যমযম কূপের ইতিহাস

বিশ্ব জগতে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন তার স্বীয় অস্তিত্বের প্রমাণ স্বরূপ অনেক নিদর্শন সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে প্রেরিত তার নবী ও রসূলদের দ্বারা তিনি এই নিদর্শন সমূহের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এই সকল অলৌকিক নিদর্শন ও বিস্ময়কর সৃষ্টিগুলো দ্বারা বিশ্বাসীরা আরও বেশী আস্তিক হয় এবং নাস্তিকেরা সুপথের সন্ধান লাভ করে। মহান স্রষ্টা আল্লাহর অপূর্ব নিদর্শনাবলীর অন্যতম যমযম কূপ। এ কুপটির উৎপত্তির ইতিহাস হযরত ইবরাহীম (আ.) এবং স্ত্রী হাজেরা ও পুত্র ইসমাঈল (আ.) এর জীবন কাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম পবিত্রময় একটি কূপ। 

সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা শহরের কাবা শরীফ থেকে ২০ মিটার বা ৬৬ ফুট পশ্চিমে মসজিদুল হারামের ভিতরে এই কূপের অবস্থান। এই পবিত্র বরকতময় কূপের ইতিবৃত্ত নিম্নে সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ ।

হযরত ইবরাহীম (আ.)-মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসমাঈল (আ.)-কে তাঁর মাতাসহ পবিত্র মক্কার অখ্যাত এক উপত্যকায় আবাসন দেয়ার আদেশপ্রাপ্ত হলেন। এ উপত্যকায় কোন মনুষ্য বসতি ছিল না। শাম থেকে ইয়েমেন এবং ইয়েমেন থেকে শামে যে সব কাফেলা যাতায়াত করত কেবল তারাই উক্ত উপত্যকায় (বিশ্রামের জন্য) সাময়িকভাবে তাঁবু স্থাপন করত। এছাড়া বছরের বাকী সময় এ উপত্যকা আরব উপদ্বীপের অন্য সকল অঞ্চলের মতোই মানবশূন্য উত্তপ্ত মরুপ্রান্তর হিসাবেই পড়ে থাকত।

এ ধরনের ভীতিপ্রদ অঞ্চলে বসবাস করা একজন নারীর জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও অসহনীয় ব্যাপার ছিল।

মরুভূমির দগ্ধকারী উত্তাপ ও এর উষ্ণ বাতাস তাঁর চোখের সামনে যেন মৃত্যুর ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তিকে উপস্থাপন করেছিল। এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে বিধায় আর ইবরাহীম (আ.) নিজেও চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি সওয়ারী পশুর লাগাম ধরে অশ্রুসজল নয়নে স্ত্রী ও পুত্রকে বিদায় জানানোর সময় হযরত হাজেরাকে বললেন,“হে হাজেরা! এ সব কিছু মহান আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী করা হয়েছে। আর তাঁর আদেশ পালন করা থেকে পালিয়ে বেড়াবার কোন পথ নেই। মহান আল্লাহর দয়া ও কৃপার ওপর নির্ভর কর। আর নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস কর যে,তিনি আমাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করবেন না।”এরপর তিনি মহান আল্লাহর কাছে একাগ্রতা সহকারে প্রার্থনা করে বললেন :

)ربِّ اجعل هذا بلداً آمناً و ارْزُقْ أهْله مِنَ الثّمرات مَنْ آمنَ منهم باللهِ و اليومِ الآخرِ(

“হে প্রভু! এ স্থানকে নিরাপদ শহর ও জনপদে পরিণত কর। এর অধিবাসীদের মধ্য থেকে যারা মহান আল্লাহ্ ও শেষ বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের ফল ও খাদ্য রিযিক হিসাবে প্রদান কর।” (সূরা বাকারা : ১২৬)

আর যখন তিনি টিলা বেয়ে নিচে নামছিলেন তখন তিনি পেছনের দিকে তাকিয়ে তাঁদের জন্য মহান আল্লাহর দয়া,কৃপা ও অনুগ্রহ প্রার্থনা করলেন।

