প্রাক ইসলামী যুগে আরবের অবস্থা (২য় পর্ব)

আরবদের সাহস ও বীরত্ব

বলা যেতে পারে যে, মানসিকভাবে জাহেলিয়াত যুগের আরবগণ লোভী মানুষের পূর্ণাঙ্গ উপমা ছিল। পার্থিব বস্তুসামগ্রীর প্রতি ছিল তাদের দুর্বার আকর্ষণ। তারা প্রতিটি বস্তু বা বিষয়কেই তার অন্তর্নিহিত লাভ ও উপকারের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করত (অর্থাৎ যে জিনিসে যত বেশি লাভ ও উপকার পাওয়া যেত সেটিই তাদের কাছে প্রিয় ও কাম্য হতো)। তারা সর্বদা অন্যদের চেয়ে নিজেদের এক ধরনের উচ্চমর্যাদা, সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব আছে বলে বিশ্বাস করত। তারা সীমাহীনভাবে স্বাধীন থাকতে ভালবাসত। তাই যে সব বিষয় তাদের স্বাধীনতাকে সীমিত করে দিত তা তারা মোটেও পছন্দ করত না।

ইবনে খালদুন আরবদের অবস্থা প্রসঙ্গে বলেছেন, “স্বভাবপ্রকৃতির দিক থেকে এ জাতিটি অসভ্য, বর্বর এবং লুটতরাজপ্রিয় ছিল। তাদের মধ্যে অসভ্যতা ও বর্বরতার কারণগুলো এতটা গভীরে প্রোথিত ছিল যে সেগুলো যেন তাদের স্বভাব-চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তারা তাদের এ ধরনের অসভ্য স্বভাব-চরিত্রকে বেশ মজা করে উপভোগ করত। কারণ তাদের এই চারিত্রিক বর্বরতা ও অসভ্যতার কারণেই তারা কোন শাসকের শাসন বা আইন-কানুনের আনুগত্য ও সকল ধরনের বাধ্যতামূলক বন্ধন থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারত এবং রাজ্যশাসন নীতির বিরুদ্ধাচরণ করত। আর এটি স্পষ্ট প্রমাণিত যে, এ ধরনের স্বভাব-চরিত্র সভ্যতা ও কৃষ্টির সম্পূর্ণ পরিপন্থী।...”

এরপর তিনি আরো বলেছেন, “তাদের স্বভাবে ছিল লুণ্ঠন ও দস্যুবৃত্তি। তারা অন্যদের কাছে যা পেত তা ছিনিয়ে নিত। বর্শা ও তরবারির মাধ্যমেই তাদের জীবিকা নির্বাহ হতো। অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করার ক্ষেত্রে তারা কোন সীমারেখার ধার ধারত না, বরং যে কোন সম্পদ ও জীবনযাপনের উপকরণের ওপর দৃষ্টি পড়লেই তারা তা লুণ্ঠন করত।”

আসলে লুটতরাজ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ আরবদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। কথিত আছে, মহানবী (সা.)-এর কণ্ঠে বেহেশতের সুখ-শান্তির কথা শোনার পর এক আরব বেহেশতে যুদ্ধ-বিগ্রহের অস্তিত্ব আছে কিনা এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিল। যখন তাকে এর উত্তরে বলা হলো : না সেখানে যুদ্ধ-বিগ্রহের কোন অস্তিত্ব নেই, তখন সে বলেছিল, “তাহলে বেহেশত থাকলেই বা লাভ কি?” আরব জাতির ইতিহাসে ১৭০০-এর বেশি যুদ্ধের কাহিনী লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কোন কোন যুদ্ধ ১০০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে চলেছে। অর্থাৎ কয়েকটি প্রজন্ম পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ করেই কালাতিপাত করেছে। কখনো কখনো অত্যন্ত তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ, রক্তপাত ও হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। ইসলামপূর্ব আরব জাতির অন্যতম ঘটনা হচ্ছে একটি দীর্ঘ যুদ্ধ যা ইতিহাসে ‘হারবু দাহিস ওয়া গাবরা’ নামে প্রসিদ্ধ। দাহিস ও গাবরা দু’গোত্রপতির দু’টি ঘোড়ার নাম ছিল। দাহিস বনি আবেস গোত্রের প্রধান কাইস বিন যুহাইরের ঘোড়ার নাম এবং গাবরা ছিল বনি ফিরাযাহ্ গোত্রপতি হুযাইফার ঘোড়ার নাম। উক্ত গোত্রপতিদ্বয়ের প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ ঘোড়াকে অন্যের ঘোড়া অপেক্ষা অধিকতর দ্রুতগতিসম্পন্ন বলে মনে করত। অবশেষে তাদের মধ্যে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়; কিন্তু প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পর প্রত্যেকেই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার দাবি করল। এই ত্চ্ছু বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো। নিহতের গোত্রও হত্যাকারী গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করল। কিন্তু ঘটনাটি এখানেই শেষ হলো না, বরং এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দু’বৃহৎ গোত্রের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা  হলো যা ৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬০৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চলতে থাকে এবং এর ফলে উভয় পক্ষের অগণিত লোক নিহত হয়।

জাহেলী যুগের আরবরা বিশ্বাস করত যে, রক্ত ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে রক্তকে ধুয়ে সাফ করা যায় না। শানফারা-এর ঘটনা যা একটি উপাখ্যানসদৃশ তা জাহেলী গোত্রপ্রীতির মাত্রার নির্দেশক হতে পারে। সে (শানফারাহ্) বনি সালমান গোত্রের এক ব্যক্তির হাতে লাঞ্ছিত হলে এর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উক্ত গোত্রের ১০০ জনকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অবশেষে দীর্ঘকাল দিগ্বিদিক ঘোরাঘুরি ও চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে অপমানকারী গোত্রের ৯৯ জনকে হত্যা করে। এরপর একদল দস্যু একটি কূপের কাছে তাকেও হত্যা করে। বহু বছর পর নিহত শানফারা-এর হাড় ও মাথার খুলি অপমানকারী গোত্রের শততম ব্যক্তির হত্যার কারণে পর্যবসিত হয়। কাহিনীটি এরূপ : বনি সালমান গোত্রের এক পথিক সেখান দিয়ে অতিক্রম করছিল। হঠাৎ মরুঝড় মাথার খুলি উড়িয়ে এনে ঐ পথিকটির পায়ে কঠিনভাবে আঘাত করে। ফলে সে পায়ের তীব্র ব্যথায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

