ইমামীয়া জাফরী মাজহাব-পর্ব-১

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন :

وجعلناکم شعوبا وقبائل لتعارفوا

এবং আমি তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও।

ইসলামের আবির্ভাবের সময় জাতি ও গোত্রসমূহ পরস্পর অপরিচিত ও বিভিন্ন দলে বিভক্ত ছিল। আরো যথার্থ বললে তারা পরস্পর বিদ্বেষী এবং দ্বন্দ-সংঘাত ও যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। কিন্তু একত্ববাদী ধর্ম ইসলামের শিক্ষার কারণে তাদের এই পরস্পর অপরিচিতি পরিচিতিতে,দ্বন্দ-সংঘাত সহযোগিতায় এবং অনৈক্য ঐক্যে পরিণত হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতে একক মহান জাতি হিসেবে তারা আবির্ভূত হয়েছিল এবং এক মহান সভ্যতার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছিল। সেই সাথে শোষক ও অত্যাচারীদের হাত হতে বিভিন্ন জাতিকে রক্ষা করেছিল এবং এই উম্মাহ বিশ্বের জাতিগুলোর কাছে সম্মানের পাত্র হয়েছিল। এর বিপরীতে অত্যাচারী ও সীমালংঘনকারীদের জন্য তারা আতঙ্ক ও চক্ষুশূল হয়েছিল।

এ সকল সফলতা কখনই অর্জিত হত না যদি না তাদের মধ্যে ঐক্য থাকত এবং ইসলামের ছায়ায় আশ্রয়গ্রহণকারী জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সম্প্রীতি বিরাজ করত। যদিও তারা ছিল বিভিন্ন জাতির,তাদের মধ্যে ছিল মতের ভিন্নতা,সাংস্কৃতিক পার্থক্য,প্রথাগত অমিল,রীতি ও আচারের বিচিত্রতা কিন্তু মৌলনীতি ও আবশ্যকীয় বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে তারা ছিল সমবিশ্বাসী ও ঐকমত্য। তারা বুঝত একতাই শক্তি আর বিভেদই দুর্বলতা।

এ রীতিই অনুসৃত হচ্ছিল কিন্তু যুগের পরিবর্তনে পুনরায় এ পরিচিতি অপরিচিতিতে,সমঝোতা ঘৃণায় পরিণত হল,মাজহাবভিত্তিক দল ও গোষ্ঠীসমূহ একে অপরকে কাফের প্রতিপন্ন করল,পরস্পরের উপর আঘাত হানতে লাগল। ফলে মর্যাদা ভূলুন্ঠিত হল,গৌরব লুপ্ত হল,ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হল এবং তাগুতী শক্তি নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনাদানকারী এ জাতিকে তুচ্ছ ও হীন মনে করল। এ বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌছল যে এ জাতির মধ্যে শৃগালের ন্যায় ধূর্ত ও নেকড়ের ন্যায় হিংস্র ব্যক্তিবর্গের বিচরণ শুরু হল,আল্লাহর অভিশপ্ত ও মানব জাতি কর্তৃক ধিকৃত বিজাতীয় শত্রুরা ইসলামী ভূখণ্ডে গুপ্তচরবৃত্তিতে লিপ্ত হল। ফলে এ ভূখণ্ডের সম্পদসমূহ ব্যাপকভাবে লুন্ঠিত হল,পবিত্র বিশ্বাসসমূহ অসম্মানিত হল,এর অধিবাসীদের সম্মান লম্পট ব্যক্তিদের করুণার অধীন হয়ে গেল,এ জাতির পতনের পর পতন ঘটতে লাগল,পরাজয়ের পর পরাজয় তাদের ললাটে কালিমা এঁকে দিল। সেদিন স্পেন (খৃষ্টানদের হাতে গ্রানাডায়),সামারকান্দ,বোখারা,তাসখন্দ ও বাগদাদে (মোগলদের হাতে) আমরা তা লক্ষ্য করেছি আর আজ ইরাক,আফগানিস্তান ও ফিলিস্তিনে একই চিত্র দেখছি।

