সূরা আন'আম;(১৪তম পর্ব)

সূরা আন'আম; আয়াত ৫৭-৬০

সূরা আন’আমের ৫৭ ও ৫৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ إِنِّي عَلَى بَيِّنَةٍ مِنْ رَبِّي وَكَذَّبْتُمْ بِهِ مَا عِنْدِي مَا تَسْتَعْجِلُونَ بِهِ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ يَقُصُّ الْحَقَّ وَهُوَ خَيْرُ الْفَاصِلِينَ (57) قُلْ لَوْ أَنَّ عِنْدِي مَا تَسْتَعْجِلُونَ بِهِ لَقُضِيَ الْأَمْرُ بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِالظَّالِمِينَ

"(হে নবী!) আপনি মুশরিকদের বলে দিন: আমার কাছে প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট প্রমাণ (তথা পবিত্র কুরআন) রয়েছে এবং তোমরা এর প্রতি মিথ্যারোপ করেছ । তোমরা শিগগিরই (প্রকাশ্য আজাব নাজেলের) দাবি করছ, তা আমার কাছে নেই। আল্লাহ ছাড়া কারো নির্দেশ চলে না। তিনি সত্য বর্ণনা করেন এবং তিনিই শ্রেষ্ঠতম মীমাংসাকারী বা সত্য ও মিথ্যার শ্রেষ্ঠ পার্থক্যকারী।" (৬:৫৭)

"(হে নবী!) আপনি বলে দিন : যদি আমার কাছে তা থাকত, যা তোমরা শীঘ্র দাবি করছ, তবে আমার ও তোমাদের পারস্পরিক বিবাদ কবেই চুকে যেত। আল্লাহ জালেমদের সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। (আল্লাহ যখনই দরকার মনে করবেন তখনই তাদের শাস্তি দেবেন।)" (৬:৫৮)

আগের আয়াতের আলোচনায় আমরা শুনেছি মুশরিকরা মূর্তি পূজারীদের দলে যোগ দিতে বিশ্বনবী (সা.)-এর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল। এ আয়াতে তাদের ওই প্রস্তাবের জবাব শুনিয়ে দেয়ার জন্য রাসূল (সা.)-কে দায়িত্ব দিয়ে  মহান আল্লাহ বলছেন, আপনি বলুন, মূর্তি পূজারীদের তো কোনো যুক্তিই নেই যে তা আমি মেনে নেব। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে যে কুরআন আমার কাছে নাজেল হয়েছে তা সত্য ও মিথ্যার স্পষ্টতম এবং পরিপূর্ণতম পার্থক্যকারী। কিন্তু তোমরা তা গ্রহণ করনি, বরং প্রত্যাখ্যান করেছ। অর্থাৎ কুরআনকে মিথ্যা বলে নাকচ করে দিয়েছ। এমনকি তারা তোমাকে এও বলেছে যে, যদি তুমি আল্লাহর নবীই হয়ে থাক, তাহলে আমাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নাজেল কর তো দেখি! তোমরা খোদায়ী শাস্তি দেখার জন্য এই যে তাড়াহুড়া করছ- এই শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা তো আমার নেই, বরং এ ক্ষমতা আল্লাহরই হাতে রয়েছে, যে আল্লাহ সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী।

আর মনে কর যদি এই শাস্তি দানের ক্ষমতা আমার হাতেই থাকত, তাহলে তো তোমরা ধ্বংসই হয়ে যেতে। তোমাদের কোনো চিহ্নই থাকত না।  এটা আল্লাহর  অশেষ দয়া যে তিনি কাফের মুশরিকদেরও সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন এবং তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য তাড়াহুড়া করেন না।

এ আয়াত দু'টি থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার-

এক. নবী-রাসূলদের দাওয়াত দলিল ও যুক্তি-প্রমাণ-ভিত্তিক। অনুমান ও কুসংস্কার-ভিত্তিক নয়। অন্যদিকে তাদের আহ্বান প্রত্যাখ্যানকারীরা যেসব অজুহাত দেখায় সেগুলো অযৌক্তিক ও খেয়ালীপনা মাত্র।

দুই. ধর্ম প্রচারই নবী-রাসূলদের দায়িত্ব। কাফের ও পাপীদের শাস্তি দেয়া তাঁদের দায়িত্ব নয়।

তিন. আল্লাহর শাস্তি আসতে দেরি হচ্ছে ভেবে কাফেররা যেন বেপরোয়া না হয়। আল্লাহ তাদের ব্যাপারটি ভুলে গেছেন এমনটা ভাবা হবে চরম বোকামি।