আরব বেদুইনরা রক্তপাত, খুন-খারাবি, লুটতরাজ ও দস্যুবৃত্তিতে এতটা অভ্যস্ত ছিল যে, পরস্পর গর্ব-অহংকার করার সময় তারা অন্যদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠনকে তাদের অন্যতম গর্ব ও অহংকারের বিষয় বলে গণ্য করত। এক জাহেলী আরব কবি লুটতরাজ করার ক্ষেত্রে নিজ গোত্রের অপারগতা দেখে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে আকাঙ্ক্ষা করেছিল :

“হায় যদি সে এ গোত্রের না হয়ে অন্য কোন গোত্রের হতো যারা অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে লুটতরাজ করত।”

এ জাতি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এ রকম বলা হয়েছে :

)و كنتم على شفا حفرة من النّار فأنقذكم منها(

“আর তোমরা, হে আরব জাতি! অগ্নিকুণ্ডের ধারে ছিলে। মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে তা থেকে পরিত্রাণ দিয়েছেন।”

জাহেলিয়াত যুগের আরবদের সাংস্কৃতিক অবস্থা

পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত ও রিসালাতের পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ নাতিদীর্ঘ বাক্যসমূহের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে (যদিও বাক্যগুলো ছোট, কিন্তু গভীর অর্থ ও তাৎপর্যমণ্ডিত)। ঐ সকল আয়াত যা দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য তন্মধ্যে এ আয়াতটি এখানে উল্লেখ করা হলো :

)و يضع عنهم إصرهم و الأغلال الّتى كانت عليهم(

“তিনি (মহানবী) তাদের থেকে তাদের বোঝা এবং শিকল ও বেড়ী থেকে মুক্ত করেন যা তাদের ওপর (বাঁধা) রয়েছে।” (সূরা আরাফ : ১৫৭)

এখানে অবশ্যই দেখতে হবে যে, যে শিকল ও বেড়ীতে ইসলাম ধর্মের শুভ সূচনালগ্নে জাহেলিয়াতের যুগের আরব জাতির হাত ও পা বাঁধা ছিল তা কি? নিঃসন্দেহে এই শিকল ও বেড়ী লৌহ নির্মিত ছিল না, বরং এ সব শিকল ও বেড়ী বলতে কুসংস্কার, অলীক কল্পনা এবং ধ্যান-ধারণাকে বোঝানো হয়েছে যা মানুষের চিন্তাশক্তি ও বিবেকবুদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। এ ধরনের বাঁধন যদি মানুষের চিন্তাশক্তির পাখার সাথে বেঁধে দেয়া হয় তাহলে তা লোহার বেড়ী ও শিকল হতে বেশি ক্ষতিকর হবে। কারণ লৌহনির্মিত শিকল কিছুদিন অতিবাহিত হলে বন্দীর হাত ও পা থেকে খুলে নেয়া হয়। আর জেলে বন্দী ব্যক্তিটি সুস্থ চিন্তাধারাসহকারে এবং কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে বাস্তব জীবনে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু অমূলক চিন্তা, ধারণা এবং ভ্রান্ত কল্পনার শিকলে যদি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি, আবেগ-অনুভূতি এবং অনুধাবন শক্তি বাঁধা হয়ে যায় তাহলে তা আমৃত্যু তার সাথে থেকেই যেতে পারে এবং তাকে যে কোন ধরনের তৎপরতা ও প্রচেষ্টা, এমনকি তা এ ধরনের বাঁধন খোলার জন্যও যদি হয়ে থাকে তা থেকে তাকে বিরত রাখে। মানুষ সুস্থ চিন্তাধারা এবং বিবেক ও জ্ঞানের ছত্রছায়ায় যে কোন ধরনের কঠিন বাঁধন ও শৃঙ্খল ভেঙে ফেলতে সক্ষম। তবে সুস্থ চিন্তাধারা ছাড়া এবং সব ধরনের অলীক ও ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত না হলে মানুষের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও কর্মতৎপরতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অন্যতম গৌরব ও কৃতিত্ব হচ্ছে, তিনি সকল প্রকার কুসংস্কার, অমূলক চিন্তাভাবনা ও অলীক কল্প-কাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তিনি মানব জাতির বিবেক-বুদ্ধিকে কুসংস্কারের মরিচা ও ধুলোবালি থেকে ধৌত করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেছেন। তিনি বলেছেন, “মানুষের চিন্তাশৈলীকে শক্তিশালী করতে এবং সব ধরনের কুসংস্কার, এমনকি যে কুসংস্কার আমার লক্ষ্য অর্জনের পথে সহায়ক সেটিরও বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতেই আমি এসেছি।”

বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনগণের ওপর শাসনকর্তৃত্ব চালানো ছাড়া যাদের আর কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে নেই তারা সব সময় যে কোন অবস্থা ও পরিস্থিতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে; এমনকি প্রাচীন কল্পকাহিনী এবং জাতির কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস যদি নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হয় তাহলে তারা তা প্রসার ও প্রচার করতে দ্বিধাবোধ করে না। আর তারা যদি চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদীও হয় তাহলেও তারা সাধারণ জনতার ধ্যান-ধারণা ও সংখ্যাগরিষ্ঠের আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নামে বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী ঐ সকল অমূলক কল্প-কাহিনী ও ধ্যান-ধারণাকে সমর্থন করতে থাকে।

তবে মহানবী (সা.) যে সব কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস তাঁর ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর কেবল সেগুলোর বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেন নি, বরং যে কোন ধরনের আঞ্চলিক কল্প-কাহিনী ও উপাখ্যান অথবা ভিত্তিহীন চিন্তা ও বিশ্বাস যা তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সহায়ক সেটির বিরুদ্ধেও তাঁর সকল শক্তি ও ক্ষমতা নিয়োগ করে সংগ্রাম করেছেন। তিনি সব সময় চেষ্টা করেছেন মানুষ যেন সত্যপূজারী হয়। ভিত্তিহীন কল্প-কাহিনী, উপাখ্যান ও কুসংস্কারের পূজারীতে যেন পরিণত না হয়। এখন উদাহরণস্বরূপ নিম্নোক্ত কাহিনীটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করুন :

