সূরা আল মায়েদা;(১২তম পর্ব)

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৪১-৪৩

সূরা মায়েদার ৪১ ও ৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ لَا يَحْزُنْكَ الَّذِينَ يُسَارِعُونَ فِي الْكُفْرِ مِنَ الَّذِينَ قَالُوا آَمَنَّا بِأَفْوَاهِهِمْ وَلَمْ تُؤْمِنْ قُلُوبُهُمْ وَمِنَ الَّذِينَ هَادُوا سَمَّاعُونَ لِلْكَذِبِ سَمَّاعُونَ لِقَوْمٍ آَخَرِينَ لَمْ يَأْتُوكَ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ مِنْ بَعْدِ مَوَاضِعِهِ يَقُولُونَ إِنْ أُوتِيتُمْ هَذَا فَخُذُوهُ وَإِنْ لَمْ تُؤْتَوْهُ فَاحْذَرُوا وَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ فِتْنَتَهُ فَلَنْ تَمْلِكَ لَهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا أُولَئِكَ الَّذِينَ لَمْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يُطَهِّرَ قُلُوبَهُمْ لَهُمْ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ (৪১) سَمَّاعُونَ لِلْكَذِبِ أَكَّالُونَ لِلسُّحْتِ فَإِنْ جَاءُوكَ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ أَوْ أَعْرِضْ عَنْهُمْ وَإِنْ تُعْرِضْ عَنْهُمْ فَلَنْ يَضُرُّوكَ شَيْئًا وَإِنْ حَكَمْتَ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِالْقِسْطِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ (৪২)

"হে রাসূল! তাদের জন্য দুঃখ করবেন না যারা দৌড়ে গিয়ে কুফরে পতিত হয় যারা মুখে বলে আমরা মুসলমান অথচ তাদের অন্তর মুসলমান নয় এবং যারা ইহুদি মিথ্যা বলার জন্য তারা গুপ্তচরবৃত্তি করে তারা অন্য দলের গুপ্তচর যারা আপনার কাছে আসেনি তারা বাক্যকে স্বস্থান থেকে পরিবর্তন করে তারা বলে যদি তোমরা এ নির্দেশ পাও তবে কবুল করে নিও এবং যদি এ নির্দেশ না পাও তবে বিরত থেকো। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান তার জন্য আল্লাহর কাছে আপনি কিছু করতে পারবেন না। এরা এমনই যে আল্লাহ তাদের অন্তরকে পবিত্র করতে চান না তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়াতে লাঞ্ছনা এবং পরকালে কঠিন শাস্তি।" (৫:৪১)

"এরা মিথ্যা বলার জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করে, হারাম ভক্ষণ করে অতএব তারা যদি আপনার কাছে আসে তবে হয় তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দিন না হয় তাদের ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকুন। যদি তাদের থেকে নির্লিপ্ত থাকেন তবে তাদের সাধ্য নেই যে আপনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারে। যদি ফয়সালা করেন তবে ন্যায়ভাবে ফয়সালা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন।" (৫:৪২)

ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী, এই আয়াতগুলো মদিনা শহরে ইহুদিদের একটি দল সম্পর্কে নাজেল হয়েছে। ঘটনাটি ছিল এ রকম, ইহুদিদের এক সম্পদশালী নেতা জেনার কাজে জড়িয়ে পড়েছিল। যেহেতু ইহুদি ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের অপরাধের শাস্তি হলো সাঙ্গেসার অর্থাৎ পাথর ছুঁড়ে মারা। সে জন্য তারা এ বিধান থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্য বলেছিল, এ ব্যাপারে ইসলামের বিধান জানার জন্য কাউকে ইসলামের নবীর কাছে পাঠাবো। হয়তো ইসলামের হুকুম আরো সহজ হবে। কিন্তু ইসলামের নবীও একই রকমের বিধানের কথা বলায় তারা ওই বিধানের বিরোধিতা করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে রাসূল (সা.)কে সম্মোধন করে নাজেলকৃত এ আয়াতে বলা হয়েছে, ইহুদিরা যদি তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহর হুকুম না মানে কষ্ট পাবেন না। কেননা কালপরিক্রমায় তাদের বৈশিষ্ট্যই ছিল নবীদের অস্বীকার করা এবং তাদের দ্বীনের শিক্ষাকে বিকৃত করা। এই দলটি সত্য দ্বীন গ্রহণ করতে তোমার কাছে আসেনি। ফলে তাদের ঈমান না আনার কারণে কষ্ট পাবেন না। তারা এসেছিল নিজেদের এবং তাদের বন্ধুদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে। কিন্তু যেহেতু তুমি তাদের প্রত্যাশার বিপরীত কথা বলেছ সেজন্য তারা তোমার কাছ থেকে চলে গেছে। তবে তারা ঐশী শাস্তির হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছে বলে ভাবলে ভুল হবে। আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে অপমানজনক কঠোর শাস্তি দেবেন। কেননা তাদের অন্তর অপবিত্র এবং বাহ্যিক দিকটাও দূষিত।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো,

