মহানবী (সা.)-এর জন্ম কালিন অলৌকিক ঘটনাবলী

জাহেলিয়াতের কালো মেঘ সমগ্র আরব উপদ্বীপের ওপর ছায়া মেলে রেখেছিল। অসৎ ও ঘৃণ্য কার্যকলাপ,রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-বিগ্রহ,লুটতরাজ ও সন্তান হত্যা সব ধরনের নৈতিক গুণের বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল। তাদের জীবন-মৃত্যুর মধ্যকার ব্যবধান মাত্রাতিরিক্তভাবে সংক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতে সৌভাগ্যরবি উদিত হলো এবং সমগ্র আরব উপদ্বীপ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মোপলক্ষে আলোকোজ্জ্বল হয়ে গেল। আর এ পথেই একটি অনগ্রসর জাতির সৌভাগ্যের ভিত্তিও স্থাপিত হলো। অনতিবিলম্বে এ নূরের বিচ্ছুরণে সমগ্র জগৎ আলোকোদ্ভাসিত হলো এবং সমগ্র বিশ্বে এক সুমহান মানব সভ্যতার ভিত্তিও নির্মিত হয়ে গেল।

সাধারণ সীরাত রচয়িতাগণ ঐকমত্য পোষণ করেন যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) হাস্তি বর্ষে  অর্থাৎ ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ই রবিউল আউয়াল (কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে ১২ই রবিউল আওয়াল) জন্মগ্রহণ করেছিলেন।  ৮৩ হিজরির এই দিনে তাঁর পবিত্র বংশধর বা আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর আস সাদিক (আ.)-ও জন্মগ্রহন করেন ।

এই দুই মহা মানবের জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে জানাই মোবারকবাদ ও শুভেচ্ছা ।

প্রত্যেক মহামানব ও মনীষীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় গভীরভাবে অধ্যয়ন করা উচিত। কখনো কখনো কোন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এতটা মহান ও ব্যাপক যে,তাঁর জীবনের সমস্ত অধ্যায়,এমনকি তাঁর শৈশব ও মাতৃস্তন্য পান করার সময়কালের প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হয়। যুগের প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গ,সমাজের নেতৃবৃন্দ ও সভ্যতার কাফেলার অগ্রবর্তীদের জীবন সাধারণত আকর্ষণীয়,সংবেদনশীল ও আশ্চর্যজনক পর্যায় ও দিক সম্বলিত। তাঁদের জীবনের প্রতিটি ছত্র যেদিন তাঁদের ভ্রুণ মাতৃজঠরে স্থাপিত হয় সেদিন থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রহস্যাবৃত। আমরা বিশ্বের মহামানবদের শৈশব ও বাল্যকাল অধ্যয়ন করলে দেখতে পাই যে,তা আশ্চর্যজনক ও অলৌকিক বিষয়াদি দিয়ে ভরপুর। আর আমরা যদি এ ধরনের বিষয় বিশ্বের সেরা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মেনে নিই তাহলে মহান আল্লাহর প্রিয় নবী ও ওলীদের ক্ষেত্রে এতদসদৃশ বিষয়াদি মেনে নেয়াও খুব সহজ হবে।

পবিত্র কোরআন হযরত মূসা (আ.)-এর শৈশব ও বাল্যকাল অত্যন্ত রহস্যময় বলে ব্যাখ্যা করেছে এবং এ প্রসঙ্গে বলেছে : মূসা (আ.) যাতে জন্মগ্রহণ করতে না পারে সেজন্য ফিরআউন সরকারের নির্দেশে শত শত নিষ্পাপ শিশুর শিরোচ্ছেদ করা হয়েছিল। মূসা (আ.)-এর জন্মগ্রহণ ও এ পৃথিবীতে আগমনের সাথেই মহান আল্লাহর ঐশী ইচ্ছা জড়িত হয়েছিল বিধায় শত্রুরা তাঁর ক্ষতিসাধন তো করতে পারেই নি,বরং তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও (ফিরআউন) তাঁর প্রতিপালনকারী ও পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিল। পবিত্র কোরআন এরশাদ করেছে : “আমরা মূসার মাকে ওহী করেছিলাম যে,সন্তানকে একটি বাক্সে রেখে সমুদ্রে ফেলে দাও,তাহলে সমুদ্রের তরঙ্গ ওকে মুক্তির সৈকতে পৌঁছে দেবে। আমার ও তার শত্রু তার প্রতিপালন করবে;আমি শত্রুর বুকে তার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধের উদ্ভব ঘটাব। আর এভাবে আমি পুনরায় তোমার সন্তানকে তোমার কাছেই ফিরিয়ে দেব।”

মূসার বোন ফিরআউনের দেশে গিয়ে বলল,“আমি এক মহিলার সন্ধান দেব যে আপনাদের প্রিয় এ শিশুটির লালন-পালনের দায়িত্ব নিতে পারে। তাই ফিরআউন-সরকারের পক্ষ থেকে মূসার মা তাদের (ফিরআউনের) প্রিয় শিশুর (মূসার) লালন-পালনের দায়িত্বভারপ্রাপ্ত হলেন।”(সূরা ত্বাহা : ৪১-৪৩)

