সূরা আন নিসা;(৩২তম পর্ব)

সূরা আন নিসা; আয়াত ১২০-১২৪

সূরা নিসার ১২০ এবং ১২১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

يَعِدُهُمْ وَيُمَنِّيهِمْ وَمَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطَانُ إِلَّا غُرُورًا (১২০) أُولَئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَلَا يَجِدُونَ عَنْهَا مَحِيصًا ((১২১

"(শয়তান) সবসময় তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাদেরকে আশ্বাস দেয়। (কিন্তু জেনে রেখো) শয়তানের প্রতিশ্রুতি প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।"(৪:১২০)

"তাদের বাসস্থান জাহান্নাম। সেখান থেকে তারা পালাবার কোনো পথ পাবে না।" (৪:১২১)

আগের পর্বে আমরা শয়তানের প্ররোচনামূলক কর্মসূচির কথা বলেছিলাম। তারি ধারাবাহিকতায় এ দু'টি আয়াতে বলা হয়েছে- মানুষকে প্রতারিত করার জন্যে শয়তান মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়,সুদূরপ্রসারী আশ্বাস দেয়। এগুলো শয়তানী প্রতারণার আরো কিছু কৌশল। বর্ণনায় এসেছে যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে গুনাহ মাফ করে দেয়া সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হলো, ইবলিস তখন তার সাঙ্গপাঙ্গদের একত্র করে বললোঃ মানুষের তওবা করার মধ্য দিয়ে আমাদের সকল শ্রমই পণ্ড হয়ে যায়। এক শয়তান বলে উঠলোঃ যখনই কেউ তওবা করার সিদ্ধান্ত নেবে তখনই তাকে আশ্বাসের জালে আটকে ফেলবো যাতে তওবার ব্যাপারটি পিছিয়ে যায় এবং এক সময় তা থেকে সরে আসে।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

প্রথমতঃ সুদূর প্রসারী আশ্বাসে আকৃষ্ট হওয়া শয়তানী জালে আটকে পড়ার শামিল।

দ্বিতীয়তঃ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি-এমনকি শিশুকে হলেও-তা শয়তানের কাজ।

 

সূরা নিসার ১২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا وَعْدَ اللَّهِ حَقًّا وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللَّهِ قِيلًا ((১২২

"যারা মুমিন এবং পূণ্যবান,শীঘ্রই তাদেরকে তলদেশ দিয়ে বহমান জলের ধারাময় বেহেশতের বাগানে প্রবেশ করানো হবে। তারা সবসময়ের জন্যে সেখানে থাকবে-এটা আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতি, কথাবার্তায় আল্লাহর চেয়ে আর কে বেশি সত্যবাদী?"(৪:১২২)

আগের আয়াতগুলোতে বলেছিলাম,শয়তান মানুষকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্ররোচিত করে। শয়তান সবসময় এমন সব প্রতিশ্রুতি দেয় যেগুলোর কোনোটাই ডাহা মিথ্যা ছাড়া সত্য কিংবা বাস্তব নয়। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, তবে আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতির সবই সত্য এবং বাস্তব। তিনি তোমাদেরকে বেহেশত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তিনি অনড়,অটল। তবে তিনি আশ্বাসের পরিবর্তে তোমাদের কাছ থেকে চেষ্টা ও আমল পেতে চান। সেটা অবশ্যই নেক বা পূণ্য আমল যার কল্যাণময় প্রভাব অন্যদের ওপরেও পড়ে। যে পূণ্য কাজের ভিত্তি হলো সুষ্ঠু এবং পবিত্র চিন্তা,যা ব্যক্তির উন্নয়ন ও বিকাশেরও সহায়ক।

এ আয়াত থেকে আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় হলোঃ

প্রথমতঃ ঈমান এবং নেক কাজ পরস্পর সংশ্লিষ্ট,কখনোই তা বিচ্ছিন্ন হয় না। তাই আমল ছাড়া মুমিন হওয়া সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর প্রতিশ্রুতিতে আকৃষ্ট হতে হবে কেননা তার চেয়ে সত্যবাদী আর কেউ নেই। এটা এমন এক বেহেশতের প্রতিশ্রুতি যা হাতছাড়া হবার কোনো আশঙ্কা নেই।

সূরা নিসার ১২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَيْسَ بِأَمَانِيِّكُمْ وَلَا أَمَانِيِّ أَهْلِ الْكِتَابِ مَنْ يَعْمَلْ سُوءًا يُجْزَ بِهِ وَلَا يَجِدْ لَهُ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا ((১২৩

 

"(শাস্তি কিংবা পুরস্কার) তোমাদের অথবা আহলে-কিতাবদের চাওয়ার ওপর নির্ভর করে না। বরং যে কেউ খারাপ কাজ করবে,সেই শাস্তি পাবে আর সে আল্লাহর সামনে নিজের কোন অভিভাবক বা সহযোগী পাবে না।" (৪:১২৩)

