সূরা আল মায়েদা;(২৮তম পর্ব)

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ৯৮-১০২ (পর্ব ২৮)

সূরা মায়েদার ৯৮ ও ৯৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

اعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ وَأَنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ (৯৮) مَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا تَكْتُمُونَ ((৯৯

"জেনে রাখো,নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা এবং একইসঙ্গে ক্ষমাশীল ও দয়ালু।" (৫:৯৮)

"রাসুলের দায়িত্ব শুধু (ঐশী নির্দেশ) পৌঁছে দেয়া। তোমরা প্রকাশ্যে ও গোপনে যা কিছু করো আল্লাহ তার সবই জানেন।" (৫:৯৯)

কেউ কেউ ধারণা করতো-হজ্বসহ ধর্মীয় বিষয়ে যেসব নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে রাসূল তা নিজে থেকেই দিচ্ছেন এবং তিনি যেভাবে চান সেভাবেই কাজের পুরস্কার ও শাস্তি নির্ধারণ করছেন। কারো কারো এমন ধারণার জবাবে এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন-

প্রথমত: রাসূল (সা.) কেবলি আল্লাহর নির্দেশ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন এবং তিনি তাই করছেন। আল্লাহর নির্দেশ পাবার পর তাতে তিনি সামান্যতম পরিবর্তন আনেন না।

দ্বিতীয়ত: পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে। এ ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর কোন ভূমিকা নেই। যারাই আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলবে তিনি তাদেরকেই পুরস্কৃত করবেন এবং যারা তার নির্দেশ অমান্য করবে তারা শাস্তি পাবে। কাজেই মানব জাতির দায়িত্ব নির্ধারণ এবং পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে। আল্লাহ মানুষের জন্য যেসব বিধি-বিধান নির্ধারণ করেন রাসূল (স.) শুধুমাত্র তা সবার কাছে পৌঁছে দেন। রাসূল (স.) আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং ধর্ম মেনে চলার ক্ষেত্রে কাউকে বাধ্য করেননি। তিনি কাউকে তার দিক-নির্দেশনা মেনে চলার জন্য জোর-জবরদস্তি করেননি।

কারণ কে ঈমান এনেছেন আর কে আনেননি তা মানুষের মনের সঙ্গে সম্পর্কিত। কেবলমাত্র আল্লাহই জানেন যে, কে প্রকৃত ঈমানদার। কেউ বাহ্যিকভাবে ঈমানদারের অভিনয় করে গোপনে কুফরি করলেও তা আল্লাহতায়ালাই ভালো বলতে পারবেন।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. মুমিনদেরদের মনে যেমন ভীতি কাজ করবে তেমনিভাবে অবশ্যই আশাবাদী হতে হবে। ভীতিটা হলো সেই সব অন্যায় কাজের জন্য যে সব কারণে আল্লাহ মানুষকে শাস্তি দেবেন। পাশাপাশি আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের বিষয়টি মাথায় রেখে মানুষকে আশাবাদী হতে হবে।

দুই. রাসূল (সা.)'র দায়িত্ব হলো, ধর্ম সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা। ধর্ম মেনে চলতে বাধ্য করা নয়।

তিন. আল্লাহর কাছে প্রকাশ্য ও গোপন-সব বিষয় সমান। সব কিছুই তার জানা। কাজেই তার কাছে কপটতা ও ভণ্ডামির কোন স্থান নেই।

সূরা মায়েদার ১০০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ لَا يَسْتَوِي الْخَبِيثُ وَالطَّيِّبُ وَلَوْ أَعْجَبَكَ كَثْرَةُ الْخَبِيثِ فَاتَّقُوا اللَّهَ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

"হে রাসূল। মানুষকে বলে দিনঃ অপবিত্র ও পবিত্র সমান নয়, যদিও অপবিত্রের প্রাচুর্য তোমাকে বিস্মিত করে। অতএব, হে বুদ্ধিমানগণ, আল্লাহকে ভয় কর-যাতে তোমরা মুক্তি পেতে পারো।" (৫:১০০)

ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে কাফেরদের সংখ্যা বেশি ছিল এবং মুমিনদের সংখ্যা ছিল কম। আর তা দেখে মুমিন ব্যক্তিরা হতাশ হয়ে পড়তো এবং তাদের ঈমান দুর্বল হয়ে যেতো। এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা রাসুলের উদ্দেশে বলছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্যতার মানদণ্ড নয়। কোনো সমাজের অধিকাংশ মানুষও যদি ইসলাম ধর্ম ও রাসূল (সা.)'র পথ অনুসরণ না করে তাহলেও তা অসত্য বা বাতিল হয়ে যাবে না। আল্লাহতায়ালা বিবেকবান মানুষদের উদ্দেশে বলছেন, যদি কল্যাণ ও মুক্তি চাও তাহলে আল্লাহ ও তার পক্ষ থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে সেসবকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয়েছে তাই সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড। কদর্য ও সৌন্দর্য-অপবিত্র ও পবিত্র-ভালো ও মন্দ কখনোই এক হতে পারে না। যদি একটি সমাজের অধিকাংশ মানুষও মন্দ ও অপবিত্র কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ে তাহলেও সত্যকে অস্বীকার করা যাবে না।

ধরা যাক, একটি কক্ষে পাঁচ জন লোক বাস করে। এর মধ্যে চার জন ব্যক্তি সিগারেট খেতে চায় ও পরিবেশকে কলুষিত করতে চায় এবং অপর ব্যক্তি সিগারেট খাওয়ার বিরোধিতা করছে। সিগারেট খাওয়ার বিরোধী ব্যক্তিটি চায় ওই কক্ষটি নির্মল ও দূষণমুক্ত থাকুক। এ অবস্থায় কী আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার পক্ষে অবস্থান নেব?

এ অবস্থায় কী আমরা এটা বলবো যে, যিনি ওই কক্ষে সিগারেট খাওয়ার বিরোধিতা করছেন তাকে কক্ষ থেকে বের করে দেয়া হোক? না আমরা তা বলবো না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. সংখ্যাগরিষ্ঠতার অর্থ এই নয় যে, তারাই সঠিক পথে রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার অর্থ শ্রেষ্ঠত্ব নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্যতার মানদণ্ড নয়। যারা বলে যে, বেশির ভাগ মানুষ যে পথে রয়েছে সে পথটিই সঠিক, তাদের কথা যৌক্তিক ও কোরআনভিত্তিক নয়।

দুই. সব মানুষেরই বিবেক রয়েছে। কিন্তু তাদের অনেকেই বিবেক দিয়ে চলে না। তারা সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি ও সংস্কৃতির আলোকে জীবন যাপন করে। কোনো কিছু ভুল হলেও তারা তা অনুসরণ করে। কাজেই ভ্রান্ত পথের অনুসারীরা সংখ্যায় বেশি হলেও তাদের আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়।

তিন. কল্যাণ ও মুক্তির জন্য ঈমান ও তাকওয়াও প্রয়োজন যাতে মানুষ ঐশী আদের্শর ভিত্তিতে সত্য ও মিথ্যাকে পৃথক করতে এবং তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

সূরা মায়েদার ১০১ ও ১০২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَسْأَلُوا عَنْ أَشْيَاءَ إِنْ تُبْدَ لَكُمْ تَسُؤْكُمْ وَإِنْ تَسْأَلُوا عَنْهَا حِينَ يُنَزَّلُ الْقُرْآَنُ تُبْدَ لَكُمْ عَفَا اللَّهُ عَنْهَا وَاللَّهُ غَفُورٌ حَلِيمٌ (১০১) قَدْ سَأَلَهَا قَوْمٌ مِنْ قَبْلِكُمْ ثُمَّ أَصْبَحُوا بِهَا كَافِرِينَ ((১০২