মহানবী (সা.)-এর এক পুত্রসন্তান মারা গেলেন যাঁর নাম ছিল ইবরাহীম। তিনি পুত্রবিয়োগে শোকাহত ও দুঃখভারাক্রান্ত ছিলেন এবং তাঁর পবিত্র নয়নযুগল থেকে অশ্রু ঝরছিল। ইবরাহীমের মৃত্যুর দিনে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। আরবের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অলীক কল্প-কাহিনীর পূজারী জাতি সূর্যগ্রহণকে মহানবী (সা.)-এর ওপর আপতিত বিপদের চরম ও বিরাট হওয়ার প্রমাণ বলে মনে করল এবং বলতে লাগল : মহানবী (সা.)-এর পুত্রের মৃত্যুতে সূর্যগ্রহণ হয়েছে। মহানবী (সা.) তাদের এ কথা শুনে বললেন, “চন্দ্র ও সূর্য মহান আল্লাহর অসীম শক্তি ও ক্ষমতার দু’টি বড় নিদর্শন এবং তারা সর্বদা আদেশ পালনকারী। কারো জীবন ও মৃত্যু উপলক্ষে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয় না। যখনই চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ হবে তখন তোমরা সবাই নিদর্শনসমূহের নামায আদায় করবে।” এ কথা বলে তিনি মিম্বার থেকে নিচে নেমে আসলেন এবং উপস্থিত ব্যক্তিবর্গকে সাথে নিয়ে আয়াতের নামায পড়লেন।

মহানবী (সা.)-এর পুত্রের মৃত্যুতে সূর্যগ্রহণ হয়েছে চিন্তা করা যদিও মহানবী (সা.)-এর প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসকে দৃঢ়তর করত এবং পরিণতিতে তাঁর ধর্মের অগ্রগতি ও প্রসারের ক্ষেত্রে সহায়কও হতো, কিন্তু তিনি চান নি এবং সন্তুষ্ট হতে পারেন নি যে, অলীক কল্প-কাহিনীর দ্বারা জনগণের অন্তরে তাঁর স্থান দৃঢ় ও শক্তিশালী হোক। অলীক কল্প-কাহিনী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম যার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হচ্ছে মূর্তিপূজা এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্তার উপাস্য হওয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তা কেবল তাঁর রিসালাতের পদ্ধতি ছিল না, বরং তিনি তাঁর জীবনের সব ক’টি পর্বেই, এমনকি তাঁর শৈশবকালেও কুসংস্কার ও ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।

যে সময় মহানবী (সা.)-এর বয়স ছিল চার বছর এবং মরুভূমিতে দুধ মা হালিমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হচ্ছিলেন তখন তিনি তাঁর দুধ মা হালিমার কাছে তাঁর দু’ভাইয়ের সাথে মরুভূমিতে যাওয়ার ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলেন। হালিমা এ ব্যাপার বলেন, “পরের দিন মুহাম্মদকে গোসল দিলাম। তার চুলে তেল ও চোখে সুরমা দিলাম। যাতে করে মরুর শয়তানগুলো তার অনিষ্ট সাধন করতে না পারে সেজন্য একটি ইয়েমেনী পাথর সুতায় ভরে তাকে রক্ষা করার জন্য তার গলায় পরিয়ে দিলাম।” মহানবী (সা.) ঐ পাথরটি গলা থেকে খুলে এনে দুধ মা হালিমাকে বললেন, مهلا يا إمّاه، فإنّ معي من يحفظني “মা, শান্ত হোন, আমার আল্লাহ্ সর্বদা আমার সাথে আছেন। তিনি আমার রক্ষাকারী।”

বিশ্বের সকল জাতি ও সমাজের আকীদা-বিশ্বাস ইসলামের সূর্যোদয়ের সময় বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কার ও অলীক উপাখ্যান দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল। গ্রীক ও সামানীয় অলীক উপাখ্যান ও কল্প-কাহিনীসমূহ সে যুগের সবচেয়ে সভ্য ও উন্নত জাতিসমূহের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এখনও প্রাচ্যের উন্নত জাতিসমূহের মধ্যে অনেক কুসংস্কার বিদ্যমান রয়েছে যা আধুনিক সভ্যতা জনগণের জীবন থেকে দূর করতে পারে নি। জ্ঞান ও কৃষ্টিসমূহের অনুপাতে কল্প-কাহিনী ও কুসংস্কারের প্রসার ও বিলুপ্ত হয়ে থাকে। সমাজ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে যত পশ্চাদপদ ও অনগ্রসর  হবে ঠিক সেই অনুপাতে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসও তাদের মধ্যে বৃদ্ধি পাবে।

ইতিহাস আরব উপদ্বীপের অধিবাসীদের প্রচুর কুসংস্কার ও কল্প-কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছে। ‘বুলূগুল আরবে ফী মারেফাতি আহওয়ালিল আরাব’ গ্রন্থের রচয়িতা৩৯ এ সব কুসংস্কার ও কল্প-কাহিনীর অনেকাংশ কতগুলো কবিতা ও গল্প আকারে ঐ গ্রন্থে সংগ্রহ করেছেন। যে কোন ব্যক্তি এ গ্রন্থ ও অন্যান্য গ্রন্থ পাঠ করার পর নানারূপ কুসংস্কারের সাথে পরিচিত হবেন যা জাহেলী আরবদের মন-মস্তিষ্ক ভর্তি করে রেখেছিল। আর এ সব ভিত্তিহীন বিষয়বস্তু ছিল অন্যান্য জাতি থেকে আরব জাতির অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ হওয়ার কারণ। ইসলাম ধর্মের অগ্রগতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ঐ সব কল্প-কাহিনী ও কুসংস্কার।

আর এ কারণেই মহানবী (সা.) তাঁর সকল শক্তি নিয়োগ করে জাহেলিয়াতের নিদর্শনসমূহ যা ছিল বিভিন্ন ধরনের অসার কল্প-কাহিনী, অলীক ধ্যান-ধারণা ও কুসংস্কার তা মূলোৎপাটন করার চেষ্টা করেছেন। মহানবী (সা.) যখন মায়ায ইবনে জাবালকে ইয়েমেনে প্রেরণ করেছিলেন তখন তিনি তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “হে মায়ায! জনগণের মধ্য থেকে জাহেলিয়াতের সকল চি‎হ্ন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস উচ্ছেদ করবে এবং ইসলামের যাবতীয় প্রথা ও আদর্শ যা হচ্ছে চিন্তা-ভাবনা এবং গভীর অনুধাবন ও উপলব্ধির দিকে আহবান তা পুনরুজ্জীবিত করবে।”

و أمت امر الجاهلية إلّا ما سنّهُ الإسلام و أظهر أمر الإسلام كلّه صغيره و كبيره

যে আরব জাতির ওপর বহু বছর যাবত জাহেলী চিন্তাধারা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আকীদা-বিশ্বাস প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল তাদের সামনে তিনি এ রকম বলেছিলেন,

كلّ مأثرة في الجاهلية تحت قدمي

“(ইসলামের আবির্ভাবের সাথে সাথে) সব ধরনের অলীক আচার-অনুষ্ঠান, আকীদা-বিশ্বাস, মিথ্যা অহমিকা ও গর্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং তা আমার পদতলে রাখা হলো।”