এ ঘটনাগুলোতে সেই হাদিসগুলোর কথাই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে যে,তোমরা দোয়া করবে কিন্তু তার কোন উত্তর পাবেনা,সাহায্যের আহবান জানাবে কিন্তু তা গৃহীত হবে না। কারণ যখন রোগ এক প্রকারের আর ঔষধ হল আরেক প্রকারের তখন সে ঔষধ  দিয়ে এ রোগ সারানো সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ কার্যকারণের নীতির বাইরে বিশ্বজগতকে পরিচালনা করেন না। তাই এ উম্মতের বর্তমান সমস্যার সমাধান তার প্রাথমিক যুগের সমাধানের মধ্যেই নিহিত রয়েছে।

বর্তমানে ইসলামী উম্মাহ তার সত্তা,বিশ্বাস ও ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নগ্ন ও কুৎসিত হামলার শিকার। তাদের শান্তিপূর্ণ মাজহাবী সহাবস্থান ও পরমতসহিষ্ণুতার মধ্যে ফাটল সৃষ্টির মাধ্যমে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়া হচ্ছে। ফলে তারা ঐক্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। এ সকল আক্রমণ দ্রুত তার পরিণতি ও মন্দ ফল বয়ে আনছে। এ মুহুর্তে তাদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত কি এটি হওয়া উচিত নয় যে,তারা সংঘবদ্ধভাবে পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবে ও তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে মজবুত ও দৃঢ় করবে। তাদের বুঝতে হবে তাদের মধ্যে মাজহাব ও ফিরকাগত মতপার্থক্য থাকলেও ধর্মীয় উৎসের দিক থেকে তারা এক কোরআন ও সুন্নাহর অনুসারী,তওহীদ,নবুওয়াত ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তারা সমবিশ্বাসী,নামাজ,রোজা,হজ,জাকাত,জিহাদ,হালাল,হারাম প্রভৃতি বিষয়ে এক শরীয়তের অনুবর্তী। মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসা এবং তাদের শত্রুদের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদের বিষয়ে একই মনোভাবের অধিকারী যদিও এ ক্ষেত্রে কারো মধ্যে আধিক্য ও কারো মধ্যে স্বল্পতা বিদ্যমান অর্থাৎ বন্ধনটি অপেক্ষাকৃত দুর্বলরূপে রয়েছে। একারণেই ইসলামী উম্মাহ এক হাতের অঙ্গুলীগুলির সাথে তুল্য যা পরিশেষে একক অস্থিতে সংযুক্ত হয়েছে যদিও তাদের মধ্যে দৈর্ঘ্য ও আকৃতিগত পার্থক্য রয়েছে। কিংবা কোন হাদিসে এ উম্মতকে একটি দেহের সাথে তুলনা করা হয়েছে যাতে একদিকে বিভিন্ন ধরনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে অন্যদিকে তাদের মধ্যে আকৃতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও শারীরতাত্তিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ও একক ভূমিকা রয়েছে যা তার অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য।

ইসলামী উম্মাহকে একবার একটি হাতের সঙ্গে আরেকবার এক দেহের সাথে তুলনা করার দর্শন সম্ভবত তাই অর্থাৎ বিষয়টি মনে হয় উপরোক্ত সত্যেরই ইঙ্গিত বহন করছে।

