বিচারবুদ্ধি ও ইসলাম

বিচারবুদ্ধি (عقل)-এর বিচরণক্ষেত্রের সীমা নিয়ে যথাযথভাবে চিন্তা না করার ফলে প্রায় সকল সমাজেই বিচারবুদ্ধির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি ও এ ব্যাপারে প্রান্তিক দৃষ্টিকোণের উদ্ভব হয়েছে। অনেকে মানুষের জীবনপথে চলার জন্যে বিচারবুদ্ধির পথনির্দেশকেই যথেষ্ট গণ্য করেছেন এবং পুরোপুরিভাবে এর ওপর নির্ভর করার পক্ষে রায় দিয়েছেন। আবার অনেকে বিচারবুদ্ধির গ্রহণযোগ্যতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। দুর্ভাগ্যজনক যে, কতক ইসলামী মনীষী বিচারবুদ্ধি ও তার হাতিয়ার যুক্তিপ্রয়োগের বিরোধিতা করায় মুসলিম দ্বীনী সমাজে তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধি ও যুক্তির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব প্রাধান্য লাভ করেছে এবং অন্ধ বিশ্বাসের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে, যদিও কার্যক্ষেত্রে সকলেই কমবেশী বিচারবুদ্ধি ও যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করছে। পরিহাসের ব্যাপার হলো এই যে, যারা বিচারবুদ্ধি ও তার হাতিয়ার যুক্তিপ্রয়োগের গ্রহণযোগ্যতা প্রত্যাখ্যান করছেন তা তাঁরা করছেন বিচারবুদ্ধিরই আশ্রয় নিয়ে এবং বহু রকমের যুক্তি প্রদর্শন করে।

অন্যদিকে কতক মনীষী বিচারবুদ্ধিবাদীদের (عقليون) কঠোর সমালোচনা করেছেন ও তাঁদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, অথচ তাঁরা নিজেরাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের অনুসারীদের ও পরবর্তীদের অনেকে বিষয়টি সম্পর্কে তলিয়ে চিন্তা না করে তাঁরা নিরঙ্কুশভাবেই বিচারবুদ্ধিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে মনে করে তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধাবশতঃ বিচারবুদ্ধি প্রত্যাখ্যানের সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হলো, এ ধরনের মনীষীগণের সমালোচনা ও প্রত্যাখ্যানের লক্ষ্য স্বয়ং বিচারবুদ্ধি ও যুক্তিপ্রয়োগ নয়, বরং যারা জীবন ও জগতের অন্তরালে নিহিত মহাসত্য উদ্ঘাটন এবং সঠিক পথ ও পথনির্দেশ উদ্ঘাটনের জন্য একমাত্র বিচারবুদ্ধির ফয়সালাকেই যথেষ্ট গণ্য করেন এবং মানুষকে ওয়াহী ও নবুওয়াত থেকে বেনিয়ায মনে করেন সেই বিচারবুদ্ধিবাদীগণ (عقليون) ও যুক্তিবাদীগণই হচ্ছেন উপরোক্ত মনীষীদের সমালোচনা ও প্রত্যাখ্যানের লক্ষ্য।

‘আক্বল্ (عقل) বা বিচারবুদ্ধি প্রশ্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক সমস্যা এটাই।

এ ব্যাপারে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি প্রায়োগিক ক্ষেত্রের সাথে সম্পৃক্ত। তা হচ্ছে, যারা বিচারবুদ্ধির অনুসরণের পক্ষপাতী তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে একটি উপসংহারকে বিচারবুদ্ধির ফয়সালা বলে দাবী করেন অথচ প্রকৃত পক্ষে তা হয়তো বিচারবুদ্ধির ফয়সালা নয়। কারণ, বিচারবুদ্ধি যতোক্ষণ কোনো বিষয়ে অকাট্য ও অভ্রান্ত উপসংহারে উপনীত হতে না পারে, বরং তাতে কিছুটা সংশয়, বা অনিশ্চয়তা, বা দুর্বলতা থেকে যায়, ততোক্ষণ ঐ উপসংহারকে বিচারবুদ্ধির ফয়সালা বলা যেতে পারে না। কিন্তু কার্যতঃ দেখা যায় যে, দু’জন দার্শনিক বিচারবুদ্ধির ফয়সালার নামে একই বিষয়ে পরস্পরবিরোধী উপসংহারে উপনীত হচ্ছেন এবং উভয়ই স্বীয় দাবীর ওপর অটল থাকছেন, অথচ তাঁদের উপসংহারের এই পারস্পরিক বৈপরীত্যই প্রমাণ করে যে, তাঁদের দু’জনের মধ্যে অন্ততঃ একজনের মতামত অবশ্যই ভ্রান্ত। (অবশ্য কতক ক্ষেত্রে উভয়ের মতামত ভ্রান্ত হওয়াও অসম্ভব নয়। )

উপরোক্ত কারণেই দেখা যায় যে, বিচারবুদ্ধি তথা যুক্তির ওপর ভিত্তিশীল অন্যতম প্রধান শাস্ত্র দর্শনের কতক পণ্ডিত জীবন ও জগতের অন্তরালে নিহিত মহাসত্য উদ্ঘাটন সংক্রান্ত আলোচনায় ভ্রান্ত যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নাস্তিকতার উপসংহারে উপনীত হয়েছেন এবং সঠিকভাবে সমালোচনা ও পর্যালোচনা ব্যতীতই আধুনিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে তাঁদের মতামত পড়ানো হচ্ছে। ফলে এসব নামী-দামী দার্শনিকের মতামতকে অন্ধভাবে গ্রহণ করে অনেকে নাস্তিক হয়ে গেছে। আর এরই প্রতিক্রিয়ায় অনেকে ইসলাম বিষয়ক আলোচনায় বিচারবুদ্ধি ও যুক্তিপ্রয়োগকে স্থান দিতে পুরোপুরি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কারণ, তাঁদের ভয়, বিচারবুদ্ধির আশ্রয়গ্রহণ বা যুক্তিপ্রয়োগ নাস্তিকতার পথকে উন্মুক্ত করে দেবে এবং দ্বীনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। এর বিপরীতে আরেক দল বিচারবুদ্ধির ওপর এতো বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছেন যে, তাঁরা মানুষকে খোদায়ী পথনির্দেশের মুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্ত গণ্য করেছেন।

