মহানবীর প্রতি সর্বপ্রথম ঈমান আনয়ণকারী

সমগ্র বিশ্বে ইসলাম ধর্মের প্রসার ধীরে ধীরেই হয়েছিল। পবিত্র কোরআনের পরিভাষায় যে সব ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং এ ধর্মের প্রচার করার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন তাঁদেরকে السّابقون (অগ্রগামিগণ) বলা হয়েছে। আর ইসলামের প্রাথমিক যুগে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অগ্রগামিতা শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি বলে গণ্য হতো। অতএব, বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে এ বিষয়টি (ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রগামিতা) আলোচনা করা উচিত। তাহলে আমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগামী মহিলা ও পুরুষকে চিনতে পারব।

মহিলাদের মধ্যে হযরত খাদীজাহ্

ইসলামের ইতিহাসের অকাট্য বিষয়াদির মধ্যে অন্যতম বিষয় হচ্ছে এই যে, হযরত খাদীজাহ্ (আ.) ছিলেন প্রথম নারী যিনি মহানবী (সা.)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। আর এ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্যও নেই। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৪০।) আমরা বর্ণনা সংক্ষেপ করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল এখানে উল্লেখ করব যা ঐতিহাসিকগণ মহানবী (সা.)-এর একজন স্ত্রীর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন।

হযরত আয়েশা বলেন, “আমি খাদীজাকে কখনই দেখি নি বলে সব সময় আফসোস করতাম এবং তাঁর প্রতি মহানবী (সা.) সব সময় যে টান ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতেন তাতে আমি খুব আশ্চর্যান্বিত হতাম। কারণ মহানবী তাঁকে খুব বেশি স্মরণ করতেন। যদি কখনো কোন দুম্বা জবাই করতেন তখন তিনি হযরত খাদীজার বান্ধবীদের খোঁজখবর নিয়ে তাঁদের কাছে জবাইকৃত দুম্বার মাংস প্রেরণ করতেন। একদিন মহানবী ঘর থেকে বের হওয়ার সময় খাদীজার কথা স্মরণ করে তাঁর প্রশংসা করছিলেন। অবশেষে অবস্থা এমন হলো যে, আমি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। পূর্ণ স্পর্ধা সহকারে আমি বলেই বসলাম : তিনি তো একজন বৃদ্ধা নারী বৈ আর কিছুই ছিলেন না। মহান আল্লাহ্ আপনাকে তাঁর চেয়ে উত্তম ভালো ভালো স্ত্রী দিয়েছেন! আমার এ কথা মহানবী (সা.)-এর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল। তাঁর মুখমণ্ডলে ক্রোধ ও অসন্তোষের চি‎‎হ্ন স্পষ্ট ফুটে উঠল। তিনি বললেন : কখনই এমন হয় নি। তাঁর চেয়ে উত্তম স্ত্রী আমি পাই নি। তিনি ঐ সময় আমার প্রতি ঈমান এনেছিলেন যখন সবাই শিরক ও কুফরে লিপ্ত ছিল। তিনি সবচেয়ে কঠিন সময় তাঁর সমুদয় ধন-সম্পদ আমার হাতে অর্পণ করেছিলেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর মাধ্যমে আমাকে সন্তান-সন্ততি দিয়েছেন যা আমার অন্য কোন স্ত্রীকে দেন নি।”

ঈমান আনয়ন করার ক্ষেত্রে বিশ্বের সকল নারীর চেয়ে হযরত খাদীজার শ্রেষ্ঠত্ব ও অগ্রগামিতার আরেকটি দলিল হচ্ছে ওহীর শুভ সূচনা ও পবিত্র কোরআনের অবতীর্ণ হওয়ার প্রসঙ্গ। কারণ যখন মহানবী (সা.) হিরা গুহা থেকে নিচে নেমে আসলেন এবং বে’সাতের (নবুওয়াতের অভিষেকের) পুরো ঘটনাটি খাদীজার কাছে সবিস্তারে বর্ণনা করলেন তখন সাথে সাথে তিনি স্পষ্টভাবে ও ইঙ্গিতে স্ত্রী খাদীজার ঈমানের সাথে পরিচিত হলেন। এছাড়া হযরত খাদীজাহ্ (আ.) আরবের ভবিষ্যদ্বক্তা ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের কাছ থেকে তাঁর স্বামীর নবুওয়াতের ব্যাপারে অনেক কথা শুনেছিলেন। আর এ সব কথা ও বাণী এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার কারণেই হযরত খাদীজাহ্ তাঁর সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।

ঈমানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলেন হযরত আলী (আ.)

