নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কিত কতিপয় বিষয়
- প্রকাশিত হয়েছে
-
- সূত্র:
- প্রত্যাশা, ২য় বর্ষ, ১ম, সংখ্যা
সংকলন : মো. আশিফুর রহমান
সমাজ ও জাতিসমূহের উন্নতি বিধানের ক্ষেত্রে আচার-আচরণ একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। মানুষের অন্তরের সুখ-শান্তি ও আনন্দ বিধানের ক্ষেত্রে আচার-আচরণের যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তা কেউ অস্বীকার করে না। উন্নত আচার-আচরণ এত প্রয়োজনীয় যে,যে সব জাতি ধর্মে বিশ্বাস করে না,তারাও একে সম্মান করে এবং এটা বিশ্বাস করে যে,জীবনের এই কঠিন পথে অগ্রগতি সাধন করতে হলে তাদেরকে অবশ্যই কিছু নৈতিকতার বিধি মেনে চলা দরকার। আমরা উন্নত বিশ্বের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই যে,সেখানে ধর্ম-কর্ম পালন করাকে তারা খুব প্রয়োজনীয় বিষয় বলে মনে করে না; কিন্তু নীতি-নৈতিকতার অনেক বিষয় তারা খুব কঠোরভাবে মেনে চলে। যেমন তারা মিথ্যা কথা বলে না,প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না,যে সব কাজের দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করা হয় সেগুলো যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়,সময়ের গুরুত্ব দেয় ইত্যাদি। আর এরকম কিছু কিছু নীতি মেনে চলার ফলেই আজ তারা উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পেরেছে।
ইসলাম মানুষকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসাবে ঘোষণা করেছে এবং তার ওপর অনেক দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তারা আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং একই সাথে অন্য মানুষের সাথে আচরণের ক্ষেত্রেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য চেষ্টা করবে। কারণ,সমাজে বসবাসের জন্য অন্যের সাথে আচরণের দিকটিই প্রধান হয়ে দেখা দেয়। তাই আচরণের গুরুত্ব অপরিসীম- কি আমাদের জীবন পথে চলার জন্য,কি আখেরাতে মুক্তির জন্য। উত্তম আচরণ সম্পর্কে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন : `সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্যসমূহ যা আমার উম্মতকে বেহেশতে দাখিল করবে তা হচ্ছে আল্লাহর ভয় ও উত্তম আচরণ।’১
মহানবী (সা.) আরও বলেছেন : ﹼ `তোমাদের মধ্যে সেই সর্বাপেক্ষা উত্তম যার নৈতিক চরিত্র ও আচরণ ভাল।’২
অন্য একটি হাদীসে এসেছে : `তোমাদের মধ্যকার সর্বাধিক চরিত্রবান ব্যক্তিই সর্বোত্তম।’৩
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন : `সেই মুমিনই ঈমানে পূর্ণতর যে চরিত্রে অধিকতর উত্তম।’ ৪
উত্তম চরিত্র সম্পর্কে আলী (আ.)-কে উপদেশ দিতে গিয়ে মহানবী (সা.) বলেন : `হে আলী! উত্তম চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত তিনটি কাজ : যে ব্যক্তি তোমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে তার সাথে সম্পর্ক গড়বে,যে তোমাকে বঞ্চিত করেছে তাকে তুমি দান করবে আর যে তোমার প্রতি অন্যায় করেছে তাকে তুমি ক্ষমা করবে।’৫
মানুষের সাথে আচরণ সম্পর্কে হযরত আলী (আ.) বলেন : `মানুষের সাথে দেখা হলে এমন আচরণ করবে যেন তোমার মৃত্যুতে তারা কাঁদে এবং তুমি বেঁচে থাকলে তোমার দীর্ঘায়ু কামনা করে।’৬
রাসূলুল্লাহ্ মন্দ স্বভাবের অধিকারীদের ঘৃণা করতেন। তিনি বারবার বলেছেন : `মন্দ স্বভাব হচ্ছে খারাপ এবং বদ স্বভাবের অধিকারী লোক তোমাদের মধ্যে নিকৃষ্ট।’৭
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন : `আল্লাহ তা`আলার নিকট সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট হল সেই ব্যক্তি যার অশালীন ও অসভ্য আচরণ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ তাকে পরিত্যাগ করে।’৮
নম্র ব্যবহার সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন : `নিশ্চয় আল্লাহ হলেন নম্র ও দয়ার্দ্র,তিনি প্রতিটি বিষয়ে নম্রতা ও দয়া প্রদর্শন পছন্দ করেন।’৯
তিনি আরও বলেন : `যে ব্যক্তি নম্র স্বভাব বঞ্চিত,সে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।’১০
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আচরণ সম্পর্কে হযরত আনাস ইবনে মালিক বলেন : `নবী (সা.) যখন কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কথা বলতেন তখন সে মুখ ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর মুখ ফিরিয়ে নিতেন না এবং যখন কারও সাথে মুসাফাহা করতেন,তখন সে তার হাত সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত তিনি তার নিকট থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিতেন না। তাঁর সাথে উপবিষ্ট লোকদের দিকে পা ছড়িয়ে দিয়ে তাঁকে কখনও বসতে দেখা যায়নি।’১১
রাসূল (সা.) বলেন, `নিঃসন্দেহে নম্রতা মানুষের মর্যাদাকে সুউচ্চ করে। সুতরাং বিনয়ী হও যেন আল্লাহ তোমাদের সম্মান দান করেন।’১২
রাসূল (সা.) আরও বলেন : ﹺ `ভদ্রলোকের অলংকার হল বিনয় বা নম্রতা।’১৩
উত্তম আচরণ এবং সদা হাসি-খুশী থাকার উপকারও রয়েছে। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন : `দয়া ও নম্র ব্যবহার জমিনকে অধিক ফলনশীল করে এবং মানুষের আয়ু বৃদ্ধি করে।’
বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ ড. স্যান্ডারসন এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন : `রোগের প্রতিরোধ ও নিরাময়ের ব্যাপারে দয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা উপাদান। অনেক ঔষধ রোগমুক্তির সাথে সাথে অবাঞ্ছিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে,অথচ দয়া স্থায়ী রোগমুক্তি ঘটিয়ে দেহের সকল অংশকে রোগমুক্ত করে। পরোপকারিতা দেহের সকল শক্তিকে প্রভাবিত করে,ভাল আচরণকারীদের রক্ত সঞ্চালন অত্যন্ত চমৎকার এবং শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াও অপেক্ষাকৃত ভাল।’১৪
উত্তম আচরণের গুরুত্ব রয়েছে অনেক বিষয়েই। তা শুধু শরীরকে সুস্থ রাখে না,বরং এর পাশাপাশি জীবনোপকরণও বৃদ্ধি করে। আলী (আ.) বলেছেন : `সদাচরণ প্রচুর পরিমাণে জীবনোপকরণ বৃদ্ধি এবং বন্ধুত্বের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাকে বাড়িয়ে দেয়।’
সমাজবিজ্ঞানী এস,মার্দিন তাঁর গ্রন্থে এ কথাগুলো উল্লেখ করেছেন : `আমি এমন একজন রেস্ট্রুরেন্ট ম্যানেজারকে জানি যিনি তাঁর অমায়িক ব্যবহারের ফলে অনেক সম্পদশালী ও জনপ্রিয় হয়েছেন। আমি জানতে পারলাম যে,পর্যটকরা অনেক দূর- দূরান্ত থেকে তাঁর রেস্ট্রুরেন্টে আসত,এজন্য যে,ঐ রেস্ট্রুরেন্টের নির্জনতা ও আনন্দদায়ক পরিবেশ তাদের কাছে অত্যন্ত ভাল লাগত। খদ্দেররা রেস্ট্রুরেন্টে থাকাকালীন ম্যানেজার তাদেরকে এমন সানন্দ সম্ভাষণ জানাতেন,যা তারা আর কোথাও দেখতে পায়নি। বস্তুতপক্ষে অন্যান্য রেস্ট্রুরেন্টে যেখানে অভিযোগের পর অভিযোগ করেও সাড়া পাওয়া যেত না এমন পরিস্থিতি এ রেস্ট্রুরেন্টে কেউ কখনও হতে দেখেনি। এই রেস্ট্রুরেন্টের কর্মচারীরা খদ্দেরদের সাথে স্বাভাবিক ক্রেতা- বিক্রেতার সম্পর্কের ঊর্ধ্বে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলত। কর্মচারীরা অত্যন্ত হাসি-খুশী সহকারে খদ্দেরদের সেবাযত্নের প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদর্শন করত। এ বিশেষ মনোযোগ অতিথিদের প্রতি তাদের প্রীতি ও শুভেচ্ছার মনোভাব হতে উদ্ভত। কর্মচারীরা তাদের অতিথিদের সাথে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলত যা তাদের মধ্যে পুনরায় এখানে আসার আগ্রহ সৃষ্টির মধ্যেই সীমিত থাকত না; বরং তারা তাদের বন্ধুদেরও এখানে নিয়ে আসত।’১৫
ইমাম সাদিক (আ.) প্রফুল্লতাকে মানুষের বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার একটি লক্ষণ হিসাবে গণ্য করেছেন। তিনি বলেছেন : `মানুষের মধ্যে যাদের পরিপূর্ণ যুক্তিজ্ঞান ও বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রয়েছে তারাই হল সর্বোত্তম আচার- আচরণের অধিকারী।’১৬
রাসূল (সা.) বলেন : `সচ্চরিত্র তার অধিকারীকে সারাদিন রোযা রাখা ও সারারাত জেগে ইবাদাত করা ব্যক্তির সমান মর্যাদায় পৌঁছে দেয়।’১৭
উত্তম ব্যবহার সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
وَلَا تَسْتَوِي الْحَسَنَةُ وَلَا السَّيِّئَةُ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ
`আর ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা রয়েছে,সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো হয়ে যাবে।’১৮
একদিন ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বসেছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁকে অপমান করতে লাগল। এ লোকটির নাম ছিল হাসান মুসান্না। ইমাম সাজ্জাদ লোকটির কথার প্রতি গুরুত্ব দিলেন না। লোকটি চলে যাবার পর তিনি তাঁর অনুসারীদের বললেন : `আমি চাই যে,আপনারা আমার সঙ্গে গিয়ে শুনবেন যে,লোকটিকে আমি কী জবাব দেই।’ ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর অনুসারীরা তদুত্তরে বললেন : `আমরা আপনার সঙ্গে যাব যদিও আমরা চেয়েছিলাম যে,আপনি বা আমরা লোকটিকে উচিত জবাব দেই।’
ইমাম পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত পড়তে পড়তে লোকটির গৃহাভিমুখে রওয়ানা হলেন :
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّـهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّـهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَىٰ مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ
`এবং যারা কোন অশ্লীল কাজ করে বসে অথবা নিজেদের প্রতি অবিচার করে,অতঃপর আল্লাহকে স্মরণ করে নিজেদের গুনাহসমূহের ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ব্যতীত গুনাহ মার্জনাকারী কে আছে? এবং তারা জেনে-বুঝে যা করেছে তার ওপর গোঁয়ারতুমি করে না।’১৯
এ কথা শোনার পর ইমামের সাথীরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে,ইমাম সাজ্জাদ (আ.) লোকটিকে কিছু সদয় কথাই বলবেন। ইমাম সাজ্জাদ (আ.) হাসান মুসান্নার বাড়ি পৌঁছলেন এবং বললেন : `তাকে বলুন,এ হচ্ছে আলী ইবনুল হুসাইন।’ লোকটি এ কথা শুনে তাঁর সাথে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসল। সে নিশ্চিতভাবে মনে করেছিল যে,ইমাম সাজ্জাদ তার কৃত কাজের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এসেছেন। হাসান মুসান্না এসে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইমাম সাজ্জাদ বললেন : `হে আমার ভাই! আপনি আমার কাছ গিয়ে কিছু কথাবার্তা বলেছেন। আপনি আমার সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন তা যদি সত্যই আমার মধ্যে থাকে,আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি,আর যদি এমন কোন বিষয়ে আপনি আমাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে থাকেন যে ব্যাপারে আমি নিরপরাধ তাহলে আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য ক্ষমা চাইছি।’