এ সব কারণে বিচারবুদ্ধির বিচরণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রসমূহ, বিভিন্ন প্রয়োগক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির মর্যাদা ও ভুমিকার মধ্যকার তারতম্য এবং বিচারবুদ্ধির অকাট্য রায় ও বিচারবুদ্ধির রায়ের নামে ভ্রমাত্মক যুক্তি বা অপযুক্তি (fallacyمغالطة ــ )- এর মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অপরিহার্য।

দ্বীন ও দর্শন হচ্ছে বিচারবুদ্ধির দুই বিচরণক্ষেত্র। তবে এ দুই বিচরণক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির ভূমিকা ও মর্যাদায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বস্তুতঃ জীবন ও জগতের মৌলিকতম সত্য উদ্ঘাটন দ্বীন ও দর্শন উভয়েরই লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্যে উপনীত হবার সর্বপ্রথম একমাত্র সর্বজনীন মাধ্যম হচ্ছে বিচারবুদ্ধি। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে দ্বীন ও দর্শনে বিচারবুদ্ধির বিচরণক্ষেত্র ও ভূমিকা পৃথক হয়ে যায়। দর্শন তার খুটিনাটি বিষয়েও বিচারবুদ্ধিকে একমাত্র আবিষ্কর্তা হিসেবে গণ্য করে, কিন্তু দ্বীনের ক্ষেত্রে খুটিনাটি বিষয়ে বিচারবুদ্ধির ভূমিকা হচ্ছে সহায়ক শক্তির ভূমিকা। অন্যদিকে দ্বীনের ক্ষেত্র দর্শনের ক্ষেত্রের তুলনায় অনেক বেশী প্রশস্ত। ফলে আয়তনের দৃষ্টিতে দ্বীনী ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির ভূমিকা অনেক বেশী, যদিও দর্শনে একমাত্র তথ্যসূত্র ও বিচারকর্তা হবার কারণে বিচারবুদ্ধির ভূমিকা সেখানে অধিকতর অনুভূত হয়ে থাকে।

দর্শন ও দ্বীন উভয়ই জীবন ও জগত সংক্রান্ত যে মৌলিক প্রশ্নগুলোর জবাব বিচারবুদ্ধির সাহায্যে উদ্ঘাটন করে তা হচ্ছে: এ জীবন ও জগতের অন্তরালে কোনো সৃষ্টিকর্তা আছেন কি? থাকলে এক, নাকি একাধিক? থাকলে সে সৃষ্টিকর্তার গুণবৈশিষ্ট্যসমূহ কী? আমাদের বস্তুদেহের অন্তরালে কোনো অবস্তুগত সত্তা আছে কি? সৃষ্টিকর্তার সাথে আমাদের সম্পর্ক কী? আমরা কি তাঁর নিকট থেকে প্রত্যক্ষ পথনির্দেশের মুখাপেক্ষী, নাকি আমাদের মধ্যে নিহিত সহজাত পথনির্দেশই যথেষ্ট? পথনির্দেশ অনুযায়ী আমাদের পার্থিব জীবনের কর্ম ও আচরণের ব্যাপারে কোনোরূপ জবাবদিহিতা (পরকালীন বিচার) কি অপরিহার্য? সৃষ্টিকর্তার পথনির্দেশ কীভাবে ও কা’র মাধ্যমে পাওয়া যেতে পারে? তাঁকে (নবীকে) চেনার উপায় কী? খোদায়ী পথনির্দেশ হিসেবে দাবীদার গ্রন্থাবলীর দাবীর সত্যাসত্য নির্ণয়ের উপায় কী?

বিচারবুদ্ধির সাহায্যে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে এ সব প্রশ্নের জবাব উদ্ঘাটন করা সম্ভব ও অপরিহার্য।

বিচারবুদ্ধি সম্ভাব্য সকল পন্থায় বিচার-বিশ্লেষণের পর যখন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও একত্ব (তাওহীদ), পরকালীন জীবনের অস্তিত্বের ও সে জীবনে ইহজীবনের কর্ম ও আচরণের ব্যাপারে জবাবদিহিতার অপরিহার্যতা, প্রত্যাদেশ (ওয়াহী) ও প্রত্যাদেশবাহক (নবী-রাসূল)-এর প্রয়োজনীয়তা, হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর বিশ্বজনীন ও সর্বশেষ নবী হওয়া এবং কোরআন মজীদের পূর্ণাঙ্গ, অবিকৃত ও সংরক্ষিত সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ হওয়ার সত্যতা উদ্ঘাটন করে, তখন তার সামনে এসব মৌলিক ধারণার শাখা-প্রশাখা এবং মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য - এই দু’টি বিশাল ক্ষেত্র সমুপস্থিত হয়। এ দু’টি ক্ষেত্র এমন যেখানকার কতক প্রশ্নের জবাব দেয়া বিচারবুদ্ধির পক্ষে সম্ভব হলেও অনেক প্রশ্নের জবাব দেয়াই তার পক্ষে সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, মানব প্রজাতির সূচনার ইতিহাস, ফেরেশতা নামক বিশেষ সৃষ্টির অস্তিত্ব আছে কি নেই, সৃষ্টিকর্তার নিকট আনুষ্ঠানিক প্রার্থনার প্রয়োজন আছে কিনা এবং থাকলে তা কীভাবে করতে হবে - এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া বিচারবুদ্ধির পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এ বিশাল ক্ষেত্রের সকল প্রশ্নের মুখ্য জবাবদানকারী হিসাবে কোরআন মজীদের দ্বারস্থ হতে হবে। যেহেতু বিচারবুদ্ধি রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত ও কোরআন মজীদের ঐশিতার ব্যাপারে অকাট্য প্রত্যয়ে উপনীত হয়েছে সেহেতু বিচারবুদ্ধির জন্যে কোরআন মজীদের প্রতিটি তত্ত্ব, তথ্য, পথনির্দেশ ও আদেশ-নিষেধকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ, এর ব্যতিক্রম করা মানে তার (বিচারবুদ্ধির) নিজের প্রত্যয়ের অকাট্যতাকেই প্রশ্নের সম্মুখীন করা।

অবশ্য এর মানে এ নয় যে, কোরআন মজীদের সত্যতার ব্যাপারে অকাট্য প্রত্যয়ে উপনীত হবার পর আর বিচারবুদ্ধির কোনো ভূমিকা থাকবে না। বরং পরবর্তী পর্যায়ে বিচারবুদ্ধি সব সময়ই কোরআন মজীদের পার্শ্বচরের ভূমিকা পালন করবে এবং কোরআন থেকে সঠিক তাৎপর্য গ্রহণে কোরআন-চর্চাকারীকে সহায়তা করবে। বিচারবুদ্ধি দ্বীনী সূত্র হিসেবে কোরআন মজীদের পরে গোটা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শুরু থেকে চলে আসা মতৈক্য (‘ইজমা‘এ উম্মাহ্) ও প্রতি স্তরে বিপুল সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত (মুতাওয়াতির) হাদীছকে সত্যায়িত করে এবং এ তিন সূত্রের সহায়তায়, কম সূত্রে বর্ণিত (খবরে ওয়াহেদ্) হাদীছের গ্রহণযোগ্যতা বিচার করে। বিচারবুদ্ধি এ সব সূত্রের সহায়তায় দ্বীনী যুগজিজ্ঞাসার জবাব দান করে।

মোটামুটি এই হলো কোরআন মজীদের সত্যায়ন পরবর্তী পর্যায়ে বিচারবুদ্ধির ভূমিকা।

তবে বিচারবুদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ের ভূমিকা সম্পর্কে আরো কয়েকটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হচ্ছে, বিচারবুদ্ধির অবস্থান ইসলাম ও কোরআন মজীদের আগে। অন্য কথায়, বিচারবুদ্ধি হচ্ছে ইসলাম-গৃহে প্রবেশের দরযা।

ইসলাম গ্রহণ করা-নাকরার বিষয়টি যে সম্পূর্ণরূপে বিচারবুদ্ধির ওপর নির্ভরশীল সে ব্যাপারে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কারণ, যারা জন্মসূত্রে মুসলমান ইসলাম ও কোরআন কেবল তাদের কাছে আসে নি, বরং সকল মানুষের কাছে এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে ব্যক্তি এক ও অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে ও মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান বা পরকালীন জীবনের অস্তিত্বে অকাট্য প্রত্যয় পোষণ করে না অথবা তা করলেও হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ) কে আল্লাহর রাসূল ও কোরআন মজীদকে আল্লাহর প্রেরিত গ্রন্থ বলে জানে না, তার নিকট তো আল্লাহ্, রাসূল ও কোরআনের দোহাই অর্থহীন; কীভাবে সে ইসলাম গ্রহণ করবে? অবশ্যই তার বিচারবুদ্ধির সামনে আল্লাহ্, পরকাল, রাসূল (ছ্বাঃ) ও কোরআন মজীদের সত্যতা তুলে ধরতে হবে। তার বিচারবুদ্ধি যখন এ সবের ব্যাপারে অকাট্য প্রত্যয়ে উপনীত হবে এবং তা গ্রহণ করে নেবে কেবল তার পরেই কোরআন মজীদ তার নিকট প্রশ্নাতীত দলীল (ডকুমেন্ট) রূপে পরিগণিত হবে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য (বিচারবুদ্ধিও যার সত্যায়ন করে) যে, বিশ্বে প্রচলিত সকল ধর্মীয় মতাদর্শের মধ্যে একমাত্র ইসলামই হচ্ছে মানুষের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার দেয়া চিরন্তন জীবনব্যবস্থা। প্রচলিত ধারণায় হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত লাভের মাধ্যমে ইসলামের সূচনা বলে মনে করা হলেও প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। বরং মানব প্রজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে এ দ্বীনের যাত্রা শুরু হয়েছিলো - এটাই কোরআন মজীদের দাবী। হযরত ইবরাহীম (আ.) সহ অতীতের অনেক নবী-রাসূলের উক্তি কোরআন মজীদে উদ্ধৃত হয়েছে যে সব উক্তিতে তাঁরা নিজেদেরকে ‘মুসলিম’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং বিশেষ করে হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর অনুসারীদেরকে ‘মুসলিমুন্’ (আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট আত্মসমর্পিত জনগোষ্ঠী) নামকরণ করেন।

মূলতঃ অন্যান্য ধর্মীয় মতাদর্শের সৃষ্টি হয়েছে এ চিরন্তন খোদায়ী জীবনব্যবস্থা থেকে পথচ্যুতি, বিকৃতি ও বিভ্রান্তির মাধ্যমে। বিভিন্ন ধর্মের নামকরণ থেকেও ইসলাম ও এ সব ধর্মের মধ্যকার একটি মৌলিক পার্থক্য ধরা পড়ে। অন্যান্য ধর্মের নামকরণ হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা স্থানের নামে। যেমন: বুদ্ধের নামে বৌদ্ধ ধর্ম, ঈসা (আ.)/ ক্রাইস্ট-এর নামে ঈসায়ী বা খৃীস্টধর্ম, ইয়াহূদা/ যীহূদা-র গোত্রের নামে ইয়াহূদী ধর্ম, হিন্দ্-এর (ভারতের) অধিবাসীদের ধর্ম হিসেবে হিন্দু ধর্ম ইত্যাদি। কিন্তু একমাত্র ‘ইসলাম’-এর নামকরণ করা হয়েছে এ ধর্মের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে; আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণই এ ধর্মের মূল কথা বিধায় এ ধর্মের নাম হয়েছে ‘ইসলাম’ (আত্মসমর্পণ)। আর যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল মানুষের স্রষ্টা সেহেতু বংশ-গোত্র, স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল মানুষেরই তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ অপরিহার্য। অবশ্য অন্যান্য সৃষ্টির ন্যায় তারাও তাঁর প্রাকৃতিক বিধানের নিকট আত্মসমর্পণ করে আছে, তাই বিচারবুদ্ধির দাবী হচ্ছে, স্বাধীন এখ্তিয়ারাধীন বিষয়াদিতেও তারা আল্লাহ্ তা‘আলার পসন্দ-অপসন্দের নিকট স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করবে।

ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও স্থানকে কেন্দ্র করে (মূলতঃ ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও স্থানের নামকে স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করে) আদি ও চিরন্তন সত্য দ্বীন ইসলাম থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণেই অন্য সমস্ত ধর্মই তাদের উপস্থাপিত মৌলিক তাত্ত্বিক দাবীসমূহকে অন্ধ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তিশীল করে উপস্থাপন করেছে। তারা তাদের মৌলিক বিশ্বাসসমূহকে ‘আক্বল্ বা বিচারবুদ্ধির আদালতে পেশ করতে ও যুক্তির মানদণ্ডে পরীক্ষা করতে দিতে রাযী হয় নি। তারা ‘ভক্তিতে মুক্তি’ এবং ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর’ ইত্যাদি আবেগময় বক্তব্যের সাহায্যে মানুষকে অন্ধ বিশ্বাসের ওপর ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। আর এর বিপরীতে কোরআন মজীদ মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস পরিত্যাগ করে ‘আক্বল্ বা বিচারবুদ্ধির ভিত্তিতে জীবন ও জগতের মহাসত্য সংক্রান্ত প্রশ্নসমূহের জবাব সন্ধানের আহবান জানিয়েছে এবং তাদেরকে বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের জন্য বার বার উৎসাহিত করেছে, আর যারা বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ করে না তাদেরকে তিরস্কার করেছে।

বস্তুতঃ দ্বীনের উপস্থাপিত মৌলিকতম দাবীসমূহের ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ করা না হলে ইসলামের প্রচার ও বিস্তার লাভের কোনো পথই থাকে না। কারণ, এ ব্যাপারে অন্ধ বিশ্বাসের নীতি অনুসরণ ও অন্ধ বিশ্বাস গ্রহণের আবেদন জানানোর (যা অনেক মুসলমানই করে থাকেন) অনিবার্য পরিণাম হচ্ছে এই যে, প্রত্যেকেই জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নিজ নিজ ধর্মের ওপর স্থির থাকবে; ইসলাম গ্রহণ করবে না। কিন্তু যেহেতু অন্ধ বিশ্বাস হচ্ছে মিথ্যার আশ্রয়স্থল সেহেতু ইসলাম বিচারবুদ্ধির অস্ত্র দ্বারা তাদের বিশ্বাসের দুর্গে আঘাত হেনেছে। তাই অন্ধ বিশ্বাসকে যদি ‘ধর্মের’ ভিত্তি বলে স্বীকার করা হয়, তাহলে বলতে হবে যে, ইসলাম একটি ‘ধর্মবিরোধী’ মতাদর্শ বা দর্শন, যা মানুষকে বিশ্বাসের বা ধর্মের অন্ধ গলি থেকে বের করে এনে বিচারবুদ্ধির মহাসড়কে তুলে দেয় এবং দেখেশুনে নিজের জন্য চলার পথ বেছে নিতে বলে।

বস্তুতঃ জীবন ও জগতের মহাসত্য প্রশ্নে ইসলাম সকল যুগেই মানুষকে বিশ্বাসের অনুসরণ পরিত্যাগ করে বিচারবুদ্ধির ফয়সালা মেনে নেয়ার জন্যে অনুপ্রাণিত করেছে। ইসলাম বলছে: তুমি নিজেই চিন্তা করে দেখো, এটাই সত্য, নাকি ঐগুলো সত্য?

কোরআন মজীদ যে বিচারবুদ্ধির ওপর কতখানি গুরুত্ব আরোপ করেছে তা অনুধাবনের জন্য ইসলামের মূলনীতি উপস্থাপনে যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ সহ কোরআনে ‘বিচারবুদ্ধি’(عقل- ‘আক্বল্) শব্দটির ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি দেয়াই যথেষ্ট। বিচারবুদ্ধি বা যুক্তির আশ্রয় গ্রহণের পাশাপাশি কোরআন মজীদ মোট ৪৯ বার ‘আক্বল্ শব্দমূল থেকে নিষ্পন্ন শব্দাবলী ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে ১৩ বার বলা হয়েছে: (افلا تعقلون) (অতঃপর তোমরা কি বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাবে না?) ৮টি আয়াতে বিভিন্ন বিষয় বর্ণনা করার পর বর্ণনার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলা হয়েছে: (لعلکم تعقلون) (যাতে তোমরা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করো/ বিচারবুদ্ধি দ্বারা অনুধাবন করো)। দু’টি আয়াতে বলা হয়েছে: (ان کنتم تعقلون) (যদি তোমরা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করো)।

কোরআন মজীদ স্বয়ং তার দ্বীনের মৌলিকতম বিষয়সমূহ উপস্থানের ক্ষেত্রে বার বার বিচারবুদ্ধি (عقل)-এর আশ্রয় নিয়েছে। যেমন, এরশাদ হয়েছে:

)وَهُوَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ وَلَهُ اخْتِلافُ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ أَفَلا تَعْقِلُونَ(.

“আর তিনিই প্রাণের উদ্ভব ঘটান ও মৃত্যু প্রদান করেন এবং দিন ও রাত্রির পরিবর্তন তাঁরই এখ্তিয়ারে; অতঃপর তোমরা কি বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করবে না?” (সূরা আল-মু’মিনূন্: ৮০)

সমগ্র সৃষ্টিজগতের পরতে পরতে একজন মহাজ্ঞানী স্রষ্টার নিদর্শন বিদ্যমান - এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে বিচারবুদ্ধির ভিত্তিতে সৃষ্টিকর্তা সংক্রান্ত বিতর্কের সমাধানের জন্য আহবান জানানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অনেক আয়াতে সরাসরি ‘বিচারবুদ্ধি’ (‘আক্বল্) শব্দমূল থেকে নিষ্পন্ন শব্দাবলী ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, এরশাদ হয়েছে:

)وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ.(

“আর তিনিই তোমাদের জন্য রাত্রি ও দিনকে এবং সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়ন্ত্রিত করেছেন। নক্ষত্রমণ্ডলী তাঁরই আদেশে নিয়ন্ত্রিত। নিঃসন্দেহে এতে সেই লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে যারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে।” (সূরা আন্-নাহল্: ১২)

অনুরূপভাবে এরশাদ হয়েছে:

)وَإِنَّ لَكُمْ فِي الأنْعَامِ لَعِبْرَةً نُسْقِيكُمْ مِمَّا فِي بُطُونِهِ مِنْ بَيْنِ فَرْثٍ وَدَمٍ لَبَنًا خَالِصًا سَائِغًا لِلشَّارِبِينَ. وَمِنْ ثَمَرَاتِ النَّخِيلِ وَالأعْنَابِ تَتَّخِذُونَ مِنْهُ سَكَرًا وَرِزْقًا حَسَنًا إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَةً لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ.(

“আর অবশ্যই তোমাদের জন্যে চতুষ্পদ জন্তুদের মধ্যে চিন্তার খোরাক রয়েছে। আমি তোমাদেরকে তার উদরস্থিত বস্তু থেকে - গোবর ও রক্ত হতে নিঃসৃত খাঁটি দুগ্ধ পান করাই যা পানকারীদের জন্য সুপেয়। আর (খাওয়াই) খেজুর গাছের ফল ও আঙ্গুর; তোমরা তা থেকে নেশাকর দ্রব্য ও উত্তম খাদ্য তৈরী করছো। নিঃসন্দেহে এতে সেই লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে যারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে।” (সূরা আন্-নাহল্: ৬৬-৬৭)

আরেক আয়াতে এরশাদ হয়েছে:

)إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَاخْتِلافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنْفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ مَاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الأرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأرْضِ لآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ(.

“নিঃসন্দেহে আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত্রি ও দিনের বিবর্তনে, সমুদ্রে চলাচলরত জাহাযসমূহে - যা মানুষকে উপকৃত করে, আল্লাহ্ আসমান থেকে যে পানি বর্ষণ করেন - অতঃপর যা দ্বারা মৃত যমীনকে সঞ্জীবিত করে তোলেন ও তাতে সব ধরনের জীবজন্তু ছড়িয়ে দেন - তাতে এবং বায়ুর আবর্তনে ও আসমান-যমীনের মাঝে ভেসে চলা মেঘমালার মধ্যে অবশ্যই সেই লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে যারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে।” (সূরা আল্-বাক্বারাহ্: ১৬৪)

আবার কোনো কোনো আয়াতে একই অর্থে ‘চিন্তা করা’র কথা বলা হয়েছে। যেমন, এরশাদ হয়েছে:

)وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ. ثُمَّ كُلِي مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلا يَخْرُجُ مِنْ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِلنَّاسِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ.(

“আর (হে রাসূল!) আপনার রব মৌমাছিকে এ মর্মে অনুপ্রাণিত করলেন যে, পাহাড়ে, বৃক্ষে ও যা কিছু উঁচু তাতে বাসা বাঁধো, এরপর ফলসমূহ থেকে ভক্ষণ করো, অতঃপর বিনীতভাবে স্বীয় রবের উন্মুক্ত পথসমূহে চলাচল করো। তার উদর থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় বহির্গত হয় যাতে মানুষের জন্য নিরাময় রয়েছে। অবশ্যই এতে সেই লোকদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে যারা চিন্তা করে।” (সূরা আন্-নাহল্: ৬৮-৬৯)

এভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা চান যে, মানুষ চিন্তা-চেতনার অন্ধত্ব থেকে বিচারবুদ্ধির দিকে প্রত্যাবর্তন করুক এবং বিচারবুদ্ধির ফয়সালার ভিত্তিতে আল্লাহ্ তা‘আলার অস্তিত্ব ও একত্বকে গ্রহণ করুক।

মুশরিকদেরকে তাওহীদের দিকে আহবান জানাতে গিয়ে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর উক্তি সম্পর্কে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে:

)قَالَ أَفَتَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَنْفَعُكُمْ شَيْئًا وَلا يَضُرُّكُمْ. أُفٍّ لَكُمْ وَلِمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَفَلا تَعْقِلُونَ(.

“(ইবরাহীম) বললো: অতঃপরও কি তোমরা আল্লাহকে ব্যতীত এমন কিছুর উপাসনা করবে যা না তোমাদের কোনো কল্যাণ সাধন করতে পারে, আর না কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারে? ধিক্কার তোমাদের প্রতি ও তার প্রতি তোমরা আল্লাহ্ ব্যতীত যার উপাসনা করছো; অতঃপর তোমরা কি বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করবে না?” (সূরা আল্-আম্বিয়া’: ৬৬-৬৭)

এখানে সুস্পষ্টতঃই যুক্তির সাহায্যে অংশীবাদকে খণ্ডন করা হয়েছে। এছাড়া অনেক আয়াতে ‘আক্বল্ (عقل) শব্দমূল থেকে নিষ্পন্ন শব্দাবলী ব্যবহার ব্যতীতই কেবল যুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নাস্তিক্যবাদ ও অংশীবাদকে খণ্ডন করা হয়েছে। যেমন, এরশাদ হয়েছে:

)أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمُ الْخَالِقُونَ(.

“তারা কি কোনো কিছু (কোনো সৃষ্টি-উৎস/ সৃষ্টিকর্তা) ছাড়াই (নিজে নিজেই/ শূন্য থেকেই) সৃষ্ট হয়েছে, নাকি তারা (নিজেরাই নিজেদের) সৃষ্টিকর্তা?” (সূরা আত্-তূর্: ৩৫)

)لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلا اللَّهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ.(

“এতদুভয়ে (আসমান ও যমীনে) যদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য উপাস্যমণ্ডলী থাকতো তাহলে এতদুভয়ই ধ্বংস হয়ে যেতো। অতএব, ‘আরশের মালিক আল্লাহ্ তা থেকে পরম প্রমুক্ত যা তারা তাঁর প্রতি আরোপ করছে।” (সূরা আল-আম্বিয়া’: ২২)

অনুরূপভাবে পরকালীন জীবনের সত্যতা সম্বন্ধেও বিচারবুদ্ধির দলীল (যুক্তি) উপস্থাপন করা হয়েছে:

)قَالَ مَنْ يُحْيِي الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ. قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ(.

“সে (পরকাল অস্বীকারকারী ব্যক্তি) বলে: ‘পচে-গলে যাওয়া অস্থিগুলোকে কে জীবিত করবে?’ (হে রাসূল!) বলুন, তিনিই তাকে (পচে-গলে যাওয়া অস্থিগুলোকে) জীবিত করবেন যিনি প্রথম বার সৃষ্টি করেছেন; আর তিনি প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে চিরজ্ঞানী।” (সূরা ইয়া-সীন্: ৭৮-৭৯)

)فَسَيَقُولُونَ مَنْ يُعِيدُنَا قُلِ الَّذِي فَطَرَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ(.

“অতঃপর অচিরেই তারা বলবে: ‘কে আমাদেরকে (মৃত্যুর পরে) প্রত্যাবর্তিত করাবে?’ (হে রাসূল!) বলুন, তিনিই যিনি প্রথম বারের মতো তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করেন।” (সূরা আল্-ইসরা/ বানী ইসরাঈল: ৫১)

তেমনি রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াত সম্বন্ধেও বিচারবুদ্ধির নিকট আবেদন জানানো হয়েছে। হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ) নবুওয়াত-প্রাপ্তির পূর্বে দীর্ঘ ৪০ বছর মক্কাহ্ শরীফে বসবাস করেন। এ সময় তিনি নিষ্কলুষ চরিত্রের লোক হিসেবে সকলের নিকট পরিচিত ছিলেন, তবে লেখাপড়া জানতেন না এবং কারো কাছ থেকে মৌখিকভাবেও জ্ঞান আহরণ করেন নি। মোটের ওপর তিনি জ্ঞানী বা প্রতিভাধর ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। এমতাবস্থায় আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া ব্যতীত কোরআন মজীদের ন্যায় উন্নততম সাহিত্যগুণসমৃদ্ধ সীমাহীন জ্ঞানে পরিপূর্ণ মহাগ্রন্থ নিজে রচনা করে উপস্থাপন করা তাঁর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। এদিকে ইঙ্গিত করে এরশাদ হয়েছে:

)قُلْ لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا تَلَوْتُهُ عَلَيْكُمْ وَلا أَدْرَاكُمْ بِهِ فَقَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُرًا مِنْ قَبْلِهِ أَفَلا تَعْقِلُونَ.(

“(হে রাসূল! তাদেরকে) বলে দিন: আল্লাহ্ যদি চাইতেন (যে, আমাকে নবুওয়াতের দায়িত্ব দেবেন না) তাহলে আমি তোমাদের নিকট তা (কোরআন) পাঠ করতাম না এবং তিনি তোমাদেরকে (এ বিষয়ে) অবহিত করতেন না; এর আগে থেকেই তো আমি আমার জীবন তোমাদের মধ্যেই কাটিয়েছি; অতঃপর তোমরা কি বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাবে না?” (সূরা ইউনুস: ১৬)

কোরআন মজীদ আল্লাহর কিতাব কিনা তা-ও বিচারবুদ্ধির সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখার জন্যে আহবান জানানো হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বিশ্বের সকল ভাষার মধ্যে আরবী ভাষা হচ্ছে ব্যাপকতম ও সূক্ষ্মতম ভাব প্রকাশের সম্ভাবনার অধিকারী একমাত্র ভাষা, আর হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওপর কোরআন নাযিলের যুগে আরবী ভাষার চর্চা (কবিতা ও ভাষণ উভয় ক্ষেত্রে) উন্নতির চরমতম শিখরে উপনীত হয়েছিলো। অন্য যে কোনো ভাষার ও আরবী ভাষার প্রকাশ ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য এতোই বেশী যে, আরবরা এ পার্থক্য লক্ষ্য করে অনারবদেরকে “আ‘জামী” (বোবা) বলে অভিহিত করতো। বস্তুতঃ আরবী ভাষার নামটিও এর বৈশিষ্ট্য প্রকাশক; عربی (‘আরাবী) মানে ‘উন্নততম ও সূক্ষ্মতম ভাব প্রকাশক্ষম প্রাঞ্জলভাষী’ এবং لسان عربی (লিসানে ‘আরাবী) মানে  ‘উন্নততম ও সূক্ষ্মতম ভাব প্রকাশক্ষম প্রাঞ্জল ভাষা’। আল্লাহ্ তা‘আলা উন্নততম প্রকাশ ক্ষমতাসম্পন্ন ভাষায় কোরআন নাযিল করেছেন এবং এ গ্রন্থের সাহিত্যিক মান ও প্রকাশ ক্ষমতা এমন চূড়ান্ত পর্যায়ের যে, আরবী ভাষী শ্রেষ্ঠতম কবি ও বাগ্মীগণ এর মোকাবিলায় চরমভাবে নিস্প্রভ হয়ে পড়ায় অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, এ গ্রন্থ কোনো মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয়। এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন:

)إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ(.

“অবশ্যই আমি একে (এ গ্রন্থকে) উন্নততম ও সূক্ষ্মতম ভাবপ্রকাশক্ষম প্রাঞ্জলতম (আরবী) পঠনীয় (কোরআন) রূপে অবতীর্ণ করেছি যাতে তোমরা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করো (এবং এটি যে আল্লাহ্ কর্তৃক প্রেরিত গ্রন্থ তা বুঝতে পারো)।” (সূরা ইউসুফ: ২; সূরা আয্-যুখরূফ: ৩)

আল্লাহ্ তা‘আলা কাফেরদেরকে কোরআনের সমতুল্য বক্তব্য রচনা করার জন্য চ্যালেঞ্জ প্রদান করে বলেন:

)أَمْ يَقُولُونَ تَقَوَّلَهُ بَلْ لا يُؤْمِنُونَ. فَلْيَأْتُوا بِحَدِيثٍ مِثْلِهِ إِنْ كَانُوا صَادِقِينَ(.

“তারা কি বলে যে, তিনি (মুহাম্মাদ ছ্বাঃ) নিজেই এটি (কোরআন) রচনা করেছেন? বরং তারা তো (নিজেরাই তাদের এ কথায়) আস্থা পোষণ করে না। তারা যদি (তাদের দাবীর প্রশ্নে) সত্যবাদী হয়ে থাকে (তারা মুখে যা বলছে এটাই যদি তাদের অন্তরের প্রত্যয় হয়ে থাকে) তাহলে তারা এর (কোরআনের) অনুরূপ (মানসম্পন্ন) বক্তব্য নিয়ে আসুক (রচনা করুক)।” (সূরা আত্-তূর্: ৩৩-৩৪)

বস্তুতঃ সমগ্র সৃষ্টিলোকে আল্লাহ্ তা‘আলার অস্তিত্বের অসংখ্য নিদর্শন বিদ্যমান যা থেকে বিচারবুদ্ধি প্রয়োগকারী লোকেরা খুব সহজেই মহাসত্যে উপনীত হতে সক্ষম। কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআন মজীদে তাঁর নিদর্শনাবলীর যে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বিচারবুদ্ধি প্রয়োগকারী লোকেরা। তাই এক আয়াতের শেষাংশে এরশাদ হয়েছে:

)كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ(

“আমি এভাবেই সেই লোকদের জন্য বিস্তারিতভাবে নিদর্শনাবলী বর্ণনা করি যারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে।” (সূরা আর্-রূম্: ২৮)

যারা পূর্ববর্তীদের অন্ধ অনুসরণকে বিচারবুদ্ধির ওপর অগ্রাধিকার প্রদান করে কোরআন মজীদ তাদের কঠোর সমালোচনা ও নিন্দা করেছে এবং তাদের এ কর্মনীতিকে তাদের হেদায়াত (সঠিক পথের সন্ধান) না পাওয়ার কারণ স্বরূপ গণ্য করেছে। শুধু তা-ই নয়, আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তুর সাথে তুলনা করেছেন এবং অন্ধ, বধির ও বোবা বলে তিরস্কার করেছেন। এরশাদ হয়েছে:

)وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلا يَهْتَدُونَ. وَمَثَلُ الَّذِينَ كَفَرُوا كَمَثَلِ الَّذِي يَنْعِقُ بِمَا لا يَسْمَعُ إِلا دُعَاءً وَنِدَاءً صُمٌّ بُكْمٌ عُمْيٌ فَهُمْ لا يَعْقِلُونَ(.

“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তার অনুসরণ করো’, তখন তারা বলে, ‘বরং আমরা তারই অনুসরণ করবো যার ওপর আমাদের পিতৃপুরুষদের পেয়েছি’। তাদের পিতৃপুরুষরা যদি মোটেই বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ না করে থাকে এবং সঠিক পথ (হেদায়াত) প্রাপ্ত না হয়ে থাকে (তবুও কি তারা তাদের অনুসরণ করবে)? আর যারা কাফের হয়েছে (সত্য দ্বীনকে প্রত্যাখ্যান করেছে) তাদের উপমা হচ্ছে তার ন্যায় যাকে ডাকা হলে সে হাকডাক ছাড়া আর কিছুই শুনতে পায় না (অর্থ বুঝতে পারে না); তারা বধির, বোবা ও অন্ধ, সুতরাং তারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করবে না।” (সূরা আল-বাক্বারাহ্: ১৭০-১৭১)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:

)وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ قَالُوا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لا يَعْلَمُونَ شَيْئًا وَلا يَهْتَدُونَ.(

“তাদেরকে যখন বলা হয়, ‘আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তার দিকে ও রাসূলের দিকে এসো,’ তখন তারা বলে, ‘আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে যার ওপর পেয়েছি তা-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট।’ তাদের পিতৃপুরুষরা যদি মোটেই জ্ঞানের অধিকারী না থেকে থাকে এবং সঠিক পথ না পেয়ে থাকে (তবুও কি তারা তাদের অনুসরণ করবে)?” (সূরা আল্-মায়েদাহ্: ১০৪)

যুগে যুগে যারা নবী-রাসূলগণের (আ.) দাও‘আত প্রত্যাখ্যান করে তাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিলো এই যে, তারা তাদের পিতৃপুরুষদের অনুসৃত নীতি-আদর্শ অনুসরণের যুক্তিতে তা প্রত্যাখ্যান করে। এরশাদ হয়েছে:

)بَلْ قَالُوا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُهْتَدُونَ. وَكَذَلِكَ مَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ فِي قَرْيَةٍ مِنْ نَذِيرٍ إِلا قَالَ مُتْرَفُوهَا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُقْتَدُونَ(.

“বরং তারা বলে, ‘অবশ্যই আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে একটি আদর্শের ওপর পেয়েছি এবং অবশ্যই আমরা তাঁদের কর্মের ভিত্তিতে সঠিক পথপ্রাপ্ত আছি।’ আর এভাবেই, আপনার আগে কোনো জনপদে এমন কোনো সতর্ককারী পাঠাই নি যাকে সেখানকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বলে নি, ‘অবশ্যই আমরা আমাদের পিতৃ- পুরুষদেরকে একটি আদর্শের ওপর পেয়েছি এবং অবশ্যই আমরা তাঁদের কর্মের অনুসরণকারী’।” (সূরা আয্-যুখরূফ্: ২২-২৩)

অনুরূপভাবে সূরা আল্-আ‘রাফ-এর ২৮ ও ৯৫, সূরা ইউনুস-এর ৭৮, সূরা আল্-আম্বিয়া’-এর ৫৩ ও ৫৪, সূরা আশ্-শূ‘আরা’-এর ৭৪ এবং সূরা লোকমান্-এর ২১ নং আয়াতে কাফের-মোশরেকদের পক্ষ থেকে পূর্বপুরুষদের অনুসরণের যুক্তি পেশ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য যে, বিচারবুদ্ধি ও আল্লাহর কালামের বিপরীতে পূর্ববর্তীদের (পিতৃপুরুষ, মুরুব্বী, ধর্মীয় পণ্ডিত ও ধর্মনেতা নির্বিশেষে) অনুসরণের যুক্তি উপস্থাপন কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে নিন্দনীয় ও বাতিল কর্মনীতি এবং তা কেবল কাফের-মোশরেকদের বেলায়ই প্রযোজ্য নয়, বরং সর্বজনীনভাবে সকলের বেলায়ই প্রযোজ্য। তাই ‘অতীতের মনীষীগণ কি ইসলামকে কম বুঝেছিলেন?’ এরূপ যুক্তিতে বিচারবুদ্ধির যুক্তি ও কোরআন মজীদ কী বলেছে তা শুনতে না চাওয়া যে গোমরাহীর কারণ তাতে সন্দেহ নেই। বস্তুতঃ বিচারবুদ্ধির অকাট্য রায়, আল্লাহর কালাম এবং রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর মত, আচরণ ও তাঁর অনুমোদিত আচরণ হিসেবে অকাট্য ও সর্বসম্মতভাবে প্রমাণিত বক্তব্য (মুতাওয়াতির হাদীছ ও ইজমা‘এ উম্মাহ্) ছাড়া কারো কোনো কথাই ভুলের উর্ধে বলে গণ্য করে অন্ধভাবে অনুসরণ পুরোপুরিভাবে ইসলাম কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত কর্মনীতি।

মুসলমানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোনো মতের পক্ষে-বিপক্ষে উপস্থাপিত বক্তব্য শোনা এবং এরপর তার মধ্য থেকে সঠিক বা উত্তমটিকে গ্রহণ করা। শুনলে পূর্বেকার ধারণা পাল্টে যেতে পারে বা যা বলা হবে তা শ্রোতার অনুসৃত বা শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির মতের সাথে সাংঘর্ষিক হবার সম্ভাবনা আছে, এ কারণে কারো তত্ত্ব বা তথ্যপূর্ণ কথা শুনতে অস্বীকার করা মুসলমানের বৈশিষ্ট্য নয়। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন:

)فَبَشِّرْ عِبَادِي. الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ وَأُولَئِكَ هُمْ أُولُو الألْبَابِ(.

“অতএব, (হে রাসূল!) সেই বান্দাহ্দেরকে সুসংবাদ দিন যারা বক্তব্য শোনে, অতঃপর তার মধ্য থেকে যা কিছু অধিকত উত্তম তার অনুসরণ করে। এরাই হচ্ছে তারা যাদেরকে আল্লাহ্ সঠিক পথ দেখিয়েছেন এবং এরাই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানবান।” (সূরাহ্ আয্-যুমার : ১৭-১৮) অন্যত্র ঈমানদারদেরকে সতর্ক করে দিয়ে এরশাদ হয়েছে :

)وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ قَالُوا سَمِعْنَا وَهُمْ لَا يَسْمَعُونَ إِنَّ شَرَّ‌ الدَّوَابِّ عِندَ اللَّـهِ الصُّمُّ الْبُكْمُ الَّذِينَ لَا يَعْقِلُونَ(

“আর তোমরা তাদের ন্যায় হয়ো না যারা বলে, ‘আমরা শুনেছি,’ অথচ তারা (ঠিক যেরূপ মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত ছিলো সেভাবে) শোনে নি। নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জন্তু হচ্ছে সেই বধির-বোবার দল যারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে না।” (সূরাহ্ আল-আনফাল : ২১-২২)

যারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে না তাদেরকে আরো কয়েকটি আয়াতে তিরস্কার করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, যারা বিচারবুদ্ধি কাজে লাগায় না আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে ঈমানের নে‘আমত প্রদান করেন না। এরশাদ হয়েছে :

)دَعْوَاهُمْ فِيهَا سُبْحَانَكَ اللَّـهُمَّ وَتَحِيَّتُهُمْ فِيهَا سَلَامٌ وَآخِرُ‌ دَعْوَاهُمْ أَنِ الْحَمْدُ لِلَّـهِ رَ‌بِّ الْعَالَمِينَ(

“আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কেউ ঈমান (পরকালীন জীবনে সুরক্ষা) অর্জন করতে পারে না। আর যারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে না তিনি (আল্লাহ্) তাদেরকে কলুষলিপ্ত করে রাখেন (ফলে তারা ঈমানের সুযোগ পায় না)।” (সূরাহ্ ইউনুস : ১০০)

এ আয়াতে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, কাউকে বিচারবুদ্ধি না থাকার কারণে নিন্দা ও সমালোচনা করা হয় নি, বরং বিচারবুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও তা কাজে না লাগানোর কারণে নিন্দা ও সমালোচনা করা হয়েছে। কোরআন মজীদ এ ক্ষেত্রে ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছে যা প্রমাণ করে যে, এরা বিচারবুদ্ধিবঞ্চিত মানসিক প্রতিবন্ধী নয়, বরং বিচারবুদ্ধির অধিকারী হয়েও তা কাজে লাগানো থেকে বিরত রয়েছে এবং এভাবে নিজেদেরকে বিচারবুদ্ধিবঞ্চিত পশুর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে।

মোদ্দা কথা, কোরআন মজীদ বিচারবুদ্ধির নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেছে। কারণ, কোনো মানুষ যতক্ষণ না অন্ধ বিশ্বাসের খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে বিচারবুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ করে ততক্ষণ তার পক্ষে সঠিক অর্থে ইসলাম গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

ইসলাম গ্রহণের পরে দ্বীনের বিস্তারিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কোনো ব্যক্তির অনুসরণ করতে হবে। আর যেহেতু বিস্তারিত বিষয়ে বিশেষজ্ঞের অনুসরণ অপরিহার্য, সেহেতু আদৌ কোনো বিশেষজ্ঞ না পেলে সে ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজের জন্যই বিশেষজ্ঞ হওয়া অপরিহার্য। কিন্তু কেউ যদি কোনো বিশেষজ্ঞের সন্ধান না পায় এবং নিজেও বিশেষজ্ঞত্ব অর্জন না করে শুধু বিচারবুদ্ধির সাহায্যে স্বীয় করণীয় নির্ধারণ করতে চায় তাহলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, স্বয়ং বিচারবুদ্ধি একে সঠিক প্রক্রিয়া বলে রায় দেয় না।

মোদ্দা কথা, বিচারবুদ্ধিকে পুরোপুরি বর্জন করা অথবা শুধু বিচারবুদ্ধির ওপর নির্ভর করা উভয়ই ভুল কর্মপন্থা। বরং বিচারবুদ্ধিকে যথাযথ ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে - এটাই ‘আক্বল্ বা বিচারবুদ্ধির দাবী; ইসলামের আবেদনও এটাই। বিচারবুদ্ধি হচ্ছে ইসলাম গৃহের দরযা; এ পথেই ইসলামে প্রবেশ করতে হবে এবং এরপর ইসলামকে সঠিকভাবে জানা-বুঝা ও অনুসরণের ক্ষেত্রে বিচারবুদ্ধির ভূমিকা হচ্ছে সহায়ক বা হাতিয়ারের ভূমিকা।

(নুর হোসেন মজিদী লিখিত জিবন জিজ্ঞাসা গ্রন্থ থেকে সংকলিত)