শিয়া ও সুন্নী নির্বিশেষে সকল ঐতিহাসিকের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, পুরুষদের মধ্য থেকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি প্রথম যে ব্যক্তি ঈমান এনেছিলেন তিনি ছিলেন হযরত আলী (আ.)। আর এ প্রসিদ্ধ অভিমতের বিপক্ষে ইতিহাসে আরো কিছু বিরল অভিমতও আছে যেগুলোর বর্ণনাকারিগণ উক্ত প্রসিদ্ধ অভিমতটির বিপরীতটি বর্ণনা করেছেন। যেমন বলা হয়ে থাকে যে, প্রথম যে ব্যক্তি পুরুষদের মধ্য থেকে মহানবী (সা.)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন তিনি ছিলেন মহানবী (সা.)-এর পালক পুত্র যায়েদ ইবনে হারিসা অথবা হযরত আবু বকর। তবে অগণিত দলিল এ দুই অভিমতের বিপক্ষে বিদ্যমান আছে; আমরা এ সব দলিল থেকে মাত্র কয়েকটি সংক্ষেপে নিচে উল্লেখ করছি :

১. হযরত আলী মহানবী (সা.)-এর তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হয়েছিলেন

হযরত আলী বাল্যকাল থেকেই মহানবী (সা.)-এর গৃহে প্রতিপালিত হয়েছিলেন এবং মহানবীও একজন স্নেহময় পিতার মতোই তাঁর লালন-পালনের ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। সকল সীরাত রচয়িতা এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে লিখেছেন :

“মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতে অভিষিক্ত হবার আগেই পবিত্র মক্কায় একবার এক মারাত্মক দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টি দেখা দিয়েছিল। মহানবী (সা.)-এর চাচা আবু তালিবের পরিবার বেশ বড় হওয়ার কারণে এবং যেহেতু তাঁর আয় তাঁর সাংসারিক ব্যয় ও খরচের সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল না এবং ভাই আব্বাসের তুলনায় তিনি বিস্তর সম্পদ ও বিত্তের অধিকারী ছিলেন না সেহেতু এ ধরনের দুর্ভিক্ষের সময় তাঁর আর্থিক অবস্থা সংকটজনক হয়ে পড়লে মহানবী (সা.) চাচা আব্বাসের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, হযরত আবু তালিবের আর্থিক সংকট ও অসচ্ছলতা কিছুটা লাঘব করার জন্য তাঁরা তাঁর কতিপয় সন্তানকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালন করবেন। যার ফলে তাঁরা আবু তালিবের সাংসারিক খরচ ও ব্যয় নির্বাহ করার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে সক্ষম হবেন। এ সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতে মহানবী (সা.) আলীকে এবং আব্বাস জাফরকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসেন।”(সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৬; এ ঘটনাটি মহানবীর নবুওয়াতে অভিষেকপূর্ব ঘটনাবলী সংক্রান্ত  অধ্যায়েও বর্ণিত হয়েছে।)

এ ধরনের পরিস্থিতিতে অবশ্যই বলতে হয় যে, যখন হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর গৃহে আসলেন তখন তাঁর বয়স ৮ বছরের চেয়ে কম ছিল না। কারণ হযরত আলীকে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্য ছিল মক্কা নগরীর প্রধান হযরত আবু তালিবের সংসারে সচ্ছলতা আনয়ন। আর যে শিশুর বয়স ৮ বছরেরও কম তাকে তার পিতা-মাতা থেকে পৃথক করা খুবই কঠিন কাজ। এ ছাড়াও হযরত আবু তালিবের জীবনে এ ধরনের শিশু ততটা প্রভাব রাখবে না।

অতএব, হযরত আলী (আ.)-এর বয়সের ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই এমনভাবে চিন্তা করা উচিত যে, তাঁকে নিয়ে যাওয়ার ফলে হযরত আবু তালিবের জীবনে লক্ষণীয় প্রভাব পড়ে। তাই এমতাবস্থায় কিভাবে বলা সম্ভব যে, যায়েদ ইবনে হারিসা ও অন্য ব্যক্তিবর্গ ওহীর গুপ্তভেদ ও রহস্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন, অথচ তাঁরই পিতৃব্যপুত্র যিনি ছিলেন অন্য সকলের চেয়ে তাঁর সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং সর্বদা তাঁরই সাথে থেকেছেন তিনি মহানবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ ঐশী রহস্যাবলী সম্পর্কে অজ্ঞ থাকবেন?!