লোকটি ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর কথা শোনার পর তাঁর কপাল চুম্বন করল এবং বলল : `প্রকৃতপক্ষে আমি এমন সব বিষয়ে আপনাকে অভিযুক্ত করেছিলাম যে ব্যাপারে আপনি নিরপরাধ। এ কথাগুলোর মধ্যে আমার অবস্থানের বর্ণনাই রয়েছে।’২০
ইমাম সাজ্জাদের কথাগুলো লোকটির অন্তরকে নাড়া দিল ও তা তার ব্যথার উপশম ঘটাল। তার দুঃখ ও অনুশোচনার মনোভাব তার অঙ্গভঙ্গির মধ্যে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হল।
চরিত্র গঠন সম্পর্কিত মতবাদ
চরিত্র গঠন সম্পর্কে দু’ ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে। প্রথম মতবাদ হল মানুষের চরিত্র খনির মতো। একে পরিবর্তন করা যায় না। মানুষ যে বংশে জন্মগ্রহণ করে সে বংশের বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে থাকে। অর্থাৎ বংশই মানুষের চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে।
দ্বিতীয় মতবাদ : এ মতবাদে বলা হয়েছে যে,মানুষের চরিত্র পরিবর্তন করা যায়। যদি কাউকে যথোপযুক্ত পরিবেশ দেয়া যায় এবং তাকে উন্নত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়া যায় তাহলে তার চরিত্রে পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ বিষয়টি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আর এ মতবাদটিই সঠিক।
মানুষের প্রবৃত্তি
মানুষের প্রবৃত্তি দুই প্রকার। যথা : পাশবিক ও আধ্যাত্মিক।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : `আল্লাহ্ ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন আকল (বিবেক-বুদ্ধি) দিয়ে এবং প্রবৃত্তি ও রাগ দেননি; পশুকে দিয়েছেন প্রথমটি ছাড়া শুধু প্রবৃত্তি ও রাগ,কিন্তু মানুষকে আকল এবং প্রবৃত্তি ও রাগ দিয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। মানুষ যদি তার প্রবৃত্তি ও রাগকে আকল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে সে ফেরেশতাদের থেকেও উৎকৃষ্ট হতে পারবে।’
মানুষকে তার প্রবৃত্তির সঠিক ব্যবহার করতে হবে। প্রবৃত্তির কম ব্যবহারের ফলে তার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়,আবার প্রবৃত্তির অধিক ব্যবহারের ফলে সে পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়। তাই মানুষকে দৈহিক ও আত্মিক উভয় দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
জিহাদে আকবার (বড় যুদ্ধ)
তাবুকের যুদ্ধ হতে মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর মহানবী (সা.) বললেন : `তাদেরকে আমার শুভেচ্ছা যারা ছোট যুদ্ধ হতে ফিরে এসেছে,কিন্তু বড় যুদ্ধ এখনও বাকী।’ সবাই জিজ্ঞেস করল : `সেটা কোন্ যুদ্ধ?’ তিনি বললেন : `সেটা হল নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’
নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেন বড় যুদ্ধ?
নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে বড় যুদ্ধ বলার পেছনে নিম্নের কারণগুলো উল্লেখ করা যায় :
১. মানুষের অস্তিত্বে সবসময় একটি পরস্পরবিরোধী শক্তি কাজ করে : একটি ভাল, একটি মন্দ। তাকে সব সময় মন্দের মোকাবিলা করতে হয়।
২. মানুষের জীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই জিহাদ চলে।
৩. এই জিহাদই মানুষের পরিপূর্ণতা লাভের প্রক্রিয়া। কারণ,সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বের মাধ্যমেই মানুষ চূড়ান্তভাবে বিকশিত হয়। দ্বন্দ্বের উপস্থিতি না থাকলে বিকাশ সম্ভব নয়।
৪. ছোট জিহাদে অনেক সময় মানুষ গনীমতের মালের লোভে অংশগ্রহণ করে এবং বিজয়ের মাধ্যমে তা লাভ করে। কিন্তু বড় জিহাদে এ সব কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা একেবারেই অমূলক।
৫. এ জিহাদের জয়-পরাজয়ই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে।
সচ্চরিত্রের আলামত
মানুষ নিজের দোষ-ত্রুটি সম্বন্ধে সব সময় সচেতন থাকে না। তাই যখন সামান্য সাধনা করে বড় বড় পাপকর্ম ছেড়ে দেয় তখন মনে করতে থাকে যে,সে চরিত্রবান হয়ে গেছে। এখন সাধনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু চরিত্রবান হওয়া আসলেই কঠিন কাজ। আর একজন প্রকৃত মুমিন মানেই সত্যিকার চরিত্রবান।
পবিত্র কুরআনে এ মুমিনদের চরিত্রের আলামত সম্পর্কে বলা হয়েছে :
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ ﴿١﴾ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ ﴿٢﴾ وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ ﴿٣﴾ وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ ﴿٤﴾ وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ ﴿٥﴾ إِلَّا عَلَىٰ أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ
`মুমিনগণ সফলকাম হয়েছে,যারা নামাযে বিনম্র,যারা অসার ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকে,যারা যাকাত দানে সক্রিয়,যারা নিজেদের যৌন অংগকে সংযত রাখে নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসিগণ ব্যতীত...।’২১
অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে :
التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنكَرِ وَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللَّـهِ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ
`তারা তওবাকারী,উপাসনাকারী,(আল্লাহর) প্রশংসাকারী,তাঁর পথে সফরকারী,রুকুকারী,সেজদাকারী,সৎকর্মের নির্দেশ দানকারী,অসৎ কর্ম হতে নিষেধকারী,আল্লাহর সীমারেখার সংরক্ষণকারী; (হে রাসূল!) বিশ্বাসীদের তুমি (বেহেশতের) সুসংবাদ দাও।’২২
সূরা ফুরকানে মহান আল্লাহ মুমিনদের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে :
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا (63) وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا (64) وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا (65) إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا (66) وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِفُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا (67) وَالَّذِينَ لَا يَدْعُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ
`রহমান’ এর বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে,তখন তারা বলে,`সালাম’; এবং তারা রাত্রি অতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দণ্ডায়মান থেকে; এবং তারা বলে,হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি বিদূরিত কর,এর শাস্তি তো নিশ্চিত বিনাশ,’ নিশ্চয়ই তা অস্থায়ী ও স্থায়ী আবাস হিসাবে নিকৃষ্ট। এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করেন না,কার্পণ্যও করে না; বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়। এবং তারা আল্লাহর সাথে কোন ইলাহকে ডাকে না। আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না।...’২৩
যদি মানুষের অবস্থা এ আয়াতগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় তবে তার সচ্চরিত্র অর্জিত হয়েছে বুঝতে হবে। আর যদি কোন সঙ্গতি না থাকে,তবে এটি অসচ্চরিত্রের আলামত। রাসূলে কারীম (সা.) মুমিনের অনেক গুণ বর্ণনা করে সচ্চরিত্রের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। যেমন :
`মুমিন সে-ই যে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করে,যা নিজের জন্য পছন্দ করে।’
মহানবী (সা.) বলেন :
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান রাখে সে যেন অবশ্যই তার মেহমানকে সম্মান করে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান রাখে সে যেন অবশ্যই আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান রাখে সে যেন ভাল কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’২৪
মহানবী (সা.) আরও বলেন :
`যাকে পুণ্য কাজ আনন্দিত করে এবং কুকর্ম দুঃখিত করে সেই মুমিন।’
কেউ কেউ সচ্চরিত্রের সকল আলামতকে একত্রে সন্নিবেশিত করেছেন এবং বলেছেন : সচ্চরিত্রবান সেই ব্যক্তি যে অধিক লজ্জাশীল,অধিক উপদেশদাতা,স্বল্পভাষী,অধিক কর্মী,সত্যবাদী,সাধু,গম্ভীর,ধৈর্যশীল,কৃতজ্ঞ,সন্তুষ্ট,সহনশীল,উত্তম সঙ্গী,পুণ্যবান,স্নেহশীল,প্রফুল্ল এবং যে কুভাষী,অপবাদদাতা,হিংসুটে,বিদ্বেষ পরায়ণ ও কৃপণ নয়,শত্রুতা আল্লাহর নিমিত্তেই করে এবং সন্তুষ্টি ও মহব্বতও আল্লাহর ওয়াস্তেই করে। এগুলো দিয়ে সচ্চরিত্রবান বোঝা যায়।
সচ্চরিত্রের সর্বোচ্চ নমুনা রাসূলুল্লাহ (সা.)
রাসূল মিষ্টভাষী ছিলেন এবং ছোট-বড়,ধনী-দরিদ্র সবার সাথে কোমল আচরণ করতেন। রাসূলের কোমলতা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলছেন :
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ
(হে রাসূল!) আল্লাহর পক্ষ থেকে এ এক অনুগ্রহ যে,তুমি তাদের প্রতি দয়ার্দ্রচিত্ত হয়েছ। যদি তুমি রুক্ষ মেজাজ ও কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতে তবে অবশ্যই তারা তোমার চারপাশ থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত।২৫
মহান আল্লাহ্ ঘোষণা করছেন :
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
রাসূলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।২৬
আর মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেই বলেছেন :
মহৎ গুণাবলীর পূর্ণতা প্রদান করার জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি।২৭
আর মহানবী (সা.)-এর দেয়া প্রতিটি বিষয় গ্রহণ করার জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে :
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।২৮
উপরিউক্ত আয়াত ও রাসূলের বাণী অনুযায়ী আমাদের চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের জন্য রাসূলের শরণাপন্ন হতে হবে। তিনি যাঁদেরকে অনুসরণ করতে বলেছেন তাঁদের শরণাপন্ন হতে হবে। তাঁদের জীবন থেকে আমরা শিক্ষা নেব। তাঁরা যেভাবে চলতে বলেছেন সেভাবে চলব। আর যেভাবে চলতে নিষেধ করেছেন সেভাবে চলা থেকে বিরত থাকব। তবেই আমরা সফলকাম হতে পারব।
