েছে। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা স্বরূপ শীয়া ও সুন্নী উভয় সমপ্রদায়ের বর্ণিত অসংখ্য হাদীসও এ কথারই প্রমাণ বহন করে। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) এর সাহাবী হযরত আবুযার গিফারী (রা.) বলেনঃ “একদিন মহানবীর পিছনে যোহরের নামায পড়ছিলাম। এ সময়ে জনৈক ভিক্ষুক সেখানে উপস্থিত হয়ে সবার কাছে ভিক্ষা চাইল। কিন্তু কেউই ঐ ভিক্ষুককে সাহায্য করল না। তখন ঐ ভিক্ষুক তার হাত দু’টো আকাশের দিকে উঠিয়ে বললোঃ ‘হে আল্লাহ্‌ তুমি সাক্ষী থেকো, রাসুল (সা.)-এর এই মসজিদে কেউই আমাকে সাহায্য করলো না। ঐ সময় হযরত ইমাম আলী (আ.) নামাযরত অবস্থায় ছিলেন। তিনি তখন রুকুতে ব্যস্ত ছিলেন। হযরত আলী (আ.) তখন রুকু অবস্থাতেই হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঐ ভিক্ষুকের প্রতি ইশারা করলেন। ঐ ভিক্ষুকও ইমাম আলী (আ.) এর ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তাঁর হাতের আঙ্গুল থেকে আংটি খুলে নিল। এ দৃশ্য দেখে মহানবী (সা.) আকাশের দিকে মাথা উচিঁয়ে এই প্রার্থনাটি করেছিলেন:‘হে আল্লাহ্‌ আমার ভাই হযরত মুসা (আ.) তোমাকে বলেছিল আমার হৃদয়কে প্রশস্ত করে দাও এবং আমার কাজগুলোকে করে দাও সহজ। আমার জিহ্ববার জড়তা দূর করে দাও যাতে সবাই আমার বক্তব্য অনুধাবন করতে পারে। আর আমার ভাই হারূনকে আমার প্রতিনিধি ও সহযোগীতে পরিণত কর।’ তখন তোমার ঐশীবাণী অবর্তীণ হলঃ ‘তোমার ভাইয়ের মাধ্যমে তোমার বাহুকে আমরা শক্তিশালী করব এবং তোমাকে প্রভাব বিস্তারের শক্তি দান করব। সুতরাং, হে আল্লাহ্‌! আমিও তো তোমারই নবী। তাই আমাকেও হৃদয়ের প্রশস্ততা দান কর। আমার কাজগুলোকেও করে দাও সহজ। আর আলীকে আমার প্রতিনিধি ও সহযোগী হিসেবে নিযুক্ত কর।” হযরত আবুযার (রা.) বললেনঃ “রাসুল (সা.)-এর কথা শেষ না হতেই পবিত্র কুরআনের আলোচ্য আয়াতটি অবর্তীণ হল”। [ -যাখাইরূল উকবা (তাবারী) ১৬ নং পৃষ্ঠা, ১৩৫৬ হিজরী মিশরীয় সংস্করণ।]

একই হাদীস সামান্য কিছু শাব্দিক পার্থক্যসহ নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহে উল্লেখিত হয়েছে। (দুররূল মানসুর, ২য় খন্ড, ২৯৩ নং পৃষ্ঠা। গায়াতুল মারাম- বাহ্‌রানী, এ বইয়ের ১০৩ নং পৃষ্ঠায়।)

আলোচ্য আয়াতের অবতরণের ইতিহাস বর্ণনায় সুন্নী সুত্রে বর্ণিত ২৪টি হাদীস এবং শীয়া সুত্রে বর্ণিত ১৯টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

মহান আল্লাহ্‌ বলেন: “আজ কাফেররা তোমাদের ‘দ্বীন্তু থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। অতএব তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় কর। আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন্তুকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অবদান (নিয়ামত) সম্পূর্ণ করে দিলাম, এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” (-সুরা মায়েদা ৩ নং আয়াত। )