হযরত আলীকে প্রতিপালন করার উদ্দেশ্য ছিল তাঁর প্রতি চাচা হযরত আবু তালিবের খেদমত ও অবদান একটি পর্যায় পর্যন্ত পূরণ করা। কোন ব্যক্তিকে সুপথে পরিচালিত করার চেয়ে আর কোন কাজ বা বিষয় মহানবী (সা.)-এর কাছে এত বেশি প্রিয় ও মর্যাদাসম্পন্ন ছিল না। এতদ্সত্ত্বেও এ কথা কিভাবে বলা সম্ভব যে, মহানবী (সা.) নিজ চাচাত ভাই যিনি ছিলেন আলোকিত মন ও হৃদয় এবং বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী তাঁকে এ বিরাট নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করবেন? স্বয়ং আলী (আ.)-এর বাণী থেকেই এ কথা শোনা উত্তম :

وقد علمتم موضعي من رسول الله بالقرابة القريبة والمنزلةِ الخصيصةِ وضعني في حجره وأنا وليدٌ يضمُّني إلى صدره ويكنفني في فراشهِ ويمسُّني جسدَه ويُشِمُّني عرفَه ... ولقد كنتُ أتَّبِعُه اتّباع الفصيل أثر أمِّه، يرفع لي في كلِّ يومٍ من أخلاقه علماً ويأمرني بالإقتداءِ به، ولقد كان يجاورُ في كلِّ سنةٍ بِحراءَ فأراه لا يراه غيري، ولم يحمعْ بيتٌ واحدٌ يومئذٍ في الإسلامِ غيرَ رسولِ اللهِ وخديجةَ وأنا ثالثهما! أرى نورَ الوحْيِ والرِّسالةَ وأشُمُّ ريحَ النُّبُوَّةِ ...

“আর তোমরা সবাই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে আমার নিকটাত্মীয়তা জনিত অবস্থান এবং বিশেষ মর্যাদার কথা জান; আমি যখন শিশু তখন তিনি আমাকে তাঁর কোলে বসাতেন। তিনি আমাকে তাঁর বুকে টেনে নিতেন এবং তাঁর বিছানায় আমাকে শোয়াতেন। তাঁর দেহ তখন আমার দেহে স্পর্শ করত; তিনি আমাকে তাঁর দেহের সুঘ্রাণ নেওয়াতেন; ... যেমন করে উট-শাবক তার মাকে অনুসরণ করে ঠিক তেমনি আমিও তাঁকে অনুসরণ করতাম; তিনি আমাকে প্রতিদিন তাঁর (মার্জিত) চারিত্রিক গুণাবলী থেকে একটি নিদর্শন আমার সামনে উপস্থাপন করতেন এবং আমাকে তা অনুসরণ করার আদেশ দিতেন। তিনি প্রতি বছর হিরা গুহায় নির্জনে বাস করতেন; অতঃপর আমি তাঁকে দেখতাম এবং আমি ব্যতীত তাঁকে অন্য কোন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ করত না। তখন (ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পরবর্তী দিনগুলোতে) রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও খাদীজাহ্ (আ.)-এর পরিবার ছাড়া ইসলামে বিশ্বাসী আর কোন পরিবার ছিল না; আর আমি ছিলাম তাঁদের (পরিবারের) তৃতীয় সদস্য। আমি ওহী ও রিসালাতের আলো প্রত্যক্ষ করি এবং নবুওয়াতের সুঘ্রাণ পাই...।”(শেখ মুহাম্মদ আবদুহু সম্পাদিত নাহজুল বালাগাহ্, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮২; মিশর থেকে মুদ্রিত)