নবী (সা.)-এর খাদেম আনাস ইবনে মালিক প্রায়ই বলতেন : আমি দশ বছর নবীর খেদমতে নিয়োজিত ছিলাম। এ সময়ের মধ্যে আমি যা কিছু করতাম বা না করতাম তিনি আমাকে কখনও উহ্ পর্যন্ত বলেননি।২৯
মহানবী (সা.)-এর জীবনের একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। রাসূলুল্লাহ (সা.) একদিন একটি নাজরানী চাদর পরিধান করে পথ চলছিলেন। এক বেদুঈন পথিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চাদর ধরে এমন জোরে টান দিল যে,চাদরের পাড় তাঁর ঘাড়ে বসে গেল। বেদুঈন বলল : `হে মুহাম্মাদ! তোমার কাছে আল্লাহর যে সম্পদ আছে তা থেকে আমাকেও দাও।’ রাসূল সেই বেদুঈনের দিকে তাকালেন এবং স্মিত হেসে তাকে কিছু দান করলেন।
যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা চরমে পৌঁছে গিয়েছিল তখনও তিনি মহান আল্লাহর কাছে এভাবে দো`আ করতেন :
`হে আল্লাহ! আমার কওমকে ক্ষমা করুন,তারা জানে না।’
অনেকে বলেন,এ দো`আটি রাসূল (সা.) উহুদের যুদ্ধের পর করেছিলেন।
আর রাসূল (সা.)-এর এসব গুণের কারণেই মহান আল্লাহ বলেছেন :
وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ
`নিঃসন্দেহে তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী।’৩০
ইমামদের জীবনেও আমরা তাঁদের উন্নত নৈতিক চরিত্রের অসংখ্য উদাহরণ দেখি। একবার ইমাম আলী (আ.) তাঁর গোলামকে ডাকলেন। সে জবাব দিল না। এরপর তিনি দ্বিতীয়বার ও তৃতীয়বার ডাকলেন। কিন্তু গোলামের পক্ষ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অতঃপর তিনি গোলামের কাছে গিয়ে দেখলেন যে,সে শুয়ে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : তুমি কি আমার ডাক শোননি?’ গোলাম বলল : `শুনেছি।’ তিনি বললেন : `তাহলে কেন জবাব দিলে না?’ গোলাম বলল : `আপনি আমাকে প্রহার করবেন- এ ভয় আমার মোটেই ছিল না। তাই অবহেলা বশত জবাব দিইনি।’ হযরত আলী বললেন : `যাও আমি তোমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত করে দিলাম।’৩১
চরিত্রবান হওয়া ও নিজেকে চেনা
নিজেদের চরিত্রবান করে গড়ে তোলার জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে। আমরা আমাদের জ্ঞান অনুযায়ী আচরণ করব,এটিই স্বাভাবিক। তবে সবসময় আমরা সব কিছু সঠিকভাবে করতে পারি না। আবার অনেক অন্যায় আচরণও করে ফেলি অসচেতনতার কারণে। এগুলো পরিহার করা উচিত। আর এজন্য আমাদের প্রয়োজন রয়েছে নিজেদের চেনার।
প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক ধার্মিক ব্যক্তির বাসনা এটি হওয়া উচিত যে,নিজের দোষ সম্পর্কে জেনে নিজেকে সংশোধন করা। নিজের দোষ সম্পর্কে জানার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া যায়। যেমন-
১. আমরা যদি নীতি-নৈতিকতার শিক্ষক বা আলেমগণের শরণাপন্ন হই তবে তাঁরা আমাদের চরিত্রের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে অবহিত করতে পারবেন।
২. নিজের কোন ধর্মপরায়ণ,সত্যবাদী ও জ্ঞানী বন্ধুকে নিজের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা।
৩. শত্রুর মুখ থেকে নিজের দোষ জেনে নেয়া। কেননা,শত্রুরা ছিদ্রান্বেষী হয়ে থাকে। এটি বললে অত্যুক্তি হবে না যে,মানুষ এ ব্যাপারে বন্ধুর তুলনায় ছিদ্রান্বেষী শত্রু দ্বারা অধিক উপকৃত হতে পারে। কেননা,বন্ধু খোশামোদের কারণে দোষ প্রকাশ করে না। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যার বিষয় হচ্ছে মানুষ জন্মগতভাবে শত্রুর উক্তিকে মিথ্যা ও হিংসাপ্রণোদিত জানে; কিন্ত অন্তর্চক্ষুর অধিকারী ব্যক্তিরা শত্রুর কথা দ্বারা উপকৃত হন।
৪. মানুষের সাথে মেলামেশা করে তাদের মধ্যে যে খারাপ দিকগুলো দেখা যায় সেগুলো নিজের মধ্যে আছে কিনা সেটা নিয়ে চিন্তা করা। কেননা,মুমিনরা পরস্পরের আয়না। তাই অপরের দোষ দেখে তারা নিজেদের দোষ জেনে নেয়। তারা জানে যে,সব মানুষের প্রকৃতি কাছাকাছি হয়ে থাকে। যে দোষ একজনের মধ্যে থাকে,তার মূল অপরের মধ্যে থাকতে পারে।
এভাবে আমরা আমাদের দোষ চিনতে পারব। আমাদের মধ্যে একটি প্রবণতা রয়েছে যে,যদি কেউ আমাদের ভুল ধরিয়ে দেয় তাহলে আমরা তাকে অপছন্দ করা শুরু করি। তাকে নিজের শত্রু বলে মনে করি। এটি মোটেও উচিত নয়। কারণ,অসচ্চরিত্র সাপ বা বিচ্ছুর মত। যদি কেউ আমাদের বলে,তোমার কাপড়ে বিচ্ছু রয়েছে তাতে আমাদের উচিত তার কাছে ঋণী হয়ে ও তার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে বিচ্ছুকে কাপড় থেকে আলাদা করে মেরে ফেলা। অথচ কিয়ামতের সেই কঠিন আযাবের মোকাবিলায় একটি বিচ্ছুর কামড় কোন কিছুই না। তাই কেউ আমাদের দোষ ধরিয়ে দিলে তার ওপর আমাদের খুশী হওয়া উচিত। অথচ আমরা খুশী না হয়ে উল্টো সেই ব্যক্তির দোষ অন্বেষণে উঠেপড়ে লাগি। আমাদের আসলে এমন ব্যক্তিকেই বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। ঐ ব্যক্তিকে নয় যে আমার ভাল-মন্দ প্রতিটি কাজের প্রশংসা করবে।৩২
চারিত্রিক ত্রুটি দূর করার উপায়
প্রকৃতপক্ষে চারিত্রিক ক্রটি-বিচ্যুতি হল এক প্রকার মানসিক রোগ। এ রোগ দূর করার জন্য তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত রোগটি কী ধরনের তা নিরূপণ করা। দ্বিতীয়ত রোগের উৎস কোথায় তা নির্ণয় করা। তৃতীয়ত রোগ নিরাময়ের উপায় নির্ধারণ করা।
রোগ নিরাময়ের উপায়
