অন্যায়-অবিচার, ঐশীরীতি ও মানব প্রকৃতির পরিপন্থী

ন্যায়ের প্রতি ভালবাসা ও অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। জুলুম ও অবিচার সকল অবস্থায় নিন্দনীয়- তা ব্যক্তি পর্যায়েই হোক বা সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হোক বা জন্মগত স্বাধীনতার কোন বিষয়ে। তাই জুলুমের উচ্ছেদ মানুষের নিরন্তন এক কামনা।

ন্যায়ের প্রতি ভালবাসা ও অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। জুলুম ও অবিচার সকল অবস্থায় নিন্দনীয়- তা ব্যক্তি পর্যায়েই হোক বা সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হোক বা জন্মগত স্বাধীনতার কোন বিষয়ে। তাই জুলুমের উচ্ছেদ মানুষের নিরন্তন এক কামনা। মানব ইতিহাসে সকল যুগেই একদল ব্যক্তিকে জালিম হিসেবে আবির্ভূত হতে দেখা গিয়েছে যারা স্বার্থপরতা, ক্ষমতালিপ্সা, পদমর্যাদা ও প্রতিপত্তির মোহ, আত্মম্ভরিতা, অহংকার, প্রতিহিংসা, স্বজাতি ও গোত্রের প্রতি অন্ধ ভালবাসা ইত্যাদির বশবর্তী হয়ে অন্যের অধিকার হরণ করেছে। কখনও কখনও তারা এ কারণে অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করেছে। বর্তমানেও পৃথিবীতে এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। পূর্বের জাতিসমূহের মধ্যে যেরূপ সবসময় এমন গোষ্ঠী ছিল যারা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করত এবং এ ধারণা রাখত যে, তারা প্রভুত্ব করার জন্য পৃথিবীতে এসেছে এবং অন্যরা তাদের সেবাদাস হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে; এখনও একদল মানুষ সেরূপ ধারণা পোষণ করে। বিষয়টি যখন একটি জাতির মধ্যে দেখা দেয় তখন তা তাদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী চিন্তার সৃষ্টি করে, আর যদি তা কোন জাতির বিশেষ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে দেখা দেয় তখন একনায়কতন্ত্র, স্বৈরাচার ও রাজতন্ত্রের জন্ম দেয়। বর্তমানে এ দু’টি ধারাই পৃথিবীর মানুষের ভাগ্য বিড়ম্বনার সবচেয়ে বড় কারণ। এ অবস্থা কোন সত্যপন্থী, ন্যায়পরায়ণ, আত্মত্যাগী ও মানবপ্রেমী মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এ বিষয়গুলো তার সহজাত মানব প্রকৃতির বিরোধী। তাই এ ধরনের প্রথা ও কাঠামোর বিরুদ্ধে মানুষ চিরকাল সোচ্চার থেকেছে। বিগত কয়েক শতাব্দীতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত আন্দোলনগুলো এ সত্যকেই তুলে ধরে। গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্ষমতাসীন একনায়কদের পতনের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা আন্দোলন ও বিপ্লবের কারণও মানুষের স্বাধীনতাকামী ও অন্যায় প্রতিরোধী মনোভাবের মধ্যে নিহিত। বর্তমানেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি আরব-বিশ্ব তথা মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোতে একনায়ক শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন চলছে। কেউ কেউ এ ধরনের গণরোষ ও ক্ষোভের একমাত্র কারণ ঐ সকল দেশের মানুষের অর্থনৈতিক বঞ্চনা বলেছেন। কিন্তু একনায়ক শাসকদের বিরুদ্ধে এ সকল দেশের মানুষের আন্দোলনকে একশ’ ভাগ অর্থনৈতিক বঞ্চনাপ্রসূত বলা যায় না। কারণ, যদিও মিশর ও ইয়েমেনের মত কিছু দেশে অর্থনৈতিক সমস্যার বিষয়টি মানুষকে ময়দানে আনতে অনেকাংশে উদ্বুদ্ধ করেছে বলা যায়, কিন্তু বাহরাইন বা লিবিয়ার মত দেশগুলোতে জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটা খারাপ নয় যে, তারা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য মৃত্যুকে বরণ করে নেবে; বরং বলা যেতে পারে, তারা তাদের সহজাত প্রবৃত্তির ডাকে সাড়া দিয়েই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে।

মানুষের জন্মগত এ অধিকারকে পবিত্র কুরআন স্বীকৃতি দিয়ে বলেছে : ‘তোমরা (অপরের ওপর) জুলুম করবে না এবং অবিচারের শিকার হবে না।’ (সূরা বাকারা : ২৭৯)। অন্যত্র মহান আল্লাহ্ বলেছেন : ‘আল্লাহ্ উচ্চৈঃস্বরে মন্দ কথার প্রকাশকে পছন্দ করেন না, তবে তার জন্য ব্যতীত যার ওপর অবিচার করা হয়েছে।’ (সূরা নিসা : ১৪৮)। অপর এক আয়াতে অন্যায় আচরণ ও অধিকার হরণ থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে সাহায্য কামনাকে অনুমোদন দিয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন : ‘যদি কেউ নির্যাতিত হওয়ার পর তা প্রতিরোধের জন্য সাহায্য চায়, তার ওপর কোন অভিযোগ নেই। অভিযোগ কেবল তাদের ওপর যারা মানুষের ওপর অবিচার করে এবং অন্যায়ভাবে পৃথিবীতে সীমালঙ্ঘন করে। বস্তুত তাদের জন্যই রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।’ (সূরা শুরা : ৪১-৪২)

এ সকল আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, ইসলাম অন্যায় ও জুলুম মেনে নেওয়াকে নিন্দনীয় মনে করে এবং জালেম, স্বৈরাচারী ও অধিকার হরণকারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে বৈধ গণ্য করে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : ‘ততক্ষণ পর্যন্ত কোন জাতিই সম্মান ও মর্যাদার পবিত্র স্থানে পৌঁছতে পারে না যতক্ষণ না তাদের দুর্বলরা কোনরূপ দ্বিধা ও সংকোচ ছাড়া তাদের শক্তিমানদের নিকট থেকে নিজেদের অধিকার আদায় করে।’

পবিত্র কুরআন ফিরআউন, নমরূদ ও তাদের ন্যায় যেসব ব্যক্তি মানুষের অধিকারসমূহ পদদলিত করত তাদের শোচনীয় পরিণতির কথা মানবজাতিকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে এজন্য যে, কেউ যেন পৃথিবীতে অহংকার ও ঔদ্ধত্যের পথ অবলম্বন করে বিপর্যয় সৃষ্টি না করে। কারণ, বিশ্ব ঐশী এক রীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত যা জুলুম ও অন্যায়কে বরদাশ্‌ত করে না। হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘পৃথিবী আল্লাহ্‌কে অস্বীকার করে টিকে থাকতে পারে, কিন্তু অন্যায় ও অবিচারের মধ্যে টিকে থাকতে পারে না।’

তাই মানুষের উচিত সকল প্রকার জুলুম পরিহার করা এবং স্বজাতির বৈধ অধিকারের ব্যাপারে সচেতন ও সোচ্চার হওয়া। আর সেসাথে উচিত সকল নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো। এটিই মনুষ্যত্বের দাবি।

(সূত্র : প্রত্যাশা, বর্ষ ১ সংখ্যা ৪)