এ হিজরত ও ভ্রমণ বাহ্যত অত্যন্ত কষ্টকর হলেও পরবর্তীতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে,তা সুমহান ফলাফল ও পরিণতি বয়ে এনেছিল। কারণ কাবাগৃহ নির্মাণ,তাওহীদে বিশ্বাসীদের জন্য সুমহান ও সুবৃহৎ ঘাঁটির গোড়াপত্তন,অত্র এলাকায় তাওহীদের ঝাণ্ডা উত্তোলন এবং এক গভীর ধর্মীয় আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন-যা এতদঞ্চলে সর্বশেষ নবী কর্তৃক বাস্তবায়িত হবে-আসলে এগুলোই হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর এ সুমহান হিজরতের মহাপরিণতি বা ফলাফল বলে গণ্য।

হযরত ইবরাহীম (আ.) সওয়ারী পশুর লাগাম হাতে ধরে অশ্রুসজল নেত্রে পবিত্র মক্কায় বিবি হাজেরা এবং নিজ সন্তান ইসমাঈলকে ত্যাগ করে রওয়ানা হলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের খাদ্য ও পানি ফুরিয়ে গেল এবং হাজেরার স্তন্য শুকিয়ে গেল। সন্তান ইসমাঈলের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে গেল। মা হযরত হাজেরার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং সাফা পাহাড়ের পাথরগুলোর কাছে উপস্থিত হলেন। মারওয়া পাহাড়ের কাছে যে মরীচিকা ছিল তা দূর থেকে তাঁর দৃষ্টিগোচর হলে তিনি দৌড়ে দ্রুত সেখানে পৌঁছলেন। তবে প্রহেলিকাময় প্রাকৃতিক এ দৃশ্যের তিক্ততা তাঁর জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ও যন্ত্রণাদায়ক হয়েছিল। তাঁর শিশুসন্তানের অনবরত গগনবিদারী ক্রন্দনধ্বনি এবং সঙ্গীন অবস্থা তাঁকে সবচেয়ে বেশি কিংকর্তব্যবিমূঢ় করেছিল। আর এর ফলে তিনি (পানির খোঁজে) যত্রতত্র ছুটাছুটি করতে লাগলেন। তিনি সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে পানির আশায় সাত বার আসা-যাওয়া করলেন। কিন্তু অবশেষে নিরাশ হয়ে সন্তানের কাছে ফিরে আসলেন।

দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈলের শ্বাস-প্রশ্বাসগুলো গোনা যাচ্ছিল (ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় তাঁর প্রাণ এতটা ওষ্ঠাগত হয়েছিল যে,তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস অত্যন্ত ধীর ও টানা-টানা হয়ে গিয়েছিল এবং তা গণনা করা যাচ্ছিল)। এর ফলে তাঁর ক্রন্দন ও চিৎকার করার শক্তিও যেন রহিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এ ধরনের বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর প্রার্থনা কবুল হলো। ক্লান্তশ্রান্ত মা দেখতে পেলেন ইসমাঈলের পায়ের তলদেশ থেকে স্বচ্ছ পানি বের হচ্ছে। যে মা সন্তানের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো প্রত্যক্ষ করছিলেন এবং নিশ্চিত ছিলেন যে,আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাঁর সন্তানের প্রাণপাখি দেহ থেকে বের হয়ে যাবে,তিনি এ পানি দেখে এতটা আনন্দিত হলেন যে যার কোন সীমা ছিল না এবং তাঁর চোখে জীবনের আলো ও দ্যুতি চমকাচ্ছিল। ঐ স্বচ্ছ পানি পান করে তিনি নিজে ও তাঁর সন্তানের তৃষ্ণা মেটালেন। হতাশা ও নিরাশার কালো মেঘ যা তাঁদের জীবনের আকাশে ছায়া বিস্তার করেছিল তা মহান আল্লাহর দয়ার মৃদুমন্দ সমীরণের দ্বারা দূরীভূত হয়ে গেল।(৯৩. তাফসীরে কুমী,পৃ. ৫২ এবং বিহারুল আনওয়ার,১২তম খণ্ড,পৃ. ১০০।) এ ঝরনাটি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ‘যমযম ঝরনা’নামে পরিচিত। এ ঝরনাটির উদ্ভব হওয়ার কারণে সেটির ওপর পাখির আনাগোনা শুরু হয়। জুরহুম গোত্র যারা উক্ত উপত্যকা থেকে দূরবর্তী এক অঞ্চলে বসবাস করত তারা পাখিদের আনাগোনা ও উড়ে বেড়ানো থেকে নিশ্চিত হলো যে,ঐ উপত্যকার আশেপাশে কোথাও পানি পাওয়া গেছে। প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য জুরহুম গোত্র দু’ব্যক্তিকে সেখানে প্রেরণ করল। তারা অনেক অনুসন্ধান করার পর মহান আল্লাহর রহমতের এ কেন্দ্রবিন্দুর সাথে পরিচিত হলো। যখন তারা হযরত হাজেরার কাছে আসলো তখন দেখতে পেল যে,একজন রমণী এক সন্তানের সাথে উক্ত পানির ধারে (যমযমের পাশে) বসে আছেন। তারা তৎক্ষণাৎ ফিরে গিয়ে এ ব্যাপারটি গোত্রপতিদেরকে জানাল। জুরহুম গোত্র দলে দলে রহমতের এ ঝরনাধারার চারপাশে তাঁবু স্থাপন করল। একাকিত্বের তিক্ততা যা হযরত হাজেরাকে ঘিরে রেখেছিল তা এখন বিদূরিত হয়ে গেল। ইসমাঈল (আ.) সেখানে শশীকলার ন্যায় বেড়ে উঠতে লাগলেন এবং বসতিস্থাপনকারী জুরহুম গোত্রের সাথে তাঁদের মেলামেশার কারণে ইসমাঈল (আ.) জুরহুম গোত্রে বিবাহ করেছিলেন। আর এ বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে তিনি জুরহুম গোত্রের যথেষ্ট সামাজিক সমর্থন ও সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইসমাঈল (আ.) এ গোত্রেরই এক মেয়েকে বিয়ে করলেন। আর এ কারণেই হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধরগণ মায়ের মাধ্যমে এ গোত্রের সাথে সংযুক্ত হয়ে পড়ে।

যে দিন যমযম কূপের উদ্ভব হয়েছিল সে দিন থেকেই জুরহুম গোত্র ঐ কূপের চারপাশে বসতি স্থাপন করেছিল এবং পবিত্র মক্কা নগরীর শাসনকর্তৃত্ব দীর্ঘ দিন তাদের হাতেই ছিল। তারা উক্ত কূপের পানি নিজেদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করত। কিন্তু পবিত্র মক্কা নগরীতে ব্যবসায় ও জনগণের আমোদ-প্রমোদের প্রসার ঘটলে তাদের শৈথিল্য, উদাসীনতা এবং চারিত্রিক দুর্বলতা ধীরে ধীরে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যে, এর ফলে যমযম কূপের পানি শুষ্ক হয়ে যায়।(জনগণের মধ্যে পাপ ও অপরাধের প্রসার আসমানী বিপদাপদ অবতীর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ। আর এটি মোটেও অসম্ভব নয় যে,অসৎ কীর্তিকলাপ দুর্ভিক্ষ,দুর্যোগ ও বিপদাপদ আনয়নকারী কার্যকারণাদির গতিপথে প্রভাব বিস্তার করে। এ বিষয়টি দার্শনিক নীতিমালার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল হওয়ার পাশাপাশি পবিত্র কোরআন ও হাদীসেও স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে। (সূরা আরাফের ৯৬ নং আয়াত দ্র.))

