সূরা আল মায়েদা;(২৫তম পর্ব)

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৮৯-৯১

সূরা মায়েদার ৮৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

لَا يُؤَاخِذُكُمُ اللَّهُ بِاللَّغْوِ فِي أَيْمَانِكُمْ وَلَكِنْ يُؤَاخِذُكُمْ بِمَا عَقَّدْتُمُ الْأَيْمَانَ فَكَفَّارَتُهُ إِطْعَامُ عَشَرَةِ مَسَاكِينَ مِنْ أَوْسَطِ مَا تُطْعِمُونَ أَهْلِيكُمْ أَوْ كِسْوَتُهُمْ أَوْ تَحْرِيرُ رَقَبَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلَاثَةِ أَيَّامٍ ذَلِكَ كَفَّارَةُ أَيْمَانِكُمْ إِذَا حَلَفْتُمْ وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

"আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অনর্থক শপথের জন্যে; কিন্তু পাকড়াও করেন ঐ শপথের জন্যে যা তোমরা মজবুত করে বাঁধ বা দৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে ব্যক্ত কর। অতএব, এর কাফফরা এই যে, দশজন দরিদ্রকে খাদ্য খাওয়াবে; মধ্যম শ্রেণীর খাদ্য যা তোমরা নিজ পরিবারকে দিয়ে থাক। অথবা, তাদেরকে বস্ত্র বা কাপড় দেবে অথবা, একজন ক্রীতদাস কিংবা দাসী মুক্ত করে দেবে। যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে না,সে তিন দিন রোযা রাখবে। শপথ করার পরও তোমরা যারা শপথ ভেঙ্গে ফেল এটাই তার কাফফরা। তোমরা নিজ শপথগুলো রক্ষা কর এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নির্দেশ বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।" (৫:৮৯)

আগের পর্বে আমরা জেনেছি বিশ্বনবী (সা.) কিয়ামতের দিনের ভয়ংকর নানা অবস্থা বর্ণনা করার পর একদল মুসলমান নিজেদের জন্য খাদ্য গ্রহণ ও ঘুমকে হারাম ঘোষণা করেন এবং নিজ স্ত্রীদের কাছ থেকেও দূরে থাকতে লাগলেন। তারা তাদের এসব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে শপথও করেন। রাসূল (সা.) তাদেরকে এসব সিদ্ধান্ত পরিহারের জন্য সতর্ক করে দেন। তিনি বলেছেন, আমাদের ধর্মে নিজেকে গুটিয়ে রাখার ও সংসার-বিরাগী হওয়ার বা বৈরাগ্যের কোনো অবকাশ নেই। এ অবস্থায় তারা বলল, কিন্তু আমরা যে শপথ করে ফেলেছি- এখন আমরা কি করব? এ আয়াতে তাদের উ্দ্দেশ্যে আল্লাহ বলছেন: তোমরা একটি অপছন্দীয় কাজের ব্যাপারে শপথ নিয়েছ, তাই এর কোনো মূল্য নেই। আল্লাহ তোমাদেরকে এ জন্য পাকড়াও করবেন না বা শাস্তি দেবেন না। তবে জেনে রাখ, অহেতুক শপথ করবে না, কারণ, শপথ করলে তা পালন করা জরুরি। আর শপথ করে যদি শপথ ভাঙ্গ তবে কাফফারা দিতে হবে। কারণ, শপথ ভাঙ্গা হারাম।

ইসলামে জরিমানার বিধানের একটি বিশেষ সুবিধা হলো, কেউ যদি ধর্মীয় বিষয়ে কোনো ভুল করে বা বিধান লঙ্ঘন করে তাহলে এর জরিমানা হিসেবে তাকে সমাজের বঞ্চিত শ্রেণীকে সাহায্য করতে বলা হয়। যেমন কেউ যদি রোজা রাখতে অক্ষম হয়, তাহলে ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেয়া তার দায়িত্ব হয়ে পড়ে। আর এখানে শপথ ভাঙ্গার ক্ষেত্রেও কাফফারা হিসেবে দরিদ্রদেরকে খাদ্য অথবা বস্ত্র দিতে কিংবা বন্দিকে মুক্তি দিতে বলা হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় কিছু দিক হলো:

এক. আল্লাহ যেমন শপথের ব্যাপারে মানুষের ভুল ক্ষমা করে দেন, তেমনিভাবে আমাদেরও উচিত মানুষের ভুলগুলো ক্ষমা করা উচিত এবং আমাদের মনে রাগ রাখা উচিত নয়।

দুই. ইসলামের বিধান ও এ ধর্মের অপরাধের বিধানও দারিদ্র দূর করার সহায়ক।

তিন. অর্থনৈতিক জরিমানার পরিমাণ ব্যক্তির আর্থিক অবস্থার আলোকে নির্ধারণ করতে হবে এবং মানুষকে জরিমানার ধরণ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দেয়া উচিত।

