সূরা আন নিসা;(৪০তম পর্ব)

সূরা আন নিসা; আয়াত ১৫৬-১৬১

সূরা নিসার ১৫৬ থেকে ১৫৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَبِكُفْرِهِمْ وَقَوْلِهِمْ عَلَى مَرْيَمَ بُهْتَانًا عَظِيمًا (১৫৬) وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللَّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَكِنْ شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِنْهُ مَا لَهُمْ بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلَّا اتِّبَاعَ الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا (১৫৭) بَلْ رَفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا ((১৫৮

"আর তাদের কুফরী এবং মরিয়মের প্রতি মহা অপবাদ আরোপ করার কারণে (তারা আল্লাহর ক্রোধ বা অভিশাপের পাত্র হয়েছিল)।" (৪:১৫৬)

"আর তাদের একথা বলার কারণে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি যিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না শুলীতে চড়িয়েছে, বরং তারা এরূপ ধাঁধার শিকার হয়ে (দেখতে ঈসার মত এক ব্যক্তিকে হত্যা করে) ছিল। বস্তুতঃ তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তাঁকে তারা হত্যা করেনি।" (৪:১৫৭)

"বরং তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ তা'আলা নিজের কাছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী,প্রজ্ঞাময়।" (৪:১৫৮)

গত পর্বের আলোচনায় আমরা বনি-ইসরাইল বা ইহুদি জাতির ওপর আল্লাহর ক্রোধ বা আজাব নাজেল হওয়ার কিছু কারণ তুলে ধরেছিলাম। এ সংক্রান্ত আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ দুই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, ইহুদিরা পবিত্র ও সতী-সাধ্বী নারী হযরত মরিয়ম (সা.)'র ওপর ব্যাভিচারের জঘন্য অপবাদ আরোপ করেছিল। তারা এ অপবাদ রটিয়ে হযরত ঈসা (আ.)কে মরিয়মের ব্যভিচারের ফসল হিসেবে তুলে ধরে এবং এর মাধ্যমে এটা দেখাতে চেয়েছে যে, ঈসা (আ.) নবী বা পথ-প্রদর্শক হওয়ার উপযুক্ত নন। আর এ অপবাদের ভিত্তিতেই ইহুদিরা ঈসা (আ.)কে রাসূল হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। তারা হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে এমন জঘন্য অপবাদ প্রচার করেই ক্ষান্ত হয়নি, এমনকি তাঁকে হত্যারও ষড়যন্ত্র করে। ইহুদি ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে হত্যা করতে পেরেছিল বলেও এক ধরনের ধাঁধা বা ভুল ধারণার শিকার হয়। আর ওই হত্যাকাণ্ডের ভিত্তিতে অত্যন্ত দম্ভ ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে তারা বলেছিল, আমরাই ঈসাকে হত্যা করেছি। কিন্তু মহান আল্লাহ কোরআনে বলছেন যে, আসলে তারা এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল যে ছিল দেখতে ঈসার মত এবং তারা ধোঁকা বা সন্দেহের শিকার হয়েই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।

এভাবে মহান আল্লাহ হযরত ঈসা (আ.)-কে উর্ধ্ব আকাশে তুলে নিয়ে হযরত ঈসা (আ.)-কে ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বার্তা হল,

প্রথমত: কখনও কখনও পবিত্রতম ব্যক্তিদেরকেও সবচেয়ে অশ্লীল বা অশালীন অপবাদ দেয়া হয়। মরিয়ম (সা.) ছিলেন ইহুদিদের মধ্যে পবিত্রতম চরিত্রের অধিকারী, অথচ ইহুদিরা তাঁকে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়েছিল, যা যে কোনো নারীর জন্য সবচেয়ে অসম্মানজনক ও অশালীন অপবাদ।

দ্বিতীয়ত: মানুষ কখনও কখনও এতটা অধঃপতনের শিকার হয় যে তারা আল্লাহর নবীকে হত্যা করতেও দ্বিধা বোধ করে না, এমনকি এ জাতীয় জঘন্য কাজের কথা গর্বভরে প্রচারও করে।

তৃতীয়ত: হযরত ঈসা (আ.)'র জন্ম ছিল যেমন অলৌকিক ঘটনা, তেমনি তার অন্তর্ধানও ছিল অলৌকিক, আসলে তিনি উর্ধ্বলোকে রয়েছেন।

সূরা নিসার ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلَّا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا ((১৫৯

"আর আহলে-কিতাবদের মধ্যে যত শ্রেণী রয়েছে তারা সবাই ঈমান আনবে ঈসার ওপর তাদের মৃত্যুর পূর্বে। আর ঈসা কেয়ামতের দিন তাদের জন্য সাক্ষী হবেন।" (৪:১৫৯)

