ইসলাম এবং বিশ্বজনীন শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন

বিশ্বব্যাপী শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন মানব জাতি সমাজবদ্ধ জীবনের শুরু থেকেই লালন করে এসেছে। ঐতিহাসিক পর্যালোচনা এবং ধর্মগ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন থেকে এ বিষয়টির সত্যতা নির্ণয় করা যায়। প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে যেমন এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দানের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়,তেমনি আধুনিক সমাজেও শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা বিশেষভাবে পরিদৃষ্ট হয়। তবে পূর্বে যেমন এরূপ মূল্যবোধ কেবল দার্শনিকরাই পোষণ করতেন,বর্তমানে তা অনেকটা সর্বজনীনতা লাভ করেছে এবং দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের পরিমণ্ডল পেরিয়ে সাধারণের পর্যায়ে পৌঁছেছে। শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি থেকে উৎসারিত। এ কারণেই পবিত্র কুরআন হযরত আদম (আ.) থেকে সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত সকল নবী প্রেরণের উদ্দেশ্য যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সে কথা বলেছে। এ ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব শুধু নবীদেরই নয়; বরং সকল মানুষের “নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সাথে দিয়েছি কিতাব (ঐশী গ্রন্থ) ও ন্যায়নীতি (মানদণ্ড) যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। (সূরা হাদীদ : ২৫)।

কিন্তু মানব-সমাজে সকল সময় একদল লোক ছিল যারা এ শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক ছিল। মানব ইতিহাসে কখনও একক ব্যক্তি,কখনও এক বংশ বা গোত্র,কখনও এক দল ও গোষ্ঠী,আবার কখনও এক রাষ্ট্র বা কয়েকটি রাষ্ট্র সমগ্র মানব জাতির শান্তিকে বিঘ্নিত করেছে এবং শোষণ ও বঞ্চনার মাধ্যমে অন্যদের ওপর জুলম ও অবিচার চাপিয়ে দিয়েছে। সার্বিক দৃষ্টিতে চিন্তা করলে এরূপ ব্যক্তি,গোষ্ঠী ও শাসকরাই ইতিহাসের সকল পর্যায়ে মানব জাতির চালিকাশক্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং মানব জাতিকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল এ অবস্থা কি পৃথিবীর প্রলয় দিবস পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে এবং মানব জাতি কি কখনই তার কাঙ্ক্ষিত বিষয় অর্জনে সক্ষম হবে না? তারা কি কখনই এমন শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে না যেখানে কোনরূপ অন্যায়-অবিচার থাকবে না? এ বিষয়টি নির্ভর করে মানব সমাজ শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে নিজের অস্তিত্ব ও মর্যাদার জন্য কতটা প্রয়োজনীয় মনে করেছে ও এ বিষয়ে কতটা সচেতন হয়েছে,সেই সাথে বর্তমান অবস্থা পরিবর্তন করে তাদের কাঙ্ক্ষিত সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাদের মধ্যে কতটা উদ্যোগ ও কর্মতৎপরতা সৃষ্টি হয়েছে তার ওপর। এর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ যে উপাদান ও নিয়ামক আবশ্যক তা হল এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং এটি বাস্তবায়নের জন্য সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্ব।

নিঃসন্দেহে এ ধরনের বিশ্বজনীন সমাজ প্রতিষ্ঠা কেবল এমন ঐশী নেতৃত্বের মাধ্যমেই সম্ভব যিনি মানব সমাজকে বস্তুগত ও অবস্তুগত পূর্ণতা ও উৎকর্ষের শীর্ষে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অধিকারী হবেন এবং ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে ও আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করবেন। কারণ,যে ব্যক্তি এমন জ্ঞানের অধিকারী নয় কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটির সম্মুখীন এবং নৈতিকভাবেও পরিশুদ্ধ নয় সে কখনই সঠিক পরিকল্পনা প্রদান ও (ব্যক্তিগত,গোত্রীয়,জাতীয় ও দলীয়) স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠতে সক্ষম নয়। যদি শাসক নিজেই ন্যায়পরায়ণ ও পরিশুদ্ধ না হয় তার পক্ষে সমাজে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সুতরাং বিশ্বব্যাপী শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য একদল উপযুক্ত ও পরিশুদ্ধ ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন যারা ন্যায়ের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করবে ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করবে যদিও এটি তাদের স্বার্থের প্রতিকূলে হয়। কুরআন উল্লিখিত বৈশিষ্ট্য সম্বলিত নেতৃত্বকে ‘উলুল আমর’ (সূরা নিসা : ৫৯) এবং এরূপ নেতৃত্বের সহযোগীদের ‘ইবাদুন সালেহ’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৫) বলে অভিহিত করেছে। আর যে বিধি-বিধান ও পরিকল্পনা বিশ্বে বাস্তবায়িত হলে বিশ্বব্যাপী শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে বলে উল্লেখ করেছে তা হল ইসলামী শরীয়ত।