১. ভাল পরিবেশে অবস্থান : পরিবেশের প্রভাবে মানুষ সংশোধিত হতে পারে। মানুষ ভাল পরিবেশ পেলে ভাল হয়ে গড়ে ওঠে আর খারাপ পরিবেশ পেলে উত্তম চরিত্রের ব্যক্তিও পরিবর্তিত হয়ে যায়।
২. সৎ সঙ্গ লাভ : খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করে সবসময় সৎ সঙ্গ লাভের জন্য চেষ্টা করতে হবে। একটি হাদীসে বলা হয়েছে : `মানুষের দীন তার বন্ধু ও সহগামীর দ্বারাই নির্ধারিত হয়।’
৩. খারাপ পরিবেশ থেকে হিজরত : খারাপ পরিবেশ ছেড়ে ভাল পরিবেশে হিজরত করতে হবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
وَمَنْ يُهَاجِرْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يَجِدْ فِي الْأَرْضِ مُرَاغَمًا كَثِيرًا وَسَعَةً
`এবং যে কেউ আল্লাহর পথে হিজরত করবে সে পৃথিবীতে বহু (নিরাপদ) স্থান ও (ধর্মপালন ও কর্মের ক্ষেত্রে) প্রশস্ততা লাভ করবে।’৩৩
আমরা ধারাবাহিকভাবে নৈতিক চরিত্রের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা রাখার চেষ্টা করব। এ প্রবন্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় কথা বলা বা জিহ্বার ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হল।
জিহ্বার ব্যবহার বা কথা বলা
কারও পরিধেয় পোশাক থেকে মানুষ হয়ত তার সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা পেতে পারে,কিন্তু তার সম্পর্কে তাদের চূড়ান্ত অনুভূতি অর্জিত হবে তার কথা বলা থেকে। তাই কথা বলার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কথা বলা থেকেই মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
আলী (আ.) বলেছেন :
`মানুষ তার কথার আড়ালে অবস্থান করে।’৩৪
আলী (আ.) বলেন,`হে লোকসকল! মানুষের দশটি গুণ তার জিহ্বা দ্বারা প্রকাশ পায় : ১. সাক্ষী,যে তার ভেতরের বার্তা প্রকাশ করে,২. বিচারক,যে লোকজনের মধ্যে বিচার করে,৩. মুখপাত্র,যে উত্তর প্রদান করে,৪. সুপারিশকারী,যার দ্বারা মনোবাঞ্ছা প্রার্থনা করা হয়,৫. প্রশংসাকারী,যে সবকিছুকে পরিচয় করিয়ে দেয়,৬. নির্দেশদানকারী,যে ভাল কাজে নির্দেশ দেয়,৭. উপদেশদাতা,যে মন্দ থেকে বারণ করে,৮. সমবেদনা প্রকাশকারী,যা দ্বারা দুঃখ-কষ্টসমূহ সহজ হয়। ৯. প্রশংসিত মাধ্যম,যা দ্বারা বিদ্বেষ দূর হয়,১০. মনোহর,যা থেকে কানসমূহ পরিতৃপ্তি লাভ করে।’৩৫
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) কম কথা বলাকে পরিপক্ব বুদ্ধির নিদর্শন বলেছেন। তিনি বলেন :
`যখন আকল পরিপক্ব হবে তখন কথা কমে যাবে।’৩৬
আলী (আ.) আরও বলেন,`জ্ঞানী লোকের জিহ্বা হৃদয়ের পেছনে,আর মূর্খ লোকের হৃদয় জিহ্বার পেছনে।’৩৭
মানুষের সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল কথা বলা। যদি কথা না বলা হয় তাহলে কোন কাজই সম্ভব নয়। মানুষ যেন তার অনুভূতি অপরের নিকট প্রকাশ করতে পারে,একজন আরেকজনের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে এজন্যই ভাষা দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমেই মানুষ তার চাওয়া-পাওয়া,তার অভাব-অভিযোগ ব্যক্ত করে। কিন্তু অতি জরুরি এ বিষয়টি সম্পাদনের সময় যদি কোন চিন্তা-ভাবনা করা না হয় তাহলেই যত বিপত্তি ঘটে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন :
`হে মানব! নিশ্চয়ই অধিকাংশ ভুল তোমাদের জিহ্বায় (কথায়)।’
অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে : `যে নীরব থাকল,সে নাজাত পেল।’৩৮
কেন এ কথা বলা হয়েছে যে,`অধিকাংশ ভুল তোমার জিহ্বায়’? কারণ,এর ব্যবহার যেহেতু ব্যাপক তাই এতে ভুলের পরিমাণও ব্যাপক। আর এজন্যই সংযত হয়ে কথা বলার জন্য বা কম কথা বলার জন্যই উৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু ভাল কাজের জন্য কথা বলাকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন :
`জিহ্বাকে রক্ষা কর ভাল ছাড়া,তাহলে তুমি শয়তানের ওপর বিজয়ী হবে।’
আলী (আ.) বলেন,`হে লোকসকল! যে ব্যক্তি স্বীয় জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না,সে অনুতপ্ত হয়।’৩৯
ইমাম গাজ্জালী বলেছেন : `বিশটি গুনাহের কারণ হল কথা বলা। আর এগুলো হল :
১. এমন কোন বিষয়ে কথা বলা যে বিষয়ে জ্ঞান নেই
২. অযথা কথা বলা
৩. কোন বাতিল বিষয় নিয়ে কথা বলা
4. তর্ক করা
৫. ঝগড়া করা
৬. বানিয়ে বা অতিরঞ্জিত কথা বলা
৭. অশোভন শব্দ উচ্চারণ করা
৮. অভিশাপ দেয়া
৯. হারাম গান বা কবিতা পাঠ
১০. অতিরিক্ত ঠাট্টা করা
১১. ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও পরিহাস করা
১২. গোপন কথা ফাঁস করে দেয়া
১৩. মিথ্যা ওয়াদা করা
১৪. মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা কসম করা
১৫. পরনিন্দা করা
১৬. কথা লাগানো (চোগলখুরী করা)
১৭. নিফাক (দুই রকম কথা বলা)
১৮. অপাত্রের প্রশংসা
১৯. কোন বাছ-বিচার ছাড়া বা হিসাব ছাড়া কথা বলা
২০. এমন কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা যা তার নিজের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় অথবা অযথা প্রশ্ন করা।
আল্লামা মাকারেম শিরাজী এগুলোর সাথে আরও দশটি বিষয় যোগ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে : ১. অপবাদ দেয়া
২. মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া