যাতে করে ইসলাম ধর্মের উচ্চাঙ্গের তত্ত্বজ্ঞান স্পষ্ট হয়ে যায় সেজন্য এখানে কতিপয় উদাহরণ পেশ করব :

১. বৃষ্টি বর্ষণের জন্য আগুন জ্বালানো : আরব উপদ্বীপ বছরের বেশিরভাগ সময়ই শুষ্ক থাকে; সেখানকার অধিবাসীরা বৃষ্টিপাতের জন্য ‘সালা’ (سلع) নামের এক প্রকার নিমজাতীয় বৃক্ষের কাঠ এবং ‘ওসর’ (عشر) নামের অপর একটি দ্রুত দহনশীল বৃক্ষের কাঠ একত্র করে সেগুলোকে গরুর লেজের সাথে বেঁধে গরুকে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যেত। তারপর ঐ কাঠগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিত। ওসর বৃক্ষের কাঠের মধ্যে দগ্ধকারী উপাদান থাকার কারণে ঐ কাঠগুলো থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠত। আর গরুটি দগ্ধ হওয়ার কারণে ছুটোছুটি ও উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার শুরু করত। তারা এ ধরনের কাপুরুষোচিত কাজকে পূর্বপুরুষদের প্রাচীন রীতিনীতির অনুসরণ হিসাবে আকাশের বিদ্যুৎ চমকানি ও বজ্রপাতের সাথে তুলনা করত। তারা অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে বিদ্যুৎ এবং গরুর চিৎকারকে বজ্রপাতের শব্দের স্থলে বিবেচনা করত; তারা তাদের এ কাজকে বৃষ্টি বর্ষণে কার্যকর প্রভাব রাখে বলে বিশ্বাস করত।

২. যদি গাভী পানি না খেত তাহলে তারা ষাঁড়কে প্রহার করত। পানি পান করানোর জন্য গাভী ও ষাঁড়গুলোকে পানির নালার ধারে নিয়ে যাওয়া হতো। মাঝে মধ্যে এমন হতো যে, ষাঁড়গুলো পানি খেত, কিন্তু গাভীগুলো পানি স্পর্শও করত না। আরবরা মনে করত যে, গাভীগুলোর পানি পান করা থেকে বিরত থাকার কারণ হচ্ছে ঐ সব শয়তান যা ষাঁড়ের দু’শিংয়ের মাঝখানে স্থান নিয়েছে এবং গাভীগুলোকে পানি পান করতে দিচ্ছে না। তাই ঐ শয়তানগুলোকে তাড়ানোর জন্য ষাঁড়ের মাথা ও মুখমণ্ডলে প্রহার করত।

৩. নীরোগ উটের মাথায় আগুনের ছ্যাঁকা দেয়া হতো যাতে করে অপরাপর উট সুস্থ হয়ে ওঠে: কোন উট যদি অসুস্থ হয়ে পড়ত অথবা উটের ঠোঁট ও মুখে ক্ষত ও ঠোসা দেখা যেত তাহলে অন্যান্য উটের মধ্যে এ রোগের সংক্রমণ রোধ করার জন্য একটি সুস্থ উটের ঠোঁট, বাহু ও ঊরুতে ছ্যাঁকা দেয়া হতো, কিন্তু তাদের এ কাজের কারণ স্পষ্ট নয়। কখনো কখনো ধারণা করা হয় যে, এ ধরনের কাজের রোগ-প্রতিষেধক দিক আছে এবং এটি এক ধরনের বৈজ্ঞানিক চিকিৎসাপদ্ধতিও হতে পারে। কিন্তু যেহেতু অনেক উটের মধ্য থেকে কেবল একটি উটের ওপর এ ধরনের বিপদ নেমে আসত তাই বলা যায় যে, তা এক ধরনের কুসংস্কার।

৪. একটি উটকে কোন কবরের কাছে আটকে রাখা হতো যাতে করে কবরবাসী কিয়ামত দিবসে পদব্রজে (কবর থেকে) উত্থিত না হয় (অর্থাৎ উক্ত উটের ওপর সওয়ার অবস্থায় উত্থিত হয়)।

যদি কোন মহান ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করত তখন ঐ ব্যক্তির কবরের পাশে একটি গর্ত খুঁড়ে তাতে একটি উট আটকে রাখা হতো এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঐ উটকে দানা-পানি ও খড়কুটা কিছুই খেতে দেয়া হতো না যাতে করে কিয়ামত দিবসে মৃত ব্যক্তি ঐ উটের ওপর সওয়ার হয় এবং দণ্ডায়মান অবস্থায় তার পুনরুত্থান না হয়।

৫. কবরের পাশে উট জবাই করা হতো। যেহেতু মৃত ব্যক্তি জীবদ্দশায় তার প্রিয় ব্যক্তি ও অতিথিদের জন্য উট জবাই করত তাই মৃতকে সম্মান ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তার আত্মীয়স্বজন তার কবরের কাছে বেদনাদায়কভাবে উট বধ করত।

কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ইসলামের সংগ্রাম

এ ধরনের কাজ যা যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার সাথে মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়। কারণ আগুন জ্বালানোর কারণে বৃষ্টিপাত হয় না, ষাঁড়কে প্রহার করলে গাভীর মধ্যে এর কোন প্রভাবই পড়ে না, আর নীরোগ উটকে ছ্যাঁকা দিলে তা রোগাক্রান্ত উটের সুস্থতা ও রোগমুক্তির কারণ হয় না এবং...) পশুগুলোর প্রতি অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা যদি এ সব আচার-আচরণকে ইসলামের সুদৃঢ় বিধিবিধান-যা জীবজন্তু সংরক্ষণ করার ব্যাপারে প্রবর্তিত হয়েছে সেগুলোর সাথে তুলনা করি তাহলে আমাদের বলতে হবে : এই শরীয়ত তদানীন্তন আরব সমাজে প্রচলিত চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা এখানে ইসলামের অগণিত বিধানের মধ্য থেকে কেবল একটি ছোট বিধান উল্লেখ করব :

মহানবী (সা.) বলেছেন, “প্রতিটি বাহক পশুর আরোহীর ওপর ছয়টি অধিকার আছে : ১. যে অবতরণস্থলে অবতরণ করবে সেখানে পশুটিকে কিছু খাদ্য খেতে দেবে, ২. যদি পানি বা জলাধারের পাশ দিয়ে গমন কর, তাহলে ঐ পশুটিকে পানি পান করাবে, ৩. পশুর মুখের ওপর চাবুক মারবে না, ৪. দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সময় পশুর পিঠের ওপর বসে থাকবে না, ৫. ক্ষমতার বাইরে পশুর ওপর অধিক বোঝা চাপাবে না, ৬. যে পথে চলার সামর্থ্য পশুটির নেই সে পথে পশুকে চালনা করবে না।”

