সূরা আল মায়েদা;(৪র্থ পর্ব)

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৭-১১

সূরা মায়েদার ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَمِيثَاقَهُ الَّذِي وَاثَقَكُمْ بِهِ إِذْ قُلْتُمْ سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ

"স্মরণ কর তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ এবং যে অঙ্গীকারে তিনি তোমাদের আবদ্ধ করেছিলেন এবং যখন তোমরা বলেছিলে আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।" (৫:৭)

আল্লাহপাক আগের আয়াতে খাবার সংক্রান্ত বিভিন্ন হুকুম-আহকাম, পারিবারিক অনেক বিষয়-আশয় এবং নামাজসহ বিভিন্ন ইবাদতের হুকুম বর্ণনা করার পর এই আয়াতে বলেছেন, মুমিনদের ওপর ঐশী এই হেদায়েত হলো আল্লাহর সবচেয়ে বড় নেয়ামত। তাই এর মর্যাদা উপলব্ধি কর এবং সবসময় এই নেয়ামতের কথা স্মরণ রেখ।

এই সূরার ৩ নম্বর আয়াতে ফিলাফাতে হযরত আলীর মনোনয়নের ঘটনার মধ্য দিয়ে দ্বীনের পূর্ণতা ঘটেছে এবং আল্লাহর নেয়ামত সম্পন্ন হয়েছে। এ আয়াতেও মুমিনদেরকেও ঐশী নেতৃত্বের বিশাল নেয়ামতের প্রশংসার দিকে আহবান জানানো হয়েছে এবং পাশাপাশি তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে যে, তোমরা গাদিরে খুমে আলী ইবনে আবি তালিবের বেলায়াত সম্পর্কে নবীজির বক্তব্য শুনেছো এবং তা মেনে নিয়েছে। ঐশী এ চুক্তির ব্যাপারে সতর্ক এবং বিশ্বস্ত থেক এবং তা লংঘন কর না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. ঐশী নেতৃত্ব এবং ইসলামের নেয়ামত বস্তুজগতিক সকল নেয়ামতের উর্ধ্বে। তাই সবসময় এ ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে।

দুই. আল্লাহতায়ালা বুদ্ধি, স্বভাব, ভাষা এবং বক্তব্যের মাধ্যমে সকল মুসলমানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছেন যে, তাঁর দেয়া আদেশ নিষেধগুলো বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবে। তাই এ ক্ষেত্রে কোন ধরনের অবহেলা করা চুক্তি ভঙ্গের শামিল।

এ সূরার ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآَنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ

"হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্য দানে তোমরা অবিচল থাকবে। অন্যের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের পাপের দিকে ঘুরিয়ে না ফেলে এবং ন্যায় বিচার বর্জনে প্ররোচিত করে। ন্যায় বিচার পূর্বে এটা ধর্মানুরাগের নিকটতম এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে পুরোপুরি অবগত।" (৫:৮)

মোটামুটি একই রকমের বক্তব্য আমরা দেখেছি সূরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতে। ওই আয়াতে অবশ্য আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন যে, ন্যায়ের ভিত্তিতে সাক্ষ্য দাও যদিও তা তোমার কিংবা তোমার নিকটজনের ক্ষতির কারণ হয়। আর এই আয়াতে বলা হয়েছে, এমনকি তোমার শক্রদের সঙ্গেও ন্যায়সঙ্গত আচরণ করো। সত্য এবং ন্যয়ের পথ থেকে কখনও সরবে না। সামাজিক কর্মকাণ্ডে তা শত্রুদের সাথেই হোক কিংবা বন্ধুদের সাথেই হোক আল্লাহকে সদা স্মরণ রেখ। জেনে রেখ- আল্লাহ তোমাদের সকল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানেন এবং ন্যায়ের মানদণ্ডেই শাস্তি কিংবা পুরস্কার দেন।

এ আয়াত থেকে আমরা শিখবো :

এক. সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা কেবল আল্লাহর ওপর ঈমান এবং তার আদেশ নিষেধগুলো পালন করার মাধ্যমেই সম্ভব।

দুই. ন্যায়বিচার কেবলমাত্র একটা নৈতিক মূল্যবোধই নয় বরং শক্র মিত্রের সাথে সমাজে পারিবারিক জীবনের সকল ক্ষেত্রের জন্যেই একটা ঐশী আদেশ।