বাহ্যত উক্ত আয়াতের বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এই আয়াত অবর্তীণ হওয়ার পূর্বে কাফেররা এই ভেবে আশ্বান্বিত ছিল যে, শীঘ্রই এমন একদিন আসবে, যেদিন ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু মহান আল্লাহ্‌ উক্ত আয়াত অবর্তীণের মাধ্যমে চিরদিনের জন্যে কাফেরদেরকে নিরাশ করলেন। আর এটাই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব লাভ ও তার ভিত্তিকে শক্তিশালী হওয়ার কারণ ঘটিয়েছিল। এটা সাধারণ কোন ইসলামী নির্দেশজারীর মত স্বাভাবিক কোন ঘটনা ছিল না। বরং এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল, যার উপর ইসলামের অস্তিত্ব টিকে থাকা নির্ভরশীল ছিল। এই সুরার শেষের অবর্তীণ আয়াতও আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন নয়।

মহান আল্লাহ্‌ বলেছেন: “হে রাসুল! পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবর্তীণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন তবে আপনি তাঁর (প্রতিপালকের) রিসালাতের কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ্‌ আপনাকে মানুষদের (অনিষ্টা) হতে রক্ষা করবেন।” (-সুরা মায়েদা, ৬৭ নং আয়াত।)

উক্ত আয়াত থেকে প্রতীয়মাণ হয় যে, মহান আল্লাহ্‌ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন, যা সাধিত না হলে ইসলামের মূলভিত্তি ও বিশ্বনবী (সা.) এর এই মহান মিশন বা রিসালত চরম বিপদের সম্মুখীন হবে। তাই আল্লাহ্‌ এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) কে নির্দেশ দেন। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.) ঐ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সাধিত হওয়ার ব্যাপারে জনগণের বিরোধীতা ও বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হওয়ার আশংকা করলেন। এমতাবস্থায় ঐ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি অতিদ্রুত সমাধা করার জন্যে জোর তাগিদ সম্বলিত নির্দেশ মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে বিশ্বনবী (সা.)এর প্রতি জারী করা হয়। মহান আল্লাহ্‌ বিশ্বনবী (সা.)-এর প্রতি উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, ঐ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সমাধানের ব্যাপারে অবশ্যই অবহেলা কর না এবং ঐ ব্যাপারে কাউকে ভয়ও কর না। এ বিষয়টি অবশ্যই ইসলামী শরীয়তের কোন বিধান ছিল না। কেননা এক বা একাধিক ইসলামী বিধান প্রচারের গুরুত্ব এত বেশী হতে পারে না যে, তার অভাবে ইসলামের মূলভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। আর বিশ্বনবী (সা.) -ও কোন ঐশী বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে আদৌ ভীত ছিলেন না।

উপরোক্ত দলিল প্রমাণাদি এটাই নির্দেশ করে যে, আলোচ্য আয়াতটি ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিবের (আ.) বিলায়াত সংক্রান্ত ব্যাপারে অবর্তীণ হয়েছে। অসংখ্য সুন্নী ও শীয়া তাফসীরকারকগণই এ ব্যাপারে ঐ ঘটনায় ঐক্যমত পোষণ করেন।

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন: “বিশ্বনবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.) এর প্রতি সবার দৃষ্টি আর্কষণ করেন। এরপর বিশ্বনবী (সা.) ইমাম আলী (আ.) এর হাত দু’টো উপরদিকে উত্তোলন করেন। এমনকি বিশ্বনবী (সা.) হযরত আলী (আ.) এর হাত এমনভাবে উত্তোলন করেছেন যে, মহানবী (সা.) এর বগলের শুভ্র অংশ প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি অবর্তীণ হয় ঃ “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন্তুকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার অবদান (নেয়ামত) সম্পূর্ণ করে দিলাম, এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” (সুরা মায়েদা, ৩ নং আয়াত। )