সূরা আন’আমের ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ

“তাঁর কাছেই অদৃশ্য জগতের চাবি রয়েছে। এগুলো তিনি ছাড়া কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা আছে,(তার সব সম্পর্কে কেবল) তিনিই জানেন। গাছের কোন পাতাও ঝরে না আল্লাহর অজ্ঞাতসারে।  মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণাও অংকুরিত হয় না অথবা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোন বস্তু নেই যা সুস্পষ্ট  (খোদায়ী) কিতাবে লিখিত নেই।” (৬:৫৯)

মুশরিকদের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে আগের কোনো এক আয়াতে আল্লাহ বলছেন, গোটা সৃষ্টি জগত বা অস্তিত্বের জগত আল্লাহরই নির্দেশে পরিচালিত হয়। আর এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, আসমান ও জমিনের যা কিছু তোমাদের সামনে গোপন বা অদৃশ্য এবং যেসব বিষয় তোমাদের কাছে গুরুত্বহীন যেমন, গাছের একটি পাতা ঝরে যাওয়া, মাটিতে একটি শস্য-বীজের অংকুরোদ্গম হওয়া – এসবই আল্লাহর জ্ঞাতসারে ঘটে। মোট কথা সব ঘটনা ও বিষয় সম্পর্কে তিনি সব সময়ই পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান রাখেন। বিশ্বের গোপন ও প্রকাশ্য  জ্ঞান-ভাণ্ডারের চাবি রয়েছে তাঁরই হাতে। মহান আল্লাহই বিশ্ব জগত ও সৃষ্টিকূল সৃষ্টি করেছেন নিজ জ্ঞানের আলোকে এবং অস্তিত্বের জগতকে বেষ্টন করে আছে আল্লাহর জ্ঞান। সব জীবের জীবন ও মৃত্যু আল্লাহরই জ্ঞাতসারে ঘটে।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:

এক. মহান আল্লাহ বিশ্ব জগত ও সৃষ্টিকূল তথা অস্তিত্বের জগতের কেবল মূল নীতি বা গুরুত্বপূর্ণ দিকের জ্ঞান রাখেন না, বরং তিনি সব বিষয়ের বিস্তারিত ও খুটি-নটি সব কিছুই জানেন।

দুই. একমাত্র আল্লাহই অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন। অদৃশ্যের কোনো জ্ঞান আল্লাহর ইচ্ছা বা অনুমতি ছাড়া অন্য কেউই জানতে পারে না।

তিন. অস্তিত্বের জগত নির্ভুল পরিকল্পনার ছকে পরিচালিত হচ্ছে এবং কোনো কিছুই আল্লাহর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার বাইরে থাকতে পারে না।

সূরা আন’আমের ৬০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَهُوَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُمْ بِاللَّيْلِ وَيَعْلَمُ مَا جَرَحْتُمْ بِالنَّهَارِ ثُمَّ يَبْعَثُكُمْ فِيهِ لِيُقْضَى أَجَلٌ مُسَمًّى ثُمَّ إِلَيْهِ مَرْجِعُكُمْ ثُمَّ يُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ

“তিনিই রাত্রি বেলায় (ঘুমের সময়) তোমাদের (রুহ) করায়ত্ত করে নেন এবং যা কিছু তোমরা দিনের বেলায় কর, তা জানেন। অতঃপর তোমাদেরকে দিবসে সম্মুখিন করেন-যাতে ( তোমাদের আয়ুর) নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়। অতঃপর তাঁরই দিকে তোমরা ফিরে যাবে। এরপর তিনি তোমাদেরকে বলে দিবেন, যা কিছু তোমরা করছিলে।” (৬:৬০)

সৃষ্টিকূলের গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছু সম্পর্কেই আল্লাহ বিস্তারিতভাবে জানেন- এ সংক্রান্ত আয়াতের পর এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, আমি পাতার ঝরে যাওয়া ও মাটির ভেতরে বীজের অবস্থান এসবই যেমন জানি তেমনি তোমাদের জাগ্রত ও ঘুমন্ত অবস্থারও সব কিছু জানি। বিচার দিবসে তোমাদের কৃতকর্মের সব রেকর্ড আমি জানিয়ে দেব। শুধু তাই নয় দিন ও রাত আমারই কর্তৃত্বে রয়েছে এবং তিনিই তোমাদের নিদ্রিত করেন এবং ঘুম থেকে আবারও জাগিয়ে তোলেন। আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিই এভাবে তোমাদের জীবনের চাকা ঘুরিয়ে নেন।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার-

এক. ঘুম ও ঘুম থেকে জাগা পুনরুত্থানের প্রতীক।

দুই. পরকালে জবাবদিহির জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত হতে হবে। তাই আমাদের জীবনের এই সীমিত সময়কে সবচেয়ে ভালভাবে কাজে লাগাতে হবে।