৩. আত্মপ্রশংসা করা
৪. অশ্লীল কথা ছড়ানো ও গুজব রটানো
৫. রূঢ় কথা বলা
৬. অযথা পীড়াপীড়ি করা
৭. আক্রমণাত্মক কথা বলা
৮. এমন কারো নিন্দা করা যে নিন্দিত নয়; নন্দিত
৯. অকৃতজ্ঞের মতো কথা বলা
১০. বাতিলের প্রসার করা
শুধু মুখের ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে এতগুলো খারাপ কাজ সংঘটিত হয়। তাই আমাদের কথা বলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার প্রয়োজন রয়েছে।
নীরবতা অবলম্বন
এতে কোন সন্দেহ নেই যে,ভাষা মানুষের জন্য মহান আল্লাহ প্রদত্ত বিরাট সম্পদ। ভাষা একের সাথে অন্যের যোগাযোগের মাধ্যম। এটি জ্ঞানের প্রচার ও মানুষকে হেদায়াত করারও মাধ্যম। মহান আল্লাহর ভাষার দ্বারা অন্যান্য পশুপাখি হতে মানুষকে পৃথক করেছেন। আল্লাহ তা`আলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন :
الرَّحْمَنُ (1) عَلَّمَ الْقُرْآنَ (2) خَلَقَ الْإِنْسَانَ (3) عَلَّمَهُ الْبَيَان
`তিনি রহমান,কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন,মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে কথা বলা শিক্ষা দিয়েছেন।’৪০
কিন্তু যদি মানুষ তার ভাষাকে নিরর্থক কথা,মিথ্যা কথা,তর্ক-বিতর্ক করা,গালিগালাজ করা,উপহাস ও বিদ্রূপ করা,গীবত করা,দোষারোপ করা,রটনা করা,প্রভৃতি থেকে সংরক্ষিত না রাখে তাহলে তা বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। সেজন্য পণ্ডিতগণ আমাদের কেবল দরকারি ক্ষেত্রে কথা বলার উপদেশ দিয়েছেন,নইলে চুপ থাকতে বলেছেন। আর এজন্যই হাদীসে বলা হয়েছে : `যে নীরব থাকল,সে নাজাত পেল।’
কথার প্রকারভেদ
উপকারিতা ও অপকারিতার দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের কথাকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
১. সম্পূর্ণ উপকারী কথা
২. সম্পূর্ণ অপকারী কথা
৩. উপকারী ও অপকারীর মিশ্রণ
৪. উপকারী অপকারী কোনটিই নয়।
ওপরের চারটি ক্ষেত্রের তিনটিতে নীরবতা অবলম্বন করার প্রয়োজন রয়েছে। যেক্ষেত্রে আমরা কথা বলব সেক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত যেন আমাদের কথা কপটতা,কৃত্রিমতা ও বাহুল্যকথন দ্বারা কলুষিত না হয়।
ইসলাম নীরবতা অবলম্বনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। মহানবী (সা.) বলেছেন :
`মহান আল্লাহ তাঁর ওই বান্দার ওপর রহম করুন যে ভাল কথা বলে। সে পুরস্কার পাবে। আর যে নীরবতা অবলম্বন করে সে নিরাপদ থাকে।’
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) হযরত দাউদ (আ.) সম্পর্কে কথা প্রসঙ্গে বলেন : `তিনি তাঁর সন্তানকে বলেছিলেন : হে আমার সন্তান! যদি কথা বলাকে রূপার তৈরি বলে বিবেচনা কর,তাহলে নীরবতা সোনার তৈরি।’৪১
ইমাম রেজা (আ.) বলেন : `প্রজ্ঞাবানের বৈশিষ্ট্য হল ধৈর্য,জ্ঞান ও নীরবতা। নীরবতা প্রজ্ঞার অন্যতম দিক। মানুষের ভালবাসা অর্জন ও বেহেশত লাভের জন্য নীরবতা একটি মাধ্যম অথবা প্রতিটি ভাল কাজের কারণ হল নীরবতা।’৪২
ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,`নীরবতা হল পণ্ডিতদের মূলমন্ত্র। এটি তাদের মূলমন্ত্র যারা অতীত মানুষের জীবন নিয়ে গবেষণা করে এবং যথাযথ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। নীরবতা ইহকালে ও পরকালে উভয় জগতের সুখের চাবিকাঠি। এটি ভুলের প্রতিষেধক। মহান আল্লাহ একে অজ্ঞের জন্য চাদর এবং জ্ঞানীর জন্য অলংকার করেছেন।’
তিনি আরও বলেন : `...তুমি তোমার মুখ বন্ধ রাখ যতটা সম্ভব,বিশেষ করে যখন তুমি আল্লাহ সম্পর্কে কথা বল যা আলোচনা করার জন্য উপযুক্ত শ্রোতা না পাও। এটি বলা হয় হয় যে,রবী ইবনে খাশিম সবসময় একখণ্ড কাগজ তাঁর সামনে রাখতেন এবং সারাদিন যেসব কথা তিনি বলতেন সেগুলো সেখানে লিখতেন। রাত্রিবেলা তিনি এগুলো সতর্কতার সাথে মূল্যায়ন করতেন। তারপর তিনি বলতেন : যে নীরব ছিল সে এখন নিরাপদ। মহানবী (সা.)-এর কিছু সংখ্যক সাহাবী তাঁদের মুখের মধ্যে পাথর পুরে রাখতেন। তাঁরা এগুলো তাঁদের মুখ থেকে তখনই বের করতেন যখন তাঁরা মহান আল্লাহর কথা বলতেন এবং আল্লাহর জন্যই কথা বলতেন।’৪৩
সুতরাং নীরবতা ও কথা বলা যথাক্রমে মানুষের মুক্তি ও ধ্বংসের কারণ হতে পারে।
তবে কথা বলা ও নীরব থাকারও ক্ষেত্র রয়েছে। যেখানে কথা বলা প্রয়োজন সেখানে চুপ থাকা উচিত নয় এবং যেখানে চুপ থাকা প্রয়োজন সেখানে কথা বলা ঠিক নয়। ইরানের বিখ্যাত কবি আমীর খসরু তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন :
`প্রতিটি কথা বলার মুহূর্ত সুখকর
কিন্তু কখনও কখনও নীরবতা আরও মধুর
মুখ বন্ধ রাখা যেন দুশ্চিন্তার দরজা বন্ধ করা,
কারণ,এ পৃথিবী ভাল ও মন্দের গর্ভধারিণী।
কথা বলার জন্য অনুতাপকারী অনেককে আমি দেখেছি
কিন্তু নীরব থাকার জন্য কাউকে অনুতাপ করতে দেখিনি।
বলার চেয়ে শোনা ভাল যদি তুমি চিন্তা কর
দ্বিতীয়টি করে শূন্য যেথায়,প্রথমটি করে পূর্ণ।
যতক্ষণ না তুমি তোমার বক্তব্যের উপযুক্ততা সম্পর্কে হচ্ছ সুনিশ্চিত
কথা বলার জন্য মুখ খোলা নয় কো তোমার উচিত।’
