সূরা আল মায়েদা;(৩য় পর্ব)

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৪-৬

সূরা মায়েদার চতুর্থ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

يَسْأَلُونَكَ مَاذَا أُحِلَّ لَهُمْ قُلْ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ وَمَا عَلَّمْتُمْ مِنَ الْجَوَارِحِ مُكَلِّبِينَ تُعَلِّمُونَهُنَّ مِمَّا عَلَّمَكُمُ اللَّهُ فَكُلُوا مِمَّا أَمْسَكْنَ عَلَيْكُمْ وَاذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ

"হে নবী, তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে যে, কোন্ কোন্ বস্তু তাদের জন্যে হালাল? আপনি বলে দিন, তোমাদের জন্যে সব পবিত্র বস্তু বা খাদ্য হালাল করা হয়েছে (যা তোমাদের স্বাভাবিক প্রকৃতিও পছন্দ করে)। যেসব শিকারী জন্তুকে (কুকুরসহ বন্য পশু-পাখি) তোমরা প্রশিক্ষণ দান কর শিকারের কাছে পাঠানোর জন্যে এবং ওদেরকে ঐ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দাও, যা আল্লাহ তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। এমন শিকারী জন্তু যে শিকারকে তোমাদের জন্যে ধরে রাখে, তা খাও এবং তার ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। আল্লাহকে ভয় করতে থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।" (৫:৪)

আগের আয়াতে নিষিদ্ধ খাদ্যের তালিকা তুলে ধরার পর এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: এর আগে উল্লেখিত জন্তু বা প্রাণী ছাড়া সব পশুর গোশতই তোমাদের জন্য হালাল বা বৈধ যা তোমরা নিজেরা ধরে এনে জবাই কর কিংবা শিকারি কুকুর দিয়ে সেসব জন্তু শিকার কর। এসব শিকারি কুকুর শিকারকে তোমাদের কাছে ধরে আনার জন্য দাঁত দিয়ে কামড়ালেও তাতে কোনো অসুবিধা নেই।

মজার ব্যাপার হলো- এ আয়াতে আল্লাহ কুকুরসহ পশু-পাখিদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা তুলে ধরে বলছেন, এসব শিকারি পশু-পাখিদের তোমরা যে ধরনের প্রশিক্ষণ দাও, তা আসলে আল্লাহই তোমাদের শিখিয়েছেন, তোমরা আগে থেকেই বা নিজ থেকেই তা জানতে না। আল্লাহই ফেরারি কুকুরকে তোমাদের অনুগত করেছেন। ফলে এসব কুকুরকে যা করতে বলা হয় তারা তা-ই করে এবং এভাবে তারা তোমাদের সেবা করছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

এক. খাদ্যদ্রব্য বৈধ হওয়ার সাধারণ নিয়ম হলো, যা কিছু পবিত্র ও মানব-প্রকৃতির প্রিয় তাই বৈধ বা হালাল। অবৈধ বা হারাম হওয়ার লক্ষণগুলো স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত সব বস্তু ও খাবারই হালাল।

দুই. খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে খোদাভীতি থাকা উচিত ও হারাম খাদ্য বর্জন করা জরুরি। কারণ, আল্লাহ হারাম খাদ্য গ্রহণকারীকে খুব দ্রুত শাস্তি দিয়ে থাকেন।

সূরা মায়েদার ৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-

الْيَوْمَ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ وَطَعَامُ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حِلٌّ لَكُمْ وَطَعَامُكُمْ حِلٌّ لَهُمْ وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ الْمُؤْمِنَاتِ وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ إِذَا آَتَيْتُمُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ وَلَا مُتَّخِذِي أَخْدَانٍ وَمَنْ يَكْفُرْ بِالْإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

"আজ তোমাদের জন্য পবিত্র (ও হৃদয়গ্রাহী) বস্তুগুলো হালাল করা হলো। আহলে কিতাবদের খাদ্য তোমাদের জন্যে হালাল এবং একইভাবে তোমাদের খাদ্যও তাদের জন্য হালাল। তোমাদের জন্যে সতী-সাধ্বী মুসলমান নারী বিয়ে করা হালাল এবং তাদের সতী-সাধ্বী নারীকেও বিয়ে করা বৈধ যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তোমাদের আগে, যখন তোমরা তাদেরকে মোহরানা প্রদান কর তাদেরকে স্ত্রী করার জন্যে, প্রকাশ্য ব্যাভিচারের জন্যে কিংবা উপপত্নী গ্রহণের জন্যে নয়। যে ব্যক্তি বিশ্বাসের বিষয় অবিশ্বাস করে, তার শ্রম বিফলে যাবে এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।" (৫:৫)

এ আয়াতে ঐশী ধর্মগ্রন্থের অধিকারী বা আহলে-কিতাবদের সম্পর্কে দু'টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে: প্রথম বিষয়টি আহলে কিতাবদের খাদ্য সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয় বিষয়টি তাদের নারীকে বিয়ে করার বৈধতা সম্পর্কিত। আগের আয়াতে জীব-জন্তুর গোশত সম্পর্কিত যে বিধান দেয়া হয়েছে তার আলোকে আহলে কিতাবদের গোশত জাতীয় খাদ্য মুসলমানদের জন্য বৈধ নয়, তবে তাদের অন্যান্য খাবার গ্রহণ জায়েজ বা বৈধ।

