সূরা আন'আম;(৫ম পর্ব)

সূরা আন'আম; আয়াত ২০-২৪

সূরা আন’আমের ২০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

الَّذِينَ آَتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمُ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ

"(ইহুদি ও খ্রিস্টানরা) যাদেরকে আমি আসমানি কিতাব দিয়েছি তারা তাকে (মুহাম্মদ সা.কে) চেনে, যেমনিভাবে তাদের সন্তানদেরকে চেনে। যারা নিজেদেরকে ক্ষতির মধ্যে ফেলেছে, তারা ঈমান আনবে না।" (৬:২০)

এ আয়াতটির সঙ্গে সূরা বাকারার ১৪৬ নম্বর আয়াতের মিল রয়েছে। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর যুগে যেসব খ্রিষ্টান ও ইহুদি বসবাস করতেন, তারা তাকে খুব ভালোভাবে চিনতেন। যেমনিভাবে একজন বাবা বা মা তার সন্তানকে ভালোভাবে চেনেন। সব বাবা-মাই তার সন্তানের খুটিনাটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত। কারণ ইসলামের নবীর নাম ও আলামত ঐশী গ্রন্থ তাওরাত ও ইঞ্জিলে এসেছে এবং আহলে কিতাবের অনুসারী মনীষীরাও হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে আল্লাহর রাসূল হিসেবে তুলে ধরে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ আয়াতের শেষ দিকে বলা হচ্ছে, যারা সত্যকে স্বীকার করতে ও ঈমান আনতে প্রস্তত নন, তারা যেন এটা না ভাবে যে, ঈমান না আনার ফলে ইসলাম ও এর রাসূলের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। আসলে যারা ঈমান আনলো না, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং নিজেদের আধ্যাত্মিক পূর্ণতা ও বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. সত্যকে চেনা ও জানাই যথেষ্ট নয় বরং সত্যকে মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করাটাই সবচেয়ে বড় বিষয়। অনেকেই হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে আল্লাহর রাসূল হিসেবে নিশ্চিত হওয়ার পরও দাম্ভিক মনোভাবের কারণে ইসলাম ধর্মকে মেনে নিতে চায় না।

দুই. পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে, আত্মিক ক্ষতিই হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি,যা  অর্থনৈতিক তথা পার্থিব ক্ষতির চেয়েও মারাত্মক। আধ্যাত্মিক ও আত্মিক পূর্ণতা লাভে ব্যর্থ হলে মানুষ ইহকালে যেমন ক্ষতির শিকার তেমনি পরকালেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।  

সূরা আন’আমের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِآَيَاتِهِ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ

"আর তার চেয়ে অধিক জালিম কে হতে পারে যে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা রচনা করে এবং তার আয়াতসমূহকে প্রত্যাখ্যান করে? নিঃসন্দেহে জালিমরা কখনো সফল হবে না।" (৬:২১)

গত আয়াতের ধারাবাহিকতায় এখানে বলা হচ্ছে, চিন্তা-চেতনা ও ধর্ম-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে জুলুমই হচ্ছে সবচেয়ে বড় অন্যায়। শিরক করা বা নিজেকে আল্লাহর সমকক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর মাধ্যমে জুলুম করা হচ্ছে। মানব জাতিকে সৎপথে পরিচালনার জন্য যেসব আয়াত নাজিল হয়েছে, সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করাও এ ধরনেরই অন্যায়। মানবাধিকার লংঘন এবং সামাজিক অবিচার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা খুবই অপছন্দনীয়। আর এসব সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের উৎসমূলে রয়েছে শিরক বা অংশীবাদ। আল্লাহকে অস্বীকার বা তার সঙ্গে কাউকে শরীক করার মাধ্যমে মানবাধিকার লংঘনের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। কেউ যদি কেবলি আল্লাহর এবাদত করে এবং নিজেকে আল্লাহর বান্দা বলে মনে করে ও রাসূলের শিক্ষাকে অনুসরণ করে, তাহলে সে কখনোই অন্যের অধিকার লংঘন করবে না। কারণ ঈমানদার ব্যক্তিরা জানেন যে, ঐশী ধর্মগুলো সব সময় মানুষের অধিকার রক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।

এই আয়াতের শেষাংশে বলা হচ্ছে, অন্যায়কারীরা যেন এটা না ভাবে যে, তারা তাদের অন্যায় আচার-আচরণ ও চিন্তা-দর্শনের মাধ্যমে কল্যাণ অর্জন করতে পারবে। কারণ, অন্যায় ও অপরাধের মাধ্যমে মানুষ কখনোই ভালো কোনো ফলাফল পেতে পারে না। কোনো দিন পাবেও না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. অংশীবাদ ও আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস হচ্ছে সব ধরনের আগ্রাসন ও জুলুমের উৎস। এর ফলে ব্যক্তি, সমাজ এবং নবী-রাসূলদের অধিকার লংঘন করা হয়। এ ধরনের ব্যক্তি আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার মাধ্যমে নিজের ওপর জুলুম করে। একত্ববাদকে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে সমাজের ওপর জুলুম করে এবং নবী-রাসূলদের শ্রম ও প্রচেষ্টাকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে নবী-রাসূলদের ওপর জুলুম করে।

