সর্বশেষ নবী : হযরত মুহাম্মদ (সা.)

হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে সর্বশেষ নবী এ বিষয়টি আল্লাহর একত্বের মতই সকলের নিকট সুস্পষ্ট ও প্রমাণিত। বলতে হয় : এ ব্যাপারে সকলেই একমত।

ইসলাম ধর্ম সর্বদা নতুন এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তৃতি যত বেশি হবে এর সামগ্রিকতা ততটা সুস্পষ্টতর হতে থাকবে এবং এর বিস্ময় কখনোই শেষ হবে না।

এখন এ বিশ্বাসগত বিষয়ের বাস্তবরূপ বিশ্লেষণ করতে হবে।

প্রথমেই একটি ধর্মের চিরন্তন হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণসমূহ বিশ্লেষণ করব। অতঃপর ইসলামকে এ দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করব :

১.কোন ধর্ম ফেতরাতগত (মানুষের সহজাত প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল) হওয়াটা ঐ ধর্মের চিরন্তনতার গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহক। যে দীনের মূল ভিত্তি মানুষের ফেতরাত ও প্রকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত, সে দীন সময়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সর্বদা অগ্রসরমান হয়ে থাকে এবং কখনোই নিঃশেষ ও নিস্তব্ধ হয়ে যায় না কিংবা কখনোই নিস্ক্রিয় পুরোনো হয়ে পড়ে না।

২.যে সকল বিধি-নিষেধ স্থান ও কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় সকল প্রকার অগ্রগতির সাথেই তার সামঞ্জস্য বজায় থাকে এবং কখনোই কালের পরিক্রমণ তার উপর পরিবর্জনের রেখা টানতে পারে না।

অপরদিকে যে বিধান কোন বিশেষ সময় ও স্থানের জন্যে নির্দিষ্ট তা, সর্বকালের জন্যে সকল মানুষের চাহিদা মিটাতে অক্ষম। যেমন : যদি বলা হয় যে, যাতায়াতের ক্ষেত্রে মানুষ কেবলমাত্র প্রাকৃতিক বাহন যথা : ঘোড়া, উট ব্যবহার করতে পারবে, তবে এ নিয়ম কখনো অপরিবর্তিত থাকতে পারবে না এবং নিজ থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ নতুন নতুন প্রয়োজন দেখা দিলে মানুষ নতুন মাধ্যম ব্যবহার করবেই।

পূর্ববর্তী দীনসমূহ বিদ্যমান ও অব্যাহত না থাকার একটি কারণ হলো এটাই যে, ঐগুলো বিশেষ সময়ের ও নির্দিষ্ট কোন সমাজের জন্যে ছিল।

৩.সামগ্রিকতা : চিরন্তন দীনকে সর্বজনীন হতে হবে এবং মানবতার সকল সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম হতে হবে। মানবতার ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ আত্মার তৃষ্ণা এক শ্রেণীর ভ্রান্ত ও আচার সর্বস্ব অনুষ্ঠানাদি যেমন : সান্ধ্য অধিবেশন, রুটি ও মদ্য পানাহার ও গলায় ক্রুশ ঝুলানোর মাধ্যমে পিপাসা নিবারণ হয় না। কিংবা প্রকৃত প্রশান্তি লাভ করে না। বরং এক সর্বজনীন বিধি-বিধানের প্রয়োজন যা তাকে সারা জীবন পথ নির্দেশনা দিয়ে যাবে এবং তার সামাজিক সমস্যাসমূহের সমাধান দিবে।

৪.অচলাবস্থার সময় পথ নিদের্শনা : সাধারণ নিয়মগুলো কখনো কখনো পারস্পরিক বিরোধ অথবা প্রয়োজন ও বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে, মানুষকে অচলাবস্থার সম্মুখীন করে যেখানে সে জানে না কি করতে হবে!

