সূরা আন নিসা;(৩৪তম পর্ব)

সূরা আন নিসা; আয়াত ১২৯-১৩২

সূরা নিসার ১২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَلَنْ تَسْتَطِيعُوا أَنْ تَعْدِلُوا بَيْنَ النِّسَاءِ وَلَوْ حَرَصْتُمْ فَلَا تَمِيلُوا كُلَّ الْمَيْلِ فَتَذَرُوهَا كَالْمُعَلَّقَةِ وَإِنْ تُصْلِحُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا ((১২৯

"তোমরা কখনও নারীদের মাঝে ন্যায় সঙ্গত ও সমতাপূর্ণ আচরণ করতে পারবে না। অতএব,সাধ্যমতো চেষ্টা করো যাতে একবারে একদিকে ঝুঁকে না পড়ো, যাতে আরেকজনকে ফেলে রাখতে হয় দায়িত্বহীনের মতো। জেনে রেখো, যদি সংশোধনের পথ এবং খোদাভীরুতার পথ অবলম্বন করো, তবে আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, করুণাময়।"(৪:১২৯)

এমন সব পুরুষদের উদ্দেশ্যে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে যাদের একাধিক স্ত্রী রয়েছে। আগের আয়াতে দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক সংশোধন ও সৌহাদের ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ আয়াতে পুরুষদেরকে ন্যায় ও সাম্যের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, কিন্তু এ আয়াতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যাবার আগে কয়েকটি বিষয়ে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইঃ

প্রথমতঃ ইসলাম কখনোই একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে পরামর্শ কিংবা আদেশ দেয় নি,বরং বিশেষ পরিস্থিতিতে একাধিক স্ত্রী গ্রহণকে বৈধতা দিয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ কোনো কোনো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ কিংবা কোনো সামাজিক ব্যবস্থার কারণে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এসব পরিস্থিতিতে যদি এর বৈধতা দেয়া না হয়, তাহলে অবৈধভাবে এই সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবার আশঙ্কা থেকে যায়। পশ্চিমা বিশ্বে বর্তমানে যেহেতু একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যবস্থা নেই,সেজন্যে সেখানে পুরুষেরা প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে একাধিক নারীর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তাদের এই সম্পর্কের ওপর কোনোরকম নিয়ন্ত্রণও নেই। এ কারণে ইসলাম একাধিক স্ত্রী গ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা না করে বরং সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। তবে ব্যাপারে উৎসাহিতও করে নি এবং একাধিক স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে ন্যায়নীতি ও সমতা বজায় রাখার মূলনীতি ও মাপকাঠি দিয়েছে। সূরা নিসার তিন নম্বর আয়াতে আমরা পড়েছিলামঃ যদি ভয় হয় যে সমতা বা ন্যায়নীতি বজায় রাখতে পারবে না তাহলে এক স্ত্রীর ওপরই নির্ভর কর।

তৃতীয়তঃ একথা সত্য যে,সকল ক্ষেত্রেই আইনের অসদ্ব্যবহার করার সুযোগ থেকে যায়। বিশেষ করে অনেকেই নিজেদের কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্যে আইনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সমতা রক্ষা বা ন্যায় আচরণ করার সামর্থ ছাড়াই একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের এই সুযোগ গ্রহণ করার কারণে তো আইনকে রহিত করা যায় না।

এ আয়াতে পুরুষদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, নারীদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎ থাকতে হবে। যাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের জের ধরে একজন মোহরানা থেকে বঞ্চিত না হয়, কিংবা পারস্পরিক ভালোবাসার ক্ষেত্রে আন্তরিকতার অভাব সৃষ্টি না হয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

প্রথমতঃ কোনো অবস্থাতেই স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ না দিয়ে বিদায় করে দেয়ার অধিকার পুরুষের নেই। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর অধিকার দিয়ে তার প্রাপ্য হক আদায় করতে হবে অথবা তালাক দিয়ে দিতে হবে যাতে নারী তার নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে পারে।

দ্বিতীয়তঃ নারী পুরুষের মাঝে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও বন্ধুত্ব এবং খোদাভীরুতা একটি পরিবারের মূল ভিত্তি। এর ফলে ঐ পরিবারের ওপর আল্লাহর রহমত ও দয়া বর্ষিত হয়।

 

সূরা নিসার ১৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِنْ يَتَفَرَّقَا يُغْنِ اللَّهُ كُلًّا مِنْ سَعَتِهِ وَكَانَ اللَّهُ وَاسِعًا حَكِيمًا ((১৩০

 

"যদি উভয়েই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে আল্লাহ্ তার অপরিসীম দয়া ও করুণার সাহায্যে প্রত্যেককে অমুখাপেক্ষী করে দেবেন। আল্লাহ্ সুপ্রশস্ত,প্রজ্ঞাময়।" (৪:১৩০)

 

ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, কোনো সমাজ কিংবা পরিবারের সমস্যা যথাযথ প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে যৌক্তিক এবং বাস্তবতার আলোকে সমাধানের উপায় প্রদর্শন করা। অনমনীয়,শুষ্ক কোনো মতবাদের মতো নিজের অনুসারীদেরকে অকার্যকর কিংবা কোনোরকম অচলাবস্থার মাঝে ফেলে দেয়া ইসলামের বৈশিষ্ট্য নয়। সমাজে এ ধরনের একটি বিষয় হলো তালাক। ইসলাম যুবকদেরকে বিয়ে করার ব্যাপারে যতোটা উৎসাহিত করেছে ঠিক ততোটাই অনুৎসাহিত করেছে তালাক কিংবা সেপারেশানের ব্যাপারে। তারপরও কখনো কখনো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যে উভয় পক্ষের জন্যেই যৌথ জীবন যাপন করা আর কিছুতেই সম্ভব হয় না। এরকম অবস্থায় তো কোনো পক্ষকেই স্থায়ী অন্তর্দহনে রেখে দিয়ে আত্মিক এবং মানসিক চাপের মধ্যে ফেলে রাখার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।

 

ইসলাম সেজন্যেই এরকম পরিস্থিতিতে তাদের মাঝে আলাদা হয়ে যাবার বিধান রেখে দিয়েছে। তবে তাদেরকে এ-ও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে,বিয়ে ভেঙ্গে যাবার কারণে স্থায়ীভাবে হতাশ হয়ে পড়ার কোনো মানে হয় না। বরং আল্লাহর রহমতের আশায় বুক বাঁধতে হবে এবং নতুন করে জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। কেননা আল্লাহর রহমত অপরিসীম,বিগত জীবনের মাঝেই তাঁর রহমত সীমাবদ্ধ নয়।

এ আয়াত থেকে শিক্ষণীয় হলোঃ

প্রথমতঃ একজন মুসলমানের জীবন পথে কোনো অচলাবস্থা নেই। ক্ষমা,সমঝোতা কিংবা তাকওয়ার পরও যদি পারিবারিক বন্ধন রক্ষা করা সম্ভব না হয় তাহলে তালাকের পথ খোলা আছে।তবে প্রথম পদক্ষেপ হলো সমঝোতা। তারপর তালাকের চিন্তা।

দ্বিতীয়ত, তালাক সবসময় খারাপ নয়। অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন কিংবা আত্মহত্যার মতো পারিবারিক বা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির চেয়ে ভালো।

 

সূরা নিসার ১৩১ এবং ১৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَلَقَدْ وَصَّيْنَا الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَإِيَّاكُمْ أَنِ اتَّقُوا اللَّهَ وَإِنْ تَكْفُرُوا فَإِنَّ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَكَانَ اللَّهُ غَنِيًّا حَمِيدًا (১৩১) وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَكَفَى بِاللَّهِ وَكِيلًا ((১৩২

"আর যা কিছু রয়েছে আসমান সমূহে ও যমীনে সবই আল্লাহর। বস্তূত: আমি নির্দেশ দিয়েছি তোমাদের পূর্ববর্তী গ্রন্থের অধিকারীদেরকে এবং তোমাদেরকেঃ তোমরা সবাই তাকওয়া অর্জন করো। যদি তোমরা তা না মান,তবে জেনো,আসমান সমূহে ও যমীনে যা কিছু রয়েছে,সে সব কিছুই আল্লাহ্ তা'আলার। আর আল্লাহ্ সর্বদা অভাবহীন,প্রসংশিত।" (৪:১৩১)

"হ্যাঁ,আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু সবই আল্লাহ্‌র অধীনে,আল্লাহ সবসময়ই অভাবমুক্ত এবং প্রশংসার পাত্র।" (৪:১৩২)

আগের আয়াতে নারী পুরুষদেরকে তাকওয়া ও পরহেজগারীর আদেশ দেয়া হয়েছে। তারি ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে,এই আদেশ কেবল তোমাদেরকেই নয় বরং তোমাদের পূর্ববর্তী দ্বীনগুলোর অনুসারীদেরকেও একই আদেশ দেয়া হয়েছে। তোমরা এমনটি ভেবো না যে, এতে আল্লাহর স্বার্থ নিহিত রয়েছে। কেননা তোমাদের কাছে আল্লাহর কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। তিনি সকল মাসমান ও যমিনের মালিক। ফলে পৃথিবীর সকল মানুষও যদি তাঁকে অস্বীকার করে, তাহলেও আল্লাহর কোনো ক্ষতি নেই।

 

লক্ষণীয় বিষয়টি হলো, এ আয়াতে মালিকানা এবং শাসনাধিকারের বিষয়টি যে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত-তা তিন তিনবার উচ্চারিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো মানুষের মাধ্যমে আল্লাহর আদেশগুলো পালন করার প্রয়োজনীয়তা যে আল্লাহর নেই, সে বিষয়টা বোঝানো এবং আল্লাহর অভাবহীনতার বিষয়টি প্রমাণ করা।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

প্রথমতঃ ঐশী ধর্মগুলোর মাঝে পারস্পরিক কোনো বৈপরীত্য নেই।সকল ঐশী ধর্মেরই উৎস এক এবং অভিন্ন। তাই ঐশী ধর্মগুলোর আদেশ নিষেধ আল্লাহরই পক্ষ থেকে।

দ্বিতীয়তঃ যিনি মানবজাতি এবং সমগ্র সৃষ্টিজগতের মালিক,একমাত্র তাঁরই অনুসরণ করা উচিত,তাঁকেই ভয় করা উচিত,অন্য কাউকে নয়।

তৃতীয়তঃ তাঁর প্রতিই ভরসা করবো, তাঁর ওপরই আস্থা রাখবো যিনি সকল আসমান এবং যমিনের মালিক, যিনি শক্তি ও সম্পদের মালিক।