গুনাহগারদেরকে শয়তান যেসব আশ্বাস দেয় সেগুলোর মধ্যে একটি হলো শয়তান তাদেরকে বলেঃ তোমরা যেহেতু মুসলমান বা খ্রিস্টান, খোদা সেজন্যে তোমাদেরকে শাস্তি দেবে না। বরং শাস্তির বিধান হলো অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যে। এই ভ্রান্ত চিন্তাটি একদিকে যেমন গুনাহের কাজের বিস্তৃতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে তেমনি গুনাহগারদেরকে আল্লাহর দরবারে তওবা করার পথ থেকেও দূরে সরিয়ে রাখে। এ আয়াতে তাই বলা হচ্ছেঃ এ ধরনের মিথ্যা আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ো না। এমনটি ভেবো না যে আল্লাহ তোমাদের জন্যে বিশেষ কোনো হিসাবের খাতা খুলে রেখেছেন এবং তোমাদের শাস্তি মাফ করে দিয়েছেন। না,এরকম নয়। বরং যে-ই পাপ করবে,সে যে গোত্র কিংবা বর্ণেরই হোক না কেন কিংবা যে মতবাদ বা ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন শাস্তি পেতেই হবে।

ইতিহাসে এসেছে,কতিপয় মুসলমান মনে করতেন আহলে কিতাব এবং তাদের মধ্যকার মতবিরোধে নবীজী মুসলমানদের পক্ষপাতিত্ব করেন। অথচ মানদণ্ড ন্যায়নীতির ওপর, সমর্থনের ওপর নয়। মানদণ্ড প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল, সম্পর্কের ওপর নয়।এ আয়াতের শিক্ষা হলোঃ

এক. স্বার্থচিন্তা, শ্রেষ্ঠত্বকামিতা এবং অমূলক প্রত্যাশা এগুলো হচ্ছে ধর্মের অনুসারীদের বিভ্রান্ত করার জন্যে শয়তানের কৌশল।

দুই. ইসলামের বিধিবিধান সত্য ও বাস্তবতার ভিত্তিমূলে প্রতিষ্ঠিত, কারো কল্পনা কিংবা ব্যক্তিগত প্রবণতার ওপর নয়।

তিন. ঐশী বিধানের কাছে সবাই সমান। তাই কোনো দ্বীন কিংবা কোনো নামের সদ্ব্যবহার করা নিষেধ।

 

সূরা নিসার ১২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَمَنْ يَعْمَلْ مِنَ الصَّالِحَاتِ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ وَلَا يُظْلَمُونَ نَقِيرًا ((১২৪

 

"নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেসব মুমিন সঠিক কাজ করবে কেবল তারাই বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং ন্যূনতম জুলুমও তাদের ওপর করা হবে না।" (৪:১২৪)

আগের আয়াতে সামগ্রিক শাস্তির নীতিমালার প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে কিয়ামতে সামগ্রিক পুরস্কারের নীতিমালা নিয়ে বলা হচ্ছেঃ আল্লাহ এবং কিয়ামতে বিশ্বাসী নারী কিংবা পুরুষ যে-ই হোক না কেন তারা যদি যে-কোনোরকম সৎ কাজ করে, কিয়ামতে তাদেরকে পুরস্কার হিসেবে বেহেশত দেয়া হবে। পুরস্কারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ঘাটতি থাকবে না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, এ আয়াতসহ কোরআনের অন্যান্য আয়াত অনুযায়ী একটি বিষয় সুস্পষ্ট, তাহলোঃ পূণ্য কাজের গ্রহণযোগ্যতার নীতিমালা হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান থাকা। যাদের ঈমান নেই তাদের পূণ্য কাজ গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কেননা, কিয়ামত কিংবা পরকালীন পুরস্কারের প্রতি যাদের বিশ্বাসই নেই, আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কারের ব্যাপারে তারা কী আশা করতে পারে। অবশ্য আল্লাহ তো পরম দয়ালু এবং মেহেরবান। তাই তিনি ইচ্ছে করলে দয়াপরবশ হয়ে তাকে তাঁর রহমতের অন্তর্ভুক্ত করে নিতেও পারেন অর্থাৎ বেহেশতে স্থান দিতেও পারেন। তবে এটা হবে তার কাছে অপ্রত্যাশিত।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

এক. বেহেশতে প্রবেশ করার চাবিকাঠি হলো ঈমান এবং নেক আমল।

দুই. আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমান। পূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে কারো জন্যেই সীমাবদ্ধতা নেই।

তিন. আমল কবুল হবার শর্ত হলো ঈমান। বে-ঈমানদের সেবার ফল এ দুনিয়াতেই দেয়া হবে।