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল : `নীরবতা ও কথা বলার মধ্যে কোনটি উত্তম।’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন : `কথা বলা ও নিশ্চুপ থাকা- উভয়েরই বিশেষ বিশেষ বিপর্যয়কর ক্ষেত্র রয়েছে। কথা বলা নীরব থাকার চেয়ে উত্তম যদি বক্তা তার কথা বলার পর নিরাপদ থাকে।’ তারা জিজ্ঞাসা করল : `কীভাবে এটি সম্ভব?’ তিনি বললেন : `মহান আল্লাহ তাঁর নবী ও মহৎ ব্যক্তিদের নীরব থাকার জন্য প্রেরণ করেননি। তিনি তাঁদের ভাষা ব্যবহারের জন্য প্রেরণ করেছিলেন এবং মানুষ কেবল নীরব থাকার জন্য বেহেশতে প্রবেশ করবে না। আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতাও নীরবতার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে না। নীরবতা দ্বারা আগুন নেভানো যায় না। এসব কাজ কেবল কথা বলার মাধ্যমেই সম্ভব। আমি সূর্যকে চাঁদের সমান বিবেচনা করব না।’৪৪
অধিক কথা বলা বা বাচালতা
স্বাভাবিকভাবেই যে ব্যক্তি বেশি কথা বলে সে সারাদিন কী কথা বলল তার মূল্যায়ন করার জন্য যথেষ্ট সময় পায় না। আর এজন্যই তার কথা ভিত্তিহীন ও ভুল হয়। শ্রোতারা বিরক্ত হয় এবং বক্তা তার কথার বলিষ্ঠতা হারায়।
ইমাম আলী (আ.) এ ব্যাপারে বলেছেন : `অধিক কথা বলা একজন জ্ঞানী ব্যক্তিকে বিপথগামী করতে পারে এবং একজন ধৈর্যশীল ব্যক্তিকে হতাশাগ্রস্ত করে। সুতরাং অধিক কথা বল না,তাহলে তুমি যেমন মানুষকে পীড়া দেবে তেমনি মানুষও তোমাকে অসম্মান করবে।’৪৫
তিনি আরও বলেন : `বাচালতা পরিহার কর। কারণ,তা তোমার ভুল ও একগুঁয়েমি বৃদ্ধি করে।’৪৬
হযরত ঈসা (আ.) বলেছেন : `তোমার কথাকে সোনার মত (মূল্যবান) মনে করবে এবং কথা বলার উপযুক্ত সময় বেছে নেবে যেমন তুমি তোমার সোনা ব্যয়ের জন্য উপযুক্ত জিনিসকে বেছে নাও।’
সুতরাং আমাদের অধিক কথা বলা পরিহার করতে হবে। আর কথা বলার সময় এ বিষয়গুলোর প্রতি অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে : সব সময় উপকারী ও সত্য কথা বলতে হবে এবং সে কথাই বলা প্রয়োজন যা অন্যের জন্য ক্ষতিকর নয়; কারও মনে আঘাত দিয়ে কোন কথা না বলা,এমনকি ঠাট্টাচ্ছলেও কারও অনুভূতিতে আঘাত না করা; পশ্চাতে কারও নিন্দা না করা; যারা অপরের নিন্দা করে তাদের কথা না শোনা; কখনও গালি-গালাজ না করা এবং যে ক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে না যে,কথা বলা উচিত কিনা,সেক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকাই কল্যাণকর। যদি কেউ কোন কথা বলে,তা ভাল-মন্দ যা-ই হোক না কেন,কখনই উদ্ধতভাবে জবাব দেয়া উচিত নয়; বরং তাকে তা বুঝিয়ে বলতে হবে।
তথ্যসূত্র
১. ওয়াসায়েল, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২১
২. আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল বুখারী, ৫ম খণ্ড, হাদীস নং ৫৫৯৪
৩. প্রাগুক্ত, হাদীস নং ৫৬০০
৪. তুহাফুল উকুল
৫. তুহাফুল উকুল
৬. মমতাজ বেগম কর্তৃক প্রকাশিত, জেহাদুল ইসলাম কর্তৃক অনূদিত নাহজ আলবালাঘা, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ১০
৭. নাহজ আল ফাসাহা, পৃ. ৩৩১
৮. আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল বুখারী, ৫ম খণ্ড, হাদীস নং ৫৬৯১
৯. আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সুনান ইবনে মাজা, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং ৩৬৮৯
১০. প্রাগুক্ত, হাদীস নং ৩৬৮৭
১১. প্রাগুক্ত, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নং ৩৭১৬
১২. বিহারুল আনওয়ার, ১৮তম খণ্ড, ৪র্থ অধ্যায়, হাদীস নং ২
১৩. প্রাগুক্ত, ৭৫তম খণ্ড, ৫১তম অধ্যায়, হাদীস নং ১১
১৪. ডন পাবলিকেশন্স কর্তৃক প্রকাশিত আল্লামা সাইয়্যেদ মুসাভী লারী প্রণীত আত্মসংশোধন ও সমাজ সংশোধনের কর্মপন্থা, পৃ. ২৫
১৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬
১৬. ওয়াসায়েল, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০১
১৭. তুহাফুল উকুল
১৮. সূরা হা-মীম আস্-সাজদা : ৩৪
১৯. সূরা আলে ইমরান : ১৩৫
২০. আল্লামা শেখ মুফিদ প্রণীত কিতাবুল ইরশাদ, পৃ. ২৫৭
২১. সূরা মুমিনূন : ১-৬
২২. সূরা তাওবা : ১১২
২৩. সূরা ফুরকান : ৬৩-৬৮
২৪. আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল বুখারী, ৫ম খণ্ড, হাদীস নং ৫৬৯৯
২৫. সূরা আলে ইমরান : ১৫৯
২৬. সূরা আহযাব : ২১
২৭. ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত মুয়াত্তা ইমাম মালিক, ২য় খণ্ড, রেওয়ায়েতনং ৮
২৮. সূরা হাশর : ৭
২৯. ফাযায়েলে খামসাহ্, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৯
৩০. সূরা কালাম : ৪
৩১. মদীনা পাবলিকেশান্স কর্তৃক প্রকাশিত, ইমাম গায্যালী প্রণীত এহইয়াউ উলুমিদ্দীন,৩য় খণ্ড, পৃ. ২৬৫-২৭২
৩২. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫৭-২৫৯
৩৩. সূরা নিসা : ১০০
৩৪. মমতাজ বেগম কর্তৃক প্রকাশিত, জেহাদুল ইসলাম কর্তৃক অনূদিত নাহজ আলবালাঘা, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ১৪৮
৩৫. তুহাফুল উকুল
৩৬. মমতাজ বেগম কর্তৃক প্রকাশিত, জেহাদুল ইসলাম কর্তৃক অনূদিত নাহজ আলবালাঘা, সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী নং ৭১
৩৭. প্রাগুক্ত, বাণী নং ৪০
৩৮. বিহারুল আনওয়ার, ৭৭তম খণ্ড
৩৯. তুহাফুল উকুল
৪০. সূরা রহমান : ১-৪
৪১. উসূলে কাফী, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৪
৪২. প্রাগুক্ত
৪৩. মিসবাহুশ শারীয়াহ
৪৪. বিহারুল আনওয়ার, ৭১তম খণ্ড, পৃ. ২৭৪
৪৫. গুরারুল হিকাম
৪৬. প্রাগুক্ত