সবর বা ধৈর্য

বান্দার প্রতি খোদার আমন্ত্রণ বা জিয়াফতের এই মাসে রহমত বরকত এবং মাগফেরাতের সদর দরজা উন্মোচিত করে দেয়া হয়, এ মাসে দোজখের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায় আর বেহেশতের সিংহ দ্বার খুলে রাখা হয়। আমাদের মত পাপী গুনাহগার বান্দাদের প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে কবুল করার সুযোগ সৃষ্টি করেন এই মাস। আমাদের আত্মাকে শক্তিশালী করার মহা উপলক্ষ তৈরি হয় এ মাসে। রিপুর উপর আত্মাকে জয়ী করার অনবদ্য সুযোগ সৃষ্টি করে এই মাস। রিপুর উপর আত্মাকে শক্তিশালী করতে হলে যে সব গুণ অর্জনের প্রয়োজন তার একটি হলো সবর বা ধৈর্য। আজ আমরা সবর বা ধৈর্য নিয়ে আলোচনা করব।

মহাগ্রন্থ কোরানের সূরা আল-আনফালের ৪৬ নম্বর আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন,

وَأَطِيعُوا اللَّـهَ وَرَ‌سُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِ‌يحُكُمْ وَاصْبِرُ‌وا إِنَّ اللَّـهَ مَعَ الصَّابِرِ‌ينَ

"আর আল্লাহ তা'আলার নির্দেশ মান্য কর এবং তাঁর রসূলের। তাছাড়া তোমরা পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হইও না। যদি তা কর, তাহলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের চিত্তের দৃঢ়তা বিলুপ্ত হবে। আর তোমরা ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা'আলা রয়েছেন ধৈর্যশীলদের সাথে।"

ইমাম জাফর সাদেক (আ) ধৈর্য্যকে স্পষ্ট ভাষায় মাথার সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, দেহের ক্ষেত্রে মাথার যে ভূমিকা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সবর বা ধৈর্যের ভূমিকা একই। মাথা না থাকলে দেহ পচে যায় একইভাবে সবর যখন বিদায় নেয় তার সাথে সাথে বিশ্বাসও বিলীন হয়ে যায়। অন্যদিকে হযরত আলী (আ) কে বিশ্বাস বা ইমান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাবে বলেছিলেন, ইমানের কাঠামো চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো হলো ধৈর্য বা সহিষ্ণুতা, অকাট্য বিশ্বাস বা ইয়াকিন, ন্যায় পরায়নতা বা আদল এবং সংগ্রাম বা জ্বিহাদ। এরপর তিনি আরো বলেন, ধৈর্যর চারটি উপাদান রয়েছে। এগুলো হলো, ব্যগ্রতা বা ঔৎসুক্য, ভয়, ধর্মভীরুতা এবং মৃত্যুর প্রত্যাশা। কাজেই যিনি বেহেশত বা স্বর্গ লাভের জন্য উদগ্রীব তিনি লোভকে সংবরণ করবে। যিনি দোজখ বা নরকের আগুনকে ভয় পান তিনি গুনাহ বা পাপ কর্ম থেকে বিরত থাকবেন। ধর্মভীরুতার অনুশীলন যিনি করবেন তিনি সহজেই এই পার্থিব জীবনের সকল দুঃখ-কষ্ঠ-বেদনাকে ধারণ করতে পারবেন। যিনি মৃত্যুর প্রত্যাশা করবেন তিনি ভাল কাজ দ্রুততার সাথে করবেন।

ইমাম জাফর সাদেক (আ) সবর বা ধৈর্যের ব্যাখা দিতে যেয়ে বলেছেন, যখন কোনো ইমানদার বান্দা তার উপর আপতিত যন্ত্রণা, দুঃখ বা কষ্টকে ধৈর্যের সাথে সহ্য করে তখন তাকে হাজার শহীদের সমতুল্য পুরস্কার দেয়া হবে।

ইমাম জাফর সাদেক (আ) আরো বলেছেন, যখন কোনো ইমানদার ব্যক্তি কবরে প্রবেশ করেন তখন নামাজ তার ডানে, জাকাত তার বামে, সৎ কর্ম তার মুখোমুখি অবস্থান নেয়। আর ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা তাকে নিজ আশ্রয়ে টেনে নেয়। যখন দুই ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কবরে প্রবেশ করে তখন নামাজ, যাকাত এবং সৎ কর্মকে উদ্দেশ্য করে ধৈর্য্য বলতে থাকে, তোমরা তোমার সাথীকে রক্ষা করো, যদি তোমরা এ কাজটি করতে না পারো তবে আমিই এ কাজটি করব।

