সূরা আন নিসা;(৪৩তম পর্ব)

সূরা আন নিসা; আয়াত ১৭১-১৭৬

সূরা নিসার ১৭১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلَا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ فَآَمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلَا تَقُولُوا ثَلَاثَةٌ انْتَهُوا خَيْرًا لَكُمْ إِنَّمَا اللَّهُ إِلَهٌ وَاحِدٌ سُبْحَانَهُ أَنْ يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَكَفَى بِاللَّهِ وَكِيلًا ((১৭১

"হে আহলে কিতাব ! ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত সামান্যমাত্র অন্য কিছু বলো না। মারইয়ামের পুত্র ঈসা মাসিহ আল্লাহ্‌র রাসূল ব্যতীত আর কিছু নয়, এবং তাঁর বাণী যা তিনি প্রেরণ করেছেন মরিয়মের নিকট এবং রূহ-তাঁরই কাছ থেকে আগত। সুতরাং আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। আর একথা বলো না যে, আল্লাহ্ তিনের এক,একথা পরিহার কর;তোমাদের মঙ্গল হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ এক ও অদ্বিতীয়। সন্তান-সন্ততি হওয়াটা তাঁর যোগ্য বিষয় নয়। যা কিছু আসমান সমূহ ও যমীনে রয়েছে সবই তার। আর কর্মবিধানে আল্লাহ্ই যথেষ্ট।" (৪:১৭১)

খ্রিস্টানদের আবহমান একটি তত্ত্বে বিশ্বাস করা হয়। তারা 'তিন' তত্ত্বে বিশ্বাসী। এই 'তিন' তত্ত্ব হচ্ছে- পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা। আল্লাহ হলেন পিতৃখোদা,আর ঈসা হলেন পুত্র খোদা। আর জিব্রাইল হলেন এই দুই খোদার মাঝখানে সম্পর্ক সৃষ্টি বা যোগাযোগ সৃষ্টিকারী। এ বিষয়টি আমাদের মুসলমানদের দৃষ্টিতে শেরেকি হিসেবে গণ্য। কারণটা হলো হযরত মাসিহ হলেন আল্লাহর সৃষ্ট একজন বান্দা। কখনোই তাঁর মর্যাদা খোদার মর্যাদার পর্যায়ে যেতে পারে না। যদিও তাঁর সৃষ্টি বা জন্মের ব্যাপারটি অন্যান্য মানুষের মতো নয়,একটু আলাদা। ঈসা (আ) এর কোনো পিতা ছিলেন না। পিতাহীন অবস্থাতেই তাঁর মা অন্তসত্ত্বা হন এবং ঈসা (আ) কে জন্ম দেন।

এই পিতৃহীন সন্তান হবার কারণে যদি ঈসা (আ) খোদা হবার প্রমাণ বহন করে তাহলে হযরত আদম (আ) এর ব্যাপারটা কী হবে? তাঁর তো পিতাও ছিলো না, মাতাও ছিল না। একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাতেই তিনি পৃথিবীতে এসেছেন। তাঁর অবস্থানটা তো আল্লাহর আরো নিকটবর্তী। অথচ আল্লাহর তো স্ত্রীও নেই, কোনো সমকক্ষই নেই।

আসলে ঈসা (আ) আল্লাহর পুত্রও নন, পুত্র খোদাও নন, তিনি বরং আল্লাহর ক্ষমতার অন্যতম নিদর্শন।

এ আয়াত থেকে আমরা শিখবোঃ

১. ধর্মীয় নেতা বা ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে বাড়াবাড়ি কিংবা ধর্মীয় গোঁড়ামি মানুষকে সত্য পথ থেকে সরিয়ে দেয় এবং সাম্প্রদায়িক করে তোলে।

২. আল্লাহর কাছে নবী-রাসূলদের মর্যাদা এবং অবস্থান সত্ত্বেও তাঁরা মানুষই, কক্ষণো আল্লাহর সমকক্ষ নন বা সে পর্যায়ে পৌছবেন না।

 

সূরা নিসার ১৭২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَنْ يَسْتَنْكِفَ الْمَسِيحُ أَنْ يَكُونَ عَبْدًا لِلَّهِ وَلَا الْمَلَائِكَةُ الْمُقَرَّبُونَ وَمَنْ يَسْتَنْكِفْ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيَسْتَكْبِرْ فَسَيَحْشُرُهُمْ إِلَيْهِ جَمِيعًا ((১৭২

"মসীহ আল্লাহর বান্দা হবেন,তাতে তার কোন দ্বিধাবোধ নেই এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাদেরও না। বস্তূত: যারা আল্লাহর দাসত্বে লজ্জাবোধ করবে এবং অহংকার করবে,তিনি তাদের সবাইকে নিজের কাছে সমবেত করবেন।" (৪:১৭২)

 

খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্যে এ আয়াতে বলা হয়েছে, কেন তোমরা ঈসাকে আল্লাহর সমপর্যায়ে নিয়ে যাও। অথচ স্বয়ং ঈসা আল্লাহর ইবাদাত করার ব্যাপারে কোনোরকম দ্বিধাবোধধ করছে না। একইভাবে আল্লাহর ফেরেশতারাও খোদার দরবারে ঘনিষ্ঠতা এবং নিকট অবস্থান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর বান্দা হিসেবে তাদের কোনো দ্বিধা নেই। প্রকৃতপক্ষে কারো পক্ষে কি আদৌ সম্ভব আল্লাহর সম্মান, মর্যাদা এবং বিশালত্বের বরাবরে নিজেকে দাঁড় করায়? কিংবা তাঁর ইবাদাত বন্দেগি করার ব্যাপারে আপত্তি জানায়? ইতিহাসে এসেছে ইমাম রেযা (আ) তাঁর সমকালীন খ্রিস্টানদের নেতাকে বলেছেন, ঈসা (আ) এর সবই ভালো ছিল, শুধু তিনি ইবাদাত-বন্দেগি করতেন না। পাদ্রী এ কথা শুনে রেগে গেল। বললোঃ উনি সবার চেয়ে বেশি ইবাদাত করেছেন। ইমাম তখন পাদ্রীকে বললেনঃ উনি কার ইবাদাত করতেন? পাদ্রী এবার চুপ করে গেলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইমাম আসলে বোঝাতে চাচ্ছেনঃ আবেদ কখনো মাবুদ হতে পারে না।

এ আয়াতের প্রথম বার্তাটি হলোঃ ধর্মীয় বিষয়ে উগ্রতা ভালো না। যেখানে ঈসা (আ) স্বয়ং নিজেকে আল্লাহর বান্দা হিসেবে মনে করেন, সেখানে আমরা কেন তাঁকে আল্লাহর পুত্র বানাতে যাবো?

দ্বিতীয় বার্তাটি হলোঃ আল্লাহর বন্দেগি এবং ইবাদাত বর্জনের পেছনে রয়েছে অহংকার এবং শ্রেষ্ঠত্বকামী আত্মা। এই অহমবোধ মানুষকে সকল কল্যাণ ও আধ্যাত্মিক বরকত থেকে বঞ্চিত রাখে।

সূরা নিসার ১৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَأَمَّا الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَيُوَفِّيهِمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدُهُمْ مِنْ فَضْلِهِ وَأَمَّا الَّذِينَ اسْتَنْكَفُوا وَاسْتَكْبَرُوا فَيُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا وَلَا يَجِدُونَ لَهُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلِيًّا وَلَا نَصِيرًا ((১৭৩

"আর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তিনি তাদেরকে পরিপূর্ণ সওয়াব দান করবেন, বরং স্বীয় অনুগ্রহে আরো বেশী দেবেন। পক্ষান্তরে যারা লজ্জাবোধ করেছে এবং অহঙ্কার করেছে তিনি তাদেরকে দেবেন বেদনাদায়ক আযাব। আল্লাহকে ছাড়া তারা কোন সাহায্যকারী ও সমর্থক পাবে না।" (৪:১৭৩)

হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে যাদের বিশ্বাস অমূলক তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে,আহলে কিতাবের অনুসারীদের মাঝে যারা ঈমানদার এবং সৎ কর্মশীল, তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরোপুরিভাবে পুরস্কার লাভ করবে এবং মুক্তি পাবে। তবে যারা সত্য গ্রহণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করছে এবং আল্লাহর বরাবরে অহংকার দেখিয়েছে,কেয়ামতে তারা কঠোর আজাবের সম্মুখিন হবে। কেননা কিয়ামতের দিন শুধুমাত্র ঈমানদার এবং সৎকর্মশীলতাই কাজে আসবে। এর বাইরে অন্য কোনো দ্বীনের অনুসরণ কিংবা অপর কোনো নবী মুক্তির উপায় হবে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

১. আমলের আগে প্রয়োজন সঠিক ঈমান।কেননা;ঈমান ছাড়া আমল অচল টাকার মতোই মূল্যহীন।

২. ঈমান এবং আমল ছাড়া শাফায়াত লাভের আশা করা বৃথা।যদিও আল্লাহর নবীদের শাফায়াত করার অনুমতি রয়েছে।

সূরা নিসার ১৭৪ এবং ১৭৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمْ بُرْهَانٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكُمْ نُورًا مُبِينًا (১৭৪) فَأَمَّا الَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَاعْتَصَمُوا بِهِ فَسَيُدْخِلُهُمْ فِي رَحْمَةٍ مِنْهُ وَفَضْلٍ وَيَهْدِيهِمْ إِلَيْهِ صِرَاطًا مُسْتَقِيمًا ((১৭৫

"হে মানবকুল! তোমাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সনদ পৌঁছে গেছে। আর আমি তোমাদের প্রতি (কোরআনের মতো) প্রকৃষ্ট নূর অবতীর্ণ করেছি।"(৪:১৭৪)

"অতএব,যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং তাতে দৃঢ়তা অবলম্বন করেছে তিনি তাদেরকে স্বীয় রহমত ও অনুগ্রহের আওতায় স্থান দেবেন এবং নিজের দিকে আসার মত সরল পথে তুলে দেবেন।" (৪:১৭৫)