চার. মহান আল্লাহর নামের পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে, তাই আল্লাহর নামে শপথ নেয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। আর যদি আল্লাহর নাম নিয়ে কোনো শপথ কেউ করে তাহলে তাকে ওই শপথ রক্ষা করতে হবে, আর এ ধরনের শপথ ভাঙ্গলে অবশ্যই কাফফারা দিতে হবে।

সূরা মায়েদার ৯০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

"হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরগুলো- এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ তো নয়। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক-যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও।" (৫:৯০)

ইসলাম এমন একটি পরিবেশে আবির্ভূত হয়েছিল যে পরিবেশে মদ, জুয়া, প্রতিমা পূজা ও ভাগ্য নির্ধারক শর- এসবের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছিল। কোরআন এসবকে আদিম জাহিলিয়াত বলে উল্লেখ করেছে। বর্তমান যুগেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা আঙ্গিকে বা পদ্ধতিতে এসব কূ-প্রথা চালু রয়েছে। কিন্তু ঈমানের শর্ত হলো, শয়তানের এসব মাধ্যম বা প্রতীক থেকে দূরে থাকতে হবে। মদসহ যা কিছু মানুষকে মাতাল করে বা বিবেক-বুদ্ধিকে স্থবির করে ইসলাম তা নিষিদ্ধ করেছে। জুয়া মানুষকে শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম ছাড়াই অর্থ উপার্জনের দিকে আকৃষ্ট করে, তাই ইসলাম এর নিন্দা জানায় এবং মদ- জুয়াকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে।

কবিতা ও মদ ছিল আরবদের অতি প্রিয় বিষয়। তাই রাতারাতি মদ নিষিদ্ধ করা হলে তা অনেকেই মান্য করত না। তাই ইসলাম ধারাবাহিক চার পর্যায়ে তথা পর্যায়ক্রমে মদ নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনের এ আয়াতে মদ পানকারীকে মূর্তি পূজারীর পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় কিছু দিক হলো:

এক. মদ পানের মত কাজগুলোকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে এ জন্য যে, এসবের মধ্যে রয়েছে বস্তুগত ও মানসিক অপবিত্রতার উপাদান।

দুই. ঈমানের শর্ত হলো, শয়তানের প্রভাবিত সব ধরনের কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। ঈমানের শর্ত হিসেবে কেবল এবাদতই যথেষ্ট নয়, খাদ্য গ্রহণে ও জৈবিক আচার-আচরণে সংযত হতে হবে।

তিন. ইসলামের সবগুলো শিক্ষাই মানুষকে সৌভাগ্য ও মুক্তির পথ দেখায়। যদিও এসব শিক্ষার কোনো কোনোটি বাস্তবায়ন আমাদের জন্য বেশ কঠিন বা কষ্ট-সাধ্য, কিন্তু এসব শিক্ষাকে সন্তানকে মানুষ করার জন্য বাবা-মায়ের গৃহীত কঠোর ব্যবস্থার সাথে তুলনা করা যায়।

 

সূরা মায়েদার ৯১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ

"শয়তান তো চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে দিতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব, তোমরা এখন ও কি নিবৃত্ত হবে?" (৫:৯১)

আগের আয়াতে মহান আল্লাহ মদ ও জুয়াকে অভিশপ্ত শয়তানের শয়তানিসূলভ আচরণ বলে উল্লেখ করেছেন। এ আয়াতে মহামহিম আল্লাহ বলছেন, শয়তান এ দুইয়ের মাধ্যমে সমাজের অন্য ব্যক্তিদের সাথে তোমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে চায় বা অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে চায় এবং এসবের মাধ্যমে সমাজে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী। মদ ও জুয়ার প্রচলনের মাধ্যমে শয়তান আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে তথা মানুষ আল্লাহর ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ে এবং নামাজ-রোজা বা আল্লাহর এবাদত ও তাঁর স্মরণের কথা ভুলে যায়।

মদ শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে মানুষের বহু ধরনের ক্ষতি করে এবং তা বহু রোগের উৎস। কিন্তু কোরআনে আল্লাহ মদের যে দু'টি ক্ষতিকর দিককে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন তা হলো, সামাজিক ক্ষতি ও আধ্যাত্মিক ক্ষতি।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় কিছু দিক হলো:

এক. যারাই মানুষের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে তারাও এক ধরনের শয়তান যদিও তারা মানুষের দেহ নিয়ে জন্ম নিয়েছে।

দুই. নামাজ আল্লাহকে স্মরণের সর্বোচ্চ প্রতীক। যা কিছু আমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে রাখে তা অপছন্দনীয় বিষয়। তাই এসব অপছন্দনীয় বিষয় এড়িয়ে চলা জরুরি তা পড়াশুনা বা ব্যবসার মত যে কোনো কাজই হোক না কেন।