সূরা আন নিসা;(১৯তম পর্ব)

সূরা আন নিসা; আয়াত ৬৯-৭৩

সূরা নিসার ৬৯ ও ৭০ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا (৬৯) ذَلِكَ الْفَضْلُ مِنَ اللَّهِ وَكَفَى بِاللَّهِ عَلِيمًا ((৭০

"যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে,(শেষ বিচারের দিন) আল্লাহ যাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন সে তাদের সঙ্গী হবে, তারা হলেন নবী , সত্যবাদী, শহীদ ও সৎকর্মশীলগণ। আর তারা সঙ্গী হিসেবে কতই না উত্তম।" (৪:৬৯)

"এটাই আল্লাহর অনুগ্রহ, আর আল্লাহ যথেষ্ট পরিজ্ঞাত।" (৪:৭০)

আমরা এর আগের ক'টি আয়াত থেকে জেনেছিলাম, যারা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী চলে তারা দুনিয়াতেই অশেষ কল্যাণ ও সৌভাগ্যের অধিকারী হয়৷ তারা মহান আল্লাহর বিশেষ হেদায়েতও লাভ করেন। এ আয়াতে বলা হচ্ছে,এ ধরনের ব্যক্তিগণ পরকালেও পয়গম্বর ও সৎকর্মশীলদের সথে অবস্থান করবেন এবং তাদের সান্নিধ্য লাভে ধন্য হবেন৷ প্রত্যেক নামাজে আমরা যখন সূরায়ে ফাতিহা পড়ি তখন বলে থাকি, হে আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক ও সোজা পথ প্রদর্শন কর, তাদেরই পথ যারা তোমার বিশেষ কল্যাণের অধিকারী হয়েছে৷

সূরা নিসার উল্লেখিত আয়াতগুলো থেকে আমরা বিশেষ কল্যাণপ্রাপ্ত মহান ব্যক্তিদের স্পষ্ট পরিচয় লাভ করতে পারছি৷ তারা হচ্ছেন, পয়গম্বর, সত্যবাদী,শহীদ ও সৎকর্মশীলগণ ৷ তাই আমাদের সব সময়ই দোয়া করা উচিত যাতে বেহেশতে এ ধরনের মহান ব্যক্তিদের সান্নিধ্য লাভ করতে পারি।

এ আয়াত দুটোর শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,

প্রথমত : দুনিয়া ও আখেরাতে ভালো মানুষের সান্নিধ্য লাভের জন্যে আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করা জরুরী ৷

দ্বিতীয়ত : সততা ও ঈমান এ দুটো গুনকে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত হিসেবে গ্রহণ করা উচিত ৷

সূরা নিসার ৭১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا خُذُوا حِذْرَكُمْ فَانْفِرُوا ثُبَاتٍ أَوِ انْفِرُوا جَمِيعًا (৭১)

"হে ঈমানদারগণ ! নিজেদের অস্ত্র তুলে নাও এবং পূর্ণ সতর্কতার সাথে পৃথক পৃথক সৈন্যদলে কিংবা সমবেতভাবে বেরিয়ে পড়।" (৪:৭১)

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ৷ তাই মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় থেকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের যাবতীয় দিক নির্দেশনা রয়েছে পবিত্র কোরআনে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শক্তির হাত থেকে দেশ ও সমাজকে রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই, ধর্ম ও ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষার জন্যে পবিত্র কোরআন মুমিনদেরকে সব সময় প্রস্তুত থাকতে বলেছে, আর এ পথে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারীকে উচ্চ মর্যাদা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