৬. রোগীদের চিকিৎসাপদ্ধতির ক্ষেত্রে কুসংস্কার : যদি কোন ব্যক্তিকে বিচ্ছু বা সাপ দংশন করত তাহলে উক্ত ব্যক্তির ঘাড়ে স্বর্ণালংকার ঝোলানো হতো এবং বিশ্বাস করা হতো যে, যদি দংশিত ব্যক্তির সাথে তামা ও টিন থাকে তাহলে সে মারা যাবে। জলাতঙ্ক রোগ-যা সাধারণত উক্ত রোগে আক্রান্ত কুকুরের দংশনে সংক্রমিত হয়-দংশিত স্থানের ওপর গোত্রপ্রধানের অল্প রক্ত মাখিয়ে চিকিৎসা করা হতো। আর নিম্নোক্ত কবিতায় তা প্রতিফলিত হয়েছে :

أحلامكم لسقام الجهل شافية

كما دماءكم تشفى من الكلب

“যেমন (জলাতঙ্ক ব্যাধিবাহী) কুকুর হতে আরোগ্য দেয় তোমাদের রক্ত

ঠিক তেমনি তোমাদের স্বপ্নগুলোও অজ্ঞতা (জনিত) ব্যাধির আরোগ্যদানকারী।”

আর যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে উন্মাদনার আলামত প্রকাশ পেত তাহলে অপবিত্র আত্মা দূর করার জন্য নোংরা কার্যকলাপের আশ্রয় নেয়া হতো। নোংরা ন্যাকড়া এবং মৃত ব্যক্তিদের হাড় পাগলের গলায় ঝুলানো হতো। যাতে করে শিশুরা শয়তানের কুপ্রভাব দ্বারা প্রভাবিত না হয় (অর্থাৎ শয়তানের প্রভাব তাদের ওপর না পড়ে) সেজন্য শিয়াল ও বিড়ালের দাঁত সুতার সাথে বেঁধে শিশুদের গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হতো। যখন শিশুদের ঠোঁট ও মুখ বিষফোঁড়ায় ভরে যেত তখন শিশুর মা একটি চালুনী মাথার ওপর বসিয়ে গোত্রের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে রুটি ও খেজুর জমা করত এবং তা কুকুরকে খেতে দিত যাতে করে নিজ সন্তানের ঠোঁট ও মুখের ফোঁড়া সেরে যায়; গোত্রের মহিলারা সজাগ দৃষ্টি রাখত যে, তাদের সন্তানরা ঐ সব রুটি ও খেজুর থেকে কিছু না খায়, পাছে তারা এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

চর্মরোগ, যেমন দেহের চামড়া ঝরে পরার চিকিৎসা করার জন্য মুখের লালা চর্মরোগাক্রান্ত স্থানে মালিশ করত। যদি কোন ব্যক্তির (চর্ম) রোগ এতে ভালো না হতো এবং অব্যাহত থাকত তাহলে ভাবা হতো রোগী যে সব প্রাণী, যেমন সাপ, শয়তানদের (অপদেবতা) সাথে যুক্ত সেগুলোর কোন একটিকে হত্যা করেছে। তারা শয়তানদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য কাদামাটি দিয়ে উটের মূর্তি নির্মাণ করত। এরপর যব, গম ও খেজুর ঐ মূর্তিগুলোর ওপরে রেখে সেগুলো পাহাড়ের গুহার সামনে রেখে চলে আসত এবং পরের দিন তারা উক্ত স্থানে ফিরে যেত। যদি তারা দেখতে পেত যে, বোঝাগুলো খোলা হয়েছে, তাহলে তারা একে নজরানা কবুল হওয়ার নিদর্শন বলে গণ্য করত এবং বলত যে, রোগীটি সুস্থ হয়ে যাবে। আর এর অন্যথা হলে তারা বিশ্বাস করত, যেহেতু এ নজরানা তুচ্ছ ও নগণ্য তাই তা অপদেবতারা গ্রহণ করে নি।

ইসলাম বিভিন্ন পদ্ধতিতে এ সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। একদল মরুচারী আরব বেদুইন যারা যাদুর কর্ণফুল, যাদুর তাবীজ, মাদুলী এবং হার-যার মধ্যে পাথর ও হাড় বেঁধে রাখা হতো তা দিয়ে রোগীর রোগের চিকিৎসা করত তারা যখন মহানবী (সা.)-এর কাছে গমন করত এবং উদ্ভিদ ও ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করত তখন মহানবী (সা.) বলতেন, “প্রতিটি রোগীর জন্য ঔষধ-পথ্যের ব্যবস্থা করা উচিত। কারণ যে আল্লাহ্ ব্যথা ও রোগযন্ত্রণা সৃষ্টি করেছেন তিনিই রোগের ঔষধও তৈরি করেছেন।” অর্থাৎ এ সব কর্ণফুল, তাবীজ, মাদুলী ও মালা রোগ নিরাময় করার ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। এমনকি যখন সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস হৃদরোগে আক্রান্ত হন তখন মহানবী (সা.) তাঁকে বলেছিলেন, “সাকীফ গোত্রের প্রসিদ্ধ ডাক্তার হারিস কালদার কাছে তোমরা অবশ্যই যাবে।” এরপর তিনি তাঁকে একটি বিশেষ ঔষধ সেবনের পরামর্শ দিলেন।

অধিকন্তু যাদুর কর্ণফুল, তাবীজ ও মাদুলী যেগুলোর আসলে কোন কার্যকর প্রভাব নেই সেগুলো সংক্রান্ত বেশ কিছু বর্ণনা বিদ্যমান রয়েছে। এখানে আমরা দু’টি বর্ণনা উল্লেখ করাই যথেষ্ট বলে বিবেচনা করছি :

এক ব্যক্তি যার সন্তান গলাব্যথা রোগে আক্রান্ত হয়েছিল সে যাদুর মাদুলী ও তাবীজসহ মহানবীর সামনে উপস্থিত হলো। মহানবী (সা.) বললেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদের যাদুর এ সব কর্ণফুল, তাবীজ ও মাদুলী দিয়ে ভয় দেখিও না। এই অসুস্থ রোগীকে ভারতীয় চন্দন কাঠের নির্যাস সেবন করানো প্রয়োজন।”

ইমাম সাদেক (আ.) বলতেন, إنّ كثيرا من التّمائم شرك “বহু বাজুবন্দ, কর্ণফুল ও মাদুলী হচ্ছে শিরক।”