পূর্বে ইসলামের বিভিন্ন ফির্কা ও মাজহাবের আলেমগণ কোনরূপ দ্বন্দ-সংঘাত ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি বাস করতেন। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তারা পরস্পরকে সহযোগিতা করতেন। তাই দেখা গেছে একজন আরেকজনের ফিকাহ বা কালামশাস্ত্রের কোন গ্রন্থের ব্যাখ্যা গ্রন্থ লিখেছেন,একজন আরেকজনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন,একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং প্রশংসা করেছেন,একে অপরের মতকে সমর্থন করেছেন,একে অপরকে নিজের সংগৃহীত হাদিস বর্ণনা করার অনুমতি দিয়েছেন,কখনও কখনও এক মাজহাবের বা ফির্কার কেউ অপর মাজহাব বা ফির্কার কারো হতে হাদিস বর্ণনার অনুমতি চেয়েছেন,একজন আরেকজনের পিছনে নামাজ পড়েছেন,একে অপরের জামাআতে ইমামতি করেছেন,এক মাজহাবের অনুসারী অপর মাজহাবের অনুসারীকে জাকাত দিয়েছেন,একে অপরের মাজহাবকে স্বীকৃতি দিয়েছেন ও সত্যতাকে স্বীকার করেছেন। সেসময়ে সমাজের সকল পর্যায়ে বিভিন্ন ফির্কা ও মাজহাবের অনুসারীরা বন্ধুত্ব ও সৌহার্দপূর্ণ মনোভাব নিয়ে পাশাপাশি সহাবস্থান করেছে যেন তাদের মধ্যে কোন বিরোধ ও মতদ্বৈততা নেই। অথচ তারা যুক্তিপূর্ণভাবে একে অপরের মতকে খণ্ডন করতেন,সমালোচনা পর্যালোচনা করতেন। কিন্তু তারা তা করতেন সম্মানের সাথে এবং আদব ও শিষ্টাচার সহকারে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রেখে।

এরূপ বিস্তৃতত সহযোগিতার জীবন্ত ও ঐতিহাসিক অসংখ্য দৃষ্টান্ত সে সমাজে ছিল এবং প্রকৃতপক্ষে সেই পারস্পরিক সহযোগিতার ফলশ্রুতিতেই মুসলিম মনীষীরা ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির পত্তন করতে পেরেছিলেন। এর মাধ্যমেই তারা মাজহাবী স্বাধীনতার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং তাদের নিকট সম্মানের পাত্র হয়েছিলেন।

এটি এমন কোন কঠিন কাজ নয় যে,উম্মাহর বিশেষজ্ঞ আলেমগণ পারস্পরিক মতদ্বৈততার কোন বিষয়ে আলোচনায় বসবেন এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সততা ও নিষ্ঠার সাথে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করবেন। সেখানে একে অপরের মত ও যুক্তিকে শ্রবণ করবেন ও সে সম্পর্কে অবহিত হবেন।

এটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও উত্তম যে,প্রত্যেক মাজহাব ও দলই তার চিন্তা-বিশ্বাস এবং ফিকাহগত অবস্থানকে একটি মুক্ত ও স্বাধীন পরিবেশে সুস্পষ্টরূপে উপস্থাপনের সুযোগ পাবে। এর ফলে তাদের উপর আরোপিত অভিযোগের অসারতা সহজেই প্রমাণিত  হবে ও সন্দেহসমূহের অপনোদন ঘটবে। তদুপরি প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মতৈক্য ও মতভিন্নতার বিষয়সমূহ সম্পর্কে জানতে পারবে। ফলে মুসলমানরা অনুভব করতে পারবে যে বিষয়গুলি তদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে তার পরিমাণ তাদের মতভিন্নতার বিষয় হতে অনেক বেশী যা তাদের মধ্যকার সম্পর্কের বরফ গলাতে সাহায্য করবে।

এ প্রবন্ধটি এ লক্ষ্য অর্জনের পথে একটি পদক্ষেপ। সত্যের সঠিক রূপটি সকলের নিকট তুলে ধরাই এ লেখার উদ্দেশ্য। আল্লাহই তৌফিক দানকারী।

ইমামীয়া জাফরী মাজহাবের আকিদা বিশ্বাস

(১) জাফরী ফিকাহর অনুসারী ইমামীয়া সম্প্রদায় বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যকার একটি বড় মাজহাব। তাদের মোটামুটি সংখ্যা মুসলমানদের এক চতুর্থাংশ। এ মাজহাবের মূল ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রোথিত যেদিন সূরা আল বাইয়্যেনাহর নিম্নোক্ত আয়াতটি মহান আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ হয়।

 

