সূরা আল মায়েদা;(১৪তম পর্ব)

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৪৮-৫০

সূরা মায়েদার ৪৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَكِنْ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آَتَاكُمْ فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ

"হে মুহাম্মাদ! তোমার প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি, যা সত্য নিয়ে এসেছে এবং ইতোপূর্বে আল্লাহর কিতাবের মধ্য থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তার সত্যতা প্রমাণকারীও তার সংরক্ষক। কাজেই তুমি আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী লোকদের বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালা কর এবং যে সত্য তোমার কাছে এসেছে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ কর না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি শরীয়াত ও একটি কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে রেখেছি। আল্লাহ চাইলে তোমাদের সবাইকে একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের যা দিয়েছেন তার মধ্যে তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য এমনটি করেছেন। কাজেই সৎকাজে একে অপরের চাইতে অগ্রবর্তী হবার চেষ্টা করো। শেষপর্যন্ত তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। তারপর তিনি সেই প্রকৃত সত্যটি তোমাদের জানিয়ে দেবেন, যে ব্যাপারে তোমরা মতবিরোধ করে আসছিলে।" (৫:৪৮)

মানুষকে হেদায়েত করার জন্যে আল্লাহ যুগে যুগে বহু নবী রাসূলকে ধর্ম এবং শরিয়তি বিধিবিধান দিয়ে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহর নবীদের প্রচারিত শিক্ষাগুলো দুঃখজনকভাবে বহুক্ষেত্রেই যেমন বিকৃত হয়ে গেছে তেমনি বিকৃতির সুযোগে বহু কল্পিত বিষয় এবং কুসংস্কারও ঢুকে পড়েছে। যে আয়াতটি শুনলেন তাতে কোরআনে কারিমের উচ্চ মর্যাদার বিষয়টি স্মরণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে,কোরআন যেহেতু পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থসমূহের সত্যতাকে প্রত্যয়ন করে, সেহেতু কোরআন সেইসব গ্রন্থের রক্ষণাবেক্ষণকারীও বটে। এমনকি পূর্ববর্তী নবীদের মূলনীতি ও আদর্শগুলো রক্ষার ওপর পরিপূর্ণ গুরুত্বও আরোপ করে। এভাবে সেগুলোকে বরং সামগ্রিক এবং পূর্ণ রূপ দিয়েছে।

আয়াতের ধারাবাহিকতায় একটি প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে। প্রশ্নটি হলো অনেকেই ভাবেন, কেন আল্লাহ পাক একটিমাত্র ধর্ম এবং একটিমাত্র উম্মাহ সৃষ্টি করলেন না। তাহলে তো ধর্মে ধর্মে বিবাদ-বিরোধিতা হতো না। জবাব হলো স্কুলে একই ক্লাসে সকল ছাত্রও পড়ে না আর সকল ক্লাসের মানও সমান নয়। যারা নীচের ক্লাসে পড়ে তারা উপরের ক্লাসের পড়া বুঝবে না। ছাত্রের জ্ঞানের মাত্রা যতো বাড়বে ততো উপরের ক্লাসে সে যাবে এবং আরো বড় শিক্ষকের কাছে পড়ার সুযোগ পাবে। একইভাবে আল্লাহও মানব জাতিকে ধীরে ধীরে কাল উপযোগী করে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং কালের উপযুক্ত নবী রাসূলকেও পাঠিয়েছেন। মানুষ যতো জ্ঞান ও বুদ্ধির অধিকারী হয়েছে ততো উন্নত ও উচ্চ পর্যায়ের প্রশিক্ষককে পেয়েছে। সর্বশেষ নবী তাই মানব জাতির জন্যে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী এবং শিক্ষক। শরিয়তের এই পার্থক্য মানুষের মধ্যকার সৃজনশীলতার পার্থক্যের মতো। এর ফলে ঝগড়া বিবাদ না হয়ে বরং যে যার সাধ্যমতো মেধা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পূণ্য কাজের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়াটাই সঙ্গত ছিল। জেনে রাখা উচিত আল্লাহ মানুষের সকল কাজ দেখেন, কোনো কিছুই তাঁর অগোচর নয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

এক. সকল ঐশী গ্রন্থের ওপর কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা রয়েছে। মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ্য বইয়ের চেয়ে ইউনিভার্সিটির বইয়ের যেমন উচ্চ মর্যাদা রয়েছে এবং ভার্সিটির বই যেভাবে নীচু ক্লাসের বইগুলোকে অনুমোদন করে।