মহানবী (সা.) এবং তাঁর সম্মানিত ওয়াসিগণ (নির্বাহী প্রতিনিধিগণ) জনগণকে অসংখ্য ঔষধ সম্পর্কে অবহিত করার মাধ্যমে যে সব অলীক ধারণা ও কুসংস্কার জাহেলী যুগের আরব জাতিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেগুলোর ওপর জোরালো আঘাত হেনেছেন। তাঁদের বর্ণিত এ সব ঔষধ-পথ্য বড় বড় হাদীসশাস্ত্রবিদ কর্তৃক ‘তিব্বুন নবী’ (নবীর চিকিৎসাপদ্ধতি), ‘তিব্বুর রেযা’ (ইমাম রেযার চিকিৎসাপদ্ধতি) ইত্যাদি শিরোনামে সংকলিত হয়েছে।

৭. আরো কিছু কুসংস্কার : দুশ্চিন্তা ও ভীতি দূর করার জন্য আরবরা নিম্নোক্ত মাধ্যমগুলো ব্যবহার করত :

ক. যখন তারা কোন গ্রামে প্রবেশ করত এবং কলেরা রোগ অথবা অপদেবতার ভীতি তাদের পেয়ে বসত তখন ভীতি দূর করার জন্য তারা গ্রামের ফটকের সামনে ১০ বার গাধার ন্যায় চিৎকার করত। আবার কখনো কখনো এরূপ চিৎকার করার সময় শিয়ালের হাড় ঘাড়ে ঝুলিয়ে রাখত।

খ. যখন তারা কোন মরুপ্রান্তরে হারিয়ে যেত তখন তারা তাদের পরিধেয় বস্ত্র উল্টে-পাল্টে পরত। সফর করার সময় যখন তারা তাদের স্ত্রীদের বিশ্বাসঘাতকতা করার আশংকা করত তখন তারা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কোন গাছের কাণ্ডে বা ডালে একটি সুতা বেঁধে রাখত। ফেরার সময় যদি তারা দেখতে পেত, সুতা অক্ষত ও পূর্বের অবস্থায় আছে তাহলে তারা নিশ্চিত হতো যে, তাদের পত্নীরা বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। আর যদি তারা দেখতে পেত, সুতাটি নেই অথবা খুলে গেছে তাহলে তারা তাদের স্ত্রীদের বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করত।

যদি তাদের সন্তানদের দাঁত পড়ে যেত তাহলে তারা ঐ দাঁতটিকে দু’আঙ্গুল দিয়ে ধরে সূর্যের দিকে ছুঁড়ে দিত ও বলত, “হে সূর্য! এ দাঁতের চেয়ে উত্তম দাঁত দাও।” যে নারীর সন্তান বাঁচত না সে যদি কোন বয়স্ক মানুষের নিহত লাশের ওপর দিয়ে সাত বার হাঁটত, তখন তারা বিশ্বাস করত যে, তার সন্তান জীবিত থাকবে।

এগুলো হচ্ছে অগণিত কুসংস্কারের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র যা জাহেলী যুগের বেদুইন আবরদের জীবনধারাকে প্রগাঢ়ভাবে তিমিরাচ্ছন্ন করেছিল এবং তাদের চিন্তা-ভাবনাকে উন্নতির সুউচ্চ শিখরে উড্ডয়ন করা থেকে বিরত রেখেছিল।

আরবের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা

মানব জাতি সামাজিক জীবনের দিকে প্রথম যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তা ছিল গোত্রীয় জীবন। গোত্র ছিল কতগুলো পরিবার ও আত্মীয়ের সমষ্টি যারা গোত্রের শেখ বা নেতার নেতৃত্বাধীনে জীবনযাপন করত। আর এভাবে গোত্রের মাধ্যমে সমাজের আদিমতম চিত্র বা রূপ অস্তিত্ব লাভ করে। সে সময়ের আরব জাতির জীবনযাত্রা এমনই ছিল। প্রতিটি গোত্র অন্য গোত্রের সাথে যোগ দিয়ে ছোট একটি সমাজ গঠন করত। গোত্রের সকল সদস্য গোত্রপতির আদেশ মেনে চলত। যে বিষয়টি তাদের পরস্পর সম্পর্কিত করে রেখেছিল তা ছিল তাদের গোত্রীয় বন্ধন ও আত্মীয়তা। এ সব গোত্র সব দিক থেকেই পরস্পর পৃথক ছিল; তাদের আচার-প্রথাও পৃথক ছিল। কারণ অন্য সকল গোত্র মূলত একে অপর থেকে আলাদা ও অপরিচিত বলে গণ্য হতো। প্রতিটি গোত্র অন্য গোত্রের কোন অধিকার ও সম্মান আছে-এ কথার স্বীকৃতি দিত না। প্রতিটি গোত্র অন্য গোত্রের ধন-সম্পদ লুণ্ঠন, সদস্যদের হত্যা এবং নারীদের অপহরণ করা তাদের আইনসংগত ন্যায্য অধিকার বলে গণ্য করত। তবে কোন গোত্রের সাথে যদি চুক্তি থাকত সে ক্ষেত্রে ছিল অন্যকথা। অন্যদিকে প্রতিটি গোত্র যখনই আগ্রাসন ও আক্রমণের শিকার হতো তখন সকল আগ্রাসনকারীকে হত্যা করা তাদের ন্যায্য অধিকার বলে গণ্য হতো। কারণ তারা বিশ্বাস করত যে, একমাত্র রক্ত ব্যতীত অন্য কিছু রক্তকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে সক্ষম নয়।

আরব জাতি ইসলাম ধর্ম কবুল করার মাধ্যমে গোত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পদার্পণ করে। মহানবী (সা.) বিক্ষিপ্ত আরব গোত্রগুলোকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে যে সব গোত্র সুদূর অতীতকাল থেকে পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও আক্রমণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল এবং একে অন্যের রক্ত ঝরাত তাদের অল্প সময়ের মধ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করা সত্যি একটি বড় কাজ এবং একটি অতুলনীয় সামাজিক মুজিযা (অলৌকিক বিষয়) বলে গণ্য। কারণ এ ধরনের বিশাল পরিবর্তন যদি কতগুলো স্বাভাবিক পরিবর্তন ও রূপান্তরেরই ফল হতো তাহলে এ ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ এবং অগণিত মাধ্যম ও উপায়-উপকরণের প্রয়োজন হতো।

