সূরা আল মায়েদা;(৬ষ্ঠ পর্ব)

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ১৫-১৭

সূরা মায়েদার ১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِمَّا كُنْتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ

''হে কেতাবীগণ আমার রাসূল তোমাদের নিকট এসেছে। কিতাবের যা তোমরা গোপন করতে সে তাঁর অনেক অংশ তোমাদের নিকট প্রকাশ করে। এবং অনেক যা এখন অপ্রয়োজনীয় তা উপেক্ষা করে। আল্লাহর নিকট থেকে তোমাদের নিকট এসেছে এক নতুন আলো এবং এক প্রাঞ্জল কিতাব।'' (৫:১৫)

আগের পর্বে আমরা জেনেছি যে, ইহুদী এবং নাসারা ধর্মগুরুদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে- কেন পবিত্র কিতাবের আয়াতগুলোকে বিক্রিত করে সত্য গোপন করছো? তোমরা কি আল্লাহর প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেছ? আজকের এ আয়াতে তাদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, তোমরাতো নিজেরাই আহলে কিতাব এবং আল্লাহর আয়াতগুলোর সঙ্গে পরিচিত। অতএব আল্লাহর রাসূল তথা ইসলামের নবীর ওপর ঈমান আনো। তাঁর অস্তিত্ব নূরের মতো আর তাঁর কিতাব সেই সত্যের প্রকাশক যে সত্য সম্পর্কে আগেকার ঐশী ধর্মগুলোর বক্তব্য থেকে তোমরা দূরে সরে গেছ। সেগুলো আর প্রকাশ করতে রাজি নও।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. ইসলাম একটা বিশ্বজনীন এবং চিরন্তন ধর্ম। ইসলাম তাই আগেকার সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে চিরন্তন ঐশীগ্রন্থ আল কোরআনের দিকে আহবান জানায়।

দুই. ঐশী শিক্ষা হলো নূর। আর বিশ্ব ওই নূর ছাড়া অন্ধকার।

এ সূরার ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلَامِ وَيُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

''যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায় এর সাহায্যে তিনি তাদের শান্তি ও নিরাপত্তার পথে পরিচালিত করেন এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখান এবং তাদের সরল পথ প্রদর্শন করেন।'' (৫:১৬)

আগের আয়াতে কোরআন নিজেকে আলোময় গ্রন্থ বলে পরিচয় দেয়ার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, হেদায়াত লাভ করার কিছু শর্তাবলী রয়েছে। শর্তগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো-সত্যান্বেষণ এবং সত্যকামিতা। তারাই কোরআনের হেদায়াত লাভ করে যারা ধন-সম্পদ, পদবী কিংবা কামনা -বাসনা চরিতার্থ করার পেছনে ছোটে না। বরং কেবলমাত্র সত্যের পেছনে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির পেছনে ছোটে। এই শর্ত যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে আল্লাহ ওই ব্যক্তিকে গোমরাহি এবং পাপের অন্ধকার থেকে সরিয়ে ঈমান এবং সত আমলের নূরানি পরিবেশের দিকে পরিচালিত করেন। আর এটা খুবই স্বাভাবিক যে এই হেদায়াত নিরাপত্তা, মানুষের চিন্তা ও আত্মার সুস্থতা, তাদের পরিবারকে সকল প্রকার বিপদ থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। কেয়ামতেও মানুষকে ঐশী নিরাপত্তাময় বেহেশতের দিকে পরিচালিত করে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে :

এক. সুস্থতা এবং নিরাপত্তা প্রাপ্তির শর্ত হলো আল্লাহর পথে বিজয়ী হওয়া। আর কোরআন হলো সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায়।

দুই. মানুষ কেবল ঐশী দিনের ছায়ায় শান্তিপূর্ণ ও আন্তরিকভাবে সহাবস্থান করতে পারে।

তিন. যেসব কাজ মানুষকে আল্লাহর পথে নিয়ে যায় সেগুলো একটু আলাদা। যেমন- নেক আমল সবার জন্যে এবং সর্বত্রই ভিন্ন রকমের। কিন্তু যদি লক্ষ্য থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা তাহলে সেইসব নেক আমল একমুখি হয়ে যায়। তাহলো সিরাতুল মুস্তাকীম বা সরল পথ।

সূরা মায়েদার ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ قُلْ فَمَنْ يَمْلِكُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ أَنْ يُهْلِكَ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا يخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

''যারা বলে মারিয়ম পুত্র মাসিহ আল্লাহ। তারা অবশ্যই কুফরি করেছে। বল, মারিয়ম পুত্র মাসিহ তার মাতা এবং দুনিয়ার সকলকে ধ্বংস করার ইচ্ছা যদি আল্লাহ করেন তবে তাঁকে বাধা দেবার ন্যূনতম শক্তি কার আছে? আকাশ এবং পৃথিবীতে এবং এর মাঝে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই অধিকারভুক্ত। তিনি যা ইচ্ছা করেন তা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।'' (৫:১৭)

আগের আয়াতে আহলে কিতাবের সবাইকে ইসলামে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে বলা হচ্ছে,খ্রিস্টানরা কেন ঈসা (আ.) কে খোদা বলে মনে করে এবং তাঁকে এক আল্লাহর শরীক ভাবে? ঈসা (আ.) কি মরিয়ম নামের তাঁর মায়ের সন্তান নন, তাহলে কিভাবে তিনি খোদা হতে পারেন? তাঁর মাতাও কি অন্যান্য মানব সন্তানের মতোই ভূমিষ্ট হননি? তাকেও কি করে খোদাদের একজন বলে মনে করা যেতে পারে? আল্লাহ যদি চান তাহলে হযরত মারিয়াম এবং ঈসা (আ.) কে মৃত্যু দিতে পারেন না। তাহলে মরণশীল সত্ত্বা কিভাবে খোদা হতে পারে। আসলে এ ধরনের বিশ্বাস নিয়ে পর্যালোচনা করা হলে দেখা যাবে এটা এক ধরনের কুফরী। কেননা একজন মানুষকে আল্লাহর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো খোদার মর্যাদাকে একজন মানুষের পর্যায়ে নামিয়ে আনা। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, আল্লাহর গুণাবলীর অন্যতম হলো জ্ঞান, শক্তি এবং হুকুমাতের ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া। হযরত মাসীহ এবং তাঁর মা এসব গুণাবলী থেকে বঞ্চিত ছিলেন। একমাত্র খোদাই হলেন আল্লাহ। তিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা এবং সর্বশক্তিমান। বিশ্বজগতের শাসক হওয়ার একমাত্র উপযুক্ত তিনি।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. ইসলামের একটা কর্মসূচী হলো পূর্ববর্তী দ্বীনগুলোর বিচ্যুত ও বিকৃত সব আকীদা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং সর্বপ্রকার বেদায়াত থেকে সেগুলোকে পবিত্র রাখা।

দুই. আল্লাহর নবীদের মর্যাদা যত উঁচুই হোক না কেন, তারা কিন্তু মানুষই। মানবীয় বৈশিষ্ট্যের বাইরে নন তাঁরা। নবীদের ব্যাপারে অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি করা দ্বীনের তৌহিদি সত্ত্বার সঙ্গে মানানসই নয়।

তিন. মাসিহ যদি খোদাই হবেন তাহলে বিরোধী পক্ষ তাকে কি করে শূলে চড়িয়ে মারলেন? খোদাকে কি তার সৃষ্টি কোনোভাবে মারার ক্ষমতা রাখে?