কখনো কখনো বলা হয় যে,জুরহুম গোত্র খুযাআহ্ গোত্রের হুমকির সম্মুখীন হয়ে নিজেদের আবাসস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেহেতু জুরহুম গোত্রপতি মাদ্দাদ ইবনে আমর নিশ্চিত বিশ্বাস করত যে,অতি শীঘ্রই সে তার নেতৃত্ব হারাবে এবং শত্রুদের আক্রমণে তার রাজ্য ও শাসনকর্তৃত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। এ কারণে সে পবিত্র মক্কার জন্য হাদিয়াস্বরূপ স্বর্ণনির্মিত যে দু’টি হরিণ এবং খুব দামী যে কয়টি তলোয়ার আনা হয়েছিল তা যমযম কূপে নিক্ষেপ করে কূপটি মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল যাতে করে শত্রুরা এ মহামূল্যবান সম্পদ ব্যবহার করতে না পারে। এর কিছুদিন পরেই খুযাআহ্ গোত্রের আক্রমণ শুরু হয়। এর ফলে জুরহুম গোত্র এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর অনেক বংশধরই পবিত্র মক্কা নগরী ত্যাগ করে ইয়েমেনের দিকে গমন করতে বাধ্য হয়। তাদের মধ্য থেকে আর কোন ব্যক্তি মক্কায় ফিরে আসে নি। এরপর থেকে মহানবী (সা.)-এর চতুর্থ ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ কুসাই বিন কিলাবের শাসনকর্তৃত্ব অর্জন করার মাধ্যমে কুরাইশদের জীবনাকাশে সৌভাগ্য-তারার উদয় হওয়া পর্যন্ত পবিত্র মক্কা নগরীর শাসনকর্তৃত্ব খুযাআহ্ গোত্রের হাতে থেকে যায়। কিছুকাল পরে শাসনকর্তৃত্ব আবদুল মুত্তালিবের হাতে চলে আসে। তিনি যমযম কূপ পুনরায় খনন করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তখনও যমযম কূপের আসল অবস্থান সূক্ষ্মভাবে কেউ জানত না। অনেক অনুসন্ধান চালানোর পর তিনি যমযম কূপের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পেলেন এবং নিজ পুত্র হারেসকে নিয়ে কূপ খননের পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

সাধারণত প্রতিটি গোত্র বা সমাজেই এমন কিছু মুষ্টিমেয় লোক পাওয়া যাবে যারা সব সময় যে কোন ভালো কাজ বাধাগ্রস্ত করার জন্য যে কোন ধরনের নেতিবাচক অজুহাত খুঁজে বেড়ায়। এ কারণেই আবদুল মুত্তালিবের প্রতিদ্বন্দ্বীরা ঘোর আপত্তি জানাতে থাকে যাতে করে তিনি এ বিরল সম্মান ও গৌরবের অধিকারী না হতে পারেন। তারা আবদুল মুত্তালিবকে লক্ষ্য করে বলেছিল, “হে কুরাইশপ্রধান! যেহেতু এ কূপ আমাদের পূর্বপুরুষ হযরত ইসমাঈলের পুণ্যস্মৃতি এবং আমরা সবাই যেহেতু তাঁরই বংশধর তাই আমাদের সবাইকে এ কাজে শরীক করুন। বিশেষ কতিপয় কারণে হযরত আবদুল মুত্তালিব তাদের কথা মেনে নিলেন না। কারণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এটিই যে,তিনি একাই এ কূপটি খনন করবেন এবং এর পানি বিনামূল্যে সকলের হাতে ছেড়ে দেবেন। আর এভাবেই বাইতুল্লাহ্ যিয়ারতকারী হাজীদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানিরও সুব্যবস্থা হয়ে যাবে। হাজীদের পানির বন্দোবস্ত করার বিষয়টি তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকার কারণে তা সব ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হবে।

যখন তিনি স্বাধীনভাবে এ কাজের গুরুদায়িত্ব নিজ হাতে নেবেন ঠিক তখনই এ বিষয়টির পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হবে।

