সূরা আন নিসা; (১৬তম পর্ব)

সূরা আন নিসা; আয়াত ৫৮-৫৯

সূরা নিসার ৫৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

 

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا ((৫৮

                             

"আল্লাহ মালিকের কাছে আমানত ফিরিয়ে দিতে তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন৷ তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে, তখন ন্যায় বিচার কর৷ অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের উত্তম উপদেশ দান করেন৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ শোনেন ও দেখেন৷" (৪:৫৮)

কোন কোন মানুষ ধর্মকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে মনে করেন৷ কিন্তু ঐশী ধর্মগুলো বিশেষকরে,ইসলাম ধর্ম পবিত্র কোরআন ও মহানবীর শিক্ষাকে ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়ের জন্যেই সৌভাগ্যের মাধ্যম বলে মনে করে৷ ইসলাম ধর্ম ঈমান ও ধার্মিকতার শর্ত হিসেবে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং আমানত রক্ষার কথা বলে৷ কোন কোন হাদীসে এসেছে, কোন ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরে সেজদা ও রুকু করছে কিনা তা লক্ষ্য কর না, বরং তাদের আমানতদারী এবং সত্যবাদিতার দিকে লক্ষ্য কর৷ কারণ, আমানতের খিয়ানত করা কপটতা ও দ্বিমুখীতার লক্ষণ৷ আমানতের ব্যাপক অর্থ রয়েছে ৷ যেমন- সম্পদের আমানত, জ্ঞানের আমানত ও পারিবারিক আমানত৷ এমনকি সমাজের নেতৃত্বও আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আমানত। যোগ্য ও সৎ ব্যক্তির কাছে সমাজের নেতৃত্ব দেয়া হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে জনগণের পূর্ণ সচেতন থাকা উচিত৷ কারণ, অযোগ্য লোকের নেতৃত্ব ও তার অত্যাচার অবিচার বহু সামাজিক সংকট সৃষ্টি করে৷ মানুষের কাছে তিন ধরনের আমানত রয়েছে ৷ প্রথম আমানত হলো মানুষের প্রতি খোদার আমানত৷ আল্লাহর বিধান মেনে চলা এবং তাঁর বিধান অমান্য না করাই হলো এই আমানত৷ দ্বিতীয় আমানত হলো, মানুষের পরস্পর আমানত৷ বিন্দুমাত্র কম না করে মালিকের কাছে এই আমানত ফিরিয়ে দেয়া উচিত৷ তৃতীয় আমানত হলো , মানুষের নিজের কাছে রাখা আমানত৷ যেমন-বয়স,শক্তি, আত্মিক ও শারীরিক ক্ষমতা৷এসবই আমাদের কাছে রাখা আমানত৷ এমনকি আমরা নিজেরাই তো নিজেদের মালিক নই৷ বরং আমরা আমাদের দেহ ও মনের আমানতদার৷ আমাদের প্রকৃত মালিককে তথা আল্লাহকে খুশি করার জন্য এসবকে সবচেয়ে ভালো পন্থায় ব্যবহার করতে হবে৷

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো, প্রত্যেক আমানতের মালিক রয়েছে৷ প্রকৃত মালিকের কাছেই আমানত ফিরিয়ে দেয়া উচিত৷ রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিচার করার মত আমানত অযোগ্য লোকদের হাতে ছেড়ে দেয়া ঈমানের লক্ষণ নয়৷ আমানতের মালিক যদি কাফেরও হয় তাও তার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে৷

সূরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا ((৫৯

"হে বিশ্বাসীগণ,যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস কর তবে,তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের অনুগত হও, আর তোমাদের মধ্য থেকে ঐসব নেতৃবৃন্দের যারা আদেশ দেয় কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে সে ব্যাপারে আল্লাহর কোরআন ও রাসূলের শরণাপন্ন হও৷ এটাই কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠ পরিণতি ৷" (৪:৫৯)

আগের আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা বলেছিলাম, যোগ্য ও সৎ মানুষের কাছে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেয়া উচিত৷ এ আয়াতে মুমিনদের বলা হচ্ছে,আল্লাহ ও রাসূল (সা.)'র আনুগত্য করা ছাড়াও ন্যায় পরায়ণ শাসকদেরও আনুগত্য করতে হবে৷ আল্লাহ ও কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাসের জন্যে এটাও জরুরী ৷ ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী মহানবী (সা.) তাবুক যুদ্ধে রওনা হবার সময় আলী ইবনে আবু তালেব (আ.) কে মদিনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান৷ মহানবী (সা.) তাঁকে বলেন, "হে আলী তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মুসার সাথে হারুনের সম্পর্কের মত, যদিও আমার পরে কোন নবী আসবে না।" এ সময় ওই আয়াত নাজিল হয় এবং হযরত আলী (আ.)'র অনুসরণ করতে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়৷ উলিল আমর বা নির্দেশদাতা নেতাকে চিহ্নিত করা এবং তাঁর বৈশিষ্ট্য নিয়ে যাতে মতভেদ দেখা না দেয়, সেজন্যে আয়াতের পরবর্তী অংশে আল্লাহ বলেছেন আল্লাহর গ্রন্থ কোরআনে এবং রাসূলের হাদীসে যা এসেছে তার শরণাপন্ন হও৷ এটাই তোমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বিচারক এবং এ দুয়ের অনুসরণের ফলাফলই সর্বোত্তম৷ এটা স্পষ্ট, মহানবী ও উলিল আমরের অনুসরণ করার অর্থ হলো,আল্লাহরই নির্দেশ মানা৷ তৌহিদ বা একত্ববাদের সাথে এর কোন সংঘাত নেই৷ কারণ, আল্লাহই মহানবী ও উলিল আমরের নির্দেশ মান্য করতে বলেছেন৷

এই আয়াতে আমরা যা শিখলাম তা হলো,

প্রথমত : মহানবী (সা.) ও উলিল আমরের নির্দেশ মেনে চলা একটি স্পষ্ট আইন৷ এ সার্বজনীন আইন কোন শর্তযুক্ত নয়৷ আর এই আয়াত থেকে বোঝা যায় রাসূলে খোদা ও উলিল আমর নিস্পাপ এবং ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত৷

দ্বিতীয়ত : ইসলামী সরকারকে মেনে নেয়া সব মুসলমানেরই দায়িত্ব৷ ইসলামী রাষ্ট্রের ন্যায় পরায়ন শাসকের আনুগত্য করা ও তাঁকে সাহায্য করাও প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য৷

তৃতীয়ত : মহানবী (সা.) দু'টি পদ বা বিভাগের দায়িত্বশীল ছিলেন৷ তিনি একদিকে আল্লাহর বিধান প্রচার করতেন এবং অন্যদিকে সমাজের চাহিদা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় বিধান প্রণয়ন করতেন৷

চতুর্থত : মুসলমানদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মতভেদ দূর করার সবচেয়ে ভালো পন্থা হলো, পবিত্র কোরআনের ও রাসূলের অনুসরণ করা ৷ মুসলমানদের প্রত্যেক মাজহাবই পবিত্র কোরআন ও রাসূলের সুন্নতকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা ৷