"হে মুমিনগণ, (রাসূলের কাছে) এমন বিষয়ে প্রশ্ন করো না যা তোমাদের জন্য প্রকাশিত হলে তোমাদের খারাপ লাগবে। যদি কোরআন অবতরণকালে তোমরা এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস কর,তবে তা তোমাদের জন্যে প্রকাশ করা হবে। অতীত বিষয় আল্লাহ ক্ষমা করেছেন আল্লাহ ক্ষমাশীল,সহনশীল।" (৫:১০১)

"এ ধরনের কথাবার্তা তোমাদের পূর্বেও এক সম্প্রদায় জিজ্ঞেস করেছিল। এরপর তারা এসব বিষয়ে অবিশ্বাসী হয়ে গেল।" (৫:১০২)

যদিও কোন বিষয়ে তথ্য জানতে প্রশ্ন করা জরুরি। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, কিছু প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণতো নয়ই বরং সমাজে অনেক সমস্যার জন্ম দিয়ে থাকে। যেমন, যুদ্ধচলা অবস্থায় যদি এ প্রশ্ন করা হয় যে, সরকারের কাছে বর্তমানে কী পরিমাণ গম মজুদ রয়েছে? তাহলে তা সবার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেয়া হলে যেমন দেশে রুটির সংকট দেখা দেয়ার আশংকা থাকে তেমনি এ ধরনের তথ্যকে শত্রুপক্ষ অপব্যবহার করতে পারে।

ধর্মীয় বিষয়েও রাসূলে আকরাম (সা.) যতটুকু প্রয়োজন হতো ততটুকুই ঈমানদার মুসলমানদেরকে অবহিত করতেন। আসলে এমন অনেক প্রশ্ন আছে যেগুলোর উত্তর সমাজে নানা সমস্যার জন্ম দিতে পারে এবং অনেকে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন থেকে দূরে থাকার জনৗ অনেক সময় নানা ধরনের প্রশ্ন করে থাকে।

যেমন- হযরত মুসা (আ.)'র সময় বনী ইসরাইল সম্প্রদায়ের ওপর এ নির্দেশ এসেছিল যে, একটি গরু জবাই করতে হবে। কিন্তু যেহেতু এ কাজটি তাদের জন্য কঠিন ছিল, সে কারণে তারা গরুর রং, গঠন,বয়সসহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্যও কী হতে হবে,তাও জানতে চেয়েছিল। এ প্রশ্নের উত্তর আসার পর তাদের জন্য এসব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কোন গরু খুজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়লো।

বিভিন্ন হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) যখন হজ্ব সম্পর্কে কথা বলছিলেন তখন একজন জিজ্ঞেস করলেন। ইয়া রাসুলুল্লাহ,প্রতি বছরই হজ্ব পালন করা ফরজ, নাকি জীবনে একবার হজ্ব পালন করলেই চলবে? কিন্তু রাসূল (সা.)এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না। এরপর ওই ব্যক্তি একই প্রশ্ন আরো কয়েক বার উত্থাপন করলেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন, বারবারই একই প্রশ্ন করছেন কেন আপনি? প্রতি বছরই যদি হজ্ব পালন জরুরি হতো,তাহলে আমিই তা বলতাম।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য সব কিছু জানা জরুরি নয়। কাজেই আমাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় তথ্যের সন্ধান করতে হবে। যেসব তথ্য সমাজে সমস্যা,বিদ্বেষ ও অস্থিরতার জন্ম দেয় তা জানার প্রয়োজন নেই।

দুই. মানুষের জন্য অনেক কিছুই ফরজ করা হয়নি, যা ঐশী ক্ষমার নিদর্শন। এমন অনেক তথ্য আছে,যা বুঝার বা মেনে চলার যোগ্যতা বা ক্ষমতা অনেক মানুষেরই নেই। এ ধরনের তথ্য অনেককে কুফরির দিকেও ঠেলে দেয়।