আল হাসানাইন (আ.)

নৈতিকতা, ধর্ম ও জীবন: ৪র্থ পর্ব

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া, তিনি মানব জাতির জন্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। আল্লাহ, ঐশী ধর্ম ও নবী-রসূলের অস্তিত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির ক্ষেত্রে মানুষের জন্য বিবেকের প্রয়োজনীয়তা জরুরি। বিবেকের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহ ও ধর্মকে বুঝতে সক্ষম হয়। ইসলাম ধর্মে নৈতিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হলো, মানুষের জৈবিক প্রবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতা অর্জন। মানুষের রয়েছে জন্মগত প্রকৃতি বা ফিতরাত। নিজেকে চেনার ক্ষেত্রে ফিতরাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের সু-বৈশিষ্ট্যের উৎসই হচ্ছে ফিতরাত। মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, জ্ঞান পিপাসা, সত্যানুসন্ধান, ন্যায়কামিতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং প্রার্থনার প্রবণতা। ইসলাম ধর্ম মানুষের বিবেককে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। তবে অনেক জটিলতা ও অচলাবস্থার ক্ষেত্রেই বিবেকের কার্যকারিতা আর থাকে না। এসব ক্ষেত্রে ধর্মের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। ঐশী ধর্মই কেবল এ ধরনের জটিলতার সমাধান দেয়ার ক্ষমতা রাখে।    
 
 
আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে ইসলাম ধর্মে মানুষের গুরুত্ব অপরিসীম। মানব সত্ত্বা তথা মানবাত্মা এতোটাই পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ যে, স্বয়ং আল্লাহ এটাকে তার নিজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। পবিত্র কুরআনের সূরা সাজদার ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা এ সম্পর্কে বলেছেন, মানুষের মধ্যে নিজের রূহ ফুঁকে দিয়েছেন তিনি। এছাড়াও পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে বলা হয়েছে, আকাশ ও জমিনের সব কিছুই মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। সব বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক নেয়ামতের অস্তিত্বও মানুষের জন্যই। এসব কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে, যাতে মানুষ সেগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। জন্মগত মর্যাদার পাশাপাশি একজন মানুষ নিজের চেষ্টার মাধ্যমে আরো উঁচু অবস্থান ও মর্যাদায় পৌঁছতে পারে। ইসলামী শিক্ষার আলোকে জীবন পরিচালনার মাধ্যমে একজন মানুষ আল্লাহর খুব কাছের মর্যাদাসম্পন্ন বান্দায় উত্তীর্ণ হতে পারে। পাশাপাশি ভিন্ন পথও অনুসরণ করতে পারে সে। নৈতিক অনাচার ও আত্মিক অবক্ষয়ের পথও বেছে নিতে পারে একজন মানুষ।
 
 
ইসলাম ধর্ম ব্যক্তি অধিকারের পাশাপাশি সামাজিক অধিকারকেও গুরুত্ব দেয়। কারণ ইসলাম ধর্ম ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণের কথা বলে। ইসলাম ধর্মমতে, মানুষ এক স্বাধীন সত্ত্বা। তবে তার রয়েছে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য। ইসলাম ধর্ম কখনোই ব্যক্তি ও সামাজিক অধিকার লঙ্ঘনের অনুমতি দেয় না। অন্যের ওপর জুলুম-নির্যাতনের বিরোধিতা করার পাশাপাশি মিথ্যাচার, পরনিন্দা, অশ্লীলতা ও অপবাদের মতো অসৎ গুণাবলী পরিহারের নির্দেশ দেয় ইসলাম ধর্ম। ইসলাম ধর্মে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও কাজের মূল ভিত্তি হচ্ছে,আল্লাহতায়ালা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই মানুষের সব কাজের মূল উদ্দেশ্য। ইসলাম ধর্মের শিক্ষা অনুযায়ী আল্লাহই হচ্ছেন সৃষ্টিজগতের সব কিছুর মালিক ও কেন্দ্রবিন্দু। সব সৃষ্টিরই উৎস হচ্ছেন তিনি এবং সব সৃষ্টির পর্যবেক্ষক হচ্ছেন আল্লাহ। আল্লাহতায়ালা কেবলমাত্র সৃষ্টিকর্তাই নন,তিনি সব সৃষ্টির পালনকর্তাও বটে। কিন্তু হিউম্যানিজমে বিশ্বাসী মানুষেরা আল্লাহ বিমুখ এবং তারা পার্থিব ও মনগড়া মূল্যবোধের অনুসারী। হিউম্যানিজম বা তথাকথিত মানবতাবাদে মানুষ বস্তুপুজারি। সেখানে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার স্থান নেই।
 
আর আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতা থেকে দূরে সরে যাবার কারণেই পাশ্চাত্য নৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। পাশ্চাত্য মানুষের মাঝে এখন চরম হতাশা লক্ষণীয়। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস মানুষকে আশাবাদী করে তোলে। ধার্মিক মানুষ কখনোই ভবিষ্যতের বিষয়ে হতাশ হন না। কিন্তু হিউম্যানিজমে বিশ্বাসীরা তাদের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় দিক-নির্দেশনার তোয়াক্কা করে না। তারা যে কোনো উপায়ে তাদের চাহিদা পূরণের চেষ্টা চালায়। কিন্তু মুসলমানেরা ধর্মের বিধি-বিধানের ভিত্তিতে তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে এবং ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে তারা তা থেকে দূরে সরে আসে। হিউম্যানিজমে বিশ্বাসীরা মনে করেন, বিবেক ও প্রজ্ঞা হচ্ছে ধর্ম ও ঐশী দিক-নির্দেশনা থেকে বিচ্ছিন্ন একটি বিষয়। তারা বিবেক ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতেই সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালানো হয় এ মতবাদে। কিন্তু এটা জানা উচিত যে, বিবেক হচ্ছে ঐশী দিক-নির্দেশনারইর খণ্ডিত অংশ এবং কামনা-বাসনা ও প্রবৃত্তির অনুসরণের মাধ্যমে কখনোই মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা যাবে না। কিন্তু ইসলাম ধর্মে মানুষ বিবেকের সহায়তায় ঐশী শিক্ষার আলোকে কল্যাণ ও পূর্ণতার পথ খুঁজে নেয়।
 
 
হিউম্যানিজমে মানুষের সব চেষ্টা হলো, তার জৈবিক প্রবৃত্তিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু ইসলাম ধর্মে তা গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলাম ধর্মে বৈষয়িক বা বস্তুগত আশা-আকাঙ্ক্ষার সীমা-পরিসীমা রয়েছে এবং এটাকেও আত্মিক পূর্ণতার মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। ধর্মীয় নির্দেশনার ভিত্তিতে ধর্মপরায়ণ মানুষেরা তার যোগ্যতা বাড়াতে এবং উন্নত নৈতিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে চেষ্টা চালায়। মানুষের সব পার্থিব তৎপরতা উন্নত এ লক্ষ্যের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। সব মিলিয়ে এটা বলা যায় যে, ইসলামি দর্শনে পৃথিবী হচ্ছে পরকালীন জীবনের শস্যক্ষেত্র। ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে পৃথিবীর সুযোগ-সুবিধাকে আধ্যাত্মিক পূর্ণতা অর্জনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। মানুষের সব পদক্ষেপ হতে হবে ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে। ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেকটি মানুষের ভিতরের সুপ্ত বিবেক নামক অতীন্দ্রিয় শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে আমাদের সবাইকে। তবে সবক্ষেত্রে বিবেকই চূড়ান্ত নয়। যেখানে বিবেক দিয়ে সমাধান হয় না, সেখানে ধর্মই একমাত্র অবলম্বন। কাজেই সবাইকে ঐশী ধর্ম আঁকড়ে ধরতে হবে। আর ঐশী ধর্মের পাশাপাশি একজন মানুষের মাঝে নৈতিকতার শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে হলে শিশুকাল থেকে সু-শিক্ষিত করে তুলতে হবে।(রেডিও তেহরান)

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)