উক্ত আয়াতটি অবর্তীণ হওয়ার পর মহানবী (সা.) বললেন: ‘আল্লাহ্‌ আকবর’ কারণ, বিশ্বনবী (সা.) এর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর ‘বিলায়াত’ (কর্তৃত্ব) প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে আজ আল্লাহ্‌র নেয়ামত ও সস্তুষ্টি এবং ইসলামের পূর্ণত্বপ্রাপ্তি ঘটলো। অতঃপর উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) বললেনঃ “আমি যাদের অভিভাবক, আজ থেকে আলীও তাদের অভিভাবক। হে আল্লাহ্‌! আলীর বন্ধুর প্রতি বন্ধু বৎসল হও ও আলীর শত্রুর সাথে শত্রুতা পোষণ কর। যে তাকে (আলীকে) সাহায্য করবে, তুমিও তাকে সাহায্য কর। আর যে আলীকে ত্যাগ করবে, তুমিও তাকে ত্যাগ কর।”

জনাব আল্লামা বাহ্‌রানী তার ‘গায়াতুল মারাম’ নামক গ্রন্থের ৩৩৬ নং পৃষ্ঠায় উক্ত আয়াতের অবতরণের কারণ প্রসঙ্গে সুন্নী সূত্রে বর্ণিত ৬টি হাদীস এবং শীয়া সূত্রে বর্ণিত ১৫টি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন।

ইসলামের শত্রুরা ইসলামকে ধ্বংস করার স্বার্থে কোন প্রকার অনিষ্ট সাধনে কখনোই কুন্ঠাবোধ করেনি। কিন্তু এত কিছুর পরও তারা ইসলামের সামান্য পরিমাণ ক্ষতি করতেও সক্ষম হয়নি। ফলে ব্যর্থ হয়ে তারা সবদিক থেকেই নিরাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু এর পরও শুধুমাত্র একটি বিষয়ে তাদের মনে আশার ক্ষীণ প্রদীপ জ্বলছিল। আর সেই আশার সর্বশেষ বস্তুটি ছিল এই যে, তারা ভেবে ছিল, যেহেতু মহানবী (সা.)-ই ইসলামের রক্ষক ও প্রহরী, তাই তার মৃত্যুর পর ইসলাম অভিভাবকহীন হয়ে পড়বে। তখন ইসলাম অতি সহজেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনা তাদের হৃদয়ে লুকানো আশার শেষ প্রদীপটাও নিভিয়ে দিল। কারণ, ‘গাদীরে খুমে’ মহানবী (সা.), হযরত ইমাম আলী (আ.) কে তাঁর পরবর্তী দায়িত্বশীল ও ইসলামের অভিভাবক হিসেবে জনসমক্ষে ঘোষণা প্রদান করেন। এমনকি বিশ্বনবী (সা.) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর পর ইসলামের এই দায়িত্বভার মহানবী (সা.)-এর পবিত্র বংশ তথা হযরত আলী (আ.) এর “ভবিষ্যত বংশধরদের” জন্যে নির্ধারণ করেন। (এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্যের জন্যে হযরত আল্লামা তাবাতাবাঈ রচিত ‘তাফসীর আল্‌ মিজান্তু নামক কুরআনের তাফসীরের ৫ম খন্ডের ১৭৭ থেকে ২১৪ নং পৃষ্ঠা এবং ৬ষ্ঠ খন্ড ৫০ থেকে ৫৪ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।)