ইসলামী রেওয়ায়েত ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশে উর্ধ্ব আকাশে চলে গেছেন। মানব-ইতিহাসের সর্বশেষ যুগে তিনি আকাশ থেকে পৃথিবীতে নেমে আসবেন এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ও মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা হযরত ইমাম মাহদী (আ.)'র পেছনে নামাজ পড়বেন। তিনি বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও জুলুম আর বৈষম্য মূলোৎপাটনের মহাসংগ্রামে ইমাম মাহদী (আ.)'র অনুসারী হবেন। এ সময় বিশ্বের সব খ্রিস্টান হযরত ঈসা (আ.)'র ওপর ঈমান আনবে। এ ঈমান হবে যথাযথ ও সঠিক, অর্থাৎ তারা তাঁকে আর আল্লাহর পুত্র বলে মনে করবে না। ইহুদিরাও হযরত ঈসা (আ.)'র নবুওয়্যাতের সত্যতাকে স্বীকৃতি দেবে।

এ আয়াত থেকে আমরা শিখতে পারি যে:

এক. মৃত্যু সব মানুষের জন্যই অনিবার্য। এমনকি নবী-রাসূলও এর ব্যতিক্রম নন। হযরত ঈসা (আ.)ও বহু শতাব্দী ধরে আকাশে বসবাসের পর পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং মৃত্যু বরণ করবেন।

দুই.নবী-রাসূলবৃন্দ নিজ নিজ উম্মতের কার্যকলাপের সাক্ষী হবেন এবং বিচার-দিবস বা কিয়ামতের দিন সাক্ষ্য তুলে ধরবেন।

সূরা নিসার ১৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَبِظُلْمٍ مِنَ الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ طَيِّبَاتٍ أُحِلَّتْ لَهُمْ وَبِصَدِّهِمْ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ كَثِيرًا ((১৬০

"বস্তুতঃ (নিজ ও অন্যদের প্রতি) ইহুদীদের জুলুম বা পাপের কারণে এবং আল্লাহর পথে বহু মানুষকে বাধা দানের দরুন তাদের জন্য আমি হারাম করে দিয়েছি বহু পূত-পবিত্র ও মনোহর বস্তু যা তাদের জন্য হালাল ছিল।" (৪:১৬০)

বর্তমান যুগে প্রচলিত ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থেও দেখা যায়, আল্লাহ পাপের শাস্তি হিসেবে কিছু হালাল খাদ্য ইহুদিদের জন্য হারাম করেছেন। অবশ্য হযরত ঈসা (আ.)'র আগমনের ফলে তাদের ওপর ওইসব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন আল্লাহ। এ থেকে বোঝা যায়- ব্যক্তি ও সমাজের তৎপরতার ধরন আল্লাহর নেয়ামতের সংখ্যা ও পরিমাণকে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিতে পারে। কোরআনের কোনো কোনো আয়াতে দেখা যায় সমাজের দরিদ্র ও এতিমদের প্রতি মানুষের অবহেলার শাস্তি হিসেবে তাদেরকে আল্লাহর অনেক নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করা হয়। অন্যদিকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সৎ কাজের কারণে মানুষের জন্য খোদায়ী রহমত, বরকত ও নেয়ামত বাড়িয়ে দেয়া হয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দু'টি বার্তা হল,

প্রথমত: আল্লাহ মানুষের পাপের শাস্তি হিসেবে কখনও কখনও তাদেরকে নানা নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করেন বা ওইসব নেয়ামত ভোগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ওইসব নেয়ামত বা জিনিসের মধ্যে ক্ষতিকারক কিছু থাকা কিংবা দূষিত কিছু থাকার কারণে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় না।

দ্বিতীয়ত: অন্যদের প্রতি জুলুম করা হলে আল্লাহ জুলুমকারীকেও অনুগ্রহ ও নেয়ামত হতে বঞ্চিত করেন।

সূরা নিসার ১৬১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَأَخْذِهِمُ الرِّبَا وَقَدْ نُهُوا عَنْهُ وَأَكْلِهِمْ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَأَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِينَ مِنْهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا ((১৬১

"আর এ কারণে যে, তারা সুদ গ্রহণ করত, অথচ এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল এবং এ কারণে যে, তারা অপরের সম্পদ ভোগ করতো অন্যায় ভাবে। বস্তুত: আমি কাফেরদের জন্য তৈরী করে রেখেছি বেদনাদায়ক আযাব।" (৪:১৬১)

আগের আয়াতের বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, ইহুদিদেরকে খোদায়ী শাস্তি দেয়ার আরেকটি কারণ হল, সুদ নিতে নিষেধ করা সত্ত্বেও তারা সুদ নিত ও মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করত। তাই আল্লাহও তাদের জন্য অনেক বৈধ জিনিষকে অবৈধ করে দেন। তবে তারা তাদের এসব পাপের আসল শাস্তি পাবে বিচার-দিবসে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হল:

এক. সুদ খাওয়া সব ঐশী ধর্মেই নিষিদ্ধ ছিল এবং সব খোদায়ী ধর্মই অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানবীয় অধিকার রক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে।

দুই. সুদ খাওয়া বাহ্যিক দিক থেকে লাভজনক মনে হলেও বাস্তবে বঞ্চনা ও খোদায়ী শাস্তির পথ সুগম করে।