হযরত ঈসা (আ.)-এর মাতৃগর্ভে বিকাশ,জন্মগ্রহণ এবং লালন-পালনকাল হযরত মূসা (আ.)-এর চেয়েও অধিকতর আশ্চর্যজনক। পবিত্র কোরআন হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম ও শৈশব কাল বর্ণনা করে বলেছে,“ঈসার মা মরিয়ম নিজ সম্প্রদায় থেকে পৃথক হয়ে গেলেন। পবিত্র আত্মা (জিবরাইল) মানুষের আকৃতি ধারণ করে তাঁর সম্মুখে প্রকাশিত হলেন এবং তাঁকে সুসংবাদ দিলেন যে,আপনাকে একটি পবিত্র সন্তান দানের জন্য আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে।” মরিয়ম তখন আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন,“কেউ আমাকে স্পর্শ করে নি এবং আমিও তো ব্যভিচারিণী নই।” আমাদের দূত তখন বললেন,“এ কাজ মহান আল্লাহর কাছে অত্যন্ত সহজ।”পরিশেষে মহান আল্লাহর নির্দেশে ঈসা মসীহর নূর হযরত মরিয়মের গর্ভে স্থাপিত হলো। প্রসববেদনা তাঁকে খেজুর গাছের দিকে নিয়ে গেল। তিনি তাঁর নিজ অবস্থার ব্যাপারে দুঃখভারাক্রান্ত ছিলেন। আমরা বললাম,“খেজুর গাছ বাঁকাও,তাহলে তাজা খেজুর নিচে পড়বে।” সন্তান জন্মগ্রহণ করলে মরিয়ম নবজাতক সন্তানসহ নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসলেন। আশ্চর্যান্বিত হয়ে জনগণের মুখের ভাষা যেন থেমে গিয়েছিল। এরপর মরিয়মের উদ্দেশ্যে তীব্র প্রতিবাদ,আপত্তি ও অসন্তোষের ঝড় উঠেছিল। মরিয়মকে পূর্বেই মহান আল্লাহ্ নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে করে তিনি বুঝিয়ে দেন যে,তারা যেন এই শিশুকে তাদের সকল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে। তারা বলেছিল,“যে দুগ্ধপোষ্য শিশু দোলনায় শায়িত সে কি কথা বলতে সক্ষম?” তখন হযরত ঈসা (আ.) ঠোঁট খুলে বলে উঠলেন,“আমি মহান আল্লাহর বান্দা (দাস)। তিনি আমাকে কিতাব (ঐশী গ্রন্থ) দিয়েছেন এবং আমাকে নবীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।”(সূরা মরিয়ম : ১৮-৩২)

পবিত্র কোরআন,তাওরাত ও হযরত ঈসার অনুসারিগণ যখন এ দু’মহান উলূল আযম নবী সংক্রান্ত যাবতীয় উল্লিখিত বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান করে তখন ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মোপলক্ষে যেসব আশ্চর্যজনক বিষয় ঘটেছিল সে সব ব্যাপারে বিস্মিত হওয়া এবং সেগুলোকে ভাসাভাসা ও অগভীর বলে বিবেচনা করা অনুচিত। আমরা হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহে দেখতে পাই :

মহানবীর জন্মগ্রহণের মুহূর্তে সম্রাট খসরুর প্রাসাদের দ্বারমণ্ডপ (ايوان) ফেটে গিয়েছিল এবং এর কয়েকটি স্তম্ভ ধসে পড়েছিল। ফারস প্রদেশের অগ্নি উপাসনালয়ের প্রজ্বলিত অগ্নি নিভে গিয়েছিল। ইরানের সাভেহর হ্রদ শুকিয়ে গিয়েছিল। পবিত্র মক্কার প্রতিমালয়সমূহে রক্ষিত মূর্তি ও প্রতিমাসমূহ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তাঁর দেহ থেকে নূর (আলো) বের হয়ে তা আকাশের দিকে উত্থিত হয়েছিল যার রশ্মি ফারসাখের পর ফারসাখ (মাইলের পর মাইল) পথ আলোকিত করেছিল। সম্রাট আনুশিরওয়ান ও পুরোহিতগণ অতি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দর্শন করেছিলেন।

মহানবী (সা.) খতনাকৃত ও নাভি কর্তিত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন :

الله أكبر و الحمد لله كثيرا سبحان الله بكرة و أصيلا

“আল্লাহ্ মহান,সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর,সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করছির।”