দুই. মিথ্যাচার এবং সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার মতো বিষয়গুলো মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির পথে বাধা সৃষ্টি করে।

সূরা আন’আমের ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَيَوْمَ نَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا ثُمَّ نَقُولُ لِلَّذِينَ أَشْرَكُوا أَيْنَ شُرَكَاؤُكُمُ الَّذِينَ كُنْتُمْ تَزْعُمُونَ (22)

"আর সেদিন আমি তাদের সবাইকে একত্রিত করবো,এরপর মুশরিকদের বলবো- ‘কোথায় তারা- যাদেরকে তোমরা (ইবাদতে) আমার শরিক মনে করতে?’ (৬:২২)

মুশরিকরা আসলে পৃথিবীতেও প্রকৃত কল্যাণ লাভ করে না। এছাড়া পুণরুত্থান দিবসেও তারা শূন্য হাতে উপস্থিত হবে। সেখানে তার কোন আশ্রয় বা অবলম্বন নেই। কারণ তারা পৃথিবীতে যাদের ওপর নির্ভর করতো এবং যাদেরকে খোদার স্থানে বসিয়েছিল ও সব শক্তির উৎস মনে করতো, কিয়ামতের দিন তারা তাদের জন্য কিছুই করতে পারবে না। তাদের উপাস্যরাই সেদিন আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

এক. পৃথিবীতে এমন কোনো বস্তু বা ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না, যে বস্তু বা ব্যক্তি পরকালে আমাদের জন্য কোনো কিছুই করতে পারবে না।

দুই.শিরক বা অংশীবাদ-অলীক কল্পনা ব্যতিত আর কিছু নয়। কিয়ামতের দিন এ বিষয়টি সবার সামনেই আরো স্পষ্ট হবে।

সূরা আন’আমের ২৩ ও ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 ثُمَّ لَمْ تَكُنْ فِتْنَتُهُمْ إِلَّا أَنْ قَالُوا وَاللَّهِ رَبِّنَا مَا كُنَّا مُشْرِكِينَ (23) انْظُرْ كَيْفَ كَذَبُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَضَلَّ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَفْتَرُونَ

"অতপর এটা ছাড়া তাদের বলার আর কোন কিছুই থাকবে না যে, ‘আল্লাহর শপথ! হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তো মুশরিক ছিলাম না।" (৬:২৩)

"(হে রাসূল) দেখো! তারা কিভাবে নিজেরাই নিজেদের অস্বীকার করছে। আল্লাহকে জড়িয়ে তারা যে মিথ্যা বলতো, তা তাদের থেকে উধাও হয়ে যাবে।" (৬:২৪)

এ আয়াতে কিয়ামত বা পুণরুত্থান দিবসে আল্লাহর আদালতে মুশরিকদের বিচারের একটি চিত্র তুলে ধরে বলা হচ্ছে, যারা পৃথিবীতে প্রেমমুগ্ধ হয়ে অনেক কাল্পনিক উপাস্যের উপাসনা করতো, তারা সেখানে ভ্রান্তির ঘুম থেকে জেগে ওঠবে এবং সত্যকে উপলব্ধি করবে। এ অবস্থায় তারা আর কোনো অজুহাত খুজে না পেয়ে বলতে থাকবে- আমরা এ অবস্থা থেকে ক্লান্ত, এখন আর আমরা মুশরিক নই। তারা একত্ববাদীদের বলবে, আমরাও এখন আপনাদের মতো আল্লাহকে একমাত্র মাবুদ বলে মনে করি। এ অবস্থায় তারা পুণরুত্থান দিবসে নিজেদের ভুল পথ ও মিথ্যাচারকে অস্বীকার করবে এবং সঠিক পথে আসতে চাইবে। কিন্তু তাতে কী লাভ? সময় ও সুযোগতো আগেই চলে গেছে।

এ আয়াত দু’টির শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

এক. পুণরুত্থান দিবসে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজ হবে না।

দুই. আমাদের এমন কোন কাজ করা উচিত হবে না যে, পরকালে নিজেই নিজের বিরুদ্ধে কথা বলতে বাধ্য হই। আমরা যাতে পৃথিবীর কাজকর্ম ও জীবন প্রণালীর ব্যাপারে আফসোস করতে বাধ্য না হই, সে বিষয়টি মনে রাখতে হবে।

তিন. পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহ ছাড়া যেসব বস্তু বা ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে, কিয়ামতের দিন সেগুলোর কোনো মূল্য থাকবে না। সেখানে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে আশ্রয় নেয়ার উপায় থাকবে না।