এই আয়াতে পুনরায় সকল মানুষকে বিশেষ করে আহলে কিতাবকে সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মাদ (সা) কে তোমাদের কাছে পাঠানোর মধ্য দিয়ে তাঁর হুজ্জাতকে পূর্ণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে তাঁর পবিত্র নূর অর্থাৎ আল-কোরআন দিয়ে পাঠিয়েছেন। ঐ কিতাব তোমাদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেয়। কোরআনের দিক-নির্দেশনা থেকে তারাই উপকৃত হয় যারা আল্লাহ আদেশ নিষেধগুলো মেনে চলে। আল্লাহর রহমত এবং বরকত তাদের ওপর বর্ষিত হয়। কোরআনের নির্দেশনায় এর প্রকৃত অনুসারীগণ এই পৃথিবীতে এবং পরবর্তী জগতেও আল্লাহর পথেই পরিচালিত হয়। এ আয়াতের শিক্ষা হলোঃ

প্রথমতঃ ইসলামের বার্তা বিশ্বজনীন এবং ইসলাম সকল মানুষ, সর্বযুগ এবং সকল প্রজন্মের কল্যাণের কথা বলে।

দ্বিতীয়তঃ ঐশী পুরস্কার হলো তাঁর দয়া এবং রহমতস্বরূপ, এই পুরস্কার আল্লাহর কাছে কারো প্রাপ্য অধিকার নয়। হেদায়েতটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা দয়া বৈ কি।

সূরা নিসার সর্বশেষ অর্থাৎ ১৭৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَسْتَفْتُونَكَ قُلِ اللَّهُ يُفْتِيكُمْ فِي الْكَلَالَةِ إِنِ امْرُؤٌ هَلَكَ لَيْسَ لَهُ وَلَدٌ وَلَهُ أُخْتٌ فَلَهَا نِصْفُ مَا تَرَكَ وَهُوَ يَرِثُهَا إِنْ لَمْ يَكُنْ لَهَا وَلَدٌ فَإِنْ كَانَتَا اثْنَتَيْنِ فَلَهُمَا الثُّلُثَانِ مِمَّا تَرَكَ وَإِنْ كَانُوا إِخْوَةً رِجَالًا وَنِسَاءً فَلِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الْأُنْثَيَيْنِ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ أَنْ تَضِلُّوا وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ ((১৭৬

"মানুষ আপনার নিকট (মীরাস সংক্রান্ত )ফতোয়া জানতে চায় অতএব, আপনি বলে দিন,আল্লাহ্ তোমাদিগকে কালালাহ (পিতাহীন বা পিতা-মাতাহীন ভাই-বোন) এর মীরাস সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নির্দেশ বাতলে দিচেছন,যদি কোন পুরুষ মারা যায় এবং তার কোন সন্তানাদি না থাকে এবং এক বোন থাকে,তবে সে পাবে তার পরিত্যাক্ত সম্পত্তির অর্ধেক অংশ এবং সে যদি নিঃসন্তান হয়,তবে তার ভাই তার উত্তরাধিকারী হবে। তা দুই বোন থাকলে তাদের জন্য পরিত্যক্ত সস্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ। পক্ষান্তরে যদি ভাই ও বোন উভয়ই থাকে,তবে একজন পুরুষের অংশ দু'জন নারীর সমান। তোমরা বিভ্রান্ত হবে আল্লাহ্ তোমাদিগকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছেন। আর আল্লাহ্ হচ্ছেন সর্ব বিষয়ে পরিজ্ঞাত।"(৪:১৭৬)

এই সূরাটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে নারীদের মীরাস সংক্রান্ত আরেকটি বিধান বর্ণনার মধ্য দিয়ে। সেটা হলো ভাইয়ের কাছ থেকে বোনের মিরাস বর্ণনার মধ্য দিয়ে। অবশ্য অপরাপর ভাই-বোন থাকার ওপর প্রাপ্য অংশের বিষয়টির তারতম্য রয়েছে। এই সূরারই ১১ নম্বর আয়াতে ওয়ারিশদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে মুমিনদের আদেশ দেয়া হয়েছে এবং এ ব্যাপারে যতোটা সম্ভব সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হলোঃ

এক. দ্বীন কেবল পরকালীন সৌভাগ্যেরই চাবিকাঠি নয় বরং পার্থিব জগতের জীবনের জন্যেও রয়েছে দ্বীনের সুস্পষ্ট বিধি-বিধান। মিরাস সংক্রান্ত বিষয়টি অর্থনৈতিক দিক থেকে যেমন, তেমনি পারিবারিক এবং ইসলামী বিষয়ের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।

দুই. নারীর তুলনায় পুরুষের মিরাসের পরিমাণ দ্বিগুণ রাখার বিষয়টি ঐশী প্রজ্ঞার ওপর স্থিত। ব্যাপারটা এমন নয় যে নবীজীর সময়কালে নারীদের দুর্বল মনে করা হতো বলে এমনটি করা হয়েছে। অতএব আমাদেরকে সর্বাবস্থায় আল্লাহর বিধান এবং আদেশের কাছে অবনত মস্তক থাকতে হবে।  ( সমাপ্ত)