এক. ঈমান বিষয়টা অন্তর দিয়ে গ্রহণ করার ব্যাপার কেবল মুখে উচ্চারণের বিষয় নয়।

দুই. আমাদেরকে অবশ্যই আল্লাহর আদেশ মেনে চলতে হবে। আল্লাহ আমাদের চাওয়ার কাছ সমর্পিত হবেন তা নয়।

তিন. শত্রুরা কুফরি কিংবা মুনাফেকির কাজে খুবই দ্রুত গতি সম্পন্ন কিন্তু, মুসলমানরা কেন সত্যের পথে অলসতা করে?

চার. সুদ এবং হারাম খাওয়া ইহুদিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

পাঁচ. ইসলামে বিচারের ভিত্তি হলো ন্যায়-নীতির বাস্তবায়ন করা। সেখানে শত্রু-মিত্র, ধনী-গরীবে কোনো পার্থক্য নেই।

এ সূরার ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَكَيْفَ يُحَكِّمُونَكَ وَعِنْدَهُمُ التَّوْرَاةُ فِيهَا حُكْمُ اللَّهِ ثُمَّ يَتَوَلَّوْنَ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ وَمَا أُولَئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ

"তারা আপনাকে কেমন করে বিচারক নিয়োগ করবে অথচ তাদের কাছে তৌরাত রয়েছে তাতে আল্লাহর নির্দেশ আছে অতপর এরা পেছন দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তারা কখনও বিশ্বাসী নয়।" (৫:৪৩)

আলোচনার শুরুতেই যেমনটি বলেছিলাম একদল ইহুদি তৌরাতের বিধান থেকে পালাবার জন্য ইসলামের নবীর কাছে এসেছিল। কিন্তু তারা ইসলামের বিধানও গ্রহণ করেনি। সে কারণে নবীজী ইবনে সাওয়ারিয়া নামের ইহুদিদেরই একজন মুরব্বির কাছে পাঠালেন। এই মুরব্বি সকল ইহুদিদের কাছেই ছিল গ্রহণযোগ্য। তাকে আরো বলতে বলা হলো- আল্লাহ মুসা (আ:)এর ওপর যে তৌরাত অবতীর্ণ করেছেন, সেই তৌরাতের বিধান অনুযায়ী এ ধরনের পাপির শাস্তি কি সাঙ্গেসার নয়? তিনি বললেন, হ্যাঁ ঠিক তাই। নবীজী বললেন, তাহলে এই বিধানের বিরোধিতা করছ কেন? সে বলল আমরা এ বিধানটি সাধারণ লোকজনের ওপর প্রয়োগ করতাম এবং সম্ভ্রান্তদের ওপর নয়। এ কারণে ধনীদের মাঝে এ অপকর্মের প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে। তাই সাধারণ লোকজন আমাদেরকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করে। অবশেষে আমরা বাধ্য হয়ে সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য সহজ একটি আইন প্রয়োগ করি। তাহলো জেনা করলে তাদেরকে চল্লিশটি বেত্রাঘাত করা হবে এবং বাজারের গলিতে ঘুরানো হবে। নবীজী তখন বললেন, হে খোদা আপনি সাক্ষী থাকুন আমি তোমার এ বিস্মৃত হুকুমটিকে ইহুদি ধর্মে পুনরায় জাগ্রত করলাম।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,

এক. কোরআনের দৃষ্টিতে সমগ্র তৌরাতই বিকৃত নয়। কিছু ঐশী হুকুম তাতে এসেছে।

দুই. ঐশী বিধান বা হুকুমের বিরোধিতা করা ঈমানের দুর্বলতার লক্ষণ। কেননা ঈমানের বিধান হলো আল্লাহর বিধানের সামনে বিনত থাকা।

তিন. আহলে কিতাবের সাথে মুসলমানদের সহাবস্থান ছিল এই টুকু যে, তারা মাঝে মাঝে ইসলামের নবীর কাছে আসত এবং তার কাছে বিভিন্ন ব্যাপারে হুকুম চাইতো।