সূরা আন নিসা; (২৭তম পর্ব)

সূরা আন নিসা;আয়াত ৯৫-৯৯

সূরা নিসার ৯৫ ও ৯৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

لَا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى وَفَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْرًا عَظِيمًا (৯৫) دَرَجَاتٍ مِنْهُ وَمَغْفِرَةً وَرَحْمَةً وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا ((৯৬

"মুমিনদের মধ্যে যারা কোন সঙ্গত কারণ না থাকা সত্ত্বেও জিহাদে অংশ নেয় না এবং যারা জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে তারা সমান নয় ৷ আল্লাহতায়ালা,যারা জিহাদে অংশ নেয়নি তাদের তুলনায় জিহাদকারীদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন,যদিও আল্লাহ প্রত্যেককেই পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ৷ মহা পুরস্কারের ক্ষেত্রে আল্লাহ মুজাহিদদেরকে যারা জিহাদে অংশ নেয়নি,তাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন ৷" (৪:৯৫)

"এসব তার পক্ষ থেকে পদমর্যাদা,ক্ষমা ও দয়া ৷ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়৷" (৪:৯৬)

এর আগের আলোচনায় আমরা বলেছি,আল্লাহ শত্রুদের ব্যাপারে কোন তাড়াহুড়ামূলক পদক্ষেপ নিতে নিষেধ করেছেন৷ এই আয়াতে শত্রুদের মোকাবেলায় জিহাদে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়ার জন্য মুসলমানদেরকে আহ্বান জানানো হয়েছে৷ ভীতু ও সুবিধাবাদী মুসলমানদেরকে জিহাদে অংশ নিতে উত্সাহিত করার লক্ষ্যে এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে,যারা জিহাদে অংশ না নিয়ে শুধু নামাজ ও দোয়ার ওপর নির্ভর করে এবং যারা জিহাদে অংশ নিয়েছে;তাদের মর্যাদা সমান নয়৷ এরপর আল্লাহ বলেছেন,মুজাহিদদের মর্যাদা অন্যদের চেয়ে বেশী৷ এই আয়াতেরই শেষে আবার বলা হচ্ছে,শুধু মর্যাদাই নয় তাদের জন্য মহা পুরস্কার অপেক্ষা করছে ৷ আর ঐ পুরস্কারের সাথে রয়েছে আল্লাহর বিশেষ দয়া,রহমত ও ভালোবাসা ৷ অবশ্য আল্লাহ তার বান্দাদের ওপর কঠিন কোন দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না৷ সুতরাং যারা অসুস্থ এবং শারীরিক দিক থেকে যুদ্ধে অংশ নিতে অক্ষম তাদেরকে জিহাদে অংশ নেয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে৷ তবে তারা যদি মুজাহিদদেরকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে,মুজাহিদদের পক্ষে প্রচার চালিয়ে এবং অন্যকোনভাবে সহযোগিতা করে,তাহলে তারাও জিহাদে অংশগ্রহণকারীদের মতই আল্লাহর প্রতিশ্রুত পুরস্কার পাবে৷ এ আয়াতে যদিও তিন তিন বার যারা যুদ্ধে অংশ নেয়নি,তাদের তুলনায় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে,অন্যদের সেবা ও শ্রমকে উপেক্ষা করা হয়েছে বরং আল্লাহ সব মুসলমানকেই পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ অর্থাৎ এখানে মুজাহিদদেরকে শ্রেষ্ঠতর হিসাবে উল্লেখ করা হলেও অন্যদের উপেক্ষা করা হয়নি৷

এই দু'টি আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,

প্রথমত: ইসলামী রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের অর্থ এই নয় যে,সেখানে সব মুসলমানই সমান৷ বরং এ ক্ষেত্রে জিহাদে অংশ নেবার মত বিষয়গুলো যে কোন মুসলমানের জন্যই ইতিবাচক দিক৷ ফলে রাষ্ট্রের জনগণ ও কর্মকর্তাদেরকে অবশ্যই এসব বিষয় মেনে চলতে হবে৷ তবে মুজাহিদদের প্রত্যাশাও অযৌক্তিক হওয়া চলবে না৷

দ্বিতীয়ত: আল্লাহর রহমত লাভের শর্ত হলো,পবিত্র থাকা ও পবিত্র হওয়া৷ অর্থাৎ প্রথমে ক্ষমা এবং এরপর রহমত৷

তৃতীয়ত: মহান আল্লাহ দয়াবান ও ক্ষমাশীল ৷ তবে আল্লাহর এই বিশেষ গুনাবলী থেকে লাভবান হতে পারার বিষয়টি মানুষের নিজের ইচ্ছা ও কর্মের ওপর নির্ভর করে ৷

সূরা নিসার ৯৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيمَ كُنْتُمْ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِي الْأَرْضِ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيرًا ((৯৭

"যারা নিজের ওপর অত্যাচার করেছে,তাদের প্রাণ হরণের সময় ফেরেশতারা বলবে তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা উত্তরে বলবে,আমরা আমাদের শহরে অসহায় ছিলাম৷ ফেরেশতারা বলবে,আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না? তোমরা হিজরত করতে পারতে ৷ অতএব,এদের বাসস্থান হলো জাহান্নাম এবং তা অতি মন্দ স্থান ৷"(৪:৯৭)

ইতিহাসে এসেছে,মক্কার কিছু মুসলমান প্রাণের ভয়ে ভীত হয়ে মাঝে মধ্যেই সেখানকার কাফেরদের সাথে সহযোগিতা করতো এবং কেউ কেউ কাফেরদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়ে নিহতও হয়েছিল ৷ এরই পরিপ্রেক্ষিতে কোরআনের এই আয়াতটি নাযিল হয় এবং এ ধরনের মুসলমানদেরকে পাপী ও অপরাধী হিসাবে ঘোষণা করা হয়৷ এই আয়াতে আরো বলা হয়েছে,স্বদেশ প্রেমের অজুহাতে শত্রুদের সাথে সহযোগিতা গ্রহণযোগ্য নয় বরং এ ক্ষেত্রে ধর্ম রক্ষাই জরুরী বা মুখ্য বিষয়৷ অর্থাৎ ধর্ম রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে হিজরত করতে হবে৷ এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো মৃত্যুর সময় ফেরেশতাদের সাথে মানুষের সাক্ষাৎ হয় এবং ফেরেশতারা তখন মানুষের সঙ্গে কথা বলে ও পাপী মানুষদেরকে তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করে ৷

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,

প্রথমত : শুধু আল্লাহই নন ফেরেশতারাও মানুষের কর্ম সম্পর্কে অবহিত ৷

দ্বিতীয়ত : ধর্ম বিরোধী সমাজ থেকে হিজরত করা মুসলমানদের জন্য ফরজ এবং কাফেরদের সাথে সহযোগিতা করা হারাম ৷

তৃতীয়ত : দেশ প্রেম নয় বরং খোদাপ্রেমই মানুষের জীবনের মূখ্য বিষয়,ফলে ধর্ম বিরোধী সমাজে পরিবর্তন আনতে হবে নতুবা অন্য কোথাও হিজরত করতে হবে ৷

সূরা নিসার ৯৮ ও ৯৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

إِلَّا الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ لَا يَسْتَطِيعُونَ حِيلَةً وَلَا يَهْتَدُونَ سَبِيلًا (৯৮) فَأُولَئِكَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَعْفُوَ عَنْهُمْ وَكَانَ اللَّهُ عَفُوًّا غَفُورًا ((৯৯

"কিন্তু পুরুষ,নারী ও শিশুদের মধ্যে যারা অসহায় এবং মুক্তির জন্য কোন উপায় বের করতে পারে না এবং কোন পথও জানে না৷" (৪:৯৮)

অতএব আশা করা যায়,আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন৷ আল্লাহ পাপ মার্জনাকারী,ক্ষমাশীল৷"(৪:৯৯)

এর আগের আয়াতে হিজরত করাকে ধর্ম রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ কিন্তু এই আয়াতে বলা হচ্ছে যারা হিজরত করতে অক্ষম ও মুক্তির জন্য কোন উপায় বের করতে পারে না,তারা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এবং আল্লাহ তাদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত কিছু আশা করে না ৷ ইসলাম ধর্মে কোন দায়িত্ব পালনের শর্ত হলো তা পালনের জন্য শক্তি ও সামর্থ থাকা৷ যারা মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ,তাদের জন্য ঐশী দায়িত্ব পালন জরুরী নয়৷ এই আয়াতে এ ধরনের অসুস্থ পুরুষ ও নারীদেরকে শিশুদের পর্যায়ভুক্ত ও দুর্বল বলে বিবেচনা করা হয়েছে ৷ এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,

প্রথমত: শক্তি ও সামর্থ থাকলে ধর্ম রক্ষার জন্য হিজরত শুধু পুরুষদের জন্যই নয় বরং নারী ও শিশুসহ পরিবারের সব সুস্থ সদস্যের জন্যেই বাধ্যতামূলক৷

দ্বিতীয়ত: যে কোন বিষয়ে সঙ্গত কারণ আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য৷ অর্থাৎ সঙ্গত কারণে কোন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে মানুষ সে ক্ষেত্রে ক্ষমা পাবে৷ কিন্তু মিথ্যা অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়৷