সূরা আন'আম;(২২তম পর্ব)

সূরা আন'আম; আয়াত ৯৪-৯৭

সূরা আন’আমের ৯৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَلَقَدْ جِئْتُمُونَا فُرَادَى كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَتَرَكْتُمْ مَا خَوَّلْنَاكُمْ وَرَاءَ ظُهُورِكُمْ وَمَا نَرَى مَعَكُمْ شُفَعَاءَكُمُ الَّذِينَ زَعَمْتُمْ أَنَّهُمْ فِيكُمْ شُرَكَاءُ لَقَدْ تَقَطَّعَ بَيْنَكُمْ وَضَلَّ عَنْكُمْ مَا كُنْتُمْ تَزْعُمُونَ

"তোমরা আমার কাছে নিঃসঙ্গ হয়ে এসেছ, আমি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম, তা পশ্চাতেই রেখে এসেছ। আমি তো তোমাদের সঙ্গে তোমাদের সুপারিশকারীদেরকে দেখছি না, যাদের সম্পর্কে তোমাদের দাবি ছিল যে, তারা তোমাদের ব্যাপারে অংশীদার। বাস্তবিকই তোমাদের পরস্পরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তোমাদের দাবি উধাও হয়ে গেছে।" (৬:৯৪)

গত পর্বে আমরা মৃত্যুর সময় মুশরিক ব্যক্তিদের কঠিন আযাবের কথা তুলে ধরেছিলাম। সে আলোচনার ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন : পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় তাদেরকে বলা হবে : জীবিত অবস্থায় তোমরা বহু মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করেছো এবং তাদের ওপর ভরসা করেছো; এমনকি নিজেদের ভাগ্যকেও তাদের ওপর ছেড়ে দিয়েছো। সম্পদের পাহাড় গড়েছো- ভেবেছো- এসব মানুষ ও সম্পদ তোমাদেরকে মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু আজ তোমাকে সবকিছু ফেলে একাকী এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে আমার কাছে চলে আসতে হচ্ছে। আজ তোমার সব অলীক কল্পনার অবসান হতে যাচ্ছে। এ দিনটির কথা কি জীবদ্দশায় কখনো ভেবে দেখেছিলে?

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. মৃত্যু পরবর্তী জীবনে মানুষ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। সেখানে সামাজিক জীবন বলে কিছু নেই। কিয়ামতের দিন পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের কোন অস্তিত্ব থাকবে না।

দুই. ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অহংকার মৃত্যুর সময় মানুষের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিন্তু তখন করার কিছুই থাকবে না।

সূরা আন’আমের ৯৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّ اللَّهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوَى يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَمُخْرِجُ الْمَيِّتِ مِنَ الْحَيِّ ذَلِكُمُ اللَّهُ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ

"নিশ্চয়ই আল্লাহ বীজ ও আঁটি থেকে অঙ্কুর সৃষ্টিকারী; তিনি জীবিতকে মৃত থেকে এবং মৃতকে জীবিত থেকে বের করেন। ইনিই আল্লাহ্‌, এরপর তোমরা কীভাবে (সঠিক পথ থেকে) বিচ্যুত হচ্ছো?" (৬:৯৫)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে মানুষের জীবন ও মৃত্যুতে আল্লাহর ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জমিতে শষ্য বপনের কাজটি মানুষ করলেও জীবন ও মৃত্যুর প্রকৃত মালিক যে মহান আল্লাহ- এ আয়াতে সে বিষয়টিই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মানুষ বীজ বপন করলেও আলো, বাতাস ও পানির মাধ্যমে তার অঙ্কুরোদ্গমের কাজটি মহান আল্লাহই করে থাকেন। আল্লাহ না চাইলে এসব বীজ থেকে কখনোই উদ্ভিদের অঙ্কুর বের হতো না। তিনিই মৃত বীজ থেকে জীবিত উদ্ভিদ সৃষ্টি করেন এবং জীবন্ত উদ্ভিদ থেকে মৃত বীজের আবির্ভাব ঘটান।

বর্ণনায় এসেছে, মানব জীবনেও কাফের পিতা-মাতাকে মৃত হিসেবে উল্লেখ করেছেন আল্লাহ। এই মৃত পিতামাতার ঘরে জীবন্ত মুমিন সন্তান দান করার ক্ষমতা মহান আল্লাহর হাতে রয়েছে। এ ছাড়া, মুমিন পিতা-মাতার ঘরেও মৃতসদৃশ কাফের সন্তান জন্ম নিয়ে থাকে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক.  প্রকৃতি নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা এবং এ সৃষ্টি রহস্যের দিকে মনোযোগী হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব।

দুই. যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে রিজিক দিয়েছেন, মানুষ সেই আল্লাহকে ভুলে কীভাবে অন্য মানুষ, সম্পদ বা ক্ষমতার পূজারি হয়ে যায়?