তিন. তাকওয়ার জন্য গোত্রীয় এবং বর্ণগত গোঁড়ামী থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন। কেননা এগুলো হিংসা বিদ্বেষ এবং আকীদার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

এই সূরার ৯ ও ১০ আয়াতে বলা হয়েছে-

"যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদের ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। (৫:৯)

যারা ঈমানকে প্রত্যাখ্যান করে এবং আমার আয়াতকে অস্বীকার করে তারা দোজখের আগুনের অধিবাসী।'' (৫:১০)

এই দুই আয়াতের মতো আরো কয়েকটি আয়াত রয়েছে পবিত্র কোরআনে। এসব আয়াতে এ বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর দেয়া শাস্তি কিংবা পুরস্কারের ভিত্তি হলো-কুফরী এবং ঈমান, ভালো এবং মন্দ কাজ। কোনো গোত্র কিংবা দলের প্রতি আল্লাহর কোনো স্বজনপ্রীতি নেই যে আল্লাহ তাদেরকে বেহেশতে নিয়ে যাবেন আর তার শক্রদেরকে দোজখে পাঠাবেন।

আগের আয়াতে বহুবার ন্যায় এবং তাকওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এই আয়াতগুলোতেও বলা হয়েছে, যদি এই দু'টি বিষয় মেনে চলো তাহলে তোমরা প্রকৃত মুমিন এবং বেহেশতে প্রবেশ করবে তা না হলে তোমরাও কাফেরদের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং দোযখে যাবে।

এ দু'টি আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

এক. বেহেশত এবং দোযখ মুমিন এবং কাফেরদের জন্যে দেয়া আল্লাহর প্রতিশ্রুতি। আর আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অলংঘনীয়।

দুই. ভাল কাজও অতীতের পাপ থেকে মুক্তির কারণ হতে পারে এবং হতে পারে ঐশী পুরস্কার লাভের উপায়।

সূরা মায়েদার ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ هَمَّ قَوْمٌ أَنْ يَبْسُطُوا إِلَيْكُمْ أَيْدِيَهُمْ فَكَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ

''হে মুমিনগণ তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর যখন শক্রদের একটি সম্প্রদায় তোমাদের বিরুদ্ধে হস্ত উত্তোলন করার পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু আল্লাহ তাদের হাত তোমাদের থেকে নিবৃত করেছিলেন। সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ- মুমিনদের উচিত একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা বা নির্ভর করা।'' (৫:১১)

ইসলামের ইতিহাসে ইসলামের নাম নিশানা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার জন্যে বহু ঘটনা দুর্ঘটনা, যুদ্ধ-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আল্লাহ তাঁর রহমত ও দয়ার মাধ্যমে মুসলমানদের রক্ষা করেছেন আর শক্রদের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দিয়েছেন। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, হে মুমিনগণ! আল্লাহর সেই দয়া ও রহমতের কথা স্মরণ রেখ আর জেনে রেখ আল্লাহর এই অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা জানাবার উপায় হলো তাকওয়া এবং পরহেজগারী। শুকরিয়া আদায়ের ফলে অদৃশ্য সেই সাহায্য অব্যাহত থাকবে। মুমিনদের জেনে রাখা উচিত মানবীয় শক্তির ওপর নির্ভরতা আর তাকে ভয় করা কিংবা তাদের প্রতিশ্রুতির ধোঁকার পরিবর্তে কেবলমাত্র খোদায়ী শক্তির ওপর ভরসা করা। তাহলে হতে পারে আল্লাহ সকল মানবীয় শক্তির মোকাবেলায় মুমিনদেরকে সাহায্য করবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. আল্লাহর নেয়ামত এবং দয়ার কথা স্মরণ করলে মানুষের ভেতর থেকে গর্ব অহংকারগুলো দূর হয়ে যায় আর আল্লাহর প্রতি মানুষের ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।

দুই. শত্রুদেরকে প্রতিহত করা আর মুসলমানদের রক্ষা করা ঐশী নেয়ামতগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই কথায় এবং কাজের মাধ্যমে তাঁর শুকরিয়া আদায় করা উচিত।