ان الذِين آمنوا و عملوا الصالحاتِ اولئك هم خير البرية

অর্থাৎ যারা ঈমান আনে এবং সৎ কর্ম করে তারাই সৃষ্টির সেরা।

সেদিন আল্লাহর রাসুল (সা.) উপস্থিত সাহাবাদের সামনে হযরত আলীর (আ.) কাঁধে হাত রেখে বলেন :

يا علي انت و شيعتك هم خير البرية

“হে আলী! তুমি ও তোমার শিয়ারাই (অনুসারী) সৃষ্টির সেরা”

এ হাদিসটি তাবারীর তাফসির গ্রন্থ জামেউল বায়ানে,আল্লামা সুয়ূতীর তাফসির গ্রন্থ দুররুল মনসুরে,আলুসি বাগদাদীর তাফসির গ্রন্থ রুহুল মায়ানী তে উপরোক্ত আয়াতের আলোচনায় বর্ণিত হয়েছে।

এ সম্প্রদায় ইমাম জাফর সাদিকের (আ.) ফিকাহর অনুসরণের কারণে তার সাথে সম্পর্কিত এবং এ মাজহাবের অনুসারীরা শিয়া নামে পরিচিত।

(২) এ মাজহাবের অনুসারীরা ইরান,ইরাক,পকিস্তান,ভারত ও আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় রয়েছেন। পারস্য উপসাগরীয় দেশসমূহ (কুয়েত,বাহরাইন প্রভৃতি),তুরস্ক,সিরিয়া,লেবানন,রাশিয়া ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন হতে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশসমূহেও (আজারবাইজান,তুর্কমেনিস্তান প্রভৃতি) বিরাট সংখ্যক জাফরী ফিকাহর অনুসারী রয়েছেন। তাছাড়া ইউরোপের ইংল্যান্ড,ফ্রান্স,জার্মানী এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র,কানাডা,আফ্রিকা মহাদেশসহ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই শিয়া জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের অসংখ্য মসজিদ এবং সামাজিক,সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান এ সকল দেশে রয়েছে।

(৩) বিভিন্ন জাতি,বংশ,ভাষা ও বর্ণের মানুষ এ মাজহাবের অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য ফির্কা ও মাজহাবের মুসলমান ভাইদের সাথে তারা শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে পাশাপাশি অবস্থান করছে। সকল ক্ষেত্রেই তারা সততা ও নিষ্ঠার সাথে মহান আল্লাহর বাণী ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই’ ও ‘সৎকর্ম ও সংযমের ক্ষেত্রে তোমরা পরস্পরকে সহযোগিতা কর’ এবং মহানবীর বাণী  ‘মুসলমানগণ অমুসলিমদের বিপরীতে পরস্পর এক হাতের অঙ্গুলীগুলির ন্যায়’ ও ‘মুমিনগণ একটি দেহের ন্যায়’ প্রভৃতির অনুবর্তী হয়ে সবসময়ই অন্যদের (অন্য মাযহাব সমূহের অনুসারী মুসলমানদের) সহযোগিতা করেছে।