সূরা আন’আমের ৯৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

  فَالِقُ الْإِصْبَاحِ وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ

"তিনি প্রভাত রশ্মির উন্মেষক। তিনি রাত্রিকে আরামদায়ক করেছেন এবং সূর্য ও চন্দ্রকে হিসাবের জন্য রেখেছেন। তিনি পরাক্রান্ত মহাজ্ঞানী নির্ধারক।"(৬:৯৬)

এ আয়াতে বলা হচ্ছে, মহান আল্লাহ শুধু বীজের ভেতর থেকেই অঙ্কুর বের করে আনেন না, সেইসঙ্গে রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে দিনের আলোর আবির্ভাব ঘটান। তিনি যেমন মৃত বীজের ভেতর থেকে জীবিত চারাগাছ সৃষ্টি করতে পারেন, তেমনি অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও সুনিপুণ পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে রাত ও দিন সৃষ্টি করেছেন। তিনি এ ব্যবস্থা করেছেন যাতে বিশ্বের প্রতিটি জীব রাতের বেলা বিশ্রাম নিতে পারে এবং দিনের আলো প্রস্ফুটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠে কাজ-কর্মে মেতে উঠতে পারে।

প্রতিদিন আমরা আকাশে সুন্দরতম যে জিনিসটি দেখতে পাই তা হচ্ছে সূর্যোদয়। সূর্য দিনের আলো উপহার দেয়ার পাশাপাশি প্রতিটি জীবনে প্রাণের সঞ্চার করে। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী ও চাঁদের ঘুর্ণায়ন কেবল দিন ও রাতই সৃষ্টি করে না, সেই সঙ্গে দিন, মাস ও বছর গণনারও উতকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। মানুষ এই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের ভিত্তিতে দিন, মাস ও বছর গণনা করে নিজের কাজ-কর্মের জন্য সঠিক কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করে।

এ আয়াত থেকে আমরা যা শিখতে পারি তা হলো :

এক. সৃষ্টিজগত নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ রব্বুল আলামিনকে চিনতে এবং তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে আরো বেশি ধারণা পেতে পারি।

দুই. মহান আল্লাহর প্রতিটি কাজ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মেনে চলে। কাজেই আমাদেরও জীবনের প্রতিটি কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী করা উচিত। তা না হলে আমাদের পক্ষে আল্লাহর রঙে রঙিন হওয়া সম্ভব হবে না।

সূরা আন’আমের ৯৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ النُّجُومَ لِتَهْتَدُوا بِهَا فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ قَدْ فَصَّلْنَا الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ

“তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্রপুঞ্জ সৃষ্টি করেছেন- যাতে তোমরা অন্ধকারে স্থল ও জলপথে দিক চিনতে পারো। নিশ্চয়ই যারা জ্ঞানী তাদের জন্য আমি নিদর্শনাবলী বিস্তারিত বর্ণনা করেছি।” (৬:৯৭)

শুধুমাত্র যে চাঁদ ও সূর্যই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাই নয়- সেইসঙ্গে তারকারাজিও মহান আল্লাহর অপরিসীম ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়। এখনো এমন অসংখ্য তারা মহাকাশে রয়েছে যার আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়নি। পবিত্র কুরআনে এটুকু বলা হয়েছে যে, আকাশের তারাগুলো মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত উন্নতি সত্ত্বেও মানবজীবনের ওপর বেশিরভাগ তারার ভূমিকা সম্পর্কে মানুষ এখনো অবগত নয়। সূরা আন’আমের এ আয়াতে সমূদ্র ভ্রমণের সময় দিক চেনার উপায় হিসেবে তারার ব্যবহারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

অতীতে যখন দিক নির্ণয়ের কোন যন্ত্র মানুষের হাতে ছিল না, তখন দিনের বেলায় সূর্যের অবস্থান এবং রাতে তারার অবস্থান দেখে সমূদ্রযাত্রীরা দিক নির্ণয় করতো। ইসলাম যে কোন কাজে প্রকৃতির ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। যেমন প্রতিদিনের নামাজের ওয়াক্ত ঠিক করা হয়েছে সূর্যের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে। পবিত্র রমজান মাসের শুরু এবং শেষ ঠিক করে দেয়া হয়েছে চাঁদ ওঠার ওপর। চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের সময় বিশেষ নামাজের নির্দেশ দেয়া হয়েছে ইসলামে। এ ছাড়া, নির্ধারিত সময়ে বৃষ্টি না হলে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ নামাজ আদায় করে তাঁর কাছে বর্ষার বারিধারা কামনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রকৃতির ওপর আল্লাহ এত বেশি গুরুত্ব দেয়ার কারণে মুসলিম বিজ্ঞানীরা বাগদাদ, দামেস্ক, কায়রো, মরক্কো এবং আন্দালুসিয়ায় মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর মুসলিম মনীষীদের লেখা মূল্যবান বইয়ের সংখ্যাও কম নয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে :

এক. আকাশের তারাগুলো এত সুনিপুণভাবে স্থাপিত হয়েছে যে, তা দেখে পৃথিবীর পথ খুঁজে বের করা সম্ভব।

দুই. যে আল্লাহ মানুষকে সফরের সুবিধার্থে পথপ্রদর্শকরূপে তারা সৃষ্টিকরেছেন, সেই আল্লাহ জীবনের বিশাল সময়ের সফরের জন্য কোন দিক নির্দেশনা দেবেন না- তা হতে পারে না।