টমাস কারলাইল বলেছেন, “মহান আল্লাহ্ ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে আরব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পরিচালিত করেছেন। সে জাতি স্থবির ছিল, যাদের ধ্বনি শোনা যেত না, যাদের কর্মতৎপরতা ও প্রাণচাঞ্চল্য অনুভূত হতো না তাদের থেকে এমন এক জাতির উদ্ভব হয় যারা অখ্যাতি থেকে খ্যাতির দিকে, অলসতা ও শৈথিল্য থেকে জাগরণের দিকে, হীনতা ও দীনতা থেকে উচ্চ মর্যাদার পানে, দুর্বলতা ও অক্ষমতা থেকে শক্তি ও ক্ষমতার দিকে অগ্রসর হয়েছে। তাদের থেকে আলো পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর একশ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই মুসলিম উম্মাহ্ এক পা ভারতে ও অপর পা আন্দালুসিয়ায় (বর্তমান স্পেন) রাখতে সক্ষম হয়েছিল।”

পাশ্চাত্যের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক মেসিয়োর ন্যাঁ (مسيورنان) তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন,

“এই বিস্ময়কর সুমহান ঘটনা (ইসলাম) যা আরব জাতিকে দিগ্বিজয়ী এবং উন্নত চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার উদ্ভাবকের পোশাকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে-তা ঘটার সময়কাল পর্যন্ত আরব উপদ্বীপের কোন অঞ্চলই না বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসের অংশ বলে গণ্য হতো, আর না বিজ্ঞান বা ধর্মের দৃষ্টিতে সেখানে সভ্যতার কোন নিদর্শন বিদ্যমান ছিল।”

হ্যাঁ, জাহেলিয়াত যুগের প্রশিক্ষণপ্রাপ্তগণ অর্থাৎ বিভিন্ন আরব গোত্র না কোন সভ্যতার আলো প্রত্যক্ষ করেছে, আর না তাদের কোন শিক্ষা-দীক্ষা, নিয়ম-কানুন ও আচার-প্রথার প্রচলন ছিল। যে সকল সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ও ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য উন্নতি ও সভ্যতা বিকাশের কারণ সেগুলো থেকে তারা সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত ছিল। অতএব, কখনই আশা করা যেত না যে, এই জাতি এত অল্প সময়ের মধ্যে মর্যাদা ও সম্মানের শীর্ষে আরোহণ করবে এবং সংকীর্ণ গোত্রীয় জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে মানবতার সুবিস্তৃত জগতের পানে অগ্রসর হবে।

পৃথিবীর জাতিসমূহ আসলে ইমারতসদৃশ। যেমনভাবে একটি মৌলিক ইমারত মজবুত উপাদানের মুখাপেক্ষী যা সঠিক পদ্ধতি অনুসারে এবং পূর্ণ শৃঙ্খলার সাথে নির্মিত হয়েছে যাতে করে তা ঝড়-ঝঞ্ঝা ও বৃষ্টি-বাদলের প্রভাব থেকে টিকে থাকতে এবং স্থায়ী হতে পারে, ঠিক তেমনি একটি সাহসী ও নৈতিক গুণসম্পন্ন জাতির গঠন-কাঠামো ও দৃঢ় ভিত্তিসমূহ অর্থাৎ মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস, পূর্ণাঙ্গ রীতি-নীতি এবং উন্নত মানবীয় স্বভাব-চরিত্রের মুখাপেক্ষী যাতে তা অস্তিত্ব বজায় রাখতে ও প্রগতির পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়।

এ মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত যে, কোথা থেকে এবং কিভাবে জাহেলী বেদুইন আরবদের ক্ষেত্রে এত আশ্চর্যজনক পরিবর্তন সাধিত হলো? যে জাতি গতকাল পর্যন্তও নিজেদের সার্বিক শক্তি মতবিরোধ ও কপটতার মধ্যে ব্যবহার করে নিঃশেষ করত এবং সব ধরনের সমাজব্যবস্থা থেকে বহু দূরে ছিল, এত অত্যাশ্চর্যজনক দ্রুতগতিতে সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও ঐক্যের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে গেল এবং একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করল যে, সেই সময়ের বিশ্বের বৃহৎ জাতিসমূহকে তাদের আকীদা-বিশ্বাস ও রীতিনীতির সামনে নতজানু ও একান্ত আনুগত্যশীল করতে সক্ষম হয়েছিল।

সত্যিই যদি নির্ধারিত হয়ে থাকে যে, হিজায অর্থাৎ আরব উপদ্বীপের আরব জাতি এত উন্নতি করবে এবং এত বড় সম্মান ও গৌরবের অধিকারী হবে তাহলে ইয়েমেনের আরবগণ যারা (পূর্ব হতে) সভ্যতা ও কৃষ্টির অধিকারী ছিল তারা বছরের পর বছর ধরে রাজত্ব করেছে এবং বড় বড় শাসনকর্তাকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছে তারা কেন এ ধরনের উন্নতি ও প্রগতির অধিকারী হতে পারে নি? শামদেশের প্রতিবেশী গাসসানী আরবগণ যারা সভ্য রোমীয় শাসনব্যবস্থার অধীনে জীবনযাপন করত তারা কেন উন্নতি ও বিকাশের এ পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হয় নি? হীরার আরবগণ যারা গতকালও বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাস করত তারা কেন এ ধরনের উন্নতি করতে সক্ষম হয় নি? প্রাগুক্ত জাতিসমূহ যদি এ ধরনের সাফল্য অর্জন করত তাহলে তা আশ্চর্যজনক বিষয় বলে বিবেচিত হতো না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এটিই যে, হিজাযের আরবগণ যাদের নিজেদের কোন ইতিহাসই ছিল না তারাই সুমহান ইসলামী সভ্যতার উত্তরাধিকারী হয়েছে।

হীরা ও গাসসান রাজ্যসমূহ

আরব উপদ্বীপের যে সব অঞ্চলের জলবায়ু ও আবহাওয়া ভালো ছিল সে সব অঞ্চল ইসলামের অভ্যুদয়ের আগে সর্বশেষ শতাব্দীতে পুরোপুরি তিন বৃহৎ শক্তি অর্থাৎ ইরান, রোম ও আবিসিনিয়ার অধীন ছিল। আরব উপদ্বীপের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ইরানের প্রভাবাধীন, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল রোমের অনুগত এবং মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চল হাবাশাহ্ অর্থাৎ আবিসিনিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। এ সব সভ্য রাষ্ট্রের পাশে থাকার কারণে এবং ঐ সব রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যের মধ্যে সর্বদা দ্বন্দ্ব থাকার কারণে আরব উপদ্বীপের সীমান্তবর্তী অঞ্চলসমূহে অর্ধ-স্বাধীন ও অর্ধ-সভ্য বেশ কিছু রাজ্যের পত্তন হয়েছিল যেগুলোর প্রতিটিই ছিল নিজ নিজ প্রতিবেশী সভ্য বৃহৎ সাম্রাজ্য ও রাষ্ট্রের অনুগত। হীরা, গাসসান ও কিন্দাহ্ ছিল ঐ ধরনের রাজ্য যেগুলোর প্রতিটি ছিল পারস্য, রোম ও আবিসিনীয় সাম্রাজ্যের যে কোন একটির প্রভাবাধীন।