২. আলী ও খাদীজাহ্ মহানবীর সাথে নামায পড়তেন

ইবনে আসীর ‘উসদুল গাবা’য়, ইবনে হাজর ‘আল-ইসাবায় আফীফ কিন্দীর জীবন বৃত্তান্তে এবং বহু ঐতিহাসিক তাঁর (আফীফ) থেকে নিম্নোক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন : “একবার জাহেলিয়াতের যুগে আমি পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করে হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের আতিথেয়তা গ্রহণ করলাম। আমরা দু’জন পবিত্র কাবার পাশে ছিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম একজন পুরুষ আসল এবং পবিত্র কাবামুখী হয়ে দাঁড়াল; এরপর একটি ছেলেকে দেখলাম-যে এসে ঐ লোকটির ডানপাশে দাঁড়াল। এর পরপরই একজন মহিলাকে দেখলাম যে এসে এদের পেছনে দাঁড়াল। আমি দেখলাম যে, এ দু’ব্যক্তি (ছেলেটি ও স্ত্রীলোকটি) ঐ লোকটিকে অনুসরণ করে রুকু ও সিজদাহ্ করছে। এ অভূতপূর্ব দৃশ্য আমাকে অনুসন্ধান করতে উদ্বুদ্ধ করল। তাই আমি আব্বাসকে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি আমাকে বলেছিলেন : ঐ লোকটি মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্; ঐ ছেলেটি তার পিতৃব্যপুত্র এবং ঐ স্ত্রীলোকটি যে এদের দু’জনের পেছনে দাঁড়িয়েছিল সে মুহাম্মদের স্ত্রী। অতঃপর তিনি বললেন : আমার ভাতিজা (মুহাম্মদ) বলে : এমন একদিন আসবে যে দিন পারস্যসম্রাট খসরু ও রোমানসম্রাট কায়সারের সকল ধনভাণ্ডার তার করায়ত্তে আসবে। তবে মহান আল্লাহর শপথ! একমাত্র এ তিনজন ব্যতীত পৃথিবীর বুকে এ ধর্মের আর কোন অনুসারী নেই।” এরপর রাবী বলেন, “আমিও আশা করছিলাম যে, হায় যদি আমি তাদের চতুর্থ ব্যক্তি হতাম।”

এমনকি যে সব ব্যক্তি হযরত আলী (আ.)-এর গুণ বর্ণনা করার ক্ষেত্রে অবহেলা প্রদর্শন করেছেন তাঁরাও উপরিউক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।

৩. আমিই সিদ্দীকে আকবর

হযরত আলী (আ.)-এর বাণী ও ভাষণসমূহের মধ্যে এ বাণী এবং এতদসদৃশ অনেক বাণী রয়েছে। যেমন তিনি বলেছেন,

أنا عبدُ اللهِ وأخو رسولِ اللهِ وأنا الصّدّيقُ الأكبرُ لا يقولها بعدي إلّا كاذبٌ مفتر ولقد صلَّيتُ مع رسولِ اللهِ قبل النّاسِ بِسبعِ سنينَ وأنا أوّلُ مَنْ صلّى

“আমি মহান আল্লাহর বান্দা এবং রাসূলুল্লাহ্ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ভ্রাতা। আমিই সিদ্দীকে আকবার (সবচেয়ে বড় সত্যবাদী)। একমাত্র অপবাদ আরোপকারী মিথ্যাবাদী ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি আমার পরে এ ধরনের দাবি করবে না। আমি মহানবী (সা.)-এর সাথে সকল মানুষের নামায পড়ারও ৭ বছর আগে নামায পড়েছি। যারা তাঁর সাথে নামায পড়েছেন তাঁদের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম।”

মহানবী (সা.) থেকে বিভিন্ন ধরনের বাক্য ও বাচনভঙ্গি সহকারে বেশ কিছু মুতাওয়াতির হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন,

أوَّلُكم وارداً عليَّ الحوضَ أوّلُكم إسلاماً عليٌّ ابن أبي طالبٍ

“তোমাদের মধ্য থেকে আমার কাছে হাউযে কাউসারে আগমনকারী সর্বপ্রথম ব্যক্তিটি হচ্ছে তোমাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী আলী ইবনে আবি তালিব।”

এ হাদীসের সনদ ও দলিল-প্রমাণ জানার জন্য আল গাদীর গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ৩২০ পৃষ্ঠা (নাজাফ সংস্করণ) অধ্যয়ন করুন।