এ সব বিষয় ও তথ্য সকল মৌলিক নির্ভরযোগ্য হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। (তারিখে ইয়াকুবী,২য় খণ্ড,পৃ. ৫;বিহারুল আনওয়ার,১৫তম খণ্ড,পৃ. ২৪৮;সীরাতে হালাবী,১ম খণ্ড, পৃ. ৬৪) হযরত মূসা ও হযরত ঈসার ব্যাপারে যে সব বিষয় আমরা বর্ণনা করেছি সেগুলো বিবেচনায় আনলে এ ধরনের ঘটনাসমূহ মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে সন্দেহ করার কোন অবকাশ থাকে না।

এখন প্রশ্ন করা যায় যে,এ ধরনের অলৌকিক ও অসাধারণ ঘটনাবলীর প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই বা কি ছিল? এ প্রশ্নের জবাবে সংক্ষেপে অবশ্যই বলতে হয় : যেমনভাবে আমরা আলোচনা করেছি ঠিক তেমনি এ ধরনের অস্বাভাবিক ও অলৌকিক ঘটনাবলী কেবল মহানবী (সা.)-এর সাথেই বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট নয়,বরং অন্যান্য নবী-রাসূলের জন্মগ্রহণের সাথেও সম্পর্কযুক্ত ছিল। পবিত্র কোরআন ছাড়াও অন্য সকল জাতি,বিশেষ করে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টান জাতির ইতিহাস তাদের নিজেদের নবীদের ব্যাপারে এ ধরনের বহু অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করেছে।

এ ছাড়াও এ ধরনের ঘটনাবলী ঐ সব অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শাসকের অনুভূতিকে জাগ্রত করে যারা বিভিন্ন জাতিকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে। এ সব অত্যাচারী ক্ষমতাধর শাসক এ সব ঘটনা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করে নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ হবে যে,কি হয়েছিল যে,একজন বৃদ্ধা রমণীর মাটি নির্মিত ঘরে চির ধরে নি,অথচ সম্রাট খসরু পারভেজের রাজপ্রাসাদের বৃহৎ বৃহৎ স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছিল? ইরানের ফারস প্রদেশের অগ্নিমন্দিরের আগুন (অগ্নি প্রজ্বলিত থাকার) সকল উপকরণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও কেন নিভে গিয়েছিল,অথচ তখন সব জিনিসই স্ব স্ব স্থানে বহাল ছিল? তারা এ ধরনের ঘটনার কারণ কি হতে পারে সে ব্যাপারে যদি চিন্তা-ভাবনা করত তাহলে বুঝতে পারত এ সব ঘটনা মূর্তিপূজার যুগের অবসান সম্পর্কে এবং খুব শীঘ্রই যে সকল শয়তানী শক্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে সে ব্যাপারেও সুসংবাদ প্রদান করছে।

মূলনীতিগতভাবে ঐ একই দিনে ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনাবলী যে অত্যাচারী শাসকদের উপলব্ধি ও শিক্ষাগ্রহণের কারণ হতেই হবে এমনটি বোধ হয় জরুরী নয়,বরং যে ঘটনাটি কোন এক বছরে সংঘটিত হয়েছে তা বছরের পর বছর শিক্ষণীয় হতে পারে এবং তার কার্যকারিতা বহাল থাকতে পারে;আর এতটুকুই যথেষ্ট।

মহানবী (সা.) যে রাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ঠিক এ রকমই। কারণ এ সব ঘটনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ঐ সব মানুষের অন্তরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দেয়া ও মনোযোগ সৃষ্টি করা যারা মূর্তিপূজা,অন্যায় ও জুলুমের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল।

মহানবীর রিসালাত বা নবুওয়াতী মিশনের সমসাময়িক জনগোষ্ঠী এবং এর পরবর্তী প্রজন্মসমূহ এমন একজন মানুষের আহবান শুনতে পাবে যিনি তাঁর সকল শক্তি প্রয়োগ করে মূর্তিপূজা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। যখন তারা তাঁর জীবনের প্রথম দিকের ঘটনাসমূহ অধ্যয়ন করবে তখন প্রত্যক্ষ করবে যে,এ ব্যক্তির জন্মগ্রহণের রাতে এমন সব ঘটনা ঘটেছিল যা তাঁর দাওয়াহ্ বা প্রচার কার্যক্রমের সাথে পূর্ণ সংগতিশীল। স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের ঘটনার একই সাথে সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি আসলে তাঁর সত্যবাদী হওয়ারই নিদর্শনস্বরূপ বলে তারা গ্রহণ করবে এবং এ কারণে তারা তাঁর প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করবে।

এ ধরনের ঘটনাবলী হযরত ইবরাহীম,হযরত মূসা,হযরত ঈসা ও হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মতো মহান নবীদের জন্মগ্রহণের সময় সংঘটিত হওয়া তাঁদের নবুওয়াত ও রিসালাতের যুগে ঐ সব অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার চেয়ে কোন অংশে কম নয়;আর এ সব কিছু আসলে মহান আল্লাহর ঐশী কৃপা থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে এবং মানব জাতির হেদায়েত ও তাদেরকে মহান নবীদের দীন প্রচার কার্যক্রমের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যই সংঘটিত হয়েছে।