দুই, সমাজ নেতাদেরকে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়-ঐশী বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে জনগণকে খুশি রাখার মাধ্যমে নিজের অবৈর্ধ স্বার্থ হাসিল করার চিন্তা।

তিন. ঐশী পরীক্ষার একটি মাধ্যম হলো ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় বিভিন্ন দ্বীনের পার্থক্য। পরীক্ষাটি হলো কে সত্য ও ন্যায়কে গ্রহণ করলো আর কে করলো না তা স্পষ্ট হয়ে যাওয়া।

সূরা মায়েদার ৪৯ এবং ৫০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ (49) أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ

"কাজেই হে মুহাম্মাদ! তুমি আহলে কিতাবের মাঝে আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী তাদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা করো এবং তাদের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করো না। সাবধান হয়ে যাও, এরা যেন তোমাকে ফিতনার মধ্যে নিক্ষেপ করে সেই হেদায়াত থেকে সামান্যতমও বিচ্যুত করতে না পারে, যা আল্লাহ‌ তোমার প্রতি নাযিল করছেন। যদি এরা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে জেনে রাখো, আল্লাহ‌ এদের কোন কোন গোনাহর কারণে এদেরকে বিপদে ফেলার সিদ্ধান্তই করে ফেলেছেন। আর যথার্থই এদের অধিকাংশ ফাসেক। (৫:৪৯)

"(যদি এরা আল্লাহর আইন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়) তাহলে কি এরা আবার সেই জাহেলিয়াতের ফায়সালা চায়? অথচ যারা আল্লাহর প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ের অধিকারী তাদের দৃষ্টিতে আল্লাহর চাইতে ভাল ফয়সালাকারী আর কেউ নেই।" (৫:৫০)

ইতিহাসে এসেছে, ইহুদিদের বেশ ক'জন ধর্মীয় নেতা নবীজীর দরবারে এসে বললোঃ আমরা আমরা ইহুদি পণ্ডিত। আমরা যদি তোমার প্রতি ঈমান আনি তাহলে বাদ বাকি ইহুদিরাও তোমার প্রতি ঈমান আনবে। কিন্তু আমাদের ঈমান আনার শর্ত হলো মতপার্থক্য দেখা দিলে আমাদের স্বার্থে আদেশ দেবে। এ আয়াতে নবীজীকে ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সচেতন করে দেয়া হয়েছে এবং এ ধরনের কার্যক্রম থেকে তাঁকে বিরত রাখা হয়েছে। সেইসঙ্গে মানুষের জীবনে পাপের বিপদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে পাপীদের পাপের পরিণতি হলো এই যে মানুষ এত বেশি কঠিন হৃদয়ের অধিকারী হয়ে যায় যে, সত্যকে বোঝা সত্ত্বেও কেবলমাত্র নিজের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে সেই সত্যকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। যেটুকু বক্তব্য নিজেদের স্বার্থানুকূলে যায় সেটুকুই শুধু মেনে নেয়। এ আয়াতে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ যদি জীবন বিধানের সন্ধানে থাকো, তাহলে আল্লাহ ছাড়া আর কাকে এ কাজের জন্যে উত্তম বলে মনে করো। তিনি মানুষসহ সমগ্র সৃষ্টিকূলের সকল রহস্য জানেন। তাঁর মাঝে কোনো ভুল ভ্রান্তির অবকাশ নেই। তোমাদের স্বার্থ কিংবা মালামালের প্রতি তার কোনো লোভ নেই। তাহলে কেন আল্লাহর আদেশ মানো না! কেন মানব রচিত কল্পিত বিধানের পেছনে পড়ে আছো?

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলোঃ

১. মানুষ যখনই সত্যের পথ থেকে সরে যায় তখনি জাহেলিয়াত বা মূর্খতার পথ ধরে, যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাকে আলেম কিংবা উচ্চ শিক্ষিত বলে মনে হয়। কেননা প্রকৃত জ্ঞানের স্বরূপ হচ্ছে সত্যকে বোঝা এবং তাকে গ্রহণ করা।

২. প্রকৃত ইমানের পরিচয় হলো ঐশী বিধান মেনে নেওয়া। যারা মানব রচিত মতবাদ গ্রহণ করেছে তারা তাদের নিজেদের ইমানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে।

৩. শত্রুদের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। শত্রুরা বিভিন্ন উপায়ে ইসলামী সমাজের নেতৃবৃন্দ, মুমিনগণ এবং যুবকদেরকে প্রতারিত করে নিজেদের দলে ভেড়ানোর সুযোগ খোঁজে।

৪. খোদা বিমুখতা বা কুফরির শেকড় গুনাহ বা পাপের মাঝেই প্রোথিত।