সবর বা ধৈর্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে যেয়ে বিখ্যাত জ্ঞান সাধক নাসির উদ্দিন তুসি বলেছেন, ধৈর্যের মানে হলো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির মুখে আত্ম সংবরণ করা। অন্যদিকে বিখ্যাত আরেফ খাজা আবদুল্লাহ আল আনসারী বলেছেন, গোপন ক্লেশের ব্যাপারে অভিযোগ জানানো থেকে বিরত থাকার নামই হলো সবর। এছাড়া সবর বা ধৈর্যের প্রকার ভেদের কথা বলতে যেয়ে হযরত আলী (আ) বলেছেন, আল্লাহর নবী বলেছেন, ধৈর্য্য তিন প্রকারের। মানসিক ক্লেশ বা কষ্টের সময় ধৈর্য ধারণ, খোদার প্রতি আনুগত্যের সময় ধৈর্য ধারণ এবং আল্লাহর অবাধ্যদের প্রতি ধৈর্য ধারণ । প্রথম দুইটির চেয়ে তৃতীয়টি শ্রেষ্ঠ।

ধৈর্যে বা সবরের কথা বলতে গেলে খুব স্বাভাবিক ভাবে আমাদের মনে হবে ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ) এর কথা। তিনি কারবালার মর্ম বিদারী হত্যাকান্ড প্রত্যক্ষ করেছেন। দেখেছেন ইয়াজিদের বাহিনী কি ভাবে কারবালার ময়দানে তার পিতা ইমাম হাসান (আ) কে হত্যা করেছে, তার ভাই, বন্ধু এবং স্বজনদের হত্যা করা হয়েছে । আহলে বাইতের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এবং আহলে বাইতের অনুগতদের। শুধু তাই না ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ) কেও নির্মম আচরণ সহ্য করতে হয়েছে। ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ) কে কুফা থেকে দামেস্কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো শিকল পরিয়ে। সাতশ মাইলের এই মরু-পথ তাকে এভাবেই বন্দি অবস্থায় অতিক্রম করতে হয়েছিলো। কিন্তু তরুণ ইমাম যয়নুল আবেদীন এমন নির্মমতায় মোটেও মুষড়ে পড়েন নি।

তিনি ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক হয়ে ঐ পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছিলেন। উমাইয়া তথা ইয়াজিদ বাহিনী কারবালায় তাদের নৃশংসতার সকল চিহ্ন মুছে ফেলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তাদের সে প্রচেষ্টা নস্যাৎ হয়ে যায় ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ)র প্রচেষ্টায়। ইয়াজিদের রাজদরবারে যারা সমবেত হয়েছিলো তাদের কাছে তুলে ধরেন কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাবলী। মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর ইমাম একটি বছর কাটিয়েছেন নিঃসঙ্গতার মাধ্যমে। তিনি সেজদায় অধিকাংশ সময় কাটাতে বলে তার নাম হয়েছিলো, আস সাজ্জাদ বা সিজদাকারী। অন্যদিকে আল আবিদ শব্দের অর্থ হলো উপাসনা মনস্ক এবং যয়নুল আবেদিন মানে হলো যিনি এবাদত বা উপাসনার ক্ষেত্রে সকলকে অতিক্রম করে গেছেন। খোদার প্রতি তার দোয়া বা প্রর্থনাগুলো অনবদ্য হয়ে উঠেছে। সৎ পথের দিশারী তার এ সব দোয়া গ্রন্থিত হয়েছে, 'সহিফায়ে সাজ্জাদিয়া' নামে। তার অসাধারণ এসব দোয়ার মধ্যে একটি হলো,

হে প্রভু!তুমি আমাকে যে অপার বদ্যানতা দান করেছো তা ফিরিয়ে নিও না।

তুমি আমাকে যে অপার উদারতা দেখিয়েছো তা ফিরিয়ে নিও না।

তুমি আমাকে তোমার দয়া দিয়ে আবৃত করে দাও এবং তা ছিন্ন করো না।

তুমি আমার খারাপ কাজ সম্পর্কে অবহিত আছো তা ক্ষমা করে দাও।

হে আমার প্রভু তোমার দরবারে তুমি আমার পক্ষে থাক।

এবং আমি তোমার শাস্তি থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই

আমি তোমার দরবারে হাজির হয়েছি তোমার বদ্যানতা, তোমার দয়া কামনা করে,

আমাকে ক্ষমা করে দাও, যা শুধু তোমাকেই শোভা পায়

আমার কৃতকর্মের জন্য আমার প্রাপ্য শাস্তি আমাকে দিও না

হে ক্ষমাশীল আমাকে ক্ষমা করে দাও!

সবর বা ধৈর্য একটি অসাধারণ আত্মার শক্তি। আধ্যাত্মিক এই শক্তি একদিকে আমাদের পৃথিবীর পথ পরিক্রমাকে সহজ করে তোলে অন্যদিকে আখেরাতে আমাদের বিশ্বস্ত সংগী হয়ে আমাদেরকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে। রাতারাতি কারো পক্ষেই এই গুণ অর্জন করা সম্ভব নয়, এই গুণ অর্জনের জন্য আমাদের প্রত্যেকে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে। হযরত আলী (আ) বলেছেন, যিনি সবর করেন তিনি কখনোই সাফল্য লাভ করা থেকে বঞ্চিত হবেন না, তবে তার সাফল্য লাভ করতে হয়ত দেরি হতে পারে। আল্লাহ আমাদেরকে সবর করার ক্ষমতা দান করুন।