সূরা আন নিসা;(৩৯তম পর্ব)

সূরা আন নিসা; আয়াত ১৫৩-১৫৫

সূরা নিসার ১৫৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

يَسْأَلُكَ أَهْلُ الْكِتَابِ أَنْ تُنَزِّلَ عَلَيْهِمْ كِتَابًا مِنَ السَّمَاءِ فَقَدْ سَأَلُوا مُوسَى أَكْبَرَ مِنْ ذَلِكَ فَقَالُوا أَرِنَا اللَّهَ جَهْرَةً فَأَخَذَتْهُمُ الصَّاعِقَةُ بِظُلْمِهِمْ ثُمَّ اتَّخَذُوا الْعِجْلَ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ فَعَفَوْنَا عَنْ ذَلِكَ وَآَتَيْنَا مُوسَى سُلْطَانًا مُبِينًا ((১৫৩

"আপনার কাছে আহলে-কিতাবরা আবেদন জানায় যে, আপনি তাদের ওপর আসমান থেকে লিখিত কিতাব অবতীর্ণ করিয়ে নিয়ে আসুন। বস্তুতঃ এরা মূসার কাছে এর চেয়েও বড় জিনিস চেয়েছে। বলেছে, একেবারে সামনাসামনিভাবে আমাদের আল্লাহকে দেখিয়ে দাও। অতএব, তাদের ওপর বজ্রপাত হয়েছে তাদের পাপের দরুন; অতঃপর তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ-নিদর্শন প্রকাশিত হবার পরেও তারা গো-বৎসকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিল; তাও আমি ক্ষমা করে দিয়েছিলাম এবং আমি মূসাকে প্রকৃষ্ট প্রমাণ দান করেছিলাম।" (৪:১৫৩)

গত পর্বের আলোচনায় আমরা বলেছিলাম, অতীতের খোদায়ী ধর্মগুলোর বিভ্রান্ত অনুসারীরা নবীদের কাউকে মানে ও কাউকে অস্বীকার করে। এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য আল্লাহ কোরআনে তাদের ভর্ৎসনা করেছেন। এ আয়াতে ইসলামের নবী (সা.)কে মেনে নিতে মদীনার ইহুদিদের অস্বীকৃতির একটি অজুহাত তুলে ধরা হয়েছে। রাসূলের (সা.) কাছে তাদের অজুহাত বা দাবি ছিল, সমগ্র পবিত্র কোরআনকেও তাওরাতের মত আকাশ থেকে একবারে লিখিত আকারে নাজেল করতে হবে। অথচ আল্লাহর প্রত্যাদেশ বা ওহী কিভাবে নাজেল করতে হবে, সেটা একমাত্র আল্লাহরই ইচ্ছাধীন বিষয়।

তা ছাড়া ওহী একবারে বা পর্যায়ক্রমে নাজেল করার সাথে ওহীর সত্য বা মিথ্যা হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন, কোরআন সূরা আনআমের ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি যদি কোরআনকে স্পর্শযোগ্য কাগজের আকারে নাজেল করতাম তারপরও কাফেররা নানা অজুহাত দেখাত ও একে জাদু বলে অভিহিত করত।

এরপর আল্লাহ কোরআনে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)তে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন: ইহুদিদের এসব অজুহাতকামীতায় আপনি দুঃখিত হবেন না। কারণ, এদের পূর্বপুরুষরাও অদ্ভুত দাবি তুলে বলেছিল, ঈমান আনার আগেই আল্লাহকে আমরা সরাসরি খালি চোখে দেখতে চাই। ইহুদিদের ওই একগুঁয়েমি তথা আল্লাহকে খালি চোখে দেখার দাবি তোলার জন্য তাদের ওপর আল্লাহর আজাব নাজেল হয়েছিল। হযরত মূসা (আ.) তাদের কাছে নানা স্পষ্ট নিদর্শন তুলে ধরা সত্ত্বেও তারা বাছুর পূজা শুরু করেছিল এবং আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু তারা এরপর তওবা করায় আল্লাহ এত বড় অপরাধের পরও তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু'টি বার্তা হল,

প্রথমত: যারা সত্য-সন্ধানী তারা সত্যের পক্ষে স্পষ্ট দলিল-প্রমাণ দেখার পর সত্যকে মেনে নেন। এরপরও নতুন নতুন অজুহত ও বায়নার আশ্রয় নেন না।

দ্বিতীয়ত: সত্য ধর্ম অস্বীকার ও নবীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্য দুনিয়ার জীবনেই শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।

সূরা নিসার ১৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَرَفَعْنَا فَوْقَهُمُ الطُّورَ بِمِيثَاقِهِمْ وَقُلْنَا لَهُمُ ادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا وَقُلْنَا لَهُمْ لَا تَعْدُوا فِي السَّبْتِ وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا ((১৫৪

"আর তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নেয়ার উদ্দেশ্যে আমি তাদের ওপর তূর পর্বতকে তুলে ধরেছিলাম এবং তাদেরকে বলেছিলাম, অবনত মস্তকে তথা সিজদানত অবস্থায় দরজায় ঢোক। আর বলেছিলাম, শনিবার দিন সীমালংঘন করো না। এভাবে তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলাম।" (৪:১৫৪)

সূরা বাকারার ৬৩ ও ৯৩ নম্বর আয়াতও অনেকটা এই আয়াতের অনুরূপ। বনি ইসরাইল থেকে অঙ্গীকার নেয়ার জন্য আল্লাহর ইচ্ছায় তুর পর্বতকে ভূমি থেকে শুন্যে তুলে আনা হয় এবং ইহুদিদের মাথার ওপর পাহাড়টি ভাসমান অবস্থায় থাকে। এরপর হযরত মূসা (আ.) ইহুদিদের কাছে আল্লাহর বিধান তুলে ধরেন এবং তারা ওই বিধানগুলো মেনে চলার অঙ্গীকার করে।

এক আল্লাহর এবাদত করা, বাবা-মায়ের সাথে সহৃদয় আচরণ করা, বঞ্চিতদের সাহায্যে এগিয়ে আসা, নামাজ কায়েম করা ও জাকাত দেয়া ছিল আল্লাহর সাথে ইহুদিদের কৃত কিছু অঙ্গীকারের মধ্যে অন্যতম। ওই অঙ্গীকারের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে সূরা বাকারার ৪০ নম্বর আয়াত থেকে পরবর্তী আয়াতে এবং সূরা বাকারার ৮৩ নম্বর আয়াত থেকে পরবর্তী আয়াতে। এই আয়াতে আল্লাহর সাথে ইহুদিদের কৃত দু'টি অঙ্গীকারের কথা এসেছে: প্রথমটি হল তারা বায়তুল মোকাদ্দাস বা জেরুজালেম শহরে প্রবেশের সময় তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে বিনম্রচিত্তে ও সিজদাবনত অবস্থায় প্রবেশ করবে। দ্বিতীয়টি হল, শনিবারে আয়-উপার্জনের কাজ থেকে বিরত থাকবে এবং এরই অংশ হিসেবে শনিবারে মাছ শিকার করা তাদের জন্য হারাম বা অবৈধ করা হয়। কিন্তু তারা ওইসব খোদায়ী বিধান বা আল্লাহকে দেয়া প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে। অথচ আল্লাহ তাদের কাছ থেকে খুবই সুদৃঢ় অঙ্গীকার নিয়েছিলেন।

এ আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পারি তা হল:

এক. ধর্মকে কেবল বিবেক ও অন্তর দিয়ে মেনে চললেই তা যথেষ্ট নয়। আল্লাহকে দেয়া অঙ্গীকারগুলোও মেনে চলতে হবে।

দুই. পবিত্র স্থানগুলোর বিশেষ করে, মসজিদের পবিত্রতা রক্ষার জন্য নানা আদব-কায়দা মেনে চলা জরুরি।

সূরা নিসার ১৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَبِمَا نَقْضِهِمْ مِيثَاقَهُمْ وَكُفْرِهِمْ بِآَيَاتِ اللَّهِ وَقَتْلِهِمُ الْأَنْبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَقَوْلِهِمْ قُلُوبُنَا غُلْفٌ بَلْ طَبَعَ اللَّهُ عَلَيْهَا بِكُفْرِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُونَ إِلَّا قَلِيلًا ((১৫৫

"অতএব, তারা যে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিল, তা ছিল তাদেরই অঙ্গীকার ভঙ্গের জন্য এবং অন্যায়ভাবে রাসূলগণকে হত্যার কারণে এবং তাদের এই উক্তির জন্য যে, তারা বলেছিল, আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন। অবশ্য তা নয় বরং কুফরীর কারণে স্বয়ং আল্লাহ তাদের অন্তরের ওপর মোহর এঁটে দিয়েছেন। ফলে অতি অল্পসংখ্যক ছাড়া এদের বেশির ভাগই ঈমান আনে না।" (৪:১৫৫)

আগের আয়াতে ইহুদি জাতি বা বনি ইসরাইলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেয়ার জন্য তাদের মাথার ওপর তুর পাহাড় ঝুলিয়ে রাখার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন- এতসব স্পষ্ট খোদায়ী নিদর্শন দেখার পরও তারা আবারও আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা লঙ্ঘন করেছিল। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে তুলে ধরা মোজেজা বা অলৌকিক নিদর্শনগুলোকেও অস্বীকার করেছিল।

এমনকি ইহুদিরা আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা লঙ্ঘন ও খোদায়ী অলৌকিক নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করা ছাড়াও আল্লাহর অনেক নবী-রাসূলকেও হত্যা করেছিল। তারা এসব পাপের সাফাই দিতে গিয়ে বলেছিল: এসব কাজের জন্য আমাদের অন্তর আচ্ছন্ন হয়ে গেছে, তাই চাইলেও আমরা এসব কাজ ছাড়তে পারছি না। কিন্তু আল্লাহ বলছেন, কুফরি বা খোদায়ী নিদর্শন প্রত্যাখ্যানের কারণেই তোমাদের অন্তরগুলোয় মোহর পড়ে গেছে। তাই মুক্তি ও সৌভাগ্যের পথ তোমাদের জন্য খোলা হচ্ছে না।

এ আয়াত থেকে কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে:

এক. মানুষের মধ্যে আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকারের প্রবণতা কখনও কখনও এতটা তীব্র হতে পারে যে তারা তাদের মুক্তিদাতা নবী-রাসূলগণকেই হত্যা করে।

দুই. আল্লাহর শাস্তি আমাদের কাজ ও চিন্তারই ফল। এসব শাস্তি আমাদের কাজ ও ইচ্ছার স্বাধীনতার অপব্যবহারেরই ফসল।