সামগ্রিক এ বিষয়টিকে মহান আল্লাহ্ নিম্নোক্ত আয়াতে এভাবে বর্ণনা করেছেন: ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ্ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে,তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন,যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদের এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দীনকে যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং অবশ্যই তাদের ভয়ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার দাসত্ব করবে এবং আমার সঙ্গে কোন কিছুকে অংশী করবে না...।’ (সূরা নূর : ৫৫)

কোন জীবন ব্যবস্থা কেবল তখনই তাকে বিশ্বজনীন বলে দাবি করতে পারে যখন তার বিশ্বদৃষ্টি নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন হবে। একমাত্র ইসলামই এমন সর্বজনীনতা ও নিরপেক্ষতা দাবি করতে পারে। কারণ,ইসলাম তার বিশ্বজনীনতার বৈশিষ্ট্য তাওহীদ (একত্ববাদ) থেকে লাভ করেছে। তাওহীদ এমন একটি বিষয় যার আহ্বান মানুষের বর্ণ,ভাষা,জাতি,দেশ ও বংশ-গোত্রের পরিমণ্ডল পেরিয়ে মানুষের মৌলিক ও সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে- যেমন বুদ্ধিবৃত্তি,সহজাত ঐশী ও সত্যমুখী প্রবণতা (ফিতরাত),নৈতিকতা,মানবিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ এবং আত্মিক উৎকর্ষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। যেহেতু তাওহীদী বিশ্বদৃষ্টি মহান আল্লাহকে সকল কিছুর সৃষ্টা ও পরিচালক বলে জানে যিনি সকল মানুষকে একই উপাদান থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তাদের সকলকে একই দৃষ্টিতে দেখেন এবং তাদের পূর্ণতার সকল দিক সম্পর্কে অবহিত,সেহেতু তিনি এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সর্বোত্তম জীবন ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছেন। ন্যায়ভিত্তিক এ জীবন ব্যবস্থা পূর্ণরূপে বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.) এবং তার বংশধারার পবিত্র ইমামদের ওপর অর্পণ করেছেন। তারা তাদের সমগ্র জীবনে এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় রত ছিলেন। কিন্তু সত্যের বিরোধীদের অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের কারণে তারা তা বাস্তবায়নে সক্ষম হননি।

তবে অন্যায়-অবিচার পৃথিবীতে চিরস্থায়ী কোন বিষয় নয়; বরং পৃথিবীর পরিসমাপ্তি ঘটবে সত্য ও ন্যায়ের চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে।এ প্রতিশ্রুতি মহান আল্লাহ এভাবে প্রদান করেছেন: ‘তিনিই (আল্লাহ্) সেই সত্তা যিনি তার রাসূলকে সঠিক পথ ও সত্য ধর্মসহ প্রেরণ করেছেন যেন তাকে সকল ধর্মের (জীবন ব্যবস্থা) ওপর বিজয়ী করেন যদিও মুশরিকরা অসন্তুষ্ট হয় ।’ (সূরা সাফ : ৯) মহান আল্লাহর এ প্রতিশ্রুতি রাসূল (সা.)-এর বংশধারারই এক ব্যক্তি কর্তৃক সমগ্র বিশ্বে বাস্তবায়িত হবে। রাসূল (সা.) এ সম্পর্কে বলেন : ‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না আমার আহলে বাইত থেকে এক ব্যক্তি ক্ষমতার অধিকারী হবে যে পৃথিবীকে ন্যায় ও সুবিচারে পূর্ণ করবে ।’ (মুসনাদে আহমাদ)। সকল মুসলমানের দৃষ্টিতে তিনি হলেন ইমাম মাহদী (আ.)। পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ তারই আগমনের প্রতীক্ষায় রয়েছে। মহান আল্লাহ্ তার আগমনকে ত্বরান্বিত করুন।

(সূত্র : প্রত্যাশা, ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা)