সূরা আন'আম;(৪র্থ পর্ব)

সূরা আন'আম; আয়াত ১৫-১৯ (পর্ব-৪)

সূরা আন’আমের ১৫ ও ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ (15) مَنْ يُصْرَفْ عَنْهُ يَوْمَئِذٍ فَقَدْ رَحِمَهُ وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْمُبِينُ

“(হে নবী! আপনি মুশরিকদের) বলুন, আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্য হতে ভয় পাই কেননা, আমি একটি মহাদিবসের শাস্তিকে ভয় করি।"(৬:১৫)

"যার কাছ থেকে ঐদিন এ শাস্তি সরিয়ে নেওয়া হবে, তার প্রতি আল্লাহর রহমত বা অনুকম্পা হবে। এটাই বিরাট সাফল্য।” (৬:১৬)

আগের আয়াতে আল্লাহ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র প্রতি কাফের-মুশরিকদের বিশেষ প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রস্তাবে তারা বিশ্বনবী (সা.)-কে বলেছিল, যদি ইসলামের দাওয়াত দেয়া বন্ধ কর তাহলে তুমি যা যা চাও তার সবই আমরা তোমায় দেব। এ আয়াতে আল্লাহ রাসূল (সা.)-কে বলছেন,  আপনি তাদেরকে বলুন তোমরা আমাকে পার্থিব জীবনের কোনো কোনো উপকরণ দেয়ার কথা বলছ, কিন্তু আমি পরকালের হিসাব-নিকাশকেই ভয় পাই, কারণ, মহান আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালনে আমি যদি বিন্দুমাত্র অবহেলা করি, অথবা আল্লাহর বাণীর কিছু অংশ গোপন করি বা বিকৃত করি তাহলে আমার ওপর মহান আল্লাহর মহাশাস্তি নেমে আসবে যা সহ্য করার ক্ষমতা  আমার নেই।

অবশ্য এটা স্পষ্ট মহানবী (সা.) কখনও আল্লাহর কোনো নির্দেশ অমান্য করেননি বা করার ইচ্ছাও কখনও পোষণ করেননি। তাই এ আয়াতের মূল উদ্দেশ্য হল মুসলমানদেরকে অবশ্যই নানা প্রলোভন ও অন্যদের বা ইসলামের শত্রুদের ওয়াদার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। মুসলমানরা যেন এ ধরনের প্রলোভনের মুখে কিয়ামত বা বিচার দিবস ও আল্লাহর শাস্তির কথা মনে করেন। শাস্তির ভয় তাদেরকে বিচ্যুতি থেকে দূরে রাখার অন্যতম বড় চালিকাশক্তি।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. মহান আল্লাহর শাস্তির বিধান সবার জন্যই সমান। নবী-রাসূলও যদি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করতেন , তবে তারাও শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে পারতেন না।

দুই. খোদায়ী শাস্তির ভয় একটি কাঙ্ক্ষিত ভয় ও যৌক্তিক। তাগুতি ও মানবীয় শক্তিকে ভয় করা উচিত নয়।

তিন. মানুষ সব সময়ই পাপে লিপ্ত হওয়ার বিপদের মুখে রয়েছে, একমাত্র আল্লাহর রহমতই মানুষকে গোনাহ থেকে দূরে রাখে, কিংবা গোনাহর পর তওবা ও ক্ষমার ক্ষেত্র তৈরি করে।

সূরা আন’আমের ১৭ ও ১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (17) وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْخَبِيرُ

“আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোন কষ্ট দেন, তবে তিনি ছাড়া তা অপসারণকারী কেউ নেই। পক্ষান্তরে যদি তোমার মঙ্গল করেন, তবে তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।" (৬:১৭)

"তিনিই পরাক্রান্ত নিজ বান্দাদের উপর। তিনিই জ্ঞানময়, সর্বজ্ঞ।” (৬:১৮)

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) যদি ইসলামের দাওয়াত বা প্রচার বন্ধ করে দেন তাহলে তিনি পার্থিব সুযোগ-সুবিধা যা-ই চান না কেন তাঁকে তা দেয়া হবে বলে কাফের-মুশরিকরা প্রলোভন দেখিয়েছিল তা গত পর্বের আলোচনায় আমরা উল্লেখ করেছি। এ দুই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, হে নবী! আপনি তাদের বলুন, সব কিছুই আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ। তিক্ত ও মিষ্ট ঘটনাসহ যা-ই ঘটুক না কেন তাঁরই ইচ্ছা বা অনুমতিতেই ঘটে থাকে। আল্লাহ যদি কারো ক্ষতি করতে চান তাহলে তা এড়ানোর সাধ্য কারো নেই। একইভাবে তিনি যদি কাউকে ব্যাপক ও অপরিমেয় মাত্রায় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিতে চান তাহলে তাতেও বাধা সৃষ্টির ক্ষমতা কারো নেই। তাই কাফের-মুশরিকরা আপনাকে প্রলুব্ধ করার জন্য যেসব ওয়াদা দিচ্ছে তার কোনো মূল্যই নেই। তাই আল্লাহ যদি না চান তাহলে তোমাদের প্রতিশ্রুত কোনো সুযোগ-সুবিধাই আমি পাব না। আর তোমরা আমাকে যত হুমকিই দাও না কেন-আল্লাহ না চাইলে তোমরা আমার কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না।

এ দুই আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার :

এক. আল্লাহই সব আশা-ভরসার আসল উৎস হওয়া উচিত। ভয়ও কেবল তাঁকেই করতে হবে। কারণ, আল্লাহই সব বিষয়ের ওপর কর্তৃত্বশীল।

দুই. আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করা উচিত নয়, বরং একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর অসীম উচ্চ অবস্থানকেই ভয় করা উচিত। কারণ, মহান আল্লাহর ক্ষমতার কাছে অন্য সবার ক্ষমতাও তুচ্ছ।

তিন. শক্তি বা ক্ষমতা তখনই মূল্যবান হয় যখন তার সাথে থাকে প্রজ্ঞা বা কৌশলের প্রয়োগ। এ আয়াতে আল্লাহর ক্ষমতার পাশাপাশি তাঁর মহাপ্রজ্ঞা ও কৌশলের কথাও বলা হয়েছে।

সূরা আন’আমের ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ أَيُّ شَيْءٍ أَكْبَرُ شَهَادَةً قُلِ اللَّهُ شَهِيدٌ بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَذَا الْقُرْآَنُ لِأُنْذِرَكُمْ بِهِ وَمَنْ بَلَغَ أَئِنَّكُمْ لَتَشْهَدُونَ أَنَّ مَعَ اللَّهِ آَلِهَةً أُخْرَى قُلْ لَا أَشْهَدُ قُلْ إِنَّمَا هُوَ إِلَهٌ وَاحِدٌ وَإِنَّنِي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ

“আপনি জিজ্ঞেস করুনঃ সর্ববৃহৎ সাক্ষ্যদাতা কে? বলে দিনঃ আল্লাহ আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী। আমার প্রতি এ কোরআন অবর্তীর্ণ হয়েছে-যাতে আমি তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে এ কোরআন পৌঁছে সবাইকে ভয় প্রদর্শন করি। তোমরা কি সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহর সাথে অন্যান্য উপাস্যও রয়েছে? আপনি বলে দিনঃ আমি এরূপ সাক্ষ্য দেব না। বলে দিনঃ তিনিই একমাত্র উপাস্য; আমি অবশ্যই তোমাদের শিরক থেকে মুক্ত।” (৬:১৯)

মক্কার একদল মুশরিক মহানবী (সা.)’র কাছে এসে তাঁকে বলেন যে, কেউই তো আপনার রেসালাত ও নবুওয়্যাতের পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে না, এমনকি আসমানি কিতাব বা ঐশী ধর্মগ্রন্থধারী ইহুদি ও খ্রিস্টানরাও আপনাকে নবী ও রাসূল হিসেবে মেনে নেয়নি। আপনি অন্ততঃ একজন ব্যক্তিকে দেখান যে আপনার রেসালাতের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। তাদের এই দাবির জবাবে নাজেল হয় এই পবিত্র আয়াত। এ আয়াতে বলা হয়েছে, তোমাদের দৃষ্টিতে কে সবচেয়ে বড় সাক্ষী? আল্লাহর চেয়ে বড় সাক্ষী কি কেউ হতে পারে যিনি কুরআন নাজেল করেছেন?  আর এই কুরআনই মুহাম্মাদ (সা.)’র রেসালতের বড় সাক্ষ্য, কারণ, এ মহাগ্রন্থের ভাষা ও বিষয়বস্তু মানুষের চিন্তার ফসল হতে পারে না।

আয়াতের পরবর্তী অংশে বিশ্বনবী (সা.)’র রেসালাতের উদ্দেশ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, কোনো পদ বা সম্পদ আমার লক্ষ্য নয়, তোমাদের কাছে এ ধরনের কিছুই আমি চাই না, আমি যা চাই তা হল তোমরা মূর্তি-পূজা থেকে বিরত হও এবং তাগুতি বা জালেম ও খোদাদ্রোহী শক্তির আনুগত্য করো না। আর কেবল আল্লাহরই এবাদত কর। এ আয়াতের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এখানে ইসলামের চিরন্তন এবং বিশ্বজনীন মিশন ও সব মানুষের প্রতি এ ধর্মের আহ্বান তুলে ধরা হয়েছে।

তাই এ আয়াতে এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে বিশ্বনবী (সা.)’র আহ্বান কেবল আরব জাতির জন্য বা বিশেষ কোনো অঞ্চল বা বিশেষ যুগ ও সময়ের মধ্যেই সীমিত নয়। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) কুরআনের “ইন্নামা হুয়া ইলাহুন ওয়াহিদুন” বা “একমাত্র তিনিই এক ইলাহ” শীর্ষক আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, যদি আল্লাহ ছাড়াও আরো অনেক খোদা বা একাধিকা খোদা থাকত তাহলে তারাও জনগণের কাছে নবী-রাসূল পাঠাতেন। অথচ দেখা গেছে যুগে যুগে যত নবী-রাসূল এসেছেন তাঁরা সবাই  এক আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছেন।    

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. ইসলামের নবী (সা.) যে সত্যিকারের নবী এবং রাসূল পবিত্র কুরআনই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

দুই. বিশ্বনবী (সা.)’র রেসালাত চিরন্তন ও বিশ্বজনীন। তার রেসালাত সব যুগ, অঞ্চল ও সব শ্রেণীর মানুষের জন্য প্রযোজ্য।

তিন. বিশ্বনবী (সা.)’র পর মুমিন ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত। কারণ, মানুষের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে না দেয়া পর্যন্ত দায়িত্ব বা কর্তব্য পালনের নির্দেশ তাদেরকে দেয়া যায় না।

চার. ধর্মের প্রতি ও ঐশী নেতা বা নবী-রাসূলের প্রতি আনুগত্য করা এবং এই আনুগত্যের ঘোষণা দেয়া জরুরি। একইসাথে অংশীবাদীতা বা শির্ক এবং অংশীবাদীদের প্রতি ঘৃণা ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করাও জরুরি।