যখন কোন ব্যক্তি পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে এ সব হাদীস অধ্যয়ন করবেন তখন তাঁর কাছে ইসলাম ধর্মে হযরত আলীর অগ্রবর্তী হওয়ার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়ে যাবে। আর তখন তিনি অন্য দু’টি বক্তব্য ও অভিমত যা আসলেই স্বল্প সূত্রে বর্ণিত অর্থাৎ সংখ্যায় নগণ্য তা কখনই গ্রহণ করবেন না। ৬০ জনের বেশি সাহাবী ও তাবেয়ী ‘আলী ছিলেন সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী’-এ বক্তব্য ও অভিমতের সমর্থক। এমনকি তাবারীই হচ্ছে সেই ব্যক্তি যিনি বিষয়টিকে সন্দেহযুক্ত করেছেন এবং কেবল অন্যের বক্তব্য ও অভিমত উদ্ধৃত করার ওপর নির্ভর করেছেন। তিনি দ্বিতীয় খণ্ডের ২১৫ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন, “নিজ পিতাকে ইবনে সাঈদ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “হযরত আবু বকরই কি সর্বপ্রথম ঈমান এনেছিলেন?” তিনি (সাঈদ) বলেছিলেন, “না, তার আগে ৫০ জনেরও অধিক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। তবে তাঁর ইসলাম অন্যদের ইসলামের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল।”

 

ইসহাকের সাথে খলীফা মামুনের কথোপকথন

ইবনে আবদে রাব্বিহ্ ‘ইকদুল ফরীদ’ গ্রন্থে  একটি চমৎকার কাহিনী বর্ণনা করেছেন যার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ : খলীফা মামুন একবার একটি বিতর্ক সভার আয়োজন করেন এবং প্রসিদ্ধ আলেম ইসহাককে ঐ সভার সভাপতি নিয়োগ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অন্যদের ওপর হযরত আলীর অগ্রবর্তিতা প্রমাণিত হওয়ার পর ইসহাক বললেন, “যখন আলী ঈমান এনেছিলেন তখন তিনি শিশু ছিলেন, তবে তখন আবু বকর পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ছিলেন; এ কারণেই তাঁর ঈমান আলীর ঈমানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল।”

মামুন সাথে সাথে তাঁর কথার উত্তর দিলেন, “মহানবী (সা.) কি আলীকে তাঁর বাল্যকালে ঈমান আনয়ন করার ব্যাপারে আহবান করেছিলেন নাকি তাঁর ঈমান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহামের (আত্মিক-আধ্যাত্মিক প্রেরণা) মাধ্যমে হয়েছিল?” কখনই বলা যাবে না যে, তাঁর ঈমান ইলহামপ্রসূত ছিল। কারণ মহানবী (সা.)-এর ঈমানও ইলহামপ্রসূত ছিল না, বরং তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমেই হয়েছিল। আর এ ক্ষেত্রে আলীর কথা তো বাদই দিলাম। সুতরাং যে দিন মহানবী (সা.) তাঁকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহবান জানালেন সে দিন কি তিনি নিজ থেকে এ কাজটি (আলীকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহবান জানানো) আঞ্জাম দিয়েছিলেন নাকি মহান আল্লাহ্ তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন? আমরা কখনই ভাবতেই পারব না যে, মহানবী (সা.) আল্লাহ্পাকের আদেশ ব্যতীত নিজেকে এবং অন্যকে কষ্টের মধ্যে ফেলবেন। তাই বাধ্য হয়ে অবশ্যই বলতে হবে যে, মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর আদেশের ভিত্তিতেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহবান জানিয়েছিলেন। তাই মহান জ্ঞানী আল্লাহ্ কি মহানবীকে নির্দেশ দিতে পারেন যে, তিনি একজন অনুপযুক্ত শিশুকে-যার ঈমান ও ঈমানশূন্যতার মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহবান জানাবেন? কাজেই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, মহাজ্ঞানী প্রজ্ঞাময় আল্লাহ্পাক থেকে এ ধরনের কাজ অসম্ভব।

অতএব, আমরা অবশ্যই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব যে, হযরত আলী (আ.)-এর ঈমান সহীহ ও দৃঢ় ছিল যা অন্যদের ঈমান থেকে কোন অংশেই কম ছিল না। আর অগ্রগামীরাই অগ্রগামী তারাই মহান আল্লাহর নিকটবর্তী (السّابقونَ السّابقونَ أولئك المقرّبون) -এ আয়াতটির সর্বোৎকৃষ্ট বাস্তব নমুনা হচ্ছেন স্বয়ং আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)।”