ঐতিহাসিক তথ্য ও বিবরণাদি অনুযায়ী খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমাংশে আশকানীয় যুগের শেষের দিকে কতিপয় আরব গোত্র ফোরাত নদীর পাড়ে অবস্থিত এলাকায় বসতি স্থাপন করে এবং ইরাকের একটি অংশকে নিজেদের কর্তৃত্বে নিয়ে আসে। তারা ধীরে ধীরে এ সব বসতি স্থাপনকারী আরব গ্রাম, দুর্গ, শহর ও নগর প্রতিষ্ঠা করে যেগুলোর মধ্যে ‘হীরা’ নগরটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ নগরীটি বর্তমান কুফা নগরীর নিকটেই অবস্থিত ছিল।

এ শহরটি ছিল দুর্গ-নগরী। আর এ বিষয়টি এ শহরের নামকরণ থেকেও স্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে যায়। এ নগরীতে আরবগণ বসবাস করত। তবে ধীরে ধীরে তা শহরে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ফোরাত অঞ্চলের ভালো জলবায়ু এবং প্রচুর নদ-নদীর অস্তিত্ব ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূল হওয়ার কারণে অত্র অঞ্চল আবাদ হয়েছিল। ঐ অঞ্চলের অধিবাসিগণ মরুবাসী আরব সর্দারদেরকে কৃষ্টি ও সভ্যতার আহবান জানাতে সক্ষম হয়েছিল। হীরা অঞ্চলের অধিবাসিগণ পারস্যের প্রতিবেশী হওয়ার কারণে পারস্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা উপকৃত হয়েছিল। খওরানাক প্রাসাদের ন্যায় হীরার সন্নিকটে বেশ কিছু প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল যা উক্ত নগরীকে এক বিশেষ সৌন্দর্য দান করেছিল। এ অঞ্চলের আরবগণ লিপি ও লিখনপ্রণালীর সাথে পরিচিত হয়েছিল এবং সম্ভবত সেখান থেকেই লিপি ও লিখনপ্রণালী আরব উপদ্বীপের অন্যান্য স্থানে প্রচলিত হয়েছিল।

হীরার শাসনকর্তা ও আমীরগণ বনি লাখম গোত্রের আরব ছিলেন এবং পারস্যের সাসানীয় সম্রাটগণ তাঁদের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। হীরার আমীরদের সাসানীয় সম্রাটগণ এ কারণে সমর্থন করতেন যাতে করে তাঁরা তাঁদের (হীরার আমীরগণ) ইরান ও আরব বেদুইনদের মাঝে অন্তরায় হিসাবে গড়ে তুলতে এবং তাঁদের সহায়তায় পারস্য সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহে লুণ্ঠনকারী আরব বেদুইন ও যাযাবরদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। (হীরার) এ সব আমীরের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। হামযাহ্ ইসফাহানী এ সব আমীরের নাম ও আয়ুষ্কাল এবং যে সব সাসানীয় সম্রাট তাঁদের সমসাময়িক ছিলেন তাঁদের একটি তালিকা প্রদান করেছেন।

যা হোক বনি লাখম বংশের রাজ্য ছিল হীরা অঞ্চলের বৃহত্তম আরবীয় রাজ্য যা ছিল অর্ধসভ্য। এ বংশের সর্বশেষ বাদশাহ্ ছিলেন নূমান বিন মুনযির যিনি পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ কর্তৃক অপসারিত ও নিহত হয়েছিলেন। তাঁর অপসারণ ও হত্যার কাহিনী ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে।

পঞ্চম শতাব্দীর শেষে অথবা ষষ্ঠ শতকের প্রথম দিকে একদল বহিরাগত আরব আরব উপদ্বীপের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে যা ছিল রোমান সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী। এ দেশটি রোমান সাম্রাজ্যের ছত্রছায়ায় ছিল এবং ঠিক যেমনি হীরার শাসকবর্গ পারস্য সম্রাটদের তাঁবেদার ছিল ঠিক তেমনি গাসসানীয় রাজ্যের শাসকবর্গও বাইজান্টাইনীয় সম্রাটদের তাঁবেদার ছিল।

গাসসান দেশটি কিছুটা সভ্য ছিল। যেহেতু দেশটির সরকারের কেন্দ্র একদিকে দামেস্কের কাছাকাছি, অন্যদিকে বসরার নিকটবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেহেতু এ দেশটি রোমান প্রভাবাধীন আরব অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল। আর অত্র এলাকাতে রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।

গাসসানিগণ হীরার লাখম গোত্রভুক্ত শাসকবর্গ এবং ইরানীদের সাথে মতবিরোধ ও দ্বন্দ্ব থাকার কারণে রোমান সাম্রাজ্যের মিত্র হয়েছিল। প্রায় ৯ অথবা ১০ গাসসানী আমীর একের পর এক এ দেশটিতে শাসনকার্য পরিচালনা করেছে।

হিজাযে জ্ঞান ও শিক্ষা

হিজাযের জনগণ ও অধিবাসীদের ‘উম্মী’ বলা হতো। ‘উম্মী’ শব্দের অর্থ অশিক্ষিত। অর্থাৎ ঐ ব্যক্তিকে উম্মী বলা হয় যে মায়ের পেট থেকে যে অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিল ঠিক সে অবস্থায়ই রয়েছে। (জাহেলিয়াতের যুগে) আরবদের মধ্যে জ্ঞান ও শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে হলে আমাদের জন্য এতটুকু জানাই যথেষ্ট যে, ইসলামের শুভ অভ্যুদয়ের লগ্নে কুরাইশ গোত্রে কেবল ১৭ ব্যক্তি লেখাপড়া জানত। আর মদীনায় ‘আওস’ ও ‘খাযরাজ’ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে কেবল ১১ জন লেখাপড়া জানত।

আরব উপদ্বীপের অধিবাসীদের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত এ আলোচনার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে মতাদর্শ, চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, অর্থনীতি, চরিত্র, আচার-ব্যবহার এবং কৃষ্টি-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পবিত্র ইসলাম ধর্মের শিক্ষা-দীক্ষার মাহাত্ম্য স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় এবং সব সময় সভ্যতাসমূহের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের ঐ সব সভ্যতার পূর্ববর্তী অধ্যায় অধ্যয়ন করতেই হবে। অধ্যয়নের পরই কেবল উক্ত সভ্যতার মহত্ত্বের প্রকৃত মূল্যায়ন করা উচিত। (চিরভাস্বর মহানবী (সা.) গ্রন্থ থেকে সংকলিত)