এ কারণে চিরন্তন দীনে সাধারণ নিয়ম-কানুন ছাড়াও অন্যান্য নিয়মও থাকতে হবে যা জরুরী অবস্থায় বা সংকটময় মুহূর্তে কী করতে হবে সে বিষয়ের ব্যাখ্যা দিবে। আর কেবলমাত্র তখনই সকল সময় বা সর্বাবস্থার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হবে এবং সর্বদা ফলপ্রসূ হবে।

উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো চিরন্তনতার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে পরিগণিত যেগুলো ইসলামী বিধানে বজায় থেকেছে। এখন আমরা সেগুলোকে ব্যাখ্যা করব।

ইসলাম একটি চিরন্তন ধর্ম

১.ইসলাম নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে স্বয়ং মানুষের ফেতরাত ও প্রকৃতি যা সর্বদা বিদ্যমান থাকে তাকে বিবেচনা করেছে এবং এ ফেতরাতের প্রয়োজনে ইতিবাচক সারা দিয়েছে।

ইসলামের কর্মসূচী এমন ভাবে বিন্যস্ত হয়েছে যে, তাতে মানুষের সকল চাহিদা পূর্ণ হয়ে থাকে। যেমন : যৌন প্রয়োজন মিটানোর জন্যে একাধিক পদ্ধতি ও সহজ পরামর্শ দিয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে সে তা পূরণ করতে পারে। অপরদিকে বাঁধনহারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করে যাতে এর কুপ্রভাব ও অনাচার সমাজে বিস্তৃতি লাভ করতে না পারে।

২.ইসলামের মূল বিধি-বিধানসমূহ কোন বিশেষ কালের জন্যে নির্ধারিত নয় বলে কালের পরিবর্তনে বস্তুসমূহের পূর্ণতার সাথে পরিবর্তিত হয় না। বরং যুগোপযোগী একটি ধর্ম এবং যা কিছু সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় ও কল্যাণময় তা নির্ধারণ করে।

ইসলামের জিহাদ কর্মসূচীতে কখনোই দেখা যায় না যে, কোন নির্দিষ্ট সময়ের বিদ্যমান যুদ্ধাস্ত্রের (যেমন : তরবারী দিয়ে যুদ্ধ) উপর নির্ভর করতে। বরং সামগ্রিকভাবে এ নির্দেশ দেয় যে, ‘শত্রুদের মোকাবিলায় শক্তি সঞ্চয় কর যাতে নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে পার এবং তাদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পার। এটি একটি সামগ্রিক নীতি যা সকল প্রকার অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ এবং সর্বকালের জন্যে দিক নির্দেশনা। অন্যান্য কর্মসূচীর ক্ষেত্রেও এরূপ অবস্থা বিদ্যমান।

৩.অচলাবস্থা ও জরুরী ক্ষেত্রে ইসলামের জরুরী আইন, অক্ষতি আইন (কায়েদায়ে লা যারার) ও অসংকীর্নতা আইন (কায়েদেয়ে লা হারায) ইত্যাদি আইন{জরুরী আইন নিরুপায় অবস্থায়, অসংকীর্নতা আইন সংকট ও অসুবিধা ক্ষেত্রে এবং অক্ষতি আইন ক্ষতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়ে থাকে। তবে এগুলোর শর্ত ফিকাহ ও উসূলে বর্ণিত হয়েছে।} বিদ্যামান যেগুলোর মাধ্যমে যে কোন প্রকার সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তাছাড়া ইমাম ও মহানবী (সা.) উত্তরাধিকারী এবং ফতোয়া দানকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে অচলাবস্থার সময় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।

৪.ইসলামের কর্মসূচী অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিস্তৃততর। ইসলামে আইনগত, অর্থনৈতিক, সামরিক শিষ্টাচারগত ইত্যাদি বিষয়গুলো উন্নততর প্রক্রিয়ায় বর্ণিত হয়েছে। আর এ বিষয়গুলোর উপর মুসলিম পণ্ডিতগণ শত সহস্র কিতাব লিখেছেন যেগুলোর উৎস ছিল কোরআন, রাসূলের এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের বক্তব্যসমূহ।

উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোকে প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিই অনুধাবন করতে পারে যে ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা যা সর্বদা মানুষের প্রয়োজনে ইতিবাচক সারা দিতে পারে। ফলে এমতাবস্থায় কোন নতুন দীন বা নবীর কোন প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না।

কোরআনের দৃষ্টিতে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি

ইসলামের পরিপূর্ণতা ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে অনেক আয়াতে অবতির্ণ হয়েছে। এখন আমরা এগুলোর কিছু নমুনা তুলে ধরব:

وتمّت كلمة ربّك صدقا و عدلا لا مبدّل لكلماته وهو السّميع العليم

সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে তোমার প্রতিপালকের বাণী সম্পূর্ণ এবং তাঁর বাক্য পরিবর্তন করবার কেউ নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ ( সূরা আনআম : ১১৫)।