এর আগের আয়াতগুলোতে শহীদদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তাদেরকে সৎকর্মশীল ও নবী রাসূলদের মর্যাদায় ভূষিত করা হবে৷ এ আয়াতে বলা হচ্ছে মুমিন মুসলমানরা যেন শত্রুর যে কোন হামলা থেকে আত্মরক্ষা করার মত সামরিক শক্তি অর্জন করে। এখানে "হাজরা" শব্দের অর্থ হচ্ছে আত্মরক্ষা বা প্রতিহত করা৷ অর্থাৎ মুমিন মুসলমানরা কারো উপর আক্রমনের জন্যে উদ্যত হবেনা বরং কারো দ্বারা আক্রান্ত হলে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ঈমান রক্ষার জন্যে তা প্রতিহত করার ব্যবস্থা নেবে৷

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : মুসলমানদের উচিত শত্রুপক্ষের সামরিক শক্তি সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখা এবং সে অনুপাতে নিজেদের প্রতিরক্ষা শক্তি গড়ে তোলা৷

দ্বিতীয়ত : প্রত্যেক মুসলমানের সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া জরুরী৷ যাতে আক্রান্ত হলে দেশ ও ধর্ম রক্ষার জন্যে প্রত্যেকে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে৷

এই সূরার ৭২ ও ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَإِنَّ مِنْكُمْ لَمَنْ لَيُبَطِّئَنَّ فَإِنْ أَصَابَتْكُمْ مُصِيبَةٌ قَالَ قَدْ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيَّ إِذْ لَمْ أَكُنْ مَعَهُمْ شَهِيدًا (৭২) وَلَئِنْ أَصَابَكُمْ فَضْلٌ مِنَ اللَّهِ لَيَقُولَنَّ كَأَنْ لَمْ تَكُنْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُ مَوَدَّةٌ يَا لَيْتَنِي كُنْتُ مَعَهُمْ فَأَفُوزَ فَوْزًا عَظِيمًا ((৭৩

"তোমাদের মধ্যে এমনও কেউ কেউ রয়েছে যাদের চিত্ত দুর্বল এবং অন্যদের মনোবল দুর্বল করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাও অনেক। তোমাদের উপর কোন বিপদ আসলে তারা বলবে,আল্লাহ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যে,আমি তাদের সঙ্গে যাইনি৷" (৪:৭২)

"পক্ষান্তরে তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন অনুগ্রহ আসলে তারা বলতে শুরু করবে হায়! আমি যদি তাদের সঙ্গে থাকতাম তাহলে আমিও সফলতা লাভ করতাম।" (৪:৭৩)

আগের আয়াত গুলোতে মুসলমানদেরকে বহিঃশত্রুর ব্যাপারে পূর্ণ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে, আর বর্তমান আয়াতে অভ্যন্তরীণ শত্রু বা মুনাফেকদের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে । সুযোগ সন্ধানীরা যে সব সময় নিজ স্বার্থ লাভের জন্যে সচেষ্ট এবং দ্বীনের জন্যে যে তারা সামান্য ত্যাগ করতেও রাজী নয় এ আয়াতে তাদের প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআন এ ধরনের স্বার্থান্বেষী মহলের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে,মুসলমানদের বিপদের দিনে তারা সরে পড়ে এবং আত্মপ্রসাদ লাভ করে, যেন খুব বুদ্ধিমানের কাজ তারা করে ফেলেছে,কিন্তু মুসলমানদের যখন বিজয় আসে তখন তারা আফসোস করে বলে যদি তাদের সঙ্গে থাকতাম তাহলে তো এখন গণিমতের মাল থেকে আমিও কিছু পেতাম৷

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : জেহাদের ময়দানেই কে প্রকৃত মুসলমান আর কে মুনাফেক তার আসল পরিচয় ফুটে উঠে৷

দ্বিতীয়ত : জেহাদের ময়দানে মুনাফেকদের উপস্থিতির ফলে অনেক সময় মুমিনদের মনোবল দুর্বল হতে পারে তাই মুনাফেকদেরকে চিহ্নিত করে তাদেরকে বহিষ্কার করা জরুরী৷

তৃতীয়ত : বিপদের সময় মুসলমানদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে অন্যের আশ্রয় নেয়া মুনাফেকীর আলামত ৷