(৪) ইসলামী ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা ইসলাম ও মর্যাদাশীল মুসলিম উম্মাহর প্রতিরক্ষায় অগ্রগামী ও প্রজ্বলিত ভূমিকা রেখেছে। তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও প্রশাসনগুলো ইসলামী সভ্যতায় ব্যাপক ও যুগান্তকারী অবদান রেখেছে। তাদের মধ্যকার চিন্তাবিদ ও আলেমগণ তাফসির,হাদিসশাস্ত্র,কালামশাস্ত্র,উসুল ও ফিকাহশাস্ত্র,নীতিশাস্ত্র,রেজাল ও দেরায়া,দর্শন,উপদেশ-মূলক বাণী,রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান,ভাষা,সাহিত্য,অভিধান প্রভৃতি বিষয়ে শত সহস্র ছোট বড় গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে ইসলামের ঐতিহ্য,সভ্যতা ও জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। এমনকি তারা চিকিৎসা ও পদার্থবিজ্ঞান,রসায়ন ও গণিতশাস্ত্র,জ্যোতির্বিজ্ঞান,জীববিজ্ঞানসহ প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় স্মরণীয় অবদান রেখেছে। অধিকাংশ জ্ঞানের ক্ষেত্রেই তারা ছিল প্রতিষ্ঠাতা ও স্থপতির ভূমিকায়। (এ সম্পর্কে জানতে সাইয়েদ হাসান সাদর রচিত তাসিসুশ শিয়া লি উলুমিল ইসলাম গ্রন্থ এবং আগা বুজুর্গ তেহরানী রচিত ২৯ খণ্ডের গ্রন্থ আযযারিয়া ইলা তাসানিফিশ শিয়া দেখুন। এছাড়া আফেন্দী রচিত কাশফুয যুনুন,কাহহালা রচিত মোজামুল মুয়াল্লিফিন,সাইয়েদ মুহসেন আমিন আল আমেলী রচিত আইয়ানুশ শিয়া গ্রন্থসমূহ দেখতে পারেন।)

(৫) তারা সেই আল্লাহয় বিশ্বাসী যিনি একক,অদ্বিতীয়,অমুখাপেক্ষী,জন্মদাতা নন,জাতও নন (কেউ তাকে জন্মদান করেনি),তার সমতুল্য কেউ নেই,তিনি নিরাকার,দেহহীন,স্থান,দিক,কাল ও পাত্রের ঊর্ধ্বে,তাঁর কোন গতি,স্থিতি,পরিবর্তন,উত্তরণ,অবতরণ নেই। যে সব ধারণা মহান আল্লাহর মহিমা,পূর্ণতা,সৌন্দর্য ও পবিত্রতার পরিপন্থী সেগুলো তারা প্রত্যাখ্যান করে।

তারা বিশ্বাস করে তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই,নির্দেশ দান ও বিধিবিধান (শরীয়ত) প্রণয়নের অধিকারী একমাত্র তিনি,অন্য কেউ নয়। তারা বিশ্বাস করে সকল প্রকার শিরক হোক তা প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য,বড় বা ছোট তা মহা অন্যায় ও ক্ষমাহীন অপরাধ।

এ বিশ্বাসসমূহকে তারা বুদ্ধিবৃত্তি ও সুদৃঢ় চিন্তার মাধ্যমে লাভ করেছে যার ভিত্তি হল মহাগ্রন্থ আল কোরআন এবং নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত সহীহ হাদিসসমূহ সেগুলোর উৎসমূল যাই হোক না কেন। তারা ধর্মের মৌল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কখনই ইসরাইলী (তওরাত ও ইনজিলের বর্ণনা) বা মাজুসী (অগ্নি উপাসক) উৎসের উপর নির্ভর করেনি। কারণ ইহুদী,খৃষ্টান ও মাজুসীরা মহামহিম আল্লাহকে মানবের প্রতিকৃতিতে চিন্তা করে,তাঁকে সৃষ্টির সদৃশ ভাবে। কখনও বা তাঁকে অত্যাচারী,অন্যায়কারী,খেলোয়াড় ও উদ্দেশ্যহীন কর্তা মনে করে অথচ এসব বৈশিষ্ট্য হতে তিনি পবিত্র ও অনেক দূরে। মহাপবিত্র ও নিষ্পাপ নবীদের প্রতিও তারা (ইহুদী ও খৃষ্টানগণ) কবিরা গুনাহতে লিপ্ত হওয়ার অপবাদ আরোপ করে।

(৬) তারা বিশ্বাস করে মহান আল্লাহ ন্যায় বিচারক ও প্রজ্ঞাবান। তিনি ন্যায় ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে সৃষ্টি করেন। কোন কিছুই তিনি উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি করেন না,হোক তা পাথর,উদ্ভিদ,প্রাণী,মানুষ,পৃথিবী বা আকাশমণ্ডলী। কারণ উদ্দেশ্যহীন কর্ম প্রজ্ঞা ও ন্যায়ের পরিপন্থী। তদুপরি তা মহান আল্লাহর প্রভূ ও উপাস্য হিসেবে সকল ত্রুটিমুক্ত ও পূর্ণতার অধিকারী হওয়ার আবশ্যকতারও পরিপন্থী।