ماكان محمّد ابا احد من رجالكم ولكم رسول الله وخاتم النّبييّن

মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নয়, বরং সে আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী (সূরা আহযাব : ৪০)।

খাতাম (خاتم) শব্দটি ‘ت’ এর উপর ফাতহা (যবর)অথবা কাছরা (যের) সহ যখন কোন বহুবচন বিশিষ্ট শব্দের সাথে যুক্ত হবে, তবে তার অর্থ হবে ‘শেষ’। তাহলে উল্লিখিত আয়াতে খাতামান্নাবিয়্যিন (خاتم النبين)-এর অর্থ হলো আখিরান্নাবিয়্যিন (اخيرالنبين) অর্থাৎ শেষ নবী। আর ‘নবী’ শব্দটি ‘রাসূল’ শব্দের চেয়ে ব্যাপক (যা রাসূলকে ও সমন্বিত করে)

অতএব, সমস্ত পয়গম্বরগণই নবী ছিলেন। সুতরাং উল্লিখিত আয়াতে যে বলা হয়েছে মুহাম্মদ খাতামান্নাবিয়্যিন অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.) নবীদের সর্বশেষ নবী এবং তার পর না কোন নবী আসবে, না কোন রাসূল কিংবা না কোন কিতাবের অধিকারী; না অন্য কেউ।

انّ هذا القران يهدي للّتي هي اقوم

এই কোরআন সর্বশ্রেষ্ঠ পথ নির্দেশ করে। নিঃসন্দেহে এমতাবস্থায় অন্য কোন কর্মসূচীর প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না ( সূরা ইসরা : ৯) ।

হাদীসের দৃষ্টিতে নবুওয়াতের পরিসমাপ্তি

খাতামিয়্যাতের ব্যাপারটি ইসলামী সনদসমূহে এতটা বর্ণিত হয়েছে যে, ইসলামী বিশ্বাসমূহের একটি সুস্পষ্টতর বিষয় বলে পরিগণিত হয়।

এখন আমরা এর কিছু নমুনা সূধী পাঠকবৃন্দের জন্যে তুলে ধরব :

১.স্বয়ং মহানবী (সা.) বলেন : জেনে রাখ, আমার পর কোন নবী আসবে না এবং আমার শরীয়তের পর অন্য কোন শরীয়ত নেই। (মোস্তাদরাক, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৬২)

২.ইমাম বাকের (আ.) বলেন : মহান আল্লাহ্ তোমাদের কিতাবের মাধ্যমে সকল কিতাবকে ও তোমাদের নবীর মাধ্যমে সকল নবীর শেষ রেখা ও যবনিকা টেনেছেন (উসূলে কাফি, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৭৭)।

৩.আলী (আ.) বলেন : মহান আল্লাহ্ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সকল রাসূলের পর পাঠিয়েছেন এবং তাঁর মাধ্যমেই ওহীর পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন (নাহজুল বালাগা )।

৪.মহানবী (সা.) আলী (আ.) বলেন : আমার সাথে তোমার সম্পর্ক মূসার সাথে হারুনের সম্পর্কের মত, পার্থক্য শুধু এটুকু যে, আমার পর কোন নবী আসবে না (কামিল, ইবনে আসির, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৭৮)।

৫.হযরত রেযা (আ.) বলেন : হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শরীয়াত কিয়ামত পর্যন্ত বিলুপ্ত হবে না এবং অনুরূপ কিয়ামত পর্যন্ত তার পর আর কোন নবী আসবেন না (উয়ূনু আখবারুর রেযা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮০)।

এছাড়া অন্যান্য অসংখ্য হাদীস বিদ্যমান যেগুলো হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর খাতামিয়্যাত ও ইসলামের চিরন্তনতার এবং ইসলামের পরিপূর্ণতা ও সত্যতার প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে।

এ দীনের বিষয়বস্তুর পূর্ণাঙ্গতা ও সমুন্নত ভাবার্থ এবং এর বিধানের বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা, এর চিরন্তনতা ও নিত্য নতুনতার নিশ্চয়তা প্রদান করে, যার ফলে তা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যহত থাকবে।

অতএব, কতই না উত্তম যে, সে দীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্যে চেষ্টা করব এবং সকলকে এ পরিপূর্ণ ও সামগ্রিক দীন থেকে লাভবান হতে আহবান করব।