সৃষ্টি জগতের প্রতিটি সৃষ্টিই প্রাকৃতিক ভাবে স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব, পূর্ণত্ব ও মহত্ব প্রাপ্তির পথে পরিচালিত ও সদা ধাবমান। মানুষও জগতের অন্যান্য সৃষ্টির মতই একটি সৃষ্টি। তাই মানুষও উক্ত আইনের ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং মানুষও তার বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী ও সামাজিক চিন্তা-চেতনা দিয়ে তার নিজ জীবনে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে, যার মাধ্যমে সে ইহ ও পরকালে দু’জীবনেই সাফল্য ও সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। এক কথায় এমন এক শ্রেণীর বিশ্বাস ও বাস্তব দায়িত্বের ভিত্তিতে মানব জীবন পরিচালিত হওয়া উচিত, যার মাধ্যমে মানুষ, জীবনের সাফল্য ও মানবীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। মানব জীবন পরিচালনার ঐ কর্মসূচী ও জীবন দর্শনের নামই দ্বীন। এই দ্বীন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত নয়। বরং তা ঐশীবাণী (ওহী) ও নবুয়তের মাধ্যমে প্রাপ্ত, যা মানব জাতির কিছু সংখ্যক বিশিষ্ট ও পবিত্র আত্মাসম্পন্ন ব্যক্তিদের (নবীগণ) মাধ্যমে অর্জিত হয়। আল্লাহ্‌র নবীরাই ‘ওহী’ বা ঐশীবাণীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে মানব জাতির কাছে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব সমূহ পৌঁছে দেন। যাতে করে ঐসব দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মানব জীবন সাফল্য মন্ডিত হয়। এটা খুবই স্পষ্ট যে, উক্ত যুক্তির ভিত্তিতে এ ধরণের একটি জীবন বিধানের প্রয়োজনীয়তা মানব জাতির জন্যে প্রমাণিত হয়। একইভাবে এর পাশাপাশি মানব জাতির ঐ মূল্যবান জীবন বিধান সম্পূর্ণ অবিকৃতরূপে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও প্রমাণিত হয়। মহান আল্লাহ্‌র অনুগ্রহের মাধ্যমে সেই ঐশী জীবন বিধান মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে যেমন বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রয়োজন, তেমনি ঐ জীবন বিধান সংরক্ষণের জন্যেও বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রয়োজন। যাতে করে ঐ জীবন বিধান চিরদিন অবিকৃতরূপে সংরক্ষিত থাকে এবং প্রয়োজনে তা মানুষের কাছে উপস্থাপন ও শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। অর্থাৎ, সর্বদাই একের পর এক এমন কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকা প্রয়োজন, যারা আল্লাহ্‌র প্রদত্ত ঐ দ্বীনকে সর্বদাই অবিকৃতরূপে সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে তা প্রচার করবেন। যে বিশিষ্ট বিশ্বাস ঐ ঐশী দ্বীনকে অবিকৃতভাবে সংরক্ষণের জন্যে মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নিয়োজিত, তাঁকেই ‘ইমাম’ নামে অভিহিত করা হয়। একইভাবে মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে ‘ওহী’ বা ঐশীবাণী ও বিধান গ্রহণের যোগ্যতাসম্পন্ন আত্মার অধিকারী ব্যক্তিকে ‘নবী’ হিসেবে অবিহিত করা হয়। নবুয়তও ইমামতের সমাহার একই ব্যক্তির মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে, আবার পৃথক পৃথকও হতে পারে। নবী রাসুলগণের জন্যে  নিষ্পাপ হওয়া যেমন অপরিহার্যতা তেমনি ইমামের জন্যে ‘ইসমাত’ বা নিষ্পাপ হওয়ারও তেমনি অপরিহার্য । কেননা, দ্বীনকে কেয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির মাঝে সম্পূর্ণ অবিকৃত ও প্রচারের যোগ্যতাসম্পন্ন অবস্থায় সংরক্ষণ করা আল্লাহ্‌র দায়িত্ব। আর এ উদ্দেশ্য ঐশী ‘ইসমাত’ (নিষ্পাপ হওয়ার গুণ) ও ঐশী নিরাপত্তা বিধান ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।