অবশেষে তাঁরা একটি তীব্র বিরোধ ও টানাপড়েনের সম্মুখীন হলেন। আরবের একজন জ্ঞানী ভাববাদীর কাছে যাওয়া এবং এ ব্যাপারে তার বিচার মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা সফরের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। তাঁরা হিজায ও শামের মধ্যবর্তী ফুল-ফল,পত্র-পল্লবহীন ধূসর মরু এলাকাগুলো একের পর এক অতিক্রম করতে লাগলেন। পথিমধ্যে তাঁরা অত্যন্ত পিপাসার্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং ধীরে ধীরে তাঁদের বিশ্বাস জন্মেছিল যে,তাঁরা তাঁদের অন্তিম মুহূর্তগুলো অতিবাহিত করছেন। এ কারণেই তাঁরা যখন মৃত্যুর কথা চিন্তা করতে থাকেন,তখন আবদুল মুত্তালিব এ অভিমত ব্যক্ত করলেন যে,প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ কবর খনন করুক। যখন তার মৃত্যু হবে তখন অন্যরা তার মৃতদেহ উক্ত কবরে শায়িত করবে। আর এভাবে যদি পানি পাওয়া না যায় এবং সকলের তৃষ্ণা অব্যাহত থাকে এবং সবাই মৃত্যুবরণ করে তাহলে এভাবে সকলেই (কেবল শেষ ব্যক্তি ব্যতীত) কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হবে এবং তাদের মৃতদেহ হিংস্র প্রাণী ও পাখির খাদ্যবস্তুতে পরিণত হবে না।

আবদুল মুত্তালিবের অভিমত সকলের কাছে মনঃপূত হলো। প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজের কবর খনন করল এবং সকলেই বিষণ্ণ বদনে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ করে আবদুল মুত্তালিব উচ্চকণ্ঠে বললেন,“হে লোকসকল! এটি এমনই এক মৃত্যু যা হীনতা ও দীনতা বয়ে আনে। তাই এটি কতই না উত্তম যে,আমরা সবাই দলবদ্ধ হয়ে এ মরুভূমির চারপাশে পানির অন্বেষণে ঘুরে বেড়াব! আশা করা যায় যে, মহান আল্লাহ্পাকের অনুগ্রহ ও কৃপার দৃষ্টি আমাদের ওপর পতিত হবে।” সবাই পশুর পিঠে আরোহণ করে হতাশা নিয়ে পথ চলতে লাগল এবং তখন তারা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিল। ঘটনাক্রমে সবাই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সুমিষ্ট পানির সন্ধান পেয়ে গেল এবং তারা সবাই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেল। এরপর তারা যে পথে এসেছিল সে পথেই পবিত্র কাবার দিকে ফিরে গেল এবং পূর্ণ সন্তুষ্টচিত্তে যমযম কূপ খনন করার ব্যাপারে আবদুল মুত্তালিবের অভিমতের সাথে একমত পোষণ করল এবং সম্মত হলো। (তারিখে ইয়াকুবী,১ম খণ্ড,পৃ. ২০৬;সীরাতে ইবনে হিশাম,১ম খণ্ড,পৃ. ৪৫।)

আবদুল মুত্তালিব একমাত্র পুত্রসন্তান হারেসকে সাথে নিয়ে কূপ খননে মশগুল হয়ে যান। খনন কার্য চালানোর ফলে কূপের চারদিকে মাটির একটি প্রকাণ্ড ঢিবি তৈরি হয়েছিল। হঠাৎ করে তিনি স্বর্ণনির্মিত দু’টি হরিণ এবং কয়েকটি তলোয়ারের সন্ধান পান। কুরাইশগণ নতুন করে হৈ চৈ শুরু করে দিল এবং সকলেই প্রাপ্ত গুপ্তধনে নিজেদের অংশ আছে বলে দাবি করতে লাগল। তারা তাদের মাঝে লটারী করার সিদ্ধান্ত নিল। ঘটনাক্রমে লটারীতে ঐ দু’টি স্বর্ণনির্মিত হরিণ এবং তরবারিগুলো যথাক্রমে পবিত্র কাবা ও আবদুল মুত্তালিবের নামেই উঠল। কুরাইশদের নামে লটারীতে কিছুই উঠল না এবং এ কারণে তারা উক্ত গুপ্তধন থেকে কোন অংশ পেল না। মহামতি আবদুল মুত্তালিব উক্ত তরবারিগুলো দিয়ে পবিত্র কাবার একটি দরজা নির্মাণ করে হরিণ দু’টি ঐ দরজার ওপর স্থাপন করেছিলেন।