বিয়ের ব্যাপারেও লক্ষণীয় বিষয় হলো, আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে কেবল সতী মেয়েদের বিয়ে করাকে মুসলিম পুরুষদের জন্য বৈধ বলা হয়েছে। কিন্তু আহলে কিতাবের পুরুষদের কাছে মুসলিম মেয়ে বিয়ে দেয়া বৈধ নয়। এর কারণ সম্ভবতঃ এটা যে নারীর মন কোমল হওয়ার কারণে তারা সাধারণতঃ স্বামীর অনুসৃত ধর্মেরই অনুসারী হয়। এক্ষেত্রেও এমন সম্ভাবনাই বেশি যে, আহলে কিতাবদের নারীও মুসলিম স্বামীর প্রভাবে ইসলামকে জানার সুযোগ পাবে এবং এই ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পেরে তারাও এ ধর্ম গ্রহণ করবে।

এ আয়াত মুসলিম পুরুষদেরকে বিয়ে করার জন্য উৎসাহ দিয়ে বলছে: তোমার পছন্দের নারী যদি কোনো খ্রিস্টান যুবতীও হয়ে থাকে তবে তার সঙ্গে অবৈধ বন্ধুত্ব বা প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক গড়ার পরিবর্তে তাকে বরং বিয়ে কর, কারণ, আল্লাহ এ পথকেই পছন্দ করেন। তাকে পাওয়ার জন্য ঈমান বিসর্জন দেয়ার বা কাফের হওয়ার প্রয়োজন নেই।

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট:

এক. নারীর সতীত্ব যে কোনো ধর্মেই একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ, ঠিক যেমনিভাবে পুরুষের জন্যও চরিত্রকে পবিত্র রাখা এবং ব্যাভিচার বা জেনা থেকে দূরে থাকা জরুরি।

দুই. কোরআনের দৃষ্টিতে স্বামী বা স্ত্রী বাছাই করার জন্য ঈমান ও পবিত্র চরিত্র-এ দু'টি বিষয়ই অপরিহার্য মানদণ্ড।

সূরা মায়েদার ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ وَإِنْ كُنْتُمْ جُنُبًا فَاطَّهَّرُوا وَإِنْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَوْ عَلَى سَفَرٍ أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِنْكُمْ مِنَ الْغَائِطِ أَوْ لَامَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا فَامْسَحُوا بِوُجُوهِكُمْ وَأَيْدِيكُمْ مِنْهُ مَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ حَرَجٍ وَلَكِنْ يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمْ وَلِيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

"হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাযের জন্যে উঠ, তখন নিজ মুখমণ্ডল ও হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধৌত কর এবং মাথার কিছু অংশ ও দুই পায়ের পাতার ওপর আঙুল থেকে গিট বরাবর সামনের অংশ পর্যন্ত (তথা পায়ের আঙুলের অগ্রভাগ থেকে হাঁটুর দিকে প্রলম্বিত পায়ের গোড়া পর্যন্ত) মাসেহ কর। যদি তোমরা অপবিত্র হও তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও এবং যদি তোমরা রুগ্ন হও, অথবা প্রবাসে থাক অথবা তোমাদের কেউ প্রসাব-পায়খানা সেরে আসে অথবা তোমরা স্ত্রীদের সাথে সহবাস কর, অতঃপর যদি (ওজু বা গোসলের) পানি না পাও, তবে তোমরা পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করে নাও-অর্থাৎ, নিজ মুখ-মন্ডল ও হাত দু'টি মাটি দিয়ে মাসেহ কর। (হে মুমিনগণ!) আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না; বরং তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি নিজ নেয়ামত পূর্ণ করতে চান-যাতে তোমরা কৃতজ্ঞাতা প্রকাশ কর।" (৫:৬)

আগের আয়াতে হালাল ও হারাম খাদ্য সম্পর্কিত বর্ণনার পর এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: যে আল্লাহ তোমাদের এত নেয়ামত দিয়েছেন এবং তোমাদের জৈবিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ দিয়েছেন তাঁর প্রতি তোমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া ও নামাজ আদায় করা উচিত। তবে নামাজ তথা আল্লাহর দিদার বা তাঁর দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য শর্ত হলো, শরীর ও মনকে পবিত্র করতে হবে। অর্থাৎ অজু করতে হবে এবং যৌন কারণে শরীর অপবিত্র হলে গোসল করতে হবে। এক্ষেত্রে সফরে থাকলে বা পানি ব্যবহারে শরীরের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে বা যথেষ্ট পানি পাওয়া না গেলে তায়াম্মুম বা মাটির মাধ্যমে হাত-পা মাসেহ করতে হবে এবং বিনম্রতা নিয়ে ও নিজেকে তুচ্ছভাবে তুলে ধরে নামাজ আদায় করতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার আমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আমাদের এ দেহ মৃত্যুর পর আবারও মাটিতে পরিণত হবে।

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট:

এক. শারীরিক ও মানসিক অপবিত্রতা আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্তরায়। পবিত্রতা আল্লাহর দাসত্বের শর্ত।

দুই. ইসলাম ধর্মে অচলাবস্থার কোনো অবকাশ নেই। ইসলামের বিধানে নমনীয়তার সুযোগ রয়েছে, কিন্তু নামাজের মত অবশ্য পালনীয় বিধানকে পুরোপুরি উপেক্ষার সুযোগ নেই।

তিন. ইসলামের বিধান প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ওজু, গোসল ও তায়াম্মুম, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের প্রাক্কালে নামাজের সময় হওয়া, সূর্যের ও নক্ষত্রের মাধ্যমে কেবলা নির্ধারণ এসবই প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত।