হযরত মুসা (আ.)'র মু'জিজার কাছে ফেরাউনের জাদুকরদের পরাজয়

মুসা (আ.)'র দেখানো দু'টি মু'জেজার প্রতিক্রিয়ায় ফেরাউন ও তার দরবারের লোকেরা জাদুকরদের জড়ো করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা জাদুর মাধ্যমে মুসা (আ.) ও তার ভাই হারুনকে অপদস্ত করে জনগণের ওপর তাদের প্রভাব কমানো বা বিলুপ্ত করা সম্ভব হবে বলে ভেবেছিল।

কিন্তু অবশেষে এখন থেকে তিন হাজার বছরেরও আগে চৌঠা জ্বিলহজ্ব তারিখের ঘটনায় মহান নবী ও বিশিষ্ট রাসূল হযরত মুসা (আ.) জাদুকরদের ওপর বিজয়ী হয়েছিলেন। এক প্রকাশ্য জনসভা ও উৎসবের আয়োজন করে দুর্ধর্ষ জালেম ফেরাউন সুদক্ষ জাদুকরদের মাধ্যমে মুসা নবীকে অপমানিত করতে চেয়েছিল এবং বিজয়ের ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল।

মুসা (আ.) প্রথমে জাদুকরদের ও ফেরাউনকে আবারও একত্ববাদ মেনে নেয়ার এবং মূর্তি পূজা পরিহারের আহ্বান জানান। এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করা হলে তার যে মারাত্মক পরিণতি হবে সে সম্পর্কেও তিনি তাদের সতর্ক করে দেন। তাদের জাদু বা ভেল্কিবাজিকে তিনি আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের প্রচেষ্টা বলেও অভিহিত করেন।

ফেরাউন ১২ হাজার দক্ষ জাদুকর জড় করেছিল। তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ৫ জাদুকরের নাম ছিল শামউন, সাদুর, গাদুর, খতাত ও মুসাফা। শামউন অন্য চারজনের গুরু ছিল। তারা মিশরে পৌঁছে শুনে যে হযরত মুসা (আ.) ঘুমানোর সময় তাঁর লাঠিটি অজগর হয়ে তাঁকে পাহারা দেয়। ফলে তারা সাহস হারিয়ে ফেলে। কারণ, জাদুকররা ঘুমিয়ে পড়ার পর তাদের জাদুর কার্যকারিতা থাকে না।

এ জাদুর প্রতিযোগিতা হয়েছিল মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়া শহরে। সেখানে স্থানীয় অধিবাসীরা, ফিরাউনের সভাসদ ও সেনা-সামন্তরা উপস্থিত ছিল। ফেরাউন নিজে একটি মঞ্চে বসে এ দৃশ্য দেখছিল।

জাদুকররা হযরত মুসা নবীকে (আ.) অলৌকিক বিষয় প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা তাঁর পক্ষ থেকে শুরু করার আহ্বান জানালে তিনি সবিনয়ে তাদেরকেই জাদুর কসরত আগে দেখাতে বলেন। তারা মাটিতে দণ্ড ও দড়ি রেখে সম্মোহনী জাদু-বিদ্যার প্রয়োগ শুরু করে, ফলে উপস্থিত জনতার মনে হল যে প্রাণহীন দণ্ড ও রশিগুলো হঠাৎ করে সাপের মত নড়েচড়ে এগিয়ে আসছে। তাপ ও আলোর প্রভাবেই এমনটি হতো। ফেরাউন ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মুখে এ সময় ছিল বিজয়ের হাসি।

এ অবস্থায় আল্লাহর নির্দেশে হযরত মুসা (আ.) তাঁর লাঠি নিক্ষেপ করলে সেটা এক বিশাল অজগরে পরিণত হয় এবং তা জাদুকরদের যাদুবিদ্যার সব কল-কাঠি গিলে ফেলে। ফলে পরিস্থিতি ও পরিবেশ পাল্টে যায়। অনেকেই ভয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে। ফেরাউন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এমন অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং ক্ষমতা হারানোর প্রমাদ গুণতে থাকে। আরো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো

এই প্রকাশ্য অলৌকিক কাণ্ড দেখে জাদুকররা বুঝতে পারে যে এটা কোনো চোখে ধুলো দেয়ার ঘটনা বা চালাকি নয়, বরং ঐশী বাস্তবতা। তাই তারা সিজদায় অবনত হয় এবং প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে স্বীকার করে যে মুসা (আ.) সত্যিই আল্লাহর নবী ও তাঁর প্রতি ঈমান আনে। অপদস্ত ফেরাউন তাদের হাত পা কেটে ফেলার ও গাছের সঙ্গে লোহার বড় বড় পেরেক দিয়ে বিদ্ধ করে হত্যার হুমকি দেয়া সত্ত্বেও জাদুকররা ঈমানের ওপর অবিচল থাকে।

আল্লাহর কি মহিমা! সেদিন সকালেও জাদুকররা ছিল কাফির বা অবিশ্বাসী। জোহরের আগেই তারা জাদু দেখায়। জোহরের সময় তারা ঈমান আনে। আর আসরের সময় ক্রুদ্ধ ফেরাউনের নির্দেশে তাদের হাত-পা কাটা হয়। মাগরিবের সময় তাদের ক্রুশ-বিদ্ধ করা হলে তারা বেহশতবাসী হয়।

জাদুকররা ঈমান আনায় মিশরের বহু মানুষ ঈমান এনেছিল। তাদের সবাইকেই উজির হামানের পরামর্শে বন্দি করেছিল ফেরাউন। এরপর ঘটেছিল ফেরাউনের দলবলের ওপর নানা আজাব বা খোদায়ি শাস্তি আসার পালা। বনি-ইসরাইলের বন্দিদের মুক্ত করে হযরত মূসা (আ.) তাদের নিজের সঙ্গে নিয়ে যান। এ সময় ফেরাউন তাদের ধাওয়া করতে গিয়ে দলবলসহ সাগরে ডুবে মারা যায়।

ফেরাউন চারশো বছর বেঁচে ছিল। সে কখনও রোগাক্রান্ত হয়নি। তার খাবার ছিল বড় জাতের কিশমিশ। ফেরাউন প্রতিরক্ষা প্রাচীর বেষ্টিত দুর্গ-শহরে থাকত। সে একটি বাঘ তার কাছে রাখত। কিন্তু মুসা নবীর আগমনের পর ওই বাঘ ভয়ে পালিয়ে যায়। হযরত মুসা (আ.) ফেরাউনের শহরের যেই দরজাতেই পৌঁছতেন সেই দরজাগুলো আপনাআপনিই খুলে যেত। ফেরাউনের প্রাসাদের দরজায় পৌছলে প্রহরীরা তাঁকে ঢুকতে না দিয়ে বলেছিল, “আল্লাহ আর কাউকে পাননি, তোমাকেই রাসূল করে পাঠিয়েছেন?” এ কথা শুনে রুষ্ট হয়ে তিনি তার লাঠি দিয়ে ওই দরজায় আঘাত করলে তা খুলে যায় এবং ফেরাউনের দরবার পর্যন্ত সব দরজা এভাবেই খুলতে খুলতে তিনি ফেরাউনের কাছে পৌঁছে তাকে নিজের রিসালাতের কথা জানান। ফেরাউন প্রমাণ দেখতে চাইলে তাঁর লাঠি বিশাল এক অজগর হয়ে যায় ও তা ফেরাউনের দিকে মুখ খুলে এগিয়ে যেতে থাকে।

এ ছাড়াও ফেরাউন তার সদর দরজায় আগুন জ্বলতে দেখে। এ দৃশ্য দেখে সে ও তার পারিষদরা ভয়ে ছুটছিল। ফলে বহু মানুষ পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যায়। ফেরাউন এ অবস্থায় আল্লাহর দোহাই দিয়ে ওই লাঠি তুলে নিতে বলে। মুসা (আ.) তা তুলে নেয়া মাত্রই আবার তা লাঠি হয়ে যায়।

হযরত মূসা (আ.) সবচেয়ে বড় ৫ জন রাসূলের মধ্যে অন্যতম। অন্য চারজন রাসূল হলেন হযরত নূহ (আ.), ইব্রাহিম (আ.), ঈসা (আ.) ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। প্রবল পরাক্রান্ত ফেরাউনের পরাজয় ও সাগরে ডুবে মরা থেকে স্পষ্ট যে জালিম ও তাগুতি শাসকরা শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত অপদস্ত হয়ে ক্ষমতা হারায়।

সুরা আ'রাফের ১৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে মুসা (আ.)'র চল্লিশ দিন অবস্থানের কথা এসেছে। ১৪৮ নম্বর আয়াত থেকে পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে এই মহান নবীর উম্মতদের বাছুর পূজারি হওয়ার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।

হযরত মুসার (আ.) মাধ্যমে বনি ইসরাইল ফেরাউনের মত জালিমের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল। ফেরাউনের লোকেরা বনি ইসরাইলের পুরুষদের ও সন্তানদের হত্যা করতো যখন তখন ও তাদের নারীদের দাসী বা স্ত্রী বানিয়ে নিত এবং তাদের দিয়ে নিম্নমানের ও কঠোর পরিশ্রমের কাজ করাতো। অথচ মুক্তি পাবার পরপরই বনি ইসরাইল নীল নদের কাছে গরু পূজারিদের দেখে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং গরুর মত খোদা এনে দিতে মুসা (আ.)'র কাছে দাবি জানায়! মুসা (আ.) এই অদ্ভুত দাবির জন্য তাদের তীব্র তিরস্কার করেন। এরপর মুসা (আ.) মহান আল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের জন্য ৪০ দিন নিজ জাতি থেকে দূরে থাকেন। এ সময় সামেরি নামের এক ব্যক্তি একটি বাছুরের মূর্তি বানায় সোনা দিয়ে। সে মানুষকে এই মূর্তির পূজা করার আহ্বান জানায়। তার বিশেষ কারসাজিতে মূর্তিটি হতে গরুর মত শব্দ বের হতো। সামেরি জনগণকে ধোকা দেয়ার জন্য বলে: এটা হচ্ছে তোমাদের ও মুসার খোদা। ফলে বনিইসরাইল তথা ইহুদিরা বাছুরটিকে খোদা ভেবে তার পূজা শুরু করে। এ প্রসঙ্গে মানুষের বিবেক জাগিয়ে তুলতে কুরআনে এরশাদ হয়েছে: তারা কি দেখেনি যে (স্বর্ণ-নির্মিত) এই জন্তুটি তাদের সঙ্গে কথা বলে না এবং মানুষকে নির্দেশ দিতে ও সুপথও দেখাতে পারে না? (রেডিও তেহরান)