(৭) তারা বিশ্বাস করে তাঁর প্রজ্ঞা ও ন্যায়পরায়ণতার কারণে তিনি পৃথিবীতে মানুষের পদার্পণের সময় হতেই তাদের মধ্যে নবী ও রাসুল প্রেরণ করেছেন। এ প্রেরিত পুরুষদের বৈশিষ্ট্য হল তারা পবিত্র,নিষ্পাপ এবং আল্লাহর পক্ষ হতে ওহীর মাধ্যমে বিস্তৃতত ও বিশেষ জ্ঞানের অনুগ্রহপ্রাপ্ত। নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য হল মানবজাতিকে পথ প্রদর্শনের মাধ্যমে তাকে তার কাঙ্ক্ষিত পূর্ণতায় পৌঁছাতে সাহায্য করা অর্থাৎ তাকে সেই আনুগত্যের পথে পরিচালিত করা যা তাকে জান্নাত,মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বিশেষ অনুগ্রহ লাভের উপযুক্ত করবে। নবীদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হলেন হযরত আদম,নুহ,ইবরাহিম,ঈসা,মুসা এবং অন্যান্য নবীগণ যাদের নাম ও বর্ণনা পবিত্র কোরআন ও হাদিসসমূহে এসেছে।

(৮) তারা বিশ্বাস করে,যে আল্লাহর আনুগত্য করবে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশ ও বিধিবিধান পালন করবে সে মুক্তি পাবে ও সফলতা লাভ করবে অর্থাৎ প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হবে যদিও সে হাবশী দাস হয়। এক্ষেত্রে বর্ণ ও বংশের কোন ভেদ নেই। আর যদি কেউ তাঁর নির্দেশ অমান্য করে,তাঁর প্রণীত বিধিবিধানকে উপেক্ষা করে অন্য কোন বিধিবিধানকে গ্রহণ ও অনুসরণ করে তবে সে অপমান ও শাস্তির উপযুক্ত এবং ক্ষতিগ্রস্থ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে যদিও সে কোরাইশ বংশের কোন নেতা হয়। মহানবীর হাদিসে এরূপই বর্ণিত হয়েছে।

তারা বিশ্বাস করে মানুষের চূড়ান্ত পুরস্কার ও শাস্তিপ্রাপ্তির দিন হল কিয়ামত যেদিন হিসাব কিতাবের জন্য তুলাদণ্ড স্থাপিত হবে এবং জান্নাত ও জাহান্নামকে আনয়ন করা হবে। মানুষ মৃত্যুর পর কবর ও বারজাখের জীবন অতিবাহিত করার পর কিয়ামতে পুনরুত্থিত হবে। কিন্তু পুনর্জন্মবাদ যাতে পরকাল অস্বীকারকারীরা বিশ্বাস করে তারা তা বিশ্বাস করেনা। কারণ তা পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহকে অস্বীকার করার শামিল।

(৯) তারা বিশ্বাস করে নবীও রাসুলগণের সর্বশেষ ও এ ধারার পরিসমাপ্তকারী হলেন আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) যিনি তাঁদের সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠ এবং মহান আল্লাহ তাঁকে সকল গুনাহ ও ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত রেখেছেন। তাঁর গুনাহ ও ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকার বৈশিষ্ট্যটি যেমন নবুয়তের পূর্বেও ছিল তেমন নবুয়তের পরেও ছিল এবং দ্বীন প্রচার ও তাঁর ব্যক্তিগত ও সামাজিক সাধারণ কর্মকাণ্ডসমূহও এ বৈশিষ্ট্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হত। মহান আল্লাহ তাঁর উপর পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ করেছেন যা অনন্তকালের জন্য মানবতার দিশারী ও মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রেই নির্দেশনা দানকারী বিধান। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) তাঁর উপর অর্পিত রেসালতের বাণী যথাযথভাবে পৌঁছিয়েছেন এবং তাঁর উপর অর্পিত আমানত ও দায়িত্ব সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন ও এপথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। মহানবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) জীবন,ব্যক্তিত্ব,চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও তাঁর আনীত মুজিযার বিবরণসম্বলিত অসংখ্য গ্রন্থ শিয়ারা রচনা করেছে। তাঁর জীবনেতিহাস সম্পর্কে জানতে শেখ মুফিদের কিতাবুল ইরশাদ,আল্লামা তাবারসীর এলামুল ওয়ারা বিআলামিল হুদা,আল্লামা মাজলিসীর মাওসুয়াতু বিহারিল আনওয়ার এবং সাম্প্রতিক লেখক সাইয়েদ মুহসেন আল খাতামীর মাওসুয়াতুর রাসুল আল মুস্তাফা গ্রন্থসমূহ দেখুন।

(১০) তারা বিশ্বাস করে পবিত্র কোরআন যা জীব্রাইলের (আ.) মাধ্যমে মহানবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) উপর অবতীর্ণ হয়েছে তা তাঁর জীবদ্দশাতেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাহাবা যাদের শীর্ষস্থানীয় হলেন হযরত আলী (আ.) কর্তৃক লিখিত,সংকলিত ও সংরক্ষিত হয়েছিল। এ সংকলন ও সংরক্ষণ কর্মটি রাসুলের (সা.) সরাসরি নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে সম্পাদিত হয়েছিল। সাহাবাগণ যথার্থরূপে তা মুখস্থ ও অন্তস্থ করেছিলেন এবং এতটা নিখুঁতভাবে সংরক্ষণ করেছিলেন যে কোরআনের বর্ণ,শব্দ,বাক্য (আয়াত) ও সূরার সংখ্যা পর্যন্ত গণনা করে লিখে রেখেছিলেন। তারা মুতাওয়াতির (বহুলভাবে বর্ণিত) সূত্রে এ কোরআনকে কোন বিকৃতি ও পরিবর্তন ছাড়াই পরবর্তী প্রজন্মের নিকট বর্ণনা করেছেন এবং এভাবে তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বর্ণিত হয়ে আমাদের নিকট পৌঁছেছে। সেই অবিকৃত কোরআনই আজ ইসলামের অনুসারী সকল জাতি,গোত্র ও সম্প্রদায় সকাল-সন্ধ্যা পাঠ করে থাকে। কোরআন সংকলনের ইতিহাস ও কোরআনের অবিকৃত থাকার বিষয়ে শিয়া আলেম ও মনীষীদের রচিত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ কলেবরের অসংখ্য পুস্তিকা ও গ্রন্থ রয়েছে। যেমন- আমিদ যানজানি রচিত তারিখুল কোরআন,আয়াতুল্লাহ খুই রচিত আল বায়ান,মুহাম্মাদ হাদী মারেফাত রচিত আত তামহীদ ফি উলুমিল কোরআন প্রভৃতি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।.

(হুজ্জাতুল ইসলাম জাফর আল হাদী লিখিত, আবুল কাসেম অনূদীত “সত্য পরিচয়” গ্রন্থ থেকে সংকলিত )

চলবে…

 

তথ্যসূত্র :

১। সূরা আল বাইয়্যেনাহ ৭।

২। মুসনাদে আহমাদ,১ম খণ্ড,পৃ. ২১৫।

৩। সহীহ আল বুখারী,কিতাবুল আদাব,পৃ. ২৭।

৪। ইমামীয়া শিয়াগণ রাসুলের উপর দরুদ পড়ার সময় তাঁর নামের পাশাপাশি তাঁর পবিত্র বংশধরদের উপরও দরুদ পড়ে থাকে। এটি তারা মহানবীর (সা.) নির্দেশ মতই করে থাকে যা সিহাহ সিত্তাহসহ অন্যান্য হাদিসগ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে।