সূরা আন নিসা;(৩১তম পর্ব)

সূরা আন নিসা; আয়াত ১১৫-১১৯

সূরা নিসার ১১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا ((১১৫

"সরল পথ তথা হেদায়েতের পথ সুস্পষ্ট হওয়ার পর যে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতিত অন্য কোনো পথের অনুসরণ করে,তাকে তার অনুসৃত পথের দিকেই ফেরাব এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান।" (৪:১১৫)

মুমিনদের জন্যে বিপজ্জনক একটি হুমকি হলো নিজস্ব দ্বীনী ব্যবস্থা থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং ঐশী নেতৃবৃন্দ ও তাদেঁর পথনির্দেশনার সাথে সচেতনভাবে বিরোধিতা করা। বর্তমান যুগে অবশ্য আমাদের মাঝে নবীজীর উপস্থিতি নেই ফলে তাঁর বিরুদ্ধে কারো রুখে দাঁড়ানোর প্রশ্নই আসে না। কিন্তু মুসলিম বহু জামাত রয়েছে এখন,যাদের বিরোধিতা করার মানে হলো মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা। এ আয়াত অনুযায়ী মুসলিম জামাতের বিরুদ্ধাচরণ নবীজীর সাথে শত্রুতার শামিল। যার পরিণতি হলো পার্থিব জগতে জাতির ঘাড়ে ন্যায়- নীতিহীন শাসনব্যবস্থা চেপে বসা আর পরকালে দোযখের কঠিন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : ইসলামী সমাজের বিরোধিতা করা এবং সেই সমাজের নেতার যথাযথ আনুগত্য না করার মানে হলো নবীজীর বিরুদ্ধাচরণ করা।

দ্বিতীয়ত : আল্লাহ পাক হেদায়াতের সকল পথ প্রদর্শন না করিয়ে কাউকেই দোযখে নেবেন না। প্রথমে সরল পথের সন্ধান দেবেন তারপরও সে যদি পথভ্রষ্ট হয় তাহলেই শাস্তি দেবেন।

সূরা নিসার ১১৬ এবং ১১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا (১১৬) إِنْ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا إِنَاثًا وَإِنْ يَدْعُونَ إِلَّا شَيْطَانًا مَرِيدًا ((১১৭

"নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে (তওবা ছাড়া) তাকে তিনি ক্ষমা করেন না। এছাড়া যাকে ইচছা ক্ষমা করেন। যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে অবশ্যই গোমরাহ হয়ে গেছে, তাও সুদূরপ্রসারী ভ্রান্তিতে।" (৪:১১৬)

"তারা আল্লাহ্কে পরিত্যাগ করে নারীর আরাধনা করে, আসলে তারা উদ্ধত শয়তান ছাড়া আর কারো পূজা করে না।" (৪:১১৭)

মক্কায় ইসলাম আগমনের সময় মুশরিকরা যেসব মূর্তির পূজা করতো সেগুলো ছিল নারী মূর্তি। এসব মূর্তির নাম রেখেছিল লাত,মানাত,ওজ্জা ইত্যাদি। মুশরিকরা আরো বিশ্বাস করতো ফেরেশতাকূল হলো আল্লাহর মেয়ে এবং বিশ্বব্যবস্থাপনা তাদেরই হাতে রয়েছে। সেজন্যে তারা ফেরেশতাদেরও একরকম পূজা করতো।এ আয়াতে তাদের সেই ভ্রান্ত বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছেঃ তারা মূলত নিজেদের ভ্রান্ত ও শয়তানী চিন্তারই অনুসরণ করছে। আর এ ধরনের শেরেকি বিশ্বাস গোমরাহি বা বিচ্যুতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

এটা স্পষ্ট যে মুশরিকরা যতোক্ষণ না শেরেকি থেকে দূরে সরে গিয়ে একত্ববাদের প্রতি ঈমান না আনবে ততোক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভ করবে না।

পক্ষান্তরে মুমিন ব্যক্তি-যিনি সঠিক আকিদা-বিশ্বাসের ওপর রয়েছেন-তিনি যদি কখনো অন্যায় বা পাপ কাজে লিপ্ত হন তাহলে তিনি ক্ষমা প্রাপ্তির যোগ্য হতে পারেন কেননা তিনি শেরেকি করেন নি। অবশ্য এই ক্ষমা প্রাপ্তির বিষয়টি বান্দার যোগ্যতা এবং আল্লাহর বিবেচনাধীন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

প্রথমতঃ সবচেয়ে বড়ো গুনাহ হলো শেরেকি। কেননা তা আল্লাহর রহমত লাভের সুযোগ নষ্ট করে দেয়।

দ্বিতীয়তঃ বিচ্যুতির যতো পথ আছে সেগুলো একটি পথে গিয়ে মিলেছে। আর ঐ পথটি হলো শয়তানের পথ।তাই যারা সত্য ও সঠিক পথ থেকে পলায়ন করবে,শয়তান ছাড়া তাদের আর কোনো আশ্রয় নেই।

তৃতীয়তঃ আল্লাহ ছাড়া অপর যে কোনো কিছুর পূজা করার মানে হলো শয়তানের পূজা করা।

সূরা নিসার ১১৮ ও ১১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَعَنَهُ اللَّهُ وَقَالَ لَأَتَّخِذَنَّ مِنْ عِبَادِكَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا (১১৮) وَلَأُضِلَّنَّهُمْ وَلَأُمَنِّيَنَّهُمْ وَلَآَمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ آَذَانَ الْأَنْعَامِ وَلَآَمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللَّهِ وَمَنْ يَتَّخِذِ الشَّيْطَانَ وَلِيًّا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُبِينًا ((১১৯

"আল্লাহ শয়তানকে অভিশাপ দিয়েছেন। কেননা শয়তান বলেছিল: আমি অবশ্যই তোমার বান্দাদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট একটি দলকে আমার দলে ভেড়াবো।" (৪:১১৮)

"তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব,তাদেরকে আশ্বাস দেব; তাদেরকে চতুষ্পদী পশুদের কান ছিদ্র করতে বলব এবং তাদেরকে আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করতে আদেশ দেব। যে কেউ আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে,সে প্রকাশ্য ক্ষতির মাঝে নিমজ্জিত হবে।"(৪:১১৯)

মুশরিকরা কেবল মূর্তি পূজাই করতো না বরং সেগুলোকে তাদের এবং খোদার মাঝে সম্পর্কসেতু নির্মাণকারী মাধ্যম বলে মনে করতো। তারা তাদের পশুগুলো এবং পশু থেকে উৎপন্ন পণ্য সামগ্রী মূর্তিগুলোর জন্যে মানত করতো, চতুষ্পদীগুলোর কান মূর্তিগুলোর অংশ নিশ্চিত করার জন্যে কেটে নিত। এর মাধ্যমে পশুগুলোকে চিহ্নিত করেও রাখা হতো যেন সেগুলোর পিঠে সওয়ার না হয় কিংবা সেগুলোর গোশত খাওয়া না হয়। আল্লাহ পাক এ আয়াতে এই ধরনের ভ্রান্ত আচার প্রথা বা চিন্তাকে শয়তানী কর্মকাণ্ড বলে উল্লেখ করে বলেছেনঃ শয়তান শপথ করেছে সে আল্লাহর বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং বিচ্যুতির পথ রচনা করবে। কেননা সে এবং তার অনুসারীরা আল্লাহর রহমত থেকে দূরে রয়েছে।

এ আয়াতে মানুষকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে শয়তানের কর্মসূচির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, শয়তান মানুষের মাঝে ব্যর্থ আশা জাগাবে এবং সৃষ্টির মাঝে পরিবর্তন আনবে। মূর্তি পূজা মানে মুক্তির আশায় আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর পূজা করাটা সেই ব্যর্থ কামনা বা আশা জাগানোরই নামান্তর। আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন আনা কিংবা আল্লাহর বিধিবিধানে পরিবর্তন আনাটাও আল্লাহর পবিত্র সত্ত্বা থেকে মানুষকে দূরে রাখার শয়তানী কৌশল। এর মাধ্যমে জীবনজুড়ে শয়তানী কর্মসূচিই পালন করা হয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

প্রথমতঃ শয়তান মানুষের চিরশত্রু। তার ফাঁদে পড়ে যেন আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত না হই সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর দেয়া হালাল জিনিসকে হারাম করা কিংবা হারামকে হালাল করা শয়তানী কাজ।

তৃতীয়তঃ শয়তান কাউকে পথচ্যুত করার জন্যে ব্যর্থ আশা জাগানো, সৃষ্টি কিংবা ঐশী বিধি-বিধানে পরিবর্তন আনা এবং ভ্রান্তির বেড়াজালে ফেলার মতো কৌশলের আশ্রয় নেয়।