সূরা আল মায়েদা;(২৯তম পর্ব)

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ১০৩-১০৫

সূরা মায়েদার ১০৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

مَا جَعَلَ اللَّهُ مِنْ بَحِيرَةٍ وَلَا سَائِبَةٍ وَلَا وَصِيلَةٍ وَلَا حَامٍ وَلَكِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَأَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ

"(হে অংশীবাদি বা মুশরিকরা!) আল্লাহ (কান চিরে দেয়া) ‘বহিরা' (বা ৫ বা ১০টি বাচ্চা জন্মদানের পর মূর্তির উদ্দেশ্যে মুক্ত করা উটনী), ‘সায়েবা' (বা রোগ অথবা যুদ্ধ থেকে নিষ্কৃতি লাভের খুশিতে মুক্ত করা উট), ওসীলা'( বা সেই ছাগী যেটার জোড়া বাচ্চা জন্ম হলে মর্দা বাচ্চাটি মূর্তির নামে মুক্ত করা হয়) এবং ‘হাম' ( বা যে মর্দা উটের মাধ্যমে নিষিক্ত উটনী দশ বাচ্চা জন্ম দেয়ায় মর্দা উটটিকে মুক্ত করা হয়) সম্পর্কে (তথা এসবের মাংস নিষিদ্ধ করার) কোন বিধান দেননি। কিন্তু যারা কাফের, তারা (জাহেলি যুগের কুসংস্কারলব্ধ এসব নিষেধাজ্ঞাকে) আল্লাহর নির্দেশ বলে (তাঁর ওপর) মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে। তাদের অধিকাংশেরই বিবেক বুদ্ধি নেই বা তারা চিন্তা-ভাবনা করে না।" (৫:১০৩)

ইতিহাসে এসেছে মুশরিকরা কোনো কোনো পশুর গোশত খাওয়াকে হারাম মনে করত। তারা একে আল্লাহর বিধান বলে দাবি করত। বর্তমান যুগেও ভারতের কোনো কোনো স্থানে এ ধরনের প্রথা দেখা যায়। যেমন, সেখানে হিন্দুরা গরুকে পবিত্র বা দেবতা বলে মনে করে এবং এসব পশুকে কোনো প্রকার কষ্ট দেয়াকে অবৈধ মনে করে।

এটা ঠিক যে সব ঐশী ধর্মেই কোনো কোনো পশুর গোশত খাওয়া বৈধ নয়, কিন্তু হালাল ও হারামের সীমানা নির্ধারণ মানুষের এখতিয়ার বহির্ভুত বিষয় । তাই যে কোনো মানুষ তার খেয়াল-খুশিমত কোনো কিছুকে হালাল বা হারাম ঘোষণা করতে পারে না। পশু-পাখিসহ সব সৃষ্টিরই স্রস্টা হলেন আল্লাহ। আর এসব বিষয়ে নীতি নির্ধারণ বা হালাল-হারামের সীমানা নির্ধারণ একমাত্র মহান আল্লাহরই এখতিয়ারে রয়েছে। খোদায়ী ধর্মে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে বলে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত গাছপালা ও পশু-পাখিসহ সৃষ্টি জগতের সব কিছুরই ব্যবহার হালাল বা বৈধ । অবশ্য কোনো কোনো ধর্মের বিধানেও কিছু কিছু কুসংস্কার ঢুকে পড়েছে। প্রত্যেক ধর্মের জ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের উচিত খোদায়ী ধর্মের বিধান থেকে এসব কুসংস্কার দূর করা।

এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো:

এক. ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষেত্রসহ যে কোনো ক্ষেত্রে খোদায়ী বিধানের বিপরীত কোনো আইন প্রণয়ন কুপ্রথা বা বেদায়াত মাত্র। এসব আইন চালু করা কুফরি ও অজ্ঞতার লক্ষন। যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে কেবল তারাই কাফের নয়, যারা এ ধরনের আইন চালু করে তারাও কাফের।

দুই. পশুকে ব্যবহার না করার উদ্দেশ্যে ছেড়ে রাখা বা মুক্ত করে রাখা জায়েজ নয়। আর মানুষকে ত্যাগ করার তো প্রশ্নই ওঠে না।

সূরা মায়েদার ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ قَالُوا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آَبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آَبَاؤُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ

"যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং রাসূলের দিকে এস, তখন তারা বলে, আমাদের জন্যে তাই যথেষ্ট, যার ওপর আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে পেয়েছি। যদি তাদের বাপ দাদারা কোন জ্ঞান না রাখে এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত না হয় তবুও কি তারা তাই করবে?" (৫:১০৪)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, যখনই মুশরিকদেরকে তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন তৎপরতা ত্যাগ করে আল্লাহর বিধানের দিকে ফিরে আসতে বলা হয় তখন তারা নিজের কাজের পক্ষে কোনো যুক্তি দেখাতে পারে না। বরং তারা বলে, আমাদের বাপ-দাদারা যেহেতু এমনটি করতেন, তাই আমরাও তাই করছি। আল্লাহ তাদের বলছেন, বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা সব প্রথাই কি সঠিক? তারা যেসব অযৌক্তিক ও অজ্ঞতাসুলভ আচার-আচরণে নিয়োজিত হয়েছে তা কোনো সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মেনে নিতে পারে না।

এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো:

এক. খোদায়ী বিধানই হলো মূল সংস্কৃতি বা আইন, বাপ-দাদার প্রথা বা সংস্কৃতি নয়।

দুই. প্রাচীন হলেই যে কোনো প্রথা বা রীতি ঠিক বা খাঁটি-এমন ধারণা অবাস্তব। আবার প্রথা বা বিধান খাঁটি হওয়ার জন্য তা নতুনই হতে হবে-এমন ধারণাও সম্পূর্ণ অমূলক। সঠিক পথ বা খাঁটি পথ হলো জ্ঞান ও হেদায়াত তথা ঐশী দিক-নির্দেশনা। অন্ধের মত অনুসরণ জ্ঞানহীনতার লক্ষণ।

সূরা মায়েদার ১০৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لَا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ إِلَى اللَّهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ

"হে মুমিনগণ, তোমরা যেন নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হও। ( জেনে রাখ) তোমরা সুপথ বা হেদায়াত পেয়েছ বলে পথভ্রান্ত ব্যক্তিরা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি তোমাদেরকে বলে দেবেন, যা কিছু তোমরা করতে।" (৫:১০৫)

আগের আয়াতে কুসংস্কারের পূজা ও পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ বন্ধ করতে মুশরিকদের আহ্বান জানানোর পর এ আয়াতে মহান আল্লাহ মুমিনদের বলছেন, বিভ্রান্ত ও পথহারাদের পথ দেখানো এবং সৎকাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজে নিষেধ করা তোমাদের দায়িত্ব। কিন্তু তোমাদের এসব কাজ যদি কাফের মুশরিকদের ওপর কোনো প্রভাব না ফেলে তাহলে হতাশ হয়ে যেও না এবং অন্ততঃ নিজ ধর্মকে রক্ষা কর। আর তা যদি কর তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে কাফের-মুশরিকদের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করবেন এবং তোমাদের ও তাদের কাজের বিচার করবেন বিচার দিবসে বা পুণরুত্থানের পর। একজন মুমিনের উচিত অবশ্যই নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা, যাতে তিনি অন্যদের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারেন। কাফের- মুশরিক বা অবিশ্বাসীদের মাধ্যমে প্রভাবিত হওয়া তার জন্য ঠিক হবে না। তাই এ আয়াতে মৌলিক যে পরামর্শ দেয়া হয়েছে তা হলো, মুমিনরা যেন নিজ ঈমানের ও আধ্যাত্মিকতার ভিত্তিগুলোকে মজবুত করার মাধ্যমে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন এবং নিজেকে যোগ্য মুমিন হিসেবে গড়ে তুলে অন্যদের ওপরও প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন।

এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হলো:

এক. অন্যদের অযৌক্তিক দাবি মোকাবেলার ক্ষেত্রে সাফল্য লাভের জন্য প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো, নিজের নফস বা প্রবৃত্তির লাগামকে নিয়ন্ত্রণ করা। নিজেকে শুদ্ধ করার পরই আমরা অন্যকে শুদ্ধ করার মত কাজে নামার নৈতিক অধিকার পাব।

দুই. অন্যরা পাপ করছে এ অজুহাত দেখিয়ে আমরাও পাপ করব-এমনটি যৌক্তিক নয়। পাপে কলুষিত সমাজে থেকেও পাপ বর্জনের জন্য সতর্ক থাকতে হবে।

তিন. বিচার দিবসে বা কিয়ামতের দিন প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্বের ও কাজের বোঝা বহন করতে হবে। সেদিন কেউই অন্যের পাপের বোঝা বহন করবে না।