সূরা আল মায়েদা;(৩২তম পর্ব)

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ১১৪-১১৭

সূরা মায়েদার ১১৪তম আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-

قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِأَوَّلِنَا وَآَخِرِنَا وَآَيَةً مِنْكَ وَارْزُقْنَا وَأَنْتَ خَيرُ الرَّازِقِينَ

"মরিয়ম তনয় ঈসা বললেনঃ হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিপালক! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করুন। তা আমাদের জন্যে অর্থাৎ, আমাদের প্রথম ও পরবর্তী সবার জন্যে আনন্দোৎসব হবে এবং আপনার পক্ষ থেকে একটি নিদর্শন হবে। আপনি আমাদেরকে জীবিকা দান করেন। আপনিই শ্রেষ্ঠ জীবিকাদাতা।" (৫:১১৪)

হাওয়ারিয়ুন নামে খ্যাত হযরত ঈসা (আ.)-এর সহচররা আবেদন জানালো যদি স্বর্গ থেকে তাদের জন্য খাদ্য আসে তাহলে তাদের ঈমান ও মনের দৃঢ়তা আরো বাড়বে। হযরত ঈসা (আ.) যখন দেখলেন যে তাদের এই আবেদনের পেছনে কোন ফন্দি নেই, বরং ঈমানের দৃঢ়তা ও ভালো উদ্দেশ্যেই তারা এই নিবেদন জানিয়েছে,তখন তিনি স্বর্গীয় খাবার পাঠানোর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-

এক. ধর্মীয় উৎসব পালন এবং খাবার বিতরণ করা ইসলামসহ সকল ধর্মেই স্বীকৃত।

দুই. খাবার গ্রহণের সময়ও লক্ষ্য রাখতে হবে যে এ সবই আল্লাহর দেয়া রিজিক, কাজেই তিনি যে ভাবে সন্তুষ্ট হন তা সেভাবেই ব্যয় করতে হবে।

এ সূরার ১১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالَ اللَّهُ إِنِّي مُنَزِّلُهَا عَلَيْكُمْ فَمَنْ يَكْفُرْ بَعْدُ مِنْكُمْ فَإِنِّي أُعَذِّبُهُ عَذَابًا لَا أُعَذِّبُهُ أَحَدًا مِنَ الْعَالَمِينَ

"আল্লাহ বললেন, নিশ্চয় আমি সে খাঞ্চা তোমাদের প্রতি অবতরণ করব। তবে যে ব্যক্তি এর পরেও অকৃতজ্ঞ হবে, আমি তাকে এমন শাস্তি দেব, যে শাস্তি বিশ্বজগতের অন্য কাউকে দেব না।" (৫:১১৫)

এই মুজেজা বা অলৌকিক ঘটনা আল্লাহর ইচ্ছায়ই সংঘটিত হয়েছিল, এ ক্ষেত্রে হযরত ঈসার কোন কৃতিত্ব ছিল না, এজন্যই আল্লাহ তা'লা হাওয়ারিয়ুনদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, কেউ যেন হযরত ঈসা (আ.) এর মুজেজার প্রতি সন্দেহ পোষণ না করে। কিন্তু বিভিন্ন বর্ণনায় দেখা যায়, আল্লাহর নির্দেশে আকাশ থেকে স্বর্গীয় খাবার নেমে আসার পরও একদল মানুষ হযরত ঈসা (আ.) এর মুজেজার প্রতি সন্দিহান হলো এবং আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করলো।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-

এক. একজন অজ্ঞ ব্যক্তির চেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তির দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। শিক্ষিত ব্যক্তি তার জ্ঞানের মাধ্যমে সত্যকে সহজেই চিনতে পারে, তারপরেও সে যদি সত্যকে গ্রহণ না করে তাহলে তার শাস্তি হবে কঠোর।

দুই. যার প্রত্যাশা বেশি তার দায়িত্বও বেশি।

এ সূরার ১১৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-

وَإِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ أَأَنْتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَهَيْنِ مِنْ دُونِ اللَّهِ قَالَ سُبْحَانَكَ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أَقُولَ مَا لَيْسَ لِي بِحَقٍّ إِنْ كُنْتُ قُلْتُهُ فَقَدْ عَلِمْتَهُ تَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِي وَلَا أَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِكَ إِنَّكَ أَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ

"যখন আল্লাহ বলবেন, হে মরিয়ম তনয় ঈসা! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আমাকে ও আমার জননীকে উপাস্যরূপে গ্রহণ কর ? ঈসা বলবেন, তুমিই মহিমান্বিত! যা বলার অধিকার আমার নেই তা বলা আমার পক্ষে শোভন নয়। যদি আমি তা বলতাম তবে তুমি তো তা জানতে। আমার অন্তরের কথা তো তুমি অবগত আছ। কিন্তু তোমার অন্তরের কথা আমি অবগত নই। নিশ্চয়ই তুমি অদৃশ্য সম্বন্ধে পরিজ্ঞাত।" (৫:১১৬)

এই আয়াতে কেয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে হযরত ঈসা (আ.)-এর কথোপকথনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও খ্রিস্টানরা হযরত মারিয়ামকে এখন তিন খোদার পর্যায়ে বিবেচনা করে না, কিন্তু বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগে খ্রিস্টানদের একটি উপদল হযরত মারিয়ামকে তিন খোদার একজন বলে বিবেচনা করতো, এমন কি খ্রিস্টানদের কোন কোন উপদল হযরত মারিয়ামের মূর্তিকে সামনে রেখে উপাসনা করতো। এখনো গীর্জাগুলোর বেদির উপরে সন্তানসহ হযরত মারিয়ামের ছবি শোভা পায় এবং খ্রিস্টানরা ওই ছবিকে ভক্তির সাথে প্রণাম করে।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-

এক. হযরত ঈসা মাসিহ (আ.)কে খ্রিস্টানরা খোদার পুত্র হিসেবে মান্য করছে, এতে হযরত ঈসা তাদের উপর অসন্তুষ্ট।

দুই. পয়গম্বররা অত্যন্ত উঁচু মর্যাদার অধিকারী হলেও তারা কোনভাবেই আল্লাহর সমকক্ষ নয়।

সূরা মায়েদার ১১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

مَا قُلْتُ لَهُمْ إِلَّا مَا أَمَرْتَنِي بِهِ أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنْتَ أَنْتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ وَأَنْتَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ

"(হে প্রতিপালক!) আপনি আমাকে যে আদেশ করেছেন তা ব্যতীত আমি তাদেরকে কিছুই বলিনি। তাদেরকে বলেছি, তোমরা আমার ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর উপাসনা কর এবং যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি তাদের ক্রিয়াকলাপের সাক্ষী ছিলাম। কিন্তু যখন আপনি আমাকে তুলে নিলেন তখন আপনিই তো ছিলেন তাদের ক্রিয়াকলাপের সাক্ষী।" (৫:১১৭)

এই আয়াতেও কেয়মতের দিন আল্লাহ পাকের সাথে হযরত ঈসা (আ.)-এর কথোপকথনের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত ঈসা (আ.) সেদিন সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিবেন যে, তিনি তাওহীদ বা একত্ববাদের বাণী প্রচার করেছেন। এই আয়াতে মূলত ত্রিত্ববাদীদেরকে এই বলে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, তারা হযরত ঈসা (আ.)-এর অনুসারী দাবী করছে, অথচ হযরত ঈসা (আ.) একত্ববাদের বাণী প্রচার করেছেন, তিনি কোন অবস্থাতেই তৃত্ববাদের কথা বলেননি।