সূরা আন'আম;(১৬তম পর্ব)

সূরা আন'আম; আয়াত ৬৬-৭০ (পর্ব-১৬)

কুরআনের সূরা আন’আমের ৬৬ ও ৬৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَكَذَّبَ بِهِ قَوْمُكَ وَهُوَ الْحَقُّ قُلْ لَسْتُ عَلَيْكُمْ بِوَكِيلٍ (66) لِكُلِّ نَبَإٍ مُسْتَقَرٌّ وَسَوْفَ تَعْلَمُونَ

"(হে মুহাম্মদ) আপনার সম্প্রদায় একে (অর্থাৎ কুরআনকে) মিথ্যা বলছে, অথচ তা সত্য। আপনি বলে দিনঃ আমি (ঈমান আনানোর ব্যাপারে) তোমাদের ওপর দায়িত্বপ্রাপ্ত নই।" (৬:৬৬)

"সব কিছুর জন্য একটি সময় নির্দিষ্ট রয়েছে এবং অচিরেই তোমরা তা জেনে নেবে।" (৬:৬৭)

এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, হে রাসূল! কুরাইশ বংশ আপনার বক্তব্যকে মেনে নিচ্ছে না। তারা কিয়ামত বা পুণরুত্থান দিবসকে প্রত্যাখ্যান করছে। কিন্তু কিয়ামত (বা বিচার দিবস) সত্য এবং পুণরুত্থান দিবসে সবারই বিচার হবে। আল্লাহ তাদেরকে এ কথা জানিয়ে দিতে বলছেন যে, আল্লাহর ওহি পৌঁছে দেয়াই রাসূলের দায়িত্ব, ঈমান আনতে বাধ্য করা রাসূলের দায়িত্ব নয়। আল্লাহর বাণীকে গ্রহণ করার বিষয়টি মানুষের নিজস্ব ব্যাপার। এ আয়াতে আরো বলা হচ্ছে, আল্লাহ ও রাসূল মানুষের শাস্তির বিষয়ে যেসব কথা বলেছেন, সময় হলেই সেসব শাস্তি নেমে আসবে। তবে বিষয়টি এমন নয় যে, আল্লাহকে অস্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যক্তির ওপর গজব বা শাস্তি নেমে আসবে। কারণ আল্লাহতায়ালা সব সময় মানুষকে ভুল পথ থেকে সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ দিয়ে থাকে।

সূরা আন'আমের ৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آَيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ

"যখন আপনি দেখেন যে তারা আমার আয়াতগুলো সম্পর্কে উপহাসমূলক আলোচনায় ব্যস্ত তখন আপনি তাদের থেকে সরে থাকুন,যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসঙ্গে প্রবৃত্ত হয়। আর শয়তান যদি আপনাকে (সরে যেতে) ভুলিয়ে দেয় তবে স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে (পরিত্যাগ করুন),জালেমদের সঙ্গে বসবেন না।" (৬:৬৮)

এ আয়াতে মুসলমানদের উদ্দেশে বলা হচ্ছে, কোন মজলিস বা বৈঠকে যদি পবিত্র কুরআন ও ঐশী নির্দেশ নিয়ে ঠাট্টা ও উপহাস করা হয়, তাহলে সেখানকার আলোচনার বিষয়বস্তুকে পরিবর্তন করার চেষ্টা চালাতে হবে। আলোচনার বিষয়বস্তু পরিবর্তন করা সম্ভব না হলে সেই বৈঠক ছেড়ে চলে যেতে হবে, যাতে মুসলমানদের সামনে কাফিররা আল্লাহকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করার সুযোগ না পায়।

আর যদি কখনো এমন হয় যে, মনের ভুলে অথবা না বুঝে কেউ এ ধরনের বৈঠকে অংশ নিয়ে ফেলেছেন, তাহলে বিষয়টি উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে ওই বৈঠক ত্যাগ করতে হবে। তখন এটা ভাবলে চলবে না যে, বৈঠকের মাঝখানে বৈঠক ত্যাগ করাটা দৃষ্টিকটু। এ আয়াতে আল্লাহ বিরোধীদের ততপরতায় অংশ নিতে সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি পাপ কাজ বন্ধের জন্যও চেষ্টা চালাতে হবে। শত্রুদেরকে আল্লাহ, ধর্ম ও রাসূলকে অবমাননা করার সুযোগ দেয়া যাবে না।

সূরা আন'আমের ৬৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَا عَلَى الَّذِينَ يَتَّقُونَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِنْ شَيْءٍ وَلَكِنْ ذِكْرَى لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

"ওদের যখন বিচার করা হবে তখন পরহেজগারদের উপর এর (অর্থাত তাদের পাপের) কোন প্রভাব পড়বে না; কিন্তু তাদের দায়িত্ব উপদেশ দান করা,হয়তো এর মাধ্যমে তারা (পাপ কাজ থেকে)বিরত থাকবে।" (৬:৬৯)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এখানে বলা হচ্ছে,যারা পাপীদেরকে উপদেশ ও সতর্ক করার জন্য ওই ধরনের বৈঠকে অংশ নেবে,তারা তাদের পাপের অংশীদার হবে না। কারণ পাপ কাজে অংশ নেয়া তাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে সব ব্যক্তিই এমন বৈঠকে অংশ নেয়ার অধিকার রাখে না। তারাই কেবল এমন বৈঠকে অংশ নিতে পারবে,যারা মুত্তাকি এবং পাপীদের মাধ্যমে তাদের প্রভাবিত হওয়ার আশংকা নেই। বরং ওই সব মুত্তাকি ব্যক্তির মাধ্যমে পাপীদের সৎ পথে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকবে।

সূরা আন'আমের ৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَذَرِ الَّذِينَ اتَّخَذُوا دِينَهُمْ لَعِبًا وَلَهْوًا وَغَرَّتْهُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَذَكِّرْ بِهِ أَنْ تُبْسَلَ نَفْسٌ بِمَا كَسَبَتْ لَيْسَ لَهَا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلِيٌّ وَلَا شَفِيعٌ وَإِنْ تَعْدِلْ كُلَّ عَدْلٍ لَا يُؤْخَذْ مِنْهَا أُولَئِكَ الَّذِينَ أُبْسِلُوا بِمَا كَسَبُوا لَهُمْ شَرَابٌ مِنْ حَمِيمٍ وَعَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْفُرُونَ

"তাদেরকে পরিত্যাগ করুন,যারা নিজেদের ধর্মকে ক্রীড়া ও কৌতুক হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে অহংকারী করে তুলেছে। কুরআন থেকে তাদেরকে উপদেশ দিন, যাতে কেউ তার কৃতকর্মের জন্য ধ্বংস না হয়। (কিয়ামতের দিন) আল্লাহ ছাড়া তার কোন সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী থাকবে না। আর (শাস্তি থেকে নিস্কৃতির জন্য) বিনিময়ে সবকিছু দিতে চাইলেও তা গ্রহণ করা হবে না। তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত। তাদের জন্য রয়েছে ফুটন্ত পানীয় ও মর্মন্তুদ শাস্তি। এ কারণে যে তারা কুফরি করতো।" (৬:৭০)

এ আয়াতে ওই সব পাপাচারী ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বলা হচ্ছে, যারা নিজের ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। তবে এর আগে ওই সব পাপাচারী ব্যক্তিকে সৎপথে আনার চেষ্টা করতে হবে এবং সৎ উপদেশ দিতে হবে। কিন্তু এরপরও যারা সংশোধন হবে না এবং আল্লাহ ও তার নির্দেশকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করবে, তাদেরকে অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. মুসলিম সমাজে যারা ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে তাদেরকে বয়কট করতে হবে,যাতে তাদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য সমাজে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।

দুই. দুনিয়াপ্রীতির কারণে মানুষ অহংকারী হয়ে উঠে এবং ধর্ম ও ধর্মীয় দিক-নির্দেশনার বিষয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ শুরু করে। কখনো কখনো আল্লাহকেই অস্বীকার করে বসে। কাজেই পার্থিব জীবনের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত প্রীতি ও